আঙ্কল টমস কেবিন – হ্যারিয়েট বিচার স্টো - বাংলা অনুবাদ - Uncle Tom's Cabin - Harriet Beecher Stowe - Bangla translation and summary |
আঙ্কল টমস কেবিন – হ্যারিয়েট বিচার স্টো - বাংলা অনুবাদ - Uncle Tom's Cabin - Harriet Beecher Stowe - Bangla translation and summary
[শুরুর আগে - টম চাচার কাহিনীর মূল গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায়। নাম ‘অংকল টমস কেবিন’। এটি লিখেছেন হ্যারিয়েট বীচার স্টো।
তার জন্ম অ্যামেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ১৮১১ সালে। মৃত্যু ১৮৯৬ সালে। পঁচাশি বছর বেঁচে
ছিলেন তিনি। একজন মানবতাবাদী মহিলা ছিলেন হ্যারিয়েট। তিনি শৈশবে ক্রীতদাসদের দুর্দশা
দেখেছেন নিজের চোখে। তার দেখা ঘটনাই ভাষা পেয়েছে টম চাচার কাহিনীতে।
এই উপন্যাস বের হওয়ার পর সারা আমেরিকায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে। এর পটভূমিতেই ক্রীতদাস রাখার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শুরু হল। উঠে গেল দাস প্রথা। বের হওয়ার সঙ্গে ওঙ্গে বইয়ের তিন লক্ষ কপি ফুরিয়ে যায়। এ পর্যন্ত বইটি ছাপতে হয়েছে একশ বারেরও বেশি।]
শুরু
মানুষ কেনা-বেচার কাহিনী
অবাক লাগবে কথাটা এখন
শুনতে। অবাক লাগলেও ব্যাপারটি সত্যি ছিল একসময়ে। তা-ও বেশিদিনের কথা নয়। আজ থেকে
দেড়শ বছর আগের ঘটনা। আমেরিকার হাটে হাটে বিকিকিনি হত মানুষ। যেমন করে বেচাকেনা হয়
গরু-ছাগল।
কোথা থেকে কিনে আনা হত এই মানুষ? পৃথিবীর এক
দরিদ্র মহাদেশ থেকে। এই মহাদেশের নাম আফ্রিকা। আফ্রিকার অবস্থা ছিল তখন খুব খারাপ।
পশ্চিমের সাদা চামড়ার লোকেরা আফ্রিকায় এসে উপনিবেশ গড়ে। সেখানকার ফসল আর সোনা দানা
লুটে নিতে থাকে গায়ের জোরে। আফ্রিকার মানুষেরা ছিল খুব সরল। লেখাপড়ার সুযোগও তখন
তারা পায়নি। এই জন্যই ইউরোপ আমেরিকার সাদা চামড়ার লোকেরা তাদের দেশ দখল করে নিতে
পেরেছিল। আফ্রিকার মানুষের গায়ের রঙ কালো। রঙ কালো হওয়াটাও সাদাদের কাছে ছিল দোষের।
এজন্য তারা আফ্রিকাবাসীদের ঘৃণা করত। জোর করে তাদেরকে দিয়ে নিজেদের কাজ করিয়ে নিত।
সাদা মানুষদের মধ্যে একদল ছিল ক্রীতদাস ব্যবসায়ী। তারা আফ্রিকার গরীব মানুষদের কিনে
নিয়ে জাহাজে করে চালান দিত আমেরিকায়। সেখানে ক্ষেতে কাজ করানোর জন্য খামার মালিকেরা
এদের কিনে নিত।
কিনে আনা মানুষদের বলা হত কেনা ‘গোলাম’। সারা জীবনের জন্য
কেনা মানুষেরা মালিকের দাস হয়ে থাকত। মালিকের ইচ্ছায় তাদের উঠতে হত। মালিকেরই ইচ্ছায়
তাদের বসতে হত। মালিকদের বেশির ভাগই ছিল জুলমবাজ। একটু এদিক-ওদিক হলেই তারা ক্রীতদাসের
ওপর অত্যাচার চালাত। মারধোর করত হাতে পায়ে বেড়ি লাগিয়ে। মালিকদের অত্যাচারে প্রাণ
হারিয়েছে বহু ক্রীতদাস। জুলুমের ভয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত বেচারা ক্রীতদাসরা।
কিন্তু পারত না। কারণ আমেরিকার সমাজে এই দাস প্রথা চালু ছিল তখন। আইন ছিল তাই মালিকদের
পক্ষে। পুলিশ ধরে নিয়ে আসত পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের। তখন তাদের ওপর চলত আরও বেশি
অত্যাচার। কিছু কিছু মালিক অবশ্য দাসদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত। তবে এদের সংখ্যা ছিল
খুবই কম। সমাজের চাপে এদের কোমলতা কোনও কাজে আসত না।
এ কাহিনী হল সে সময়কার। এক অসহায় নিগ্রো কীতদাসের
করুণ কাহিনী এই টম চাচার কুড়ে।
টম চাচা
টম একজন ক্রীতদাস।
আমেরিকার কেন্টাকি এলাকার এক তুলাখামার মালিকের
