মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, March 4, 2022

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 2 of 4

বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie।

বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie

১ম পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – বাংলা অনুবাদ - Bangla 

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ আগাথা ক্রিস্টি বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 2 of 4

অধ্যায় ৩

মেজর মেটকাফের আগমনের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি নিয়মের গণ্ডিতে আটকা পড়লো মঙ্কসওয়েল ম্যানরের দৈনন্দিন কাজকর্ম। মিসেস বয়েলের মতো ভয়ংকর নন তিনি, আর নাতো ক্রিস্টোফার রেনের মতো অস্থির গোছের। বরং ভাবলেশহীন ও মিলিটারি দর্শনের একজন মানুষ তিনি। মাঝবয়সি এই মানুষটা কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময়ই ব্যয় করেছেন ভারতে। নিজের ঘর ও তার আসবাব নিয়ে সন্তুষ্টই দেখা গেল তাকে। আর মিসেস বয়েল যখন মেজর মেটকাফের সঙ্গে পারস্পারিক কোনো বন্ধু পেলেন না, অর্থাৎ মিউচুয়াল কোনো বন্ধু নেই বুঝতে পারলেন, তখন মেজর মেটকাফ জানালেন, তিনি পুনায় থাকা মিসেস বয়েলের কোনো এক বন্ধুর চাচাতো ভাই-বোনদের চেনেন। ইয়র্কশায়ার শাখায়, বলেছিলেন তিনি যাই হোক, তাঁর মালপত্র বোঝাই করা লাগেজও বেশ ভারি ছিল। যার ফলে জাইলসের সন্দেহবাতিকও নিবৃত্ত হলো শেষমেশ।

সত্যি বলতে, অতিথিদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করার মতো যথেষ্ট সময় মোটেও পায়নি মলি ও জাইলস। ব্যস্ত ছিল রাতের খাবার বানানো, পরিবেশন, খাওয়া ও ধোয়ামোছার মধ্যেই। কফির প্রশংসা করেছিলেন মেজর মেটকাফ। যাই হোক, বিজয়ী বেশে বিছানায় আসার পরপরই ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়লো দুজনে। আর ঠিক ভোর দুটোর সময় বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো তাদের।

বাল! বিরক্তি ভরে বলল জাইলস। সেই সামনের দরজা। কী যে...

আরে, তাড়াতাড়ি কর, বলল মলি। গিয়ে দেখ, কে এসেছে।  

ওর দিকে প্রচণ্ড ভৎসনার দৃষ্টি দিলো জাইলস, তারপর ড্রেসিং গাউন গায়ে জড়িয়ে নিচে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। একটু পরই দরজার হুড়কি খোলার ও কথাবার্তার শব্দ ভেসে এলো নিচ থেকে। কৌতূহলের কাছে হার মেনে বিছানা ছাড়লো মলি, তারপর সিঁড়ির কাছে গিয়ে উঁকি মারলো নিচে।

দাড়িওয়ালা এক লোকের সঙ্গে কথা বলছে জাইলস, কোটভর্তি বরফ নিয়ে ঠকঠক করছে কাঁপছে লোকটা। ভাঙা ভাঙা কিছু শব্দ কানে এলো ওর।

ঠানননন...আমমম, গলার স্বরে বিদেশী মনে হলো লোকটাকে। ঠান্ডায় আমার আঙুলে ক ক ক...কোনো বোধ নেই। ও খোদা, আমার পা... বরফে থপথপ শব্দ হলো একটা।  

আসুন আসুন, চট করে লাইব্রেরির দরজা খুলে দিলো জাইলস। এখানে আগুন আছে। রুম রেডি করা পর্যন্ত এখানে বসেই গা গরম করুন বরং।  

ভাগ্যটা অন্তত ভালো আমার, লোকটার মার্জিত গলা শুনে রেলিংয়ের ফাক দিয়ে আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো মলি। মুখে ছোটো ছোটো কালো দাড়ি ও শয়তানের মতো একদিক উঁচু চোখের ভ্রু। কপালে বয়সের সূক্ষ্ণ  ভাজ চোখে পড়লেও তাগড়া যুবকের মতো দৃঢ় ভঙ্গিতে পা ফেলে হাঁটছে সে। লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করে এবার দ্রুত সিঁড়ির ওপরে উঠে এলো জাইলস। তাকে দেখে হাঁটুভাঙা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো মলি লোকটা কে? জিজ্ঞেস করল সে।

হাসি ফুটে উঠল জাইলসের ঠোটে, অতিথিশালার জন্য নতুন অতিথি। বরফের স্রোতের মুখে পড়ে গাড়ি উল্টে গেছে তার। কোনোমতে বের হয়ে জান নিয়ে পালিয়েছে। দেখ, এখনো তুষারঝড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, রাস্তা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতেই আমাদের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে তার। এটাকে প্রার্থনার তাৎক্ষণিক ফল বলছে সে।

কী মনে হয় তোমার, লোকটা ভালো তো?

খামোখা চিন্তা করছো, সোনা। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল জাইলস। সিঁধেল চোরের জন্য এটা মোটেও কোনো আদর্শ রাত নয়।

জাইলসের অভিব্যক্তি দেখেও ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না মলি। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল, তবুও, লোকটা তো বিদেশী, তাই না?

হ্যা, বলল জাইলস। নাম প্যারাভিসিনি। লোকটার ওয়ালেট দেখেছি আমি। মনে হচ্ছে, উদ্দেশ্য নিয়েই ওটা দেখিয়েছে সে। ওয়ালেট ভর্তি টাকা। কোন রুমটা দেওয়া যায়?

গ্রিন রুম, বলল মলি। ওটা একদম পরিপাটি করা আছে, শুধু বিছানা ঠিক করতে হবে।

লোকটাকে পায়জামা ধার দিতে হবে মনে হচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে কোনোরকমে বেরিয়ে এসেছে বলে সবকিছু ওখানেই রয়ে গেছে তার।

কিছু না বলে বিছানার চাদর, বালিশের কভার আর তোয়ালে নিলো মলি। দুজনে মিলে দ্রুত বিছানা ঠিক করার সময় জাইলস বলল, যে হারে বরফ বাড়ছে, তাতে শীঘ্রই আটকা পড়ব আমরা। পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব সবার কাছ থেকে। একদিক থেকে কিন্তু ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর, তাই না?

জানি না, দ্বিধায় পড়ে গেল মলি। আটকা পড়লে আমি সোডা ব্রেড বানাতে পারব তো, জাইলস?

অবশ্যই পারবে, হেসে ফেলল ওর বিশ্বস্ত স্বামী। যে-কোনো জিনিসই বানাতে পারবে তুমি।

কখনো ব্রেড বানানোর চেষ্টাও করিনি আমি। এই ধরনের জিনিসগুলো একটু ঠিকঠাক করে বানাতে হয়। দেখ, তাজা হোক বা বাসি, সাধারণত বেকারীর লোকজনই দিয়ে যায় এসব। কিন্তু একবার আটকা পড়লে কোনো বেকারীর লোকই পাব না আমরা।

আর না তো কোনো কসাই, পোস্টম্যান কিংবা খবরের কাগজ। আবার হয়তো টেলিফোন লাইনও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

মানে, শুধু ওয়্যারলেসের ঘ্যানঘ্যানানী শুনে ঠিক করতে হবে, কী করা উচিত?  

