|  | 
| রহস্য গল্প - বাদাবনের হাতছানি - আলী ইমাম | 
রহস্য গল্প - বাদাবনের হাতছানি - আলী ইমাম (২ পর্বের ২য় পর্ব)
১ম পর্বের পর থেকে
-দেখেছি। পাখিদের নিয়ে একটি ছবি। কী যেন নাম। দূর ছাই মনে পড়ছে না। 
-দি
বার্ডস। একঝাঁক পাখি কী করে পুরো একটা শহরকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। কি রকম নিষ্ঠুর
হয়ে মানুষের উপর আক্রমণ করছিল খুদে পাখিগুলো। মনে আছে একটি লোকের চোখ ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলেছিল, ফর্শা লোকটি
কেমন ফিসফিস করে বলতে থাকে,-এটা কিন্তু খুবই খারাপ কথা যে তুমি ছবির নামটা চট করে মনে
করতে পারোনি। তার মানে তোমার স্মরণশক্তি দুর্বল। এ বয়স থেকেই কীভাবে স্মরণশক্তিকে
বাড়ানো যায় তার চেষ্টা করা উচিত। জানো, যে কোনো মানুষ তার মস্তিষ্কের
ক্ষমতার মাত্র সামান্য অংশ ব্যবহার করে থাকে। আইনস্টাইনের মতো লোক তার মস্তিষ্কের ক্ষমতার
মাত্র শতকরা তেরো ভাগ ব্যবহার করেছিলেন। আর তাতেই আমাদের আধুনিক সভ্যতাকে কতটা প্রচণ্ডভাবে
নাড়া দিতে পেরেছিলেন। 
রাতের
ট্রেনের এই যাত্রীকে তখন চমৎকার লাগে আমার কাছে। 
-জানো, হিপনোটাইজ
করে মানুষের স্মৃতিশক্তিকে অনেক বাড়ানো যায়। মানুষের মনের ভেতরের অনেক কথাকে টেনে
বার করে আনা যায়। এই ধরো তুমি এখন কী ভাবছো আমি যদি হিপনোটাইজ করার বিদ্যেটা জানতাম,
তাহলে ঠিক বলে দিতে পারতাম। 
বলে
ফর্শা লোকটি আমার দিকে তীব্রভাবে তাকায়। আমার মাথাটা যেন একটু দুলে ওঠে। মনে হয় কামরার
সব বাতিগুলো নিভে গেছে। শুধু সবুজ রঙের একটা বাতি জ্বলছে। তার মাঝে লোকটার মুখ কুয়াশার
মতো মিশে আছে। সেই সবুজ আলোটা ক্রমশ তীরের মতো হয়ে উঠছে। যেন আমার শরীরের ভেতরে বিধে
যাবে।। আমি জোর করে মনটাকে সরিয়ে আনি। ঝট করে তাকাই জানালার বাইরের
দিকে। একটা স্টেশনের আলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। 
ট্রেন
আস্তে আস্তে এসে থামে ছোট্ট একটি স্টেশনে। মিটমিট করে কয়েকটা আলো জ্বলছে। কয়েকজন
লোক লটবহর নিয়ে নামে। ফেরিঅলারা ছোটাছুটি করতে থাকে। আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। এক
ফল বিক্রেতার কাছ থেকে একটি কচি ডাব কিনে ঢকঢক করে খাই। আমার মুখ সেই পানিতে ভিজে যায়। হঠাৎ চোখ পড়ে সামনের বেঞ্চির সেই ফর্শা লোকটির দিকে। আমার দিকে
কী রকম অস্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে আছে। লোকটির ওই রকম চাউনি আমার কাছে মোটেই ভালো লাগে
না। 
-তুমি
বুঝি ফিল্ম দেখতে ভালবাসো? 
-হুম। 
-আমি
ফিল্ম বানাই। 
-তাই
নাকি!