কেনা গোলাম ছিল সে। মালিকের নাম শেবি। তার খামারে বেশ কয়জন দাস-মজুর ছিল। টম তাদের
সঙ্গে মিলে মিশে থাকত। টম ছিল সরল ধরনের। তার সরলতার জন্য তাকে শেলবি পরিবারের লোকদের
বেজায় পছন্দ ছিল। খাটতেও পারত টম অসুরের মতো। দশজনের কাজ একাই করার ক্ষমতা ছিল তার।
কাজও ছিল তার নিখুত। এজন্য সবাই তাকে ভাল বাসত। মালিক পক্ষ তো বটেই, ভালবাসত আর সব
ক্রীতদাসরাও। সবারই বড় ভরসা ছিল টম। ডাকতো সবাই আদর করে টম চাচা।
কিন্তু এরপরেও যা সত্যি তা হল টম একজন ক্রীতদাস।
তার মন বলতে কিছু থাকবে না, তার কোনও স্বাধীন সত্তা থাকতে পারবে না। নিজের সময়ের ওপর
তার কোনও অধিকার নেই, অধিকার নেই তিলমাত্র স্বস্তি স্বাচ্ছন্দ্য লাভের। তার দায় শুধু
কাজ। কাজ মানে দৈহিক শ্রম। কেবল খেটে যাবে সে। তার খাটুনিতে মালিকের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে।
রিক্ত অবস্থায়ই একদিন সে শেষ হয়ে যাবে। মৃত্যু ঘটবে। খাটুনির জন্যই সে খাওয়া পাবে।
সে খাওয়ায় পর্যন্ত তার রুচি বা পছন্দের প্রশ্ন থাকবে না। সে সম্পূর্ণভাবে দেউলে,
তার সব কিছুই বেচা অন্যের কাছে। অন্যের প্রয়োজনেই সে বেঁচে আছে। তার বেঁচে থাকাটাও
মালিকের দয়ার উপর নির্ভর করে। চাইলেই সে কোথাও যেতে পারে না। ইচ্ছামতো কিছু করা তার
জন্য মানা। মুক্তি কি জিনিস, এই পৃথিবীতে সে কোনও দিন জানবে না।
টমের মনে এজন্য অনেক ব্যথা। দিনের কাজ শেষে যখন
সে একলা হয়, তার মন হু হু করে ওঠে। রাতের আঁধারে সে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়েও যদি শুধু স্বাধীনতাটা
পেত সে।
কিন্তু না, টম এজন্য সবার সামনে মুখ ভার করে
না। দিনভর সে হাসিখুশি থাকে। আনন্দ প্রকাশের জন্য গলা ছেড়ে গান করে। আর সব ক্রীতদাসের
মনের বেদনা সে বোঝে। বোঝে বলেই হাসি গান দিয়ে সবাইকে ভুলিয়ে রাখে। কারও কাছে অভিযোগ
করে না, কারও অভিযোগের গুরুত্ব দেয় না, কাজ কর আর ফুর্তি কর--ভাবটা দেখাত এরকম।
দিন যায়। সূর্য ওঠে আবার ডোবে। নদীতে অনেক পানি
গড়ায়। কিন্তু টমের মধ্যে কোনও পরিবর্তন নেই। সে একইভাবে হাসে, গান করে আর জান দিয়ে
শেলবি সাহেবের তুলার ক্ষেতে কাজ করে। কিন্তু এটুকু ভাগ্যও প্রতারণা করল টমের সঙ্গে।
শেলবি হঠাৎ এক সময় দেনার দায়ে বিপাকে পড়লেন। টাকার দরকার হল তার। অনেক টাকার। কিন্তু
কোথাও থেকে টাকার জোগাড় হল না। কিছুতেই হিল্লে হল না বিপদের। কী করেন? কী-ই বা করার
আছে তার? হ্যা, আছে ঐ ক্রীতদাস। তাদের মধ্যে থেকে দুএকজনকে বেচে দিলেই এর একটা সুরাহা
হতে পারে। অগত্যা শেলবি সাহেব এ পথই বেছে নিলেন।
সেই সময়ে হ্যালি ছিল শহরের ডাকসাইটে ক্রীতদাস-ব্যবসায়ী।
ক্রীতদাসদের সে জানোয়ারেরও অধম বলে মনে করত। টাকাটাই ছিল তার সব। ক্রীতদাসদের খাটিয়ে
টাকা রোজগার ছিল তার মুখ্য। খাটতে খাটতে যদি ওরা মরেও যায়, তবু কাজ আদায় করা চাই-ই
চাই। এই হল হ্যালি। মানুষ না যেন আস্ত একটা কসাই। ক্রীতদাস বিক্রির খোঁজ পেয়েই হ্যালি
তখন শেলবি সাহেবের খামার বাড়ি ছুটে এল। এমন মওকা ছাড়তে রাজী নয় সে। খামারে এসে সে
সব কজন ক্রীতদাসকে খুটিয়ে দেখল। টমকেই সে পছন্দ করল। তা টম তো পছন্দ করার মতোই। সহিষ্ণুতা,
স্বভাব, মেজাজ, কাজ করার ক্ষমতা - সব মিলে টমের মতো সুনাম
অর কার আছে? হ্যালির পছন্দ হল টমের ছোট্ট ছেলেটিকেও।
শেলবি মহা ফাঁপরে পড়লেন। টমকে বেচতে হবে, এটা
তিনি ভাবতেও পারেননি। তাঁর স্ত্রী টমকে স্নেহ করেন। তাদের ছেলে জর্জও ভালবাসে টম চাচাকে।
ওরা কেউ-ই টমকে ছাড়তে রাজী না। কিন্তু না হলে কি হবে! হ্যালি তো অন্য কাউকে কিনবে