যাই হোক না কেন, আমাদের নিজেদেরকেই ইলেকট্রিক লাইটগুলো ঠিক করতে হবে।

কাল অবশ্যই আবারও ইঞ্জিন চালু করবে তুমি। সেন্ট্রাল হিটিংও ঠিক রাখতে হবে, নাহলে কপালে শনি আছে।  

বাইরে যা অবস্থা, তাতে পরবর্তী কয়লার লট আসতে পারবে বলেও তো মনে হয় না।  

ওহ, খোদা! মুষড়ে পড়লো মলি। ভালো লাগছে না, জাইলস, সত্যিই খুব বিপদের মধ্যে আছি আমরা। যাই হোক, তাড়াতাড়ি করে প্যারা-ট্যারা-কী যেন নাম, ডাকো ঐ লোকটাকে। আমি ঘুমাতে যাব।

গুটিগুটি পায়ে আসা পরদিনের বিষন্ন সকালটাই জাইলসের কথার সত্যতার প্রমাণ দিলো। পাঁচ ফুট উঁচু বরফের নিচে ঢাকা পড়েছে প্রকৃতি, বরফের চাপে পায়ে শেকল গজিয়েছে দরজা-জানালা সবকিছুর। পিনপতন নিস্তব্ধতার চাদরে ঘাপটি মেরেছে প্রকৃতি। পুরো পৃথিবীটাই সাদা, নিস্তব্ধ। আর কোনো সূক্ষ্ম, সাবধানী দৃষ্টিকোণ থেকে-ভয়ংকর।

সকালের নাস্তা করছেন মিসেস বয়েল। আশেপাশে আর কেউ নেই, খা খা করছে পুরো ডাইনিং রুম। পাশের টেবিলে মেজর মেটকাফের জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়েছে এতক্ষণে। অথচ মিস্টার রেনের টেবিলে রেখে যাওয়া নাস্তা যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। একজন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে, অন্যজন সম্ভবত দেরিতে। আর মিসেস বয়েল নিজে সকালের নাস্তার জন্য আদর্শ সময় বলতে বোঝেন-ঠিক সকাল নয়টা।

সুস্বাদু অমলেট গলাধঃকরণ করে এখন নিজের শক্ত ও সাদা দাঁতের মাঝখানে টোস্ট চেপে ধরলেন তিনি। কাজটা যেন নিতান্তই অনিচ্ছয় করতে হচ্ছে তাঁকে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অনিশ্চয়তা, নিদারুণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি ঝেকে ধরেছে তাকে। এখানে ব্রিজ খেলা কিংবা অবিবাহিতা কোনো মহিলাকে আশা করেছিলেন তিনি। তাঁর সামাজিক অবস্থান ও নানা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কথা শুনে যার চোয়াল ঝুলে পড়ত। যাকে ইঙ্গিত দিতে পারতেন নিজের ওয়ার সার্ভিসের গুরুত্ব, এবং যার সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন নানা গোপন ব্যাপার নিয়ে।

যুদ্ধপরবর্তী সময়টা যেন মিসেস বয়েলকে ছুঁড়ে ফেলেছিল জনমানবশূন্য কোনো এক নির্জন দ্বীপে। বরাবরই ব্যস্ত গোছের মহিলা ছিলেন তিনি। একইসঙ্গে দক্ষতা ও সংগঠন নিয়ে অনর্গল বাকপটুতা তাকে দিয়েছিল আলাদা সম্মান। তাঁর প্রাণশক্তি আর কর্মব্যস্ততা দেখে কখনো সাংগঠনিক কাজের ক্ষেত্রে কেউ তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি। যুদ্ধের ময়দানে একাই যেন একটি দুর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। যে মানুষটা একসময় অন্যদের নেতৃত্ব দিত, তর্জনগর্জন করত, যার ভ্রু একটু কুঁচকালে ভয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে পালাতে পরাজিত নারীরা সেই মানুষটা আজ নিজেই হয়ে উঠেছেন পরাজিত একজন।

সমাপ্তি ঘটেছে জীবনের সেই উত্তেজনাকর অধ্যায়ের। আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন তিনি। প্রাক্তন সেসব বেসরকারি কাজের ইস্তফা ঘটেছে। যুদ্ধের সময় আর্মিরা দখল করেছিল তার বাড়ি। যেটা এখন পুনরায় বাসযোগ্য হওয়ার আগে বেশ বাজেভাবেই মেরামতের দরকার পড়েছে। তাছাড়া সাংসারিক নানা কাজকর্মের চাপ নিয়ে ওখানে ওঠা রীতিমতো দুঃসাধ্য। বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। চেষ্টা করলে যে নিজের জন্য ভালো কোনো জায়গা পাবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক তো হলো দৌড়াদৌড়ি, এবার একটু থিতু হওয়ার সময়। আর এই সমস্যার একমাত্র সমাধান বলতে গেলে কোনো হোটেল কিংবা বোর্ডিংহাউজ।

ঠিক এই কারণেই শেষমেশ মঙ্কসওয়েল ম্যানরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মুখে অপমানিত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেন তিনি।

খুবই অসৎ, আপনমনেই বিড়বিড় করলেন তিনি, একবারও বলেনি সবে খুলেছে এটা।  

নাস্তার প্লেটটা দূরে ঠেলে দিলেন তিনি। এটা ঠিক যে বেশ যত্ন নিয়েই চমৎকার রান্না হয়েছে। ত্রুটি ছিল না পরিবেশনেও তা সত্ত্বেও অদ্ভুতভাবেই রাগে ফুসছেন তিনি। যতই রাগ হোক, অভিযোগ করার জন্য যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ মাথায় আসছে না তাঁর। নরমালিশ আর সুন্দর কারুকাজ করা চাদরে ঢাকা বিছানাটা বেশ আরামদায়ক ছিল। যাই হোক, একইসঙ্গে আরাম ও খুঁত খুঁজে বেড়াতে পছন্দ করেন মিসেস বয়েল। যদিও এই দুটোর মধ্যে খুঁত খোজার প্রতি প্রবল আসক্তিই এগিয়ে থাকে সবসময়।  

আত্মগরিমায় ভারি শরীরটা কোনোরকমে টেনে তুলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। লালচুলো সেই অস্বাভাবিক যুবকের ঘরের দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক নজরে ভেতরে তাকালেন। আজ একটা কটকটে সবুজ রঙের উলের টাই পরেছে লোকটা।

জঘন্য, আপনমনেই বলে উঠলেন মিসেস বয়েল, একেবারে জঘন্য।  

পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকাতেই লোকটার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তাঁর। ঘোলাটে চোখের কোণা দিয়ে তাঁর দিকে মনে হলো যেন উপহাসের দৃষ্টি দিলো সে। অস্বাভাবিক আর অস্বস্তিকর সেই দৃষ্টি মোটেও ভালো লাগল না তাঁর।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, নিজেকেই বললেন মিসেস বয়েল। নিঃসন্দেহে মানসিক সমস্যা আছে লোকটার।   