লোকটির প্রতি আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি। 
-আমি
বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রার উপর ছবি তুলছি। এবার যাচ্ছি সুন্দরবন।
বাঘ আর হরিণের উপর ছবি তুলতে। আগামী বছর অটোয়াতে এ ধরনের ডকুমেন্টারি ছবির এক বিরাট
প্রতিযোগিতা হবে। আমি সেখানে এ ছবি নিয়ে যেতে চাই। 
লোকটি
তার ব্রিফকেস খুলে আমাকে বিভিন্ন প্রাণীর রঙিন স্থিরচিত্র দেখায়। এই দেখ, এটা
বনরুই। অনেকেই মনে করে এটা বুঝি দক্ষিণ আমেরিকার আর্মিডিলোর ছবি। যারা লম্বা জিভ দিয়ে
সুড়ৎ করে শুধু পিঁপড়ে খায়। জঙ্গল এলাকায় বনরুই পাওয়া যায়। দেখছো, এর পিঠ রুই মাছের মতো বড় বড় আঁশে ঢাকা। দিনের বেলায় এর কোনো পাত্তা নেই।
রাত হলেই উইপোকার ঢিবি নয়তো পিঁপড়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এদের উপর সুটিং করতে আমাকে
খুব বেগ পেতে হয়েছিল। 
লোকটি
বেশ উৎসাহের সঙ্গে আমাকে ছবিগুলো দেখাতে থাকে। নোট বইতে বিভিন্ন প্রাণীর উপর নানা তথ্য
লেখা। কখনও কখনও সেগুলো পড়ে শোনায়। 
-এটা
হলো মাছবিড়াল। হাওড়, বিল, আর নদী পাড়ের ঝোপ-জঙ্গলে থাকে। এর শরীরে বাদামি ছাপ। কপাল ঘাড় পর্যন্ত ৬ থেকে ৮টি কালো ডোরা
দাগ আছে। মাছ, শামুক, ঝিনুক খায়। অনেক
সময় ছোট ছোট পাখিদেরও ধরে খায়। আমি একসময় খুব ভয়ের ছবি দেখতাম। ভাবতাম ওই ধরনের
ছবি বানাব। ড্রাকুলার ছবি দেখে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। 
-ড্রাকুলা
কে? 
-এই
দেখ, হিচককের নাম জানো আর ড্রাকুলার কথা জানো না। প্রিন্স ড্রাকুলা। মধ্য যুগের
জার্মানির এক রাজপুত্র। জঙ্গলের ভেতরে দুর্গবাড়িতে থাকত। অদ্ভুত এক নেশা ছিল তার।
মানুষের রক্ত পান করা। প্রিন্স ড্রাকুলার গা ছমছম করা কাণ্ডকারখানা নিয়ে অনেক ছবি
হয়েছে। কিন্তু একটি পোলিশ ছবি দেখে আমার সব ধারণা পাল্টে গেল। 
-কেন? কী
ছিল সেই ছবিতে? 
-ছবিটির
নাম ছিল ম্যাথুসের দিন। ম্যাথুস নামের এক বুড়ো থাকত পাহাড়ি ছোট্ট গ্রামে। লেকের পাশে
বাড়ি। খুব শান্ত প্রকৃতি চারদিকে। ম্যাথুস গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পাখি আর লেকের মাছ খুব ভালবাসতো। ওর মনে হতো, সে নিজেও বুঝি প্রকৃতির এক অংশ। কেউ গাছ
কাটলে সে দারুণ কষ্ট পেতো। বঁড়শি দিয়ে
মাছ গেঁথে তুলতে তার খারাপ লাগতো। একবার এক শিকারি
একটি বককে গুলি করেছিল। ম্যাথুস সেই গুলিবিদ্ধ বিশাল বকটিকে বুকে আগলে ছলছল করে তাকিয়েছিল।
আস্তে আস্তে নেতিয়ে আসছে বকটি। ঘোলাটে চোখ মেলে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ক্যামেরা এখানে বিগ
ক্লোজ আপে বকের চোখের ছবি নিয়েছে। বকটি একসময় মারা যায়। যেনো সভ্যতার মৃত্যু হয়।
সেই ছবি আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল। তারপর থেকে আমি আমাদের দেশের বন্য প্রাণীদের ছবি
তুলতে থাকি। 
ট্রেন
আরেকটি স্টেশনে এসে থাকে। টুনুভাই দিব্যি ঘুমাচ্ছেন। ফর্শা লোকটি হঠাৎ আমার দিকে তীব্রভাবে
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কোথায় যাচ্ছো? 
-সুন্দরবন।
সুন্দরবনে কেন? 
আমি
তখন আমতা আমতা করতে থাকি। লোকটি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, 
-সুন্দরবন
কেন যাচ্ছো? 