না। তাহলে নগদ অতগুলো টাকা কোথায় পাবেন শেলবি সাহেব? বাধ্য হয়েই হ্যালির কথায় সায়
দিতে হল তাকে। টমকে তিনি তার কাছে বেচলেন। তবে একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। হাতে টাকা এলেই
আবার টমকে তিনি কিনে আনবেন। হ্যালি রাজী হল তার এই শর্তে। শেলবি যদি টাকা নিয়ে যায়,
তবে টমকে তার কাছেই ফিরিয়ে দেবে সে।
এই বেচাকেনার কথা যখন চলছে, টম তখন আসর জমিয়ে
গান গাইছে বাড়ির বাইরে। হাসি-মশকরা করছে ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে। সে টেরও পায়নি গান
গাওয়ার দিন তার ফুরিয়ে এসেছে। রাতের দিকে খবরটা কানে এল। যেন ধাক্কা খেল। মানে এত
কষ্ট আর কখনো সে পায়নি। তবে নিজের থেকেও ছেলের জন্যই বেশি দুঃখ তার। ঐটুকু, মানুষ,
তার ভাগ্যও এত খারাপ।
বন্ধুরাও ব্যথিত হল। টমকে ছেড়ে থাকা! কল্পনা
করা যায় না। তাদের আশাহীন জীবনে টমই ছিল একমাত্র আলো।
আর কিছু না হোক-হাসি-গানে টম তাদের করুণ মুহর্তগুলো
ভরে রাখত। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিত। সেই টম। সেই চলে যাবে তাদের
ফেলে? ওরা বাঁচবে কী নিয়ে? ওরা বুদ্ধি দিল, পালিয়ে যাও। পালিয়ে গেলেই এড়াতে পারবে
বিপদ।
কিন্তু টম বলল, না, আমি পালাব না। আমি পালিয়ে
গেলে মনিব টাকা পাবেন না। হাজার হলেও তিনি আমার প্রতি নির্দয় ছিলেন না। তাকে ফাঁকি
দিতে আমি পারব না।
সবাই অবাক হয়ে গেল। আবার লজ্জাও পেল। টমের সত্যি
তুলনা হয় না। শেল্বি সাহেব নরম মনের মানুষ, সন্দেহ নেই। তিনি অত্যাচারী মনিব নন,
এও মিথ্যে নয়। কিন্তু শুধু এই কারণে টম নিজের সুবিধেটুকুও পেতে রাজী নয়। এরই নাম
বুঝি কৃতজ্ঞতা। এমন কৃতজ্ঞ মন কটি আছে এ সংসারে?
কানাডার পথে টম চাচার ছেলে ও স্ত্রী এলিজা
কিন্তু নিজের ছেলেকে নিয়ে টম বাজী ধরতে পারল
না। বলতে পারল না, ওর ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে। ছেলের জন্য তার মন কেদে উঠল -ওকে বাঁচাতেই
হবে। পাঠাতেই হবে দুরে কোথাও-হিংস্র মালিকদের নাগালের বাইরে। না হয় টম আর না-ই পেল
ছেলেকে কাছে এমন কি তাকে না-ই দেখতে পেল আর এ জীবনে, তবুও তো ও বেচে থাকবে! বউ আর ছেলেকে
ঐ রাতেই গোপনে পাঠিয়ে দিল কানাডার পথে।
টমের বউ এলিজা। সাদাসিধে মেয়ে। এই ঘটনায় দিশেহারা
হয়ে পড়ল। স্বামীকে একা রেখে যেতে হবে? নতুন মালিক নিশ্চয় তাকে অনেক কষ্ট দেবে। নিঃসঙ্গ
টম এত কষ্ট কি করে সহ্য করবে? কিন্তু ওদিকে যে ছেলে! পালিয়ে না গেলে ছেলেকে যে রক্ষা
করা যাবে না। কী আর করে। এলিজা ছল ছল চোখে রাতের আঁধারে পাড়ি দিল অজানা পথে। বাচ্চাটি
শুধু তার সঙ্গে। দুরু দুরু কাঁপছিল এলিজার বুক। খবর ঠিকই বের হয়ে গেল। শয়তান হ্যালির
অনুচরেরা নেকড়ের মতো ওদের পিছু নিল। প্রতিক্ষণেই মনে হচ্ছিল এই বুঝি ওরা ধরে ফেল এলিজা
আর তার ছেলেকে। এলিজা বেচারী প্রাণপণ ছুটছে। বুকে জাপটে থাকা ছেলেটির গা ভিজে গেছে
তার চোখের পানিতে। কপাল ভাল ছিল এলিজার। পথে সে সাহায্যকারী হিসেবে পেল এক হৃদয়বান
মানুষকে। তিনি শ্বেতকায়। তার সাহায্যে এলিজা সীমান্ত পার হল, পৌছল গিয়ে কানাডায়।
নিঃশ্বাস নিল মন ভরে। কিন্তু টম। ও যে পড়ে রইল সেই কন্টক ভরা জীবনে? ও যে জানতেও পারল
না ছেলেকে নিয়ে তার বউ ঠিক জায়গায় পৌছে গেছে? আর কি ওদের দেখা হবে? আর কি ওরা একসঙ্গে
থাকতে পারবে? টমের বউয়ের চোখ সজল হয়ে ওঠে।
অবুঝ ছেলে বাবাকে খোঁজে। ওদিকে টম তাদের পার
করে দেয়ার মাশুল গুনছে। হ্যারি ক্ষেপে উঠেছে তেলে বেগুনে। পুরো বারো শ ডলার খরচ করে
শেল বির কাছ থেকে হ্যালি কিনেছিল টম আর তার ছেলেকে। এখন ছেলেটাকে নিয়ে কিনা তার মা