ঝমকালো টাইয়ের দিকে শেষবারের মতো বিতৃষ্ণার দৃষ্টি ছুঁড়ে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। তারপর দৃঢ় ভঙ্গিতে সোজা চলে এলেন ড্রয়িং রুমে। আরামদায়ক সব চেয়ার পাতা রয়েছে চারদিকে। বিশেষ করে গোলাপের মতো লালবর্ণের চেয়ারটা। ওটা যাতে কেউ দখল করতে না পারে, তার জন্য সতর্কতাস্বরূপ হাতে থাকা উল দিয়ে মোজা বোনার কাঠি আর সুতা রাখলেন তিনি। এবার আরও খানিকটা হেঁটে গিয়ে হাত রাখলেন রেডিয়েটরের ওপর। যেমনটা সন্দেহ করেছিলেন, জিনিসটা একটু উষ্ণ, তবে উত্তপ্ত নয়। এটা নিয়ে অন্তত কিছু একটা বলা যাবে। বিজয়ী ভঙ্গিতে চারদিকে নিজের মিলিটারি দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেন তিনি।

জানালার ওপাশে তাকাতেই বাইরের শুভ্র পৃথিবী চোখে পড়লো তাঁর। একেবারে বাজে একটা আবহাওয়া। যাই হোক, খুব বেশিদিন আর এখানে থাকার ইচ্ছা নেই তার। যদি না আরও লোকজন এসে সরগরম করে তোলে জায়গাটা।

আচমকা ছাদ থেকে খানিকটা বরফ নিচে আছড়ে পড়তেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি। না, জোর দিয়ে বললেন তিনি, আমি আর বেশি দিন থাকব না এখানে।

পরক্ষণেই খিকখিক করে হেসে উঠল কেউ একজন। চট করে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন তিনি, সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে দৃষ্টি। রেন নামের যুবকটা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে ফুটে উঠেছে কৌতূহলের অভিব্যক্তি।

না, বলল সে। আমারও মনে হয় না আপনি থাকবেন।  

পেছনের দরজা থেকে বরফ সরানোর কাজে জাইলসকে সাহায্য করছেন মেজর মেটকাফ। মানুষটা বেশ কর্মঠ, কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল জাইলসের অভিব্যক্তিতে।

দারুণ ব্যায়াম, মেজর মেটকাফ বললেন। জানেন তো, প্রতিদিনই ব্যায়াম করে ফিট রাখতে হয় নিজেকে।

আচ্ছা, মেজর মেটকাফ তাহলে ব্যায়ামের ভক্ত। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল জাইলস। যার কারণে সকাল সাতটায় নাস্তা দিতে হয় মেজরকে।

মনে হলো যেন জাইলসের অভিব্যক্তি পড়েই স্বগোতক্তি করলেন তিনি, তাড়াতাড়ি নাস্তা দিয়ে ভালোই করেছেন আপনার স্ত্রী। আর সদ্য পাড়া ডিম পেয়েও ভালো লাগছে।

হোটেল চালানোর যন্ত্রণাকে অভিশাপ দিতে দিতে সেই সকাল সাতটার আগেই বিছানা ছেড়েছে জাইলস। সিদ্ধ ডিম আর চা খেয়ে মলির সঙ্গে বসার রুমে আসে সে। সবকিছু একেবারে ঝকঝকে তকতকে। চারদিকে তাকিয়ে একটা কথা না ভেবে পারল না জাইলস, নিজের প্রতিষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসলে কারো বাপের সাধ্যি নেই এত সকালে তাকে ঘুম থেকে ওঠায়। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, যতটা সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে বিছানায় লেপ্টে থাকত সে।

যাই হোক, মেজর মেটকাফও বিছানা ছেড়ে পুরো বাড়িতে চক্কর দিয়ে বেড়ালেন কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল শক্তি কিলবিল করছে শরীরে।  

খারাপ না, ভাবলো জাইলস। পরিষ্কার করার জন্য বরফের অভাব নেই এখানে।  

চোখের কোণা দিয়ে নিজের সঙ্গীর দিকে তাকালো সে। আসলেই বেশ শক্তপোক্ত একটা মানুষ। তাছাড়া দেখেই ঝেঝা যায়, খুব সহজে দমবার পাত্র নন। ব্যতিক্রম বলতে চোখদুটো, কিছু একটা যেন বেখাপ্পা লাগছে। এক মনে কাজ করে গেলেও দৃষ্টিতে যেন কীসের সন্দেহ উঁকিঝুঁকি মারছে তাঁর। একটা ব্যাপার ঠিক মাথায় ঢুকছে না জাইলসের-কোনো কিছুই যাকে টলাতে পারবে বলে মনে হয় না, সেই মানুষটা মঙ্কসওয়েল ম্যানরে কী করছে?

অবসর নিয়েছে, ভাবলো সে। সম্ভবত করার মতো কিছু নেই এখন।

 

- - - - - - - - -

সবার পরে নিচে নামলো মিস্টার প্যারাভিসিনি। মাপামাপা কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ কফি আর একটা টেস্ট খেলো সে। খাবারগুলো নিয়ে মলি যখন এগিয়ে এলো, ঠিক তখনই প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। ওহ, আমার মনোমুগ্ধকর হোস্টেজ, আমি তো একদম ঠিক সময়ে এসেছি, তাই না?

মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো মলি। তবু কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে জানালো যে, একদম ঠিক সময়েই এসেছে। এই সময়ে অন্তত কোনোরূপ প্রশংসা হজম করার মতো মানসিকতা ওর নেই।

কিন্তু কেন, চিন্তাভাবনা না করেই ঝনঝন করে চিনামাটির বাসনকোসন সিংকে ফেলল সে। কেন একেকজন একেক সময়ে নাস্তা করতে আসবে? কষ্ট হয় তো।  

প্লেটগুলো তাকের ওপর রেখে দ্রুত ওপর তলায় বিছানা গোছাতে চলে এলো সে। কাজটা একাই করতে হবে ওকে। জাইলসের ওপর ইঞ্জিনঘর ও মুরগির খোয়াড় পরিষ্কারের দায়িত্ব পড়েছে। তাই আপাতত তার কাছ থেকে কোনোরূপ সাহায্য আশা করা যায় না।

মোটামুটি দশ হাতে কাজ সামলানোর মতো সর্বোচ্চ গতিতে-অনেকটা অগোছালোভাবেই-বিছানা ঝাড়মোছ করল মলি। চাদর টেনেটুনে, বালিশ ঠিক করেই বাথরুম পরিষ্কার করতে ঢুকে গেল তারপর আর ঠিক তখনই টেলিফোনের শব্দে চমকে উঠল। কাজে ব্যাঘাত ঘটায় প্রথমে চরম বিরক্ত হলেও, পরক্ষণেই এটা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যে, এখনো অন্তত কাজ করছে যন্ত্রটা। দৌড়ে লাইব্রেরিতে ঢুকেই কানে ঠেকালো রিসিভার। ফুসফুসে আগুন ধরে গেছে যেন। বন্ধ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। কোনোমতে বলল, হ্যালো?'