-আমার
খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি জড়িত স্বরে বলি। 
-তুমি
ঘুমোও। নীল ঘুমের রাজ্যে তুমি চলে যাও। ঘুমটা যেন শান্ত একটি হ্রদ। তার ভেতরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাও তুমি। তারপর তোমার সঙ্গে আমার
দেখা হবে। কথা হবে। 
আমার
চোখের সামনে থেকে তখন সবকিছু ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু মনে হয় একটি সবুজ বাতি
থেকে আলো এসে পড়েছে আমার মুখে। ট্রেন তখনও চলছে সাঁই সাঁই করে। আমার আর কিছু মনে থাকে
না। 
টুনুভাইয়ের
ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গে। ইস্, কী ঘুমকাতুরে ছেলেরে বাবা। এত ধাক্কাধাক্কি করছি। 
কামরাটি
রোদে ঝলমল করছে। আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। সেই ফর্শা লোকটিকে কোথাও দেখলাম না। ট্রেন
স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হঠাৎ মনে হলো আমরা যে গড় মুকুন্দপুরে গুপ্তধনের খোঁজে
যাচ্ছি,
কৈখালি গ্রামে যাচ্ছি, সব কথা সেই লোকটা জানে।। 
--টুনুভাই, রাতের
বেলায় একটি লোক আমাকে হিপনোটাইজ করেছিল। 
-নে
নে হয়েছে। এখন জলদি করে নাম। রাজ্যির সব ভুতুড়ে বই পড়ে এসব কথা বকছিস। জলদি নাম। 
স্টেশনের
কাছের একটি দোকান থেকে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। গরম ভাত। পাঙ্গাস মাছের ঝোল। তারপর ক্ষীরের
মিষ্টি। 
দুপুরবেলায়
রওনা দিলাম সুন্দরবনের দিকে। লঞ্চ চলছে ভটভট করে। 
-প্রথম
আমরা যাব বুড়ি গোয়ালিনি রেঞ্জে। সেখান থেকে নৌকা করে যেতে হবে। 
দু
পাশে সুন্দরী গাছের সারি। কোথাও কোথাও কাঠশালার জঙ্গল। গাঙচিল আর স্নাইপ
(কাদাখোঁচা) উড়ে যাচ্ছে। গাঙচিলগুলো লঞ্চের পেছনের ছিটকে যাওয়া পানির ভেতর থেকে ছোঁ
মেরে মাছ তুলে নিচ্ছে। 
গোলপাতা
বোঝাই করে নৌকা যাচ্ছে। মাছ ধরার নৌকা যাচ্ছে। 
নৌকাতে
মটকা ভর্তি মিঠা পানি। তেঁতুলগোলা পানি। হঠাৎ করে দেখা যায় কেওড়া গাছের জঙ্গল। সেখানে
কুড়াবক থাকে। কত রকমের গাছ আছে এই জঙ্গলে। আমি সারেঙের ঘরে যাই। বৃদ্ধ সারেঙ। পেটা শরীর। 
বলে, বহু
জাতের গাছ। সুন্দরী, গরান, কাঁকড়া,
আমড়া, বান, হেতাল,
গেওয়া, গোল । এদিককার গরিব লোকদের বাড়ি গোলপাতায় ছাওয়া।
হেতাল গাছের ঝোপে বাঘ লুকিয়ে থাকে। আর আছে কেঁচো ঘাসের বন। 
আচ্ছা
সারেঙ,
এখানে বনমুরগি কেমন? 
-আগে
স্যার অনেক ছিল। এখন কমে গেছে। বনবিবির পুজার জন্য বাওয়ালিরা জঙ্গলে এসে তার নামে
মানত করা মোরগ মুরগি ছেড়ে দিত। সেগুলো জঙ্গলের ভেতরে লকলক করে বড় হতো। খেতো রাজ্যের পোকামাকড় আর কাঁকড়ার বাচ্চা। কাঁকড়ার বাচ্চা খেয়ে
খেয়ে বনমুরগিগুলোর শরীরে তেলও হতো। এরা গাছের খোড়লে
ডিম পাড়ে। তা দেয়। বাচ্চা ফোটায়। কট কট কটাস শব্দ করে ডাকে। 
লঞ্চ
একসময় বুড়ি গোয়ালিনির ফরেস্ট অফিসের কাছে এসে থামে। আমি আর টুনুভাই নির্বিকার। আমরা
যে ঢাকা থেকে সাঙ্ঘাতিক একটা উত্তেজনাকর কাজে এসেছি সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। গুপ্তধনের
ব্যাপার। খুব সাবধানে থাকতে হবে। কোনোমতেই যেন কিছু ফাঁস না হয়ে যায়। 
বুড়ি
গোয়ালিনিতে টুনুভাইয়ের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আছে। ভদ্রলোক বন বিভাগে কাজ করেন।
তার ওখানেই উঠলাম। ভদ্রলোক খুব আমুদে। আমাদের পায়রাতলি মাছের ভাজি খাওয়ালেন। 
-এসব
গাছের হিসেব নিকেশ রেখে লাভ নেই। বড্ড ড্রাই কাজ। বুঝলে টুনু, ভাবছি
কুমিরের চাষ করব। 
-কিসের
চাষ! 