পালিয়েছে। কতগুলো টাকা গচ্চা গেল পানিতে! টমের ওপরেই হ্যালির যত রাগ গিয়ে পড়ে। শোধ
নিতে হয় কি করে, তা হ্যালির জানা আছে। আগে তো ওকে নেয়া হোক তার বাড়িতে। কড়া লাগানো
হল টমের হাতে। একটি ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হল তাকে ঠিক যেমন করে কয়েদীকে নেয় লোকে।
টম এখন হ্যালির কেনা গোলাম। টমকে নিয়ে যা-খুশি তা করার অধিকার তার আছে। কেউ বারণ করতে
আসবে না। বাধা দেয়ার অধিকারও নেই কারও। দুর্দান্ত হ্যালি মনে মনে আত্মতৃতি অনুভব করে।
তার হাব-ভাব সে দেখায়ও প্রকাশ্যে।
গাড়ির কাছে সবাই এসে দাঁড়ায়। নীরবে টমকে বিদায়
জানায়। টম সকলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক সময় গাড়ি ছাড়ে। টম চলল কেনটাকি ছেড়ে। এখানে
সে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছে। কেন্টাকির এই খামার বাড়িটাকে জীবনভর সে নিজের বাড়ি
বলে মনে করছে। এখানে তার শৈশব কেটেছে। একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে এই বাড়িতে। একদিন
বিয়ে করেছে—এলিজা তার বউ হয়ে এসেছে। ছেলেটির জন্ম এখানে।
ভালবাসে টম কেন্টাকিকে, ভালবেসেছে সে শেলবির খামার বাড়ির প্রতিটি ধুলোকণাকে। তাইতো
আজ তার মন এমন করে ককিয়ে উঠছে। টমের চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ে। শেলবির খামারের সবচেয়ে
আমুদে গোলামটি আজ বিষন্ন। হাশিখুশির মানুষটির ঠোঁট আজ কাঁপছে। যে চোখ-জোড়া সারাক্ষণ
মন-ভোলানো আশা ও আশ্বাসে ঝলসেছে, আজ সে চোখ দিয়ে দর দর অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু
সে পানি কেউ মুছতে এল না। ক্রীতদাসের চোখের পানি মুছতে হয় না। ও চোখে আপনিই পানি আসে।
আবার অপিনিই যায় শুকিয়ে।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে টমকে এনে নামানো হলো বন্দরের
জেটিতে। সেখানে আরও অনেক ক্রীতদাসকে আনা হয়েছে। এদের সবাইকে দাস-মালিকদের কাছে বেচে
দেয়া হবে। সবার হাতে শেকল। সবার মুখই করুণ। এদের সবার মনে একই দুঃখ। সবাই এখানে সমান
দুঃখী। অবশেষে জাহাজে ওঠানো হল তাদের। ওরা ভয়ে কাঁপছিল অর অঝোরে কাঁদছিল। টম চুপচাপ
দাড়িয়েছিল। কেনটাকি ছেড়ে এসে সে আবার শক্ত হয়ে গেছে। চোখের পানি আর আসছে না। সে
জানে, ক্রীতদাসদের আবেগ-অনুভূতির কোনও মূল্য নেই। কাজেই মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করা
ঠিক না। সে দাড়াল এসে অন্যসব ক্রীতদাসদের কাছে। গলা ছেড়ে শুরু করল গান। সে গানে ছিল
সান্তনার কথা, আত্মস্থ হওয়ার কথা। ছিল আত্মবিশ্বাসের কথা, অশাবাদী হওয়ার কথা। টমের
গান ছুয়ে গেল সবার মন। সবাই চাঙ্গা হয়ে উঠল, সবাই কান্না ভুলে গেল। সকলের মুখে হাসি
এনে দিয়ে টম শান্তি পেল। ক্ষণিকের এই শান্তিই তার সম্বল। এই মুহর্তের স্বস্তি-ই তার
কাছে বড়, পর মুহর্তে কী ঘটবে, জানতে চায় না সে। কারণ টম জানো ক্রীতদাসের জীবনের প্রতিটি
ক্ষণ অনিশ্চয়তা আর গ্লানিতে ভরে থাকে, থাকবে।
হাটতে হাটতে টম জাহাজের এক কোণায় এসে থমকে দাঁড়াল।
সাদা চামড়ার লোকেরা আসর জাঁকিয়ে গল্প করছিল। ওদের চোখে মুখে খুশি। মাঝে মাঝে হা হা
করে ওরা গলা ফাটিয়ে হাসছিল। ওরা দেশে ফিরছিল। টম ভাবল, ওরা কত সুখি। ওদের সব আছে,
বাড়ি আছে। কিন্তু ক্রীতদাসদের? দেশ নেই, ঠিকানা নেই। তাদের কখন কোথায় যেতে হবে, তারা
জানে না। যেমন এখন টম জানে না—সে কোথায় যাচ্ছে।
কোথায় টমের বাবা-মা? কোথায় টমের বউ-ছেলে? জাহাজের
রেলিং ধরে শূন্যে তাকিয়ে থাকে টম, তার ভাবনা দিগন্তে হারিয়ে গেল।