ঘড়ঘড় করে বেশ আন্তরিক একটা গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে, এটা কি মঙ্কসওয়েল ম্যানর?

মঙ্কসওয়েল ম্যানর গেস্ট হাউজ।

আমি কি কমান্ডার ডেভিসের সঙ্গে কথা বলতে পারি, প্লিজ?

সে তো একটু ব্যস্ত, এই মুহূর্তে টেলিফোনে আসতে পারবে না, বলল মলি। আমি মিসেস ডেভিস বলছি, আপনার পরিচয়টা?

সুপারিন্টেন্ডেন্ট হোগবেন, বার্কশায়ার পুলিশ।  

মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস প্রায় আটকে গেল মলির। দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, জি জি, বলুন।  

মিসেস ডেভিস, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা জানানোর জন্য ফোন করা। যদিও ফোনে বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না আমি। তাই ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রটারকে পাঠিয়ে দিয়েছি। যে-কোনো মুহূর্তেই ওখানে পৌছে যাবে

সে।  

সেটা সম্ভব নয়, বলল মলি। পুরোপুরি বরফের মাঝখানে আটকা পড়েছি আমরা। তাছাড়া রাস্তা-টাস্তাও সব বন্ধ হয়ে গেছে।

ট্রটার ঠিকঠাকভাবেই পৌছে যাবে, মিসেস ডেভিস, ওপাশের গলাটা বলল। সে যা বলবে, দয়া করে সেটা আপনার হাজব্যান্ডকে জানিয়ে দেবেন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই খুব সাবধানে তার প্রতিটি নির্দেশনা মানবেন। ব্যস, এটুকুই।  

কিন্তু দেখুন, দ্রুত বলে উঠল মলি, মিস্টার হোগবেন...?

তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খট করে লাইন কেটে গেল। নিজের বক্তব্য খুব পরিষ্কারভাবে দিয়েই লাইন কেটে দিয়েছে হোগবেন। আরও কিছুক্ষণ লাইন নিয়ে খুটখাট করে হাল ছেড়ে দিলো মলি। রিসিভার জায়গা মতো রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই মুখোমুখি হলো জাইলসের।

ওহ, জাইলস! হাঁফ ছেড়ে বলল সে, তুমি এখানে।  

মাথার চুলভর্তি বরফ আর মুখে কয়লায় সয়লাব হয়ে আছে জাইলস। দেখে মনে হচ্ছে না, শীত নিয়ে ভাবছে। বেশ গরমই মনে হচ্ছে তাকে।

কী হয়েছে? কয়লার ঝুড়ি ভরে কাঠের সঙ্গে রেখেছি। এবার মুরগির খোয়াড় পরিষ্কার করে বয়লার দেখতে যাব। সমস্যা নেই তো? মলির অভিব্যক্তি দেখে গলার স্বর পাল্টে ফেলল সে। কী হয়েছে, মলি? ভীত দেখাচ্ছে তোমাকে।

জাইলস, ঢোক গিলে বলল মলি, পুলিশ ফোন করেছিল।

পুলিশ? অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিলো জাইলস।

হ্যা, বলল মলি, ইন্সপেক্টর নাকি সার্জেন্ট-টার্জেন্ট কাকে পাঠাবে বলল।

কিন্তু কেন? কী করেছি আমরা?

জানি না। বিধ্বস্ত দেখালো মলিকে। আয়ারল্যান্ডের ঐ ব্যাটার দুই পাউন্ডের জন্য নয় তো?

ভ্রুকুটি করল জাইলস। ওয়্যারলেস লাইসেন্স তো নিয়েছিলাম আমি। তাই না?  

হ্যা, ডেস্কেই আছে ওটা। জাইলস, বৃদ্ধ মিসেস বিডলক আমার পুরনো পশমের কোটটা নিয়ে তার বদলে তার পাঁচটা কুপন দিয়েছে আমাকে। মনে হয় কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার নিজের কোট দিয়ে কুপন নিলে সমস্যাটা কোথায়? ওহ, জাইলস, এছাড়া আর কী করেছি আমরা?

সেদিন একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা প্রায় লেগেই গিয়েছিল। যদিও শেষমেশ বেঁচে যাই। কিন্তু তাতে তো আমার কোনো দোষ ছিল না, সব দোষ ঐ ড্রাইভার ব্যাটার। সত্যি বলছি!

না না, কিছু একটা তো ঠিকই করেছি আমরা, বিলাপ করতে লাগল মলি।

সমস্যা হচ্ছে, আজকাল আমরা যাই করি, কোনো না কোনো দিক থেকে সেটাই অবৈধ। বিষন্ন ভঙ্গিতে বলল জাইলস। ঠিক এই কারণেই সবসময় অপরাধবোধে ভুগি আমরা। যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে সমস্যাটা এই জায়গা নিয়ে। গেস্ট হাউজ চালানোতে হয়তো এমন কিছু ভেজাল আছে, যার কথা আমরা কখনো শুনিওনি।

দেখ, আমার তো মনে হয়েছিল, মদ-টদ পরিবেশন করাই একমাত্র সমস্যা। কিন্তু আমরা তো কাউকেই সেরকম কিছু দিচ্ছি না। তাহলে নিজেদের বাড়ি নিজেদের খুশিমতো ব্যবহার করলে সমস্যাটা কোথায়?

আমি জানি, কথাটা ঠিক। কিন্তু আজতো সবকিছুতেই কমবেশি নিষেধাজ্ঞা আছে।

ধুর, দীর্ঘশ্বাস ফেলল মলি। যদি এটা শুরুই না করতাম। কয়েকদিনের জন্য বরফের মধ্যে আটকা পড়তে যাচ্ছি আমরা। যারা আছে, সবাই খিটমিটে হয়ে যাবে, আর খামোখা বসে বসে জমিয়ে রাখা সব খাবারের টিনের পিণ্ডি চটকাবে।  

হতাশ হয়ো না, বলল জাইলস। এখন আমাদের খারাপ সময় হলেও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আবার।

অন্যমনস্কভাবে মলির কপালে চুমু খেলো সে। তারপর আগের চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ব্যাপারটা ভাববার মতো, মলি। খুব জরুরি কিছু না হলে এভাবে পুলিশ সার্জেন্ট পাঠানোর কথা না। বাইরে বরফের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল সে। সত্যিই খুব জরুরি কিছু...  

দুজনের মধ্যে স্থির দৃষ্টি বিনিময় হলো কিছুক্ষণ। ঠিক সেই মুহূর্তেই

দড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে পা রাখলেন মিসেস বয়েল।

আপনি তাহলে এখানে, মিস্টার ডেভিস, তিনি বললেন। ড্রয়িং রুমের সেন্ট্রাল হিটিং যে একেবারে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে, জানেন?  

দুঃখিত, মিসেস বয়েল। আসলে কয়লার শর্ট পড়ে গেছে...