-কুমিরের।
ইন্ডিয়াতে অনেকেই করছে। রীতিমতো কুমিরের খামার করে। ব্যাপারটা এই রকম। লোক লাগিয়ে
জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুমিরের ডিম সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেগুলো ইনকুবেটরে
যান্ত্রিকভাবে ফোটাতে হবে। কুমিরের বাচ্চাদের লালন করতে হবে। তারপর একটু বড় হলেই বিদেশে
চিড়িয়াখানাগুলোতে পাঠাও। দারুণ ডিমান্ড রয়েছে। 
পরদিন
ভোরে নৌকা করে মুকুন্দপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেদ্ধ ডিমের মতো মসৃণ আকাশ। আঁকাবাঁকা
খাল। অনেক জায়গাতে গাছপালা ঝুঁকে থাকার জন্যে থমথমে অন্ধকার। কোথাও কোথাও গাছের শাখায়
দক্ষিণ রায়ের বাসা দেখা যায়। দক্ষিণ রায় বাঘের দেবতা। বাদাবনে তার খুব দাপট। 
দক্ষিণ
রায়ের মূর্তি দেখতে চমৎকার। হলুদ বরণ শরীর। মাথায় বাবরি চুল। তার উপর মুকুট। কানে
কুণ্ডল। কপালে রক্ততিলক। হাতে তীর ধনুক। পিঠে ঢাল। জানু পেতে বসে আছে। সোনালি খড়ে
ছাওয়া মাটির থানে দক্ষিণ রায় বসা। দেড়শো বছরের পুরনো সেই ডাইরির পাতায় দক্ষিণ রায়ের
পুজোর কথা উল্লেখ করা আছে। 
মাঝির
সঙ্গে আমাদের ভাব হয়ে যায়। মাঝি সুন্দরবনের পুথি জানে। আমরা মাঝির সেই ভরাট গলার
পুথিপাঠ টেপ করে রাখি। 
এবলিয়া
বাঘ সব সাজিতে লাগিল। 
খান্দেওয়ালা
বাঘ সেই প্রথমে সাজিল। 
সেই
বাঘ হয় সেই প্রথমে সাজিল। 
সেই
বাঘ হয় সব বাঘের প্রধান। 
রাক্ষস
ধরিয়া খায় ভাঙ্গিয়া গর্দান।
সাজে
বাঘ বেড়াভাঙা বৃহৎ ভীষণ। 
মারিয়া
অসুর সিংহ করেন ভক্ষণ। 
সাজে
বাঘ দানে ওরা চলে লম্ফ দিয়া। 
আকাশের
সূর্য চায় খাইতে ধরিয়া ।। 
সাজে
বাঘ কালকূট ধবধব চলে। 
হাতি
নিয়া দৌড় দেয় দন্তে ধরি গলে। 
দুপুরের
ছলাৎ ছলাৎ নদীর ভেতরে আমরা মাঝির পুথিপাঠ রেকর্ড করি। 
শেষবিকেলের
দিকে গাছপালার ফাঁকে ভাঙা ইটের দেউল চোখে পড়ে। কয়েকটি শামুকখোল ওদিকে উড়ে যায়।
এখানকার লোক শামুকখোলকে বলে যুঁটিভাঙা সারস। মাঝি সেদিকে তাকিয়ে বলে, 
-হুই
যে মুকুন্দপুরের গড়। 
আমার
আর টুনুভাইয়ের বুক ছলকে ওঠে। শেষবিকেলের মরে যাওয়া আলোতে সেই গড়কে খুব রহস্যময়
দেখায়। আমার মনে হয় এর কোথায় জানি মাটির তলায় লুকিয়ে আছে ঘড়াভর্তি মোহর! কোথায়
তার নিশানা। 
আমরা
মুকুন্দপুরের বাজারে যাই। ছোট্ট কয়েকটি চালাঘর। আনাজপাতি বিক্রি হয়। গুড় বিক্রি
হয়। নোনা পানির দেশ বলে এখানকার লোক বেশ গুড় খায়। কৈখালি গ্রাম এখান থেকে বেশ দূরে।
পরদিন সকালে সেখানে রওনা দেব বলে ভাবি। রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব। মুকুন্দপুরের এক
স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি তার বাড়িতেই রাতে থাকার নিমন্ত্রণ জানান। 
সন্ধেবেলায়
আমরা গড়টা ভালো করে দেখতে যাই। গুপ্তধনের নিশানা আছে পাকুড় গাছের নিচে হাতির দাঁতের