জাহাজে টমের পরিচয় হল ইভা নামে একটি ফুটফুটে
মেয়ের সাথে। ছোট্ট ইভার সঙ্গে মুহূর্তেই বন্ধুত্ব হল টমের। ইভা এটা ওটা এনে খাওয়ায়
টমকে। ডাকে টম চাচা বলে। পাখির মতো চঞ্চল মেয়েটির কাছে টম যেন তার আপন চাচা। টমের
সঙ্গে ইভার কথাই ফুরোয় না। কত খবর, কত নালিশ, টমকে তার সব বলা চাই। টমকে বলেই তার যত আনন্দ। এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকে না মেয়েটা, হাঁটা নয়, দৌড়ানোই
তার পছন্দ। ছুটোছুটি করতে গিয়ে একদিন হঠাৎ জাহাজ থেকে পড়েই গেল ইভা। কী ভাগ্য, টম-ই
তা দেখতে পেল। একটুও দেরি করল না সে-ঝাঁপিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে নদীতে। মেয়েটাকে টেনে
তুলে আনল, প্রাণ ভরে তার সুশ্রুষা করল। ইভা বেঁচে গেল। ইস্ টম যদি না থাকত? যদি টম
অমন করে ওর জন্য ঝাপ না দিত? ইভাকে কি আর পাওয়া যেত! ইভা তো মরেই যেত? কল্পনা করেই
ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন ইভার বাবা সেইন্ট ক্লেয়ার। টমের ওপর খুশি হলেন তিনি। পনেরো শত
ডলার দিয়ে কিনে নিলেন টমকে। ইভার হাসি দেখে কে! টম চাচা তাদের সঙ্গে তাদের বাড়ি যাবে।
ও সারাক্ষণ টম চাচার সঙ্গেই থাকবে।
সেইন্ট ক্লেয়ার সাহেবের সঙ্গে টম তাদের বাড়িতে
এল। তাদের নিউ অরলিয়নসের বাড়িটি বেশ ছিমছাম। এ বাড়িতেই মা-বাবার সঙ্গে থাকে ইভা।
শুরু হল টমের নতুন জীবন। প্রজাপতি-মেয়ে ইভার সঙ্গে তার দিন তরতরিয়ে কাটে। কেবল ইভা
নয়, ভারী ভাল ইভার বাবাও। তিনিও টমের সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেন। টম ভাবে, এতদিনে
বুঝি সুখ এল তার জীবনে। কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। টমকে ভালবাসত সবচেয়ে বেশি
যে ইভা, সেই ইভাই হঠাৎ একদিন অসুখে পড়ল। যে সে অসুখ না, কঠিন অসুখ। কত ওষুধ, কত পথ্য,
কিছুতেই কিছু হল না। শেষে একদিন চলেই গেল ইভা চিরতরে। পরীর মতো সুন্দর মেয়ের সুন্দর
মনের পরিচয় পাওয়া গেল তার মরণের সময়েও। মৃত্যুশয্যায় বাবার হাত ধরে বলেছিল, আমার
যদি কিছু হয় বাবা, টম চাচাকে তুমি মুক্তি দিয়ো। মেয়ের শেষ কথা রাখার চেষ্টা করেছিলেন
সেইন্ট ক্লেয়ার। টমকে ডেকে বললেন, ইভার ইচ্ছে আমি পুরণ করব টম। তোমাকে আমি মুক্তিপত্র
লিখে দেব! মনিব মুক্তিপত্র লিখে দিয়ে ক্রীতদাসেরা স্বাধীন হতে পারত। পারত খোলা আলো-বাতাসে
ঘুরে বেড়াতে। এত দুঃখেও কথাটি টমকে শান্তি দিল। তাহলে সত্যি সত্যি সে দাস-জীবনের গ্লানি
থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। ইভাকে সে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে-- ওর অত্মিা যেন শান্তিতে
থাকে স্বর্গে।
কিন্তু ভাগ্য ঠাট্টা করল টমের সঙ্গে এবারও। টমকে
মুক্তি দেয়ার আগেই শত্রুর হাতে নিহত হলেন সেন্ট ক্লেয়ার। পরিবারের কর্তৃত্ব এল তার
স্ত্রীর হাতে। তিনি ছিলেন অন্য ধাঁচের মানুষ। ক্রীতদাসদের পশুর মতোই মনে করতেন তিনি।
স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ঘরবাড়ি সব নীলামে চড়িয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে বেচে দিলেন
দাস-দাসী যা আছে সবাইকে। বিক্রি হয়ে গেল টমও। সাইমন লেগ্রি নামে এক জাদরেল দাস-মালিক
নীলামে কিনে নিলেন ক্লেয়ার পরিবারের সকল ক্রীতদাসদের। লেগ্রি ছিল একটা ঘুঘু প্রকৃতির
মানুষ। তার মতো বদ স্বভাবের লোক কমই জন্মেছে পৃথিবীতে। বেপারীরা যেমন করে গরু কেনে,
ঠিক তেমনি করেই কেনার সময় পা থেকে মাথা পর্যন্ত টেনে টুনে টমকে খতিয়ে দেখেছিল সে।