সপ্তাহে সাত গিনি করে দিচ্ছি, মাঝখানেই খেকিয়ে উঠলেন মিসেস বয়েল। দয়া মায়ার চিহ্নও নেই গলায়। সাত গিনি, তার জন্য নিশ্চয়ই বরফে জমে যাওয়ার আশা করছি না।

লাল হয়ে গেল জাইলস, সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলল, আমি দেখছি।

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল সে। তার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই মলির দিকে ফিরলেন মিসেস বয়েল। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না, মিসেস ডেভিস। কিন্তু জানেন, এখানে একটা অস্বাভাবিক ছোকরাকে থাকতে দিয়েছেন আপনি? তার আচরণ, তার টাই...ওহ, ছোকরাটা কি কখনো চুল আঁচড়ায় না?

খুবই ব্রিলিয়ান্ট একজন আর্কিটেক্ট উনি, আর...  

কী বললেন?  

ক্রিস্টোফার রেন একজন আর্কিটেক্ট, এবং…’

শোন, মেয়ে, মাঝখানেই বলে উঠলেন মিসেস বয়েল, স্বাভাবিকভাবেই স্যার ক্রিস্টোফার রেনেবুর্গ শুনেছি আমি। অবশ্যই একজন আর্কিটেক্ট ছিলেন তিনি, আর সেইন্ট পলস তারই বানানো। তোমরা পুচকে ছেলে-ছোকরা তো দেখছি, জ্ঞানীর অভিনয় করলেই জ্ঞানী হওয়া যায় মনে করছে।

বয়সে তুলনামূলকভাবে বড়ো হবেন মিসেস বয়েল। তাই তুমি সম্বোধনে কিছু মনে করল না মলি। বলল, মিস্টার রেনের কথা বলেছি। আমি, তার নামই ক্রিস্টোফার। তার বাবা-মা তাকে এই নামে ডাকত। কারণ তাদের ইচ্ছা ছিল তাঁদের ছেলে একদিন আর্কিটেক্ট হবে। আর উনি একজন আর্কিটেক্ট, বা আর্কিটেক্ট হতে যাচ্ছেন।

ধুর! নাক সিঁটকালেন মিসেস বয়েল। খুবই সন্দেহজনক গল্প মনে হচ্ছে আমার কাছে। তোমার জায়গায় আমি থাকলে ঠিকই খবর বের করতাম। কী জানো ঐ ছোকরার ব্যাপারে?

ঠিক যতটা আপনার ব্যাপারে জানি, মিসেস বয়েল। আপনারা দুজনেই সপ্তাহে সাত গিনি করে দিচ্ছেন, আর এটুকুই তো জানা উচিত আমার, তাই না? যতটুকু জানা উচিত, ততটা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন আমি। এটা মোটেও দেখার বিষয় নয় যে, আমি আমার অতিথিকে পছন্দ করি..., দৃঢ় ভঙ্গিতে মিসেস বয়েলের দিকে তাকালো মলি, ...নাকি করি না।

রাগে মুখের ওপর চিৎকার করে উঠলেন মিসেস বয়েল, বয়স কম তোমাদের, অভিজ্ঞতাও নেই। তাই তোমাদের থেকে বেশি জানা কারো উপদেশ মাথা পেতে নেওয়া উচিত। ঐ উটকো বিদেশী লোকটা? সে আবার কখন এলো?

মাঝরাতে, সংক্ষেপে জানালো মলি।

সত্যি, এটাও সন্দেহজনক। সাধারণ মানুষ অত রাতে বাইরে ঘুরঘুর করে না।

সহজ-সরল পর্যটকের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা নীতিবিরুদ্ধ, মিসেস বয়েল। মিষ্টি করে বলল মলি।।

তুমি হয়তো এটা জানো না যে...

আমি শুধু এটা জানি যে, প্যারাভিসিনি লোকটা আমাদের কাছে...

সাবধান হও, মেয়ে। সাবধান। শয়তানের ব্যাপারে কথা বলছো, তারপর কিন্তু...।  

মাঝখানেই আর্তনাদ করে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন মিসেস বয়েল। মনে হলো যেন সাক্ষাৎ শয়তান উদয় হয়েছে তার সামনে। দুজনের কেউই লক্ষ্য করেনি, কখন যেন মিস্টার প্যারাভিসিনি এসে উপস্থিত হয়েছে তাদের মাঝখানে। দুহাত সমানে ঘষতে ঘষতে ধূর্ত ভঙ্গিতে হাসছে সে।

আপনি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছেন আমাকে, থতমত খেয়ে বললেন মিসেস বয়েল। বুঝতেই তো পারিনি কখন এসেছেন।  

পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে প্রবেশ করি আমি, তাই..., মিস্টার প্যারাভিসিনি বলল। ...কখনো কেউ আমার যাওয়া আসা বুঝতে পারে না। ব্যাপারটা বেশ মজা লাগে আমার। মাঝেমাঝে আড়ি পেতে অনেক কথাও শুনি, আরও নরম গলায় যোগ করল, আর যেটা একবার শুনি, সেটা কখনো ভুলে যাই না।

গলার স্বর খাদে নামিয়ে ক্ষীণ স্বরে মিসেস বয়েল বললেন, ওহ, তাই নাকি? আমার সুতা ড্রয়িং রুমে রেখে এসেছি। ওগুলো নিতে হবে।

কথাটা বলেই রীতিমতো ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এদিকে হতভম্ব হয়ে মিস্টার প্যারাভিসিনির দিকে তাকিয়ে রইলো মলি। প্রায় পাখির মতো লাফিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো সে।

ওহ, আমার সুন্দরী হোস্টেজের মন খারাপ মনে হচ্ছে। কথাটা বলেই ওর এক হাত টেনে নিয়ে চুমু খেল সে। কী হয়েছে?

সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে, বাধা দেওয়ার সুযোগও পায়নি মলি। ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়লো সে। পরক্ষণেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে এক পা পিছিয়ে এলো। মিস্টার প্যারাভিসিনিকে আদৌ ওর ভালো লেগেছে কিনা, নিশ্চিত নয়। ওর দিকে ভুড়ো ভামের মতো শয়তানী কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটা।

বরফের কারণে কাজকর্ম সব কঠিন হয়ে পড়েছে আজ, হালকা চালে বলল মলি।

আসলেই, জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল মিস্টার প্যারাভিসিনি। কাজকর্ম খুব কঠিন বানিয়ে দেয় বরফ, তাই না? কিংবা খুব সহজ।  

আমি জানি না কী বলছেন আপনি।

জানি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সে। অনেক কিছুই জানেন না দেখছি। আমার তো মনে হচ্ছে, গেস্টহাউজ চালানোর ব্যাপারেও খুব বেশি কিছু জানেন না।  

ঝগড়া করার ভঙ্গিতে চট করে মুখ তুলে তাকালো মলি। হ্যা, হয়তো জানি না। তবুও খুব ভালোভাবেই চালানোর চেষ্টা করব আমরা।

বেশ, বেশ!