বাক্সের ভেতরে। সেটা উদ্ধার না করা পর্যন্ত গড় মুকুন্দপুর আমাদের কাছে শুধুমাত্র নোনাধরা
ইটের দেয়াল। শ্যাওলা ছোপ ছোপ দেয়াল। এলোমেলো বাতাসে সাপের খোলসের ফিনফিনে দুলুনি। 
আমি
আর টুনুভাই সাবধানে গড়ের ভেতরে হাঁটতে থাকি। কোথাও পড়ে আছে প্যাচার ডিম। হঠাৎ আমার
মনে হয় কে যেন হেঁটে আসছে। এই নির্জন গড়ে আবার কে আসবে? টর্চটা
নিবিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সরু আলোর রেখা দেখা
যাচ্ছে। একজন লোক এদিকে আসছে। টর্চের আলোতে লোকটিকে আমি চিনতে পারি। ট্রেনের সেই ফর্শা
চিত্রপরিচালক। আমার মুখ দিয়ে বিস্ময়ের একটা শব্দ বের হতেই সে লোকটি চমকে যায়। ঠিক
সেই সময়ে একটা রাতচরা পাখি বিচ্ছিরিভাবে ডেকে ওঠে। লোকটি গড় থেকে দৌড়ে পালিয়ে মিশে
যায় অন্ধকারের ভেতরে। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে রহস্যময় লাগে। 
পরদিন
খুব ভোর থাকতেই কৈখালি গ্রামের দিকে নৌকা ছেড়ে দেই। দু'পাশে
কষাড়ের ঘন জঙ্গল। একটা লোককে দেখলাম হরিণের বাচ্চা কোলে নিয়ে যেতে। মাঝে মাঝে পাখির
ঝাক মাথার উপর চক্কর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। একটি ডিঙি নৌকা কামট শিকার করে ফিরছিল। তাদের
জিজ্ঞেস করতেই বলল, সামনের বাঁকটা পেরুলেই কৈখালি গ্রাম দেখা যাবে। 
আমি
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টানটান হয়ে যাই। শুশানঘাটের কাছে পাকুড় গাছ। ট্রেজার আইল্যান্ড
উপন্যাসের কথা মনে হয়। নীল রঙের কোটপরা কাপ্তান গানের সুর শিস দিতে দিতে আসছে। গানটা
সমুদ্রের। লোকটার পিঠে ঝুলছে শুয়োরের লেজের মতো বেনি। গালের এক পাশে তলোয়ারের আঘাতের
কাটা দাগ। সামুদ্রিক বাতাসে ভরে থাকা ছোট্ট শহরে কাপ্তান গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে, 
মরা
মানুষের সিন্দুক । 
নজর
রেখেছে পনের জন 
হা
হা হা। 
আমার
মনে হতে লাগল সেই উপন্যাসের লাল কালিতে আঁকা ম্যাপটার কথা। 
বেশির
ভাগ ধনরত্ন এইখানে 
লম্বা
গাছ, স্পাই গ্লাস কাঁধ, 
কঙ্কাল
দ্বীপ দশ ফিট 
রূপার
বাঁট উত্তর কোণে 
পুবের
দিক ঘেষে দশ হাত দূরে 
বালিয়াড়িতে
সঙ্কেত চিহ্ন আছে 
শুধু
এসব মনে হচ্ছে। কৈখালির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চুনকুড়ি। আমরা একটা হিজল গাছের কাছে নৌকা
বাধলাম। একজন বৃদ্ধ লোক জাল নিয়ে যাচ্ছে। তাকে ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, এখানকার
শুশানঘাটটা কোথায়? 
বৃদ্ধ
কিছুক্ষণ অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দূরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, বহু
বছর আগেই সেটা নদীতে তলিয়ে গেছে। 
তাকিয়ে
দেখলাম দুপুরের রোদে চিকচিক করছে নদী। কয়েকটি গাঙচিল সেখানে পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে। 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
No comments:
Post a Comment