এমনকি হাঁ করিয়ে দাঁতও পরখ করেছিল টমের। এভাবে সব ক’জন ক্রীতদাসকেই বাজিয়ে
দেখে নিয়েছিল। তারপর কেনা-মানুষদের তার বাড়ি নিয়ে গেল। শুরুতেই সে সবাইকে হুশিয়ার
করে দিল। বলল, ‘দ্যাখো বাপুরা, আমার খাওয়া-পরার কোন অভাব নেই। আমি চাই কেবল
টাকা আর টাকা। টাকার জন্য সবই করতে পারি আমি। সেই টাকা গতর খেটে রোজগার করতে হবে তোমাদের।
বুঝেছ?’ এরপর চোখ পাকিয়ে সে
বলল, ‘খবরদার। কেউ ভেগে যাওয়ার
চেষ্টা কর না যেন। তাতে লাভ একটুও হবে না। ঐ ডালকুত্তাগুলো দেখে রেখো। পালানোর চেষ্টা
করলে ওদের পেটে যেতে হবে।’
টমের জীবনের সবচেয়ে করুণ পালা শুরু হল। সত্যি
সত্যি বড় ভয়ংকর সাইমন লেগ্রি। তার তুলা ক্ষেতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সকলকে কাজ
করে যেতে হয় একটানা। একদণ্ড বিশ্রাম নেই। চাবুক হাতে নিয়ে লেগ্রি কাজের তদারক করে।
ক্লান্ত হয়ে কেউ কাজ একটু থামালে অমনি শয়তানটা তার পিঠে শপাং করে চাবুক মারে। তার
চাহিদা মতো তুলা এনে জমা দিতে হবেই। একটু কম হলে আর রক্ষা নেই, পিটুনি খেতে হবে বেদম।
টম ফাঁকি দেয়ার মানুষই নয়। এখানেও সে খাটতে শুরু করল গাধার মতো। এই জন্যই তাকে লেগ্নি
ক্রীতদাসদের সদর বানিয়ে দিল।
সাইমন লেগ্রির দুজন ক্রীতদাসী ছিল। নাম এমিলিন
আর কেসি। ওদেরও খুব খাটতে হত তূলা ক্ষেতে। একটু এদিক সেদিক হলেই লেগ্রি যেত ক্ষেপে।
একদিন শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না এমিলিনের। গাছ থেকে সেদিন সে বেশি তুলা ছাড়াতে পারেনি।
ভয়ে বেচারী কাঠ হয়ে গেল। কি করবে? কাকে বলবে? সাহায্য করার মতো কে আছে? টমের কথা
মনে হল। ঐ একজনকেই দুঃখের কথা বলা চলে। টমের কাছে গিয়ে শুকনো মুখে বলল, ‘টম চাচা, আমার যে আজ
তুলা কিছু কম পড়ে গেছে। কী উপায় হবে আমার, বলত?’ টম এড়িয়ে গেল না,
পরিণাম চিন্তা করল না, এমিলিনকে নিজের ভাগ থেকে কিছু তুলে দিল। দিয়ে সাহায্য করল।
ব্যাপারটি ঠিকই কানে গেল লেগ্রির। রেগেমেগে সে
আগুন। টমকে ডাকাল। বলল, এত স্পর্ধা তোমার। ফাঁকিবাজগুলোকে সাহায্য করে বেড়াচ্ছ তুমি!
আর আমি কিনা তোমাকেই সর্দার বানিয়েছি! দাড়াও, দেখাচ্ছি মজা। উঠে গেল সে। ফিরে এল
তার চাবুকটা হাতে নিয়ে। দিল ওটা টমের হাতে। হুকুম করল, এমিলিনকে মারো। টম দাঁড়িয়ে
থাকল। নড়ল না। কথা বলল না। চোখ তুলে তাকালও না। গর্জে উঠল লেগ্রি, কষে ঘা লাগাও বলছি।’
‘না, না’—জীবনে
এই প্রথম প্রতিবাদ করল টম, ‘না, কাউকে আমি আঘাত দিতে পারব না। যতক্ষণ
আমার শ্বাস থাকবে, আমি খাব, খেটে খাব। কিন্তু কোন অন্যায় আমাকে দিয়ে হবে না।’
একটা গোলামের এমন কথায় আচমকা থ হয়ে গেল লেগ্রি।
পরক্ষণেই ফুসে উঠল। হিংস্র জন্তুর মতো। চাবুক মারতে থাকল টমকে। মেরে মেরে একেবারে রক্তাক্ত
করে দিল। এরপর টাকা দিয়ে যে ষণ্ডামার্কা লোক গুলোকে পুষতো তাদের আনল। আনিয়ে তাদের
দিয়েও মারল।
পড়ে পড়ে টম মার খেল। মারের চোটে অজ্ঞানের মতো
হয়ে গেল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি রইল না। জখম সারা পিঠে, হাতে, পায়ে, মুখে। লেগ্রি খুশি
হল, ভাবল উচিত শিক্ষা হয়েছে লোকটার। লেগ্রি এবার টমকে হাট, মুড়ে বসে ক্ষমা চাইতে
বলল। আদেশ করল, তোমার অপরাধের জন্য তুমি আমার কাছে মাফ চাও। কিন্তু আশ্চর্য, আজ কী
যে হল টমের। সে আর ভীরু নয়। আজ সে কথা বলছে সাহসী মানুষের মতো। মাথা উচু করে বলল,
‘আমি ক্ষমা চাইতে পারি
না। আমি তো অন্যায় করিনি।’
‘করেছ। আলবৎ করেছ,’ চিৎকার করে উঠল সাইমন
লেগ্রি, ‘আমার কথা অমান্য করেছ
তুমি। এখনও করছ। আমি কি টাকা দিয়ে তোমাকে কিনিনি?’