মোটকথা, অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানিকটা উদ্বেগ ফুটে উঠল মলির গলায়, আর যাই হোক, একেবারে খারাপ রাঁধুনী নই আমি।

নিঃসন্দেহে জাদুকরী রান্না আপনার! মিস্টার প্যারাভিসিনি বলল। কী আপদ মার্কা বিদেশী রে, ভাবলো মলি।

মুহূর্তেই আচরণ বদলে গেল প্যারাভিসিনির। মনে হলো যেন মলির চিন্তা পড়েই আগের চেয়ে শান্ত ও গম্ভীর স্বরে বলল, আপনাকে একটু সতর্ক করতে পারি, মিসেস ডেভিস? যাকে তাকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না আপনাদের। এখানের গেস্টদের ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ নিয়েছেন তো?

সচরাচর এরকম হয় নাকি? দ্বিধায় পড়ে গেল মলি। আমরা তো ভেবেছি মানুষ শুধু আসে আর যায়।  

আপনার ঘরে কে থাকছে না থাকছে, তার ব্যাপারে জানা সবসময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামনে ঝুঁকে এসে ওর কাঁধে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে টোকা দিলো সে। যেমন, আমার কথাই ধরুন, মাঝরাতে এসে বললাম তুষারঝড়ে গাড়ি উল্টে গেছে। অমনি বিশ্বাস করে নিলেন সেটা। মিসেস ডেভিস, আমার ব্যাপারে কতটা জানেন আপনি? একটুও না। সম্ভবত বাকি গেস্টদের ব্যাপারেও না।

মিসেস বয়েল..., মলি মুখ খুলতে না খুলতেই সুতার দলা নিয়ে পুনরায় হাজির হলেন মিসেস বয়েল। বললেন, ড্রয়িং রুমে খুব ঠান্ডা, আমি বরং এখানেই বসি।  

কথাটা বলেই ফায়ারপ্লেসের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। এদিকে প্রায় এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে আবারও নাচের ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে গেল মিস্টার প্যারাভিসিনি। আমি আগুন নেড়ে দিচ্ছি।  

লোকটার প্রাণোচ্ছল পদক্ষেপ দেখে ঠিক প্রথম রাতে মলি যেরকম হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, সেই একই অনুভূতি আবারও ঘিরে ধরল ওকে। সে লক্ষ্য করেছে, প্যারাভিসিনি সবসময় আলোর উৎসকে নিজের পেছনে রেখে দাঁড়ায়। চেষ্টা করে নিজের চেহারা আড়ালে রাখার। কিন্তু এই মুহূর্তে সে আগুনের সামনে হাঁটু ভেঙে বসতেই কারণটা পরিষ্কার বুঝতে পারল মলি। মিস্টার প্যারাভিসিনির চেহারা সম্পূর্ণ প্রসাধনীতে ঢাকা।

তার মানে বুড়ো গাধাটা নিজেকে যুবকের মতো দেখাতে চায়। তাই তো? বেশ, মোটেও সফল হয়নি সে। বয়সের সব সূক্ষ্মভাজ ধরা পড়ে গেছে। তার, ব্যতিক্রম শুধু হাঁটাচলা। আচ্ছা আচ্ছা, সম্ভবত এটাও খুব সাবধানে নকল করা।

আচমকা মেজর মেটকাফের আগমনে এক ঝটকায় কল্পনা থেকে তালগোল পাকানো বাস্তবে ফিরে এলো মলি।

মিসেস ডেভিস, নিচতলার পায়খানার..., নম্রভাবে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেললেন তিনি, ...পাইপগুলো জমে গেছে।

ওহ খোদা, অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল মলি। কী বাজে একটা দিন শুরু হলো! প্রথমে পুলিশ, আর এখন আবার পাইপ।  

কথাটা বলতে না বলতেই বিস্ফোরণের মতো মুহূর্তেই পাল্টে গেল পরিবেশ। প্রথমে মিস্টার প্যারাভিসিনি দুম করে আগুন নাড়ার খুন্তিটা ফেলে দিলো হাত থেকে। মিসেস বয়েল বন্ধ করে দিলেন তার বুননকাজ। চোয়াল প্রায় ঝুলেই পড়েছে তার। এদিকে মেজর মেটকাফের দিকে তাকিয়ে পুরোপুরি গোলকধাঁধায় পড়ে গেল মলি। আচমকাই একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলেন মেজর। চোখেমুখে ফুটে উঠল অবর্ণনীয় এক অভিব্যক্তি। দুর্বোধ্য সেই অভিব্যক্তি দেখে মলির মনে হলো, একটা কাঠের পুতুলকে দাঁড় করিয়ে রেখে যেন নিংড়ে বেরিয়ে গেছে গেছে সবটুকু আবেগ।

পুলিশের কথাই বলছিলেন? খুবই সংক্ষেপে আর ছাড়া ছাড়া গলায় বললেন তিনি।

এই ব্যাপারে মলি পুরোপুরি নিশ্চিত যে, মেজরের হাভভাবে ফুটে ওঠা পাথরের মতো স্থির অভিব্যক্তির পেছনে উন্মাদের মতো গর্জন করছে অন্য কোনো হিংস্র আবেগ। এটা হয়তো আতঙ্ক, হয়তো সতর্কতা, কিংবা হতে পারে আকস্মিক উত্তেজনা।

এই লোকটা, নিজেকেই বলল মলি, বিপজ্জনক।

আবারও মুখ খুললেন মেজর, তবে এবার কেবল স্বাভাবিক কৌতূহল ফুটে উঠেছে চোখেমুখে। পুলিশের ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন?

এই একটু আগেই ফোন করেছিল, বলল মলি। এখানে একজন সার্জেন্ট পাঠাচ্ছে তারা। জানালার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে প্রত্যাশা ফুটিয়ে তুলল সে। কিন্তু মনে হয় না কোনোভাবে এসে পৌছাতে পারবে।  

এখানে কেন পুলিশ পাঠাচ্ছে তারা? ওর দিকে এক পা এগিয়ে এসে বললেন মেজর। কিন্তু মুখ খোলার আগেই দরজা খুলে গেল, জাইলস পা রাখল ভেতরে।

আধ স্টোনের বেশি লাল কয়লা আছে, রেগেমেগে বলল সে। তারপর আরও রূঢ়ভাবে যোগ করল, কী হয়েছে?

তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন মেজর মেটকাফ। এখানে পুলিশ আসছে শুনলাম, বললেন তিনি। কিন্তু কেন?