‘হ্যা, কিনেছেন। ঠাণ্ডা গলায় বলল টম, কিনেছেন আমার শরীরটাকে, মনটা নয়।’
আর সহ্য করা সম্ভব হল না। আবার ক্ষিপ্ত হল পাষণ্ডটা।
টমের ওপর নতুন করে নির্যাতন চালাল। চাবুকের আঘাতে শেষ পর্যন্ত জ্ঞান হারিয়েই ফেলল
টম।
যে মেয়েকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই এমিলিন, সবাই
ঘুমুতে গেলে পর টমের কাছে এল চুপি চুপি। সঙ্গে কেসি। এসে কেঁদে ফেলল, ‘চল টম চাচা, পালিয়ে
যাই আমরা। এত কষ্ট আর সইতে পারছি না।’
কাপুরুষের মতো টম পালাতে রাজী হল না। ওরা টাকা
দিয়ে সাহায্য করতে চাইল। অনেক অনুনয় করল। কিন্তু টমকে টলানো গেল না। টমের একই কথা।
অগত্যা নিজেরাই বেছে নিল ওরা মুক্তির পথ। কেসি
অর এমিলিন পালিয়ে গেল। লেগ্রির লোকেরা ওদের ধরার অনেক চেষ্টা করল। পারল না। মেয়ে
দুটোর পালানোর দায়ও এসে পড়ল টমের ওপর। টম মুখ খুলল না। কিছুতেই না। কোনও প্রতিবাদও
জানাল না। একবারও বলল না, আমি কিছু জানি না। অটল পাহাড়ের মতো রইল সে। তেমনি কঠিন,
তেমনি উচু। লেগ্রি ছাড়ল না।
প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। ক্রীতদাসের এত সাহস
মনিব হয়ে সে কেন মেনে নেবে? এমন করে কোন প্রভু লাই দিয়েছে তার দাসকে? আস্কারা পেলে
টমের আরও বাড় বাড়বে। তাকে সাইজ মতেই রাখতে হবে।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। লেগ্রি দেরি করল না। টমের
উপর শুরু করল জুলুম। চালাল অত্যাচার। যখন তখন লকলকে বেত মারতো তার পিঠে, কথায়-কথায়
কিল ঘুষি চড় মারত তাকে। লাঞ্ছনা আর যন্ত্রণায় বশ করতে চাইল টমকে।
টম বশীভূত হল না। তার মন আর হার মানল না। তবে
শরীরটা একেবারে ভেঙে পড়ল তার। মুখের হাসি তো কবেই গেছে, মিলিয়ে গেছে কণ্ঠের গান,
ছিল ধড়ে শুধু ধিকি ধিকি প্রাণ। এবার তাও যেতে বসেছে। নাকের আগায় এসে পড়ল নিঃশ্বাস।
মৃত্যুর ফেরেশতা মাথার কাছে এসে দাঁড়াল তার। টমের জন্য সঙ্গীদের মন বেদনায় ভরে যায়।
কিন্তু কারও কিছু করার নেই, সবাই ঐ নেকড়ে লেগ্রিটাকে ভয় পায়।
এমন সময় একদিন লেগ্রির খামার বাড়ি এল এক অতিথি।
নাম জর্জ। শেলবি সাহেবের ছেলে জজ শেলবি। হ্যা, কেটাকির সেই শেলবি। যে কেটাকি ছিল টমের
কাছে স্বর্গপুরী, শেলবি ছিলেন টমের কাছে সবচে আপন। যে শেলবি বিপাকে পড়ে টমকে বেচতে
বাধ্য হয়েছিলেন। অবস্থা ভাল হলে আবার টমকে ফিরিয়ে আনবেন বলে যিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন।
শেলবি সাহেব আজ আর নেই। তারই ছেলে এই জর্জ শেলবি সেদিনের ছোট্ট জর্জ টম চাচাকে ভোলেনি।
ভুলে যায়নি টম চাচাকে দেয়া তার বাবার অঙ্গীকার। তাদের অবস্থা আবার ফিরেছে। সেই থেকে
তারা টমকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জর্জের মাও টমকে ভোলেনি। অবশেষে জজ খবর পেয়েছে টমের। টাকা
দিয়ে ছাড়াতে এসেছে সে টমকে। লেগ্রিকে বলল জর্জ, ‘টম চাচাকে নিয়ে যেতে এসেছি। যত টাকা
লাগে, তাকে নিয়ে যাব। বলুন কত লাগবে?’
বিদ্রুপের হাসিতে ফেটে পড়ল নিষ্ঠুর লেগ্রি।
চিরে চিরে বলল, ‘নেবে, নাও। অমনি নিয়ে যাও। মরা নিগ্রো লেগ্রি
বেচে না।’
শেলবি সাহেবের ছেলে জর্জ ও আঙ্কল টম
‘কী!’ অতকে উঠল জর্জ। শয়তানের
চেলাটা বলছে কি? টম চাচা বেঁচে নেই? বিশ্বাস হয় না জর্জের। ভাবল ওটা একটা চাল লেগ্রির।
কিন্তু নিয়ে গেল লেগ্রি টমের কাছে জর্জকে। ইশারায় দেখল কুড়ে ঘরের এককোণে পড়ে-থাকা
আধমরা টমের দিকে। ছুটে গেল জর্জ টম চাচার কাছে। হু হু করে উঠল তার বুক। এই মানুষটির
প্রতীক্ষায় এত গুলো দিন তারা গুনেছে। এই মানুষটিকে তারা এত খোজা খুঁজেছে। আজ তাকে
পেয়েছে। কিন্তু এ কী পাওয়া? টমের এতই কষ্ট? এতই মুমূর্ষ অবস্থা! মাথাটা কোলে তুলে
নিল জজ। দেখল প্রাণের স্পন্দন তখনও কিছুটা আছে। হঠাৎ চোখ মেলে চাইল টম তার দিকে। তার
মলিন মুখে খুশির রেখা। কথা বলতে পারে না, তবু বলল থেমে থেমে ফিসফিসিয়ে, ‘তুমি এসেছ জজ! জান আমি
কত যেতে চেয়েছি কেন্টাকি। আমি মনে মনে তোমাদের আশায় দিন কাটিয়েছি। দম নিল একটু টম,
আবার কথা বলতে লাগল। জর্জ বাধা দিল, কিন্তু টম বলেই চলল, এখন আমি যাচ্ছি জর্জ। যাচ্ছি
কেন্টাকির চেয়েও ভাল জায়গায়, বেহেশতে। মাকে খবরটা দিয়ো। বলো কেন্টাকির সবাইকে।
ওরা আমাকে ভালবাসত।’
টমের চোখে যেন স্বর্গের দ্যুতি— ‘আমি গান গাইতাম। ওরা
খুশি হত। তুমি তখন কত ছোট।’
বুজে গেল টমের গলা। ঝরে পড়ল শেষ নিঃশ্বাস। চির
বিদায়ের পথে চলে গেল টম।
টমচাচার মৃতদেহটা কেন্টাকিতে নিয়ে এল জর্জ।
মিসেস শেলবি আঘাত পেলেন। ছেলে মানুষের মতো কাঁদলেন। টমের মতো ভাল ও সরল মানুষ তিনি
খুব কমই দেখেছেন অথচ সে কিনা জন্মাল ক্রীতদাসের ভাগ্য নিয়ে। শেষে জীবনও দিল ভাগ্যের
হাতে মার খেয়ে খেয়ে। টমের মৃত্যুতে শুধু শোকাহতই হলেন না মিসেস শেলবি, নতুন দীক্ষাও
যেন পেয়ে গেলেন। তিনি বুঝলেন, মানুষ বেচাকেনার মতো বড় অন্যায় আর কিছু নেই। নেই এর
চেয়ে বড় কোন পাপ। টমকে কবর দিয়ে এসে তিনি তার খামারের সব ক’জন দাস মজুরকে মুক্তি
দিলেন। সকল ক্রীতদাসদের এমন করে স্নেহে আর ভালোবাসা বিলিয়ে টমের স্মৃতির প্রতি-ই তিনি
সম্মান দেখালেন।
সদ্যমুক্ত দাসদের মুখে হাসি ফুটল। তারা এখন মুক্ত,
তারা এখন স্বাধীন। তারা বলল, ‘আহা, সব ক্রীতদাস-ই যদি এমন করে মুক্তি
পেতে পারত, কি ভালই না। হত!’ জর্জ তাদের কাছে গিয়ে বলল, ‘হবে। একদিন সব দাসদের
হাতের বেড়ি খুলে যাবে। টম চাচা একার জীবন দিয়ে সকলের জীবন মুক্ত করার পথ করে দিয়ে
গেছেন।’
ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না, বলল, ‘সত্যি?’
‘হ্যা,’ জর্জ জোর দিয়ে জানাল,
‘কোনও মানুষই দাস হওয়ার
জন্য জন্মায় না। আসবেই একদিন সকলের মুক্তি।’
জর্জের কথাই সত্য হয়েছিল।
শেষ কথা
এই হল টম চাচার কাহিনী। এখানেই এর শেষ। কিন্তু
এ শুধু একজন ক্রীতদাসের গল্প নয়। আমেরিকার লাখ লাখ ক্রীতদাসের দুঃখ রূপ পেয়েছে এর
মধ্যে। টম চাচা পৃথিবীর সকল হতভাগ্য ক্রীতদাসের দুঃখের প্রতীক।
টম চাচার এই কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়ার পর সারা
আমেরিকা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। মানবতাবাদীরা ক্রীতদাসদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে জানালেন
তীব্র প্রতিবাদ। মানুষ বিকিকিনির এই ঘৃণ্য প্রথা তুলে দেয়ার দাবী উঠল চারদিক থেকে।
এই দাবীর মুখেই একদিন উঠে গেল ক্রীতদাস প্রথা। টম চাচা নিজের জীবন দিয়েই খুলে দিলেন
আর সবার মুক্তির পথ।
সুন্দর
ReplyDelete