আরে ধুর, কিছু হয়নি, জবাব দিলো জাইলস। পাঁচ ফুট উঁচু বরফ জমেছে বাইরে, রাস্তা-ঘাটও সব বন্ধ হয়ে গেছে। কারো পক্ষেই আসা সম্ভব নয় এখানে, আর আজও কেউ আসবে না।   

আর ঠিক তখনই জানালার কাঁচে তিনবার জোরে আঘাত করার ঠকঠক শব্দ হলো।

হঠাৎ এরকম শব্দে চমকে উঠল সবাই। জোরালো শব্দটা যেন বয়ে এনেছে হিমশীতল ভূতুড়ে হুমকি। কয়েক মুহূর্তের জন্য আড়ালে রইলো ওটার উৎস। তারপর আচমকাই প্রায় আর্তনাদ করে উঠে ফ্রেঞ্চ জানালার দিকে ইঙ্গিত করল মলি। ওপাশে দাঁড়িয়ে শার্সিতে টোকা দিচ্ছে একটা লোক। এই বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও তার আগমনের রহস্য উন্মচিত হলো একটু পরেই-পায়ে স্কি পরে এসেছে লোকটা।

মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে দ্রুত দরজার কাছে এগিয়ে গেল জাইলস। তারপর কোনোরূপ ইতস্ততা না দেখিয়ে চট করে খুলে দিলো সেটা।

থ্যাংক য়ু, স্যার, হাসি ফুটিয়ে বলল আগম্ভক। চেহারা তামাটে বর্ণের, গলার স্বর নিতান্তই স্বাভাবিক হলেও বেশ আন্তরিক তার। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রটার, এবার নিজের পরিচয় দিলো সে।।

চোখেমুখে তীব্র অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে, সুতার ফাঁক দিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকালেন মিসেস বয়েল।

আপনি সার্জেন্ট হতে পারেন না, দুদিকে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন তিনি। বয়স খুব কম আপনার। পদের তুলনায় একটু বেশিই যুবক মনে হওয়া মানুষটা এরকম সমালোচনায় অপমান বোধ করল যেন। গলায় স্পষ্ট ঝাঁজ ফুটিয়ে তুলে বলল, দেখে যতটা কম বয়স্ক মনে হয় ঠিক ততটা বাচ্চা আমি নই, ম্যাডাম।

সবার ওপর চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে জাইলসের ওপর দৃষ্টি স্থির করল সে। আপনিই তো মিস্টার ডেভিস, তাই না? কিছু মনে না করলে, স্কিগুলো খুলে কোথাও রাখতে পারি?  

অবশ্যই, আমার সঙ্গে আসুন। সার্জেন্টকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জাইলস। পেছনে হলের দরজা বন্ধ হতে হতেই কণ্ঠে তীব্র ব্যঙ্গ নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন মিসেস বয়েল। বাহ, আজকাল তাহলে উইন্টার স্পোর্টসে গিয়ে মজা করার জন্যই পুলিশের লোকগুলোকে বেতন দিই আমরা।

মলির আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো প্যারাভিসিনি। তারপর প্রায় সাপের মতো হিসহিস করে বলল, পুলিশ ডেকেছেন কেন, মিসেস ডেভিস?

ঝট করে এক পাক খেয়ে লোকটার ঘৃণায় টগবগ করতে থাকা দৃষ্টির মুখোমুখি হলো মলি। এ যেন এক নতুন প্যারাভিসিনি। দীর্ঘসময় ছায়ার আড়ালে থাকার পর লাফিয়ে বেরিয়ে আসা কোনো শ্বাপদ বলে মনে হচ্ছে তাকে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মলি, তারপর অসহায়ের মতো কোনোরকম বলে উঠল, আমি ডাকিনি...আমি ডাকিনি।  

ঠিক তার পরপরই উত্তেজিত অবস্থায় মিস্টার রেন প্রবেশ করল ভেতরে। চারদিকে একবার তাকিয়ে তীক্ষ্ণভাবে ফিসফিস করে উঠল তারপর। হলের লোকটা কে? কোথা থেকে এসেছে? কলিজা আছে বটে, সারা গায়ে বরফ তার।  

চট করেই জবাব দিলো না কেউ। তারপর আচমকাই বাজের মতো শব্দ করল মিসেস বয়েলের কণ্ঠ। বিশ্বাস কর আর না কর, লোকটা পুলিশ। একটা পুলিশ, যে কিনা স্কিয়িং করছে!

সবাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় নিজ থেকে কথা বলা একটা অভ্যাস তাঁর।

এদিকে মলির কানের ধারে বিড়বিড় করে উঠলেন মেজর মেটকাফ। মিসেস ডেভিস, আমি কি টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি।

অবশ্যই, মেজর মেটকাফ।

সম্মতি পেয়ে যন্ত্রটার কাছে এগিয়ে গেলেন মেজর মেটকাফ। তিনি সরে যেতেই তীক্ষ কণ্ঠে ক্রিস্টোফার রেন বলল, লোকটা বেশ হ্যান্ডসাম, তাই না? আমি তো পুলিশের লোকদের সবসময় ভয়ংকর চেহারার ভাবতাম।

হ্যালো...হ্যালো...ওহ, ওদিকে উদভ্রান্তের মতো টেলিফোন নিয়ে খুটখাট করছেন মেজর মেটকাফ। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে মলির দিকে ফিরলেন তিনি। মিসেস ডেভিস, টেলিফোন লাইন তো শেষ।

আর কিছু করার নেই এখন, আমি...  

মাঝপথেই থেমে যেতে হলো ওকে। কারণ পাগলের মতো উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেছে ক্রিস্টোফার রেন। মনে হচ্ছে টেলিফোন লাইন নষ্ট হওয়ায় খুব মজা পেয়েছে সে। আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে এবার সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি আমরা, একেবারে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। মজার ব্যাপার, তাই না?

এখানে হাসার মতো কিছু দেখছি না আমি, কঠিন গলায় বললেন মেজর মেটকাফ।

আমিও না, সমর্থন জানালেন মিসেস বয়েল। তবুও অনবরত হেসেই চলেছে ক্রিস্টোফার রেন। মনে হয় না কারো কথা কানে গেছে তার। এটা আমার ব্যক্তিগত একটা জোক, বলল সে। শশশ.... ঠোটের মাঝখানে আঙুল রাখল সে। গোয়েন্দাটা এদিকেই আসছে।

রেনের পূর্ব সংকেত দেওয়ার পরপরই সার্জেন্ট ট্রটারকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো জাইলস। এতক্ষণে পা থেকে স্কি খুলে গায়ের বরফও ঝেড়েমুছে ফেলেছে গোয়েন্দা লোকটা। হাতে এখন একটা বড়ো নোটবুক ও পেন্সিল ধরে রেখেছে সে। দেখে মনে হচ্ছে, ধীর গতির কোনো বিচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে আছে যেন।

মলি, জাইলস বলল, সার্জেন্ট ট্রটার আমাদের সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাচ্ছেন।

দুজনকে অনুসরণ করে রুমের বাইরে পা রাখল মলি স্টাডিরুমে যাব আমরা, বলল জাইলস।

হলের পেছনে ছোটো রুমটার দিকে এগিয়ে গেল সবাই। ভেতরে ঢোকার পর সাবধানে দরজা বন্ধ করে দিলো সার্জেন্ট ট্রটার।

কী করেছি আমরা? করুণভাবে জানতে চাইলে মলি।

কী করেছেন? ওর দিকে স্থির দৃষ্টি দিলো সার্জেন্ট ট্রটার। পরক্ষণেই চওড়া হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ওহ, বলল সে। সেরকম কিছু না, ম্যাডাম। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। মিসেস ডেভিস, একেবারে ভিন্ন একটা ব্যাপারে কথা বলব আমরা। এক ধরনের পুলিশের নিরাপত্তা বলতে পারেন এটাকে। 

কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মলি ও জাইলস।

সাবলিলভাবে বলতে লাগল সার্জেন্ট ট্রটার। ব্যাপারটা মিসেস লিওন, মানে মিসেস মরিন লিওনের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। যিনি দুদিন আগে লন্ডনে খুন হয়েছিলেন। কেসটা নিয়ে কাগজে লেখাও তো বেরুলো। পড়েছেন নিশ্চয়ই।

হ্যা, সংক্ষেপে বলল মলি।

আমি প্রথমেই জানতে চাইবো, মিসেস লিওনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় আছে কিনা।  

কখনো না, একইসঙ্গে বিড়বিড় করল মলি ও জাইলস।

বেশ, আমরাও ঠিক এরকমই ভেবেছি। যাই হোক, খুন হওয়া মহিলাটার আসল নাম কিন্তু লিওন নয়। পুলিশের খাতায় তাঁর নাম ও আঙুলের ছাপের রেকর্ড থাকায় সহজেই পরিচয় বের করতে পেরেছি আমরা। তাঁর আসল নাম গ্রেগ, মরিন গ্রেগ। তাঁর প্রয়াত স্বামী, অর্থাৎ জন গ্রেগ ছিলেন একজন কৃষক। লংগ্রিজ ফার্মে থাকতেন তিনি, জায়গাটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। লংগ্রিজ ফার্মের কেস সম্পর্কে শুনে থাকবেন হয়তো।  

পিনপতন নিরবতা নেমে এলো পুরো ঘরে। দীর্ঘ নিরবতায় ছেদ ফেলল ছাদ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়া বরফের অপ্রত্যাশিত একটি শব্দ। প্রায় গোপন আর অশুভ সেই শব্দে ঘরের আবহাওয়া যেন নেমে গেল আরও কয়েক ডিগ্রি।

বলতে লাগল ট্রটার। উনিশ শ চল্লিশ সালে গ্রেগ দম্পতির কাছে তিন শরণার্থী বাচ্চা থাকত লংগ্রিজ ফার্মে। যাদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে বেআইনিভাবে অবহেলা ও অত্যাচারের কারণে মারা যায়। খুবই হৃদয়বিদারক এই ঘটনা বেশ নাড়া দিয়েছিল তখন। যার ফলে মামলায় জেল হয় গ্রেগ দম্পতির। যাই হোক, পরে যে-কোনোভাবে পালাতে সক্ষম হন গ্রেগ। একটা গাড়ি নিয়ে পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু পথেই ক্র্যাশ করে ওটা, আর সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটে তার। মিসেস গ্রেগ ঠিকঠাকভাবেই তার সাজা ভোগ করেন, এবং দুমাস আগে ছাড়া পান জেল থেকে।

আর এখন খুন করা হয়েছে তাকে, বলল জাইলস। কে করছে বলে মনে করছেন আপনারা?  

সরাসরি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না সার্জেন্ট ট্রটার। মনে হয় কোনো তাড়া আছে তার। কেসটার কথা মনে আছে, স্যার? জিজ্ঞেস করল সে।

দুদিকে মাথা নাড়লো জাইলস, উনিশ শ চল্লিশ সালে ভূমধ্যসাগরে একটা জাহাজের কর্মচারী হিসাবে কাজ করছিলাম আমি।

আ...আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা শুনেছি আমি, প্রায় দম বন্ধ হওয়া অবস্থায় বলল মলি। কিন্তু আমাদের কাছে কেন এসেছেন? ওসবের সাথে আমাদের সম্পর্ক কোথায়?

প্রশ্নটা আপনাদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, মিসেস ডেভিস!

প্রাণের ঝুঁকি? চরম অবিশ্বাস নিয়ে বলল জাইলস।

ঠিক এরকমই, স্যার। খুনের জায়গা থেকে কিছুটা দূরে একটা নোটবুক পাওয়া গেছে, যেখানে দুইটা ঠিকানা লেখা ছিল। যাদের মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে সেভেন্টি-ফোর কালভার স্ট্রিট।  

যেখানে মহিলা খুন হয়েছেন? মাঝখানে বলে উঠল মলি।।

হ্যা, মিসেস ডেভিস। যাই হোক, দ্বিতীয় ঠিকানাটা এই মঙ্কসওয়েল ম্যানরের।

কী? অবিশ্বাসে চোয়াল ঝুলে পড়লো মলির। কিন্তু, এটা তো অস্বাভাবিক।  

একদম। ঠিক এই কারণেই লংগ্রিজ ফার্মের কেসের সঙ্গে আপনাদের, কিংবা এই বাড়ির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা বাধ্যতামূলক বলে মনে করছেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট হেগবেন।

অসম্ভব, কোনো সম্পর্ক নেই, জাইলস বলল। ব্যাপারটা একদম কাকতালীয়ও তো হতে পারে।

নম্রভাবে মুখ খুলল সার্জেন্ট ট্রটার। কিন্তু সুপারিন্টেন্ডেন্ট হোগবেন এটাকে কাকতালীয় ভাবছেন না। সম্ভব হলে তিনি নিজেও চলে আসতেন এখানে। খারাপ আবহাওয়া, এবং স্কি-তে এক্সপার্ট বলে আমাকে সম্পূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। যাতে বাড়ির সবার ব্যাপারে ভালোভাবে খোজ নিয়ে ফোনে তাঁকে রিপোর্ট করতে পারি। আর হ্যা, বাড়ির সবার নিরাপত্তার জন্য যা যা দরকার, সব যেন ঠিকঠাকভাবে করতে পারি, তার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।  

এবার বেশ স্পষ্ট করে জাইলস বলল, নিরাপত্তা? ঈশ্বর না করুন, আপনি কি এখানে কেউ খুন হবে বলে ভাবছেন নাকি?

ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে মুখ খুলল ট্রটার, আপনার স্ত্রীকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি। আসলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হোগবেন ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছেন।

কিন্তু তার কারণটা কী... মাঝপথেই থেমে গেল গেল জাইলস। ততক্ষণে জবাব দিয়ে ফেলেছে ট্রটার, ঠিক সেটা খুঁজতেই এখানে এসেছি আমি।

সবকিছু তো স্রেফ পাগলামী মনে হচ্ছে।

হ্যা, আর পাগলামী বলেই এটা বিপজ্জনক।

এবার মলি মুখ খুলল। এখনো সবকিছু আমাদেরকে বলেননি আপনি। তাই না, সার্জেন্ট?

জি, ম্যাডাম। নোটবুকের পৃষ্ঠার ওপরের দিকে ***থ্রি ব্লাইন্ড মাইস*** কথাটা লেখা ছিল। আবার লাশের সঙ্গে এটা প্রথম লেখা একটা নোট পাওয়া গেছে। ঠিক তার নিচেই তিনটা ইদুর ও মিউজিক বারের ছবি আঁকা, মিউজিকের সুরটা থ্রি ব্লাইন্ড মাইস নামে একটা নার্সারির ছড়ার।

গুনগুন করে গাইতে লাগল মলি

থ্রি ব্লাইন্ড মাইস

সি হাউ দে রান

দে অল রান আফটার দ্য ফার্মার'স ওয়াইফ!

চট করে গান থামিয়ে ট্রটারের দিকে ফিরল সে। ওহ, ভয়ংকর! আচ্ছা, সেখানে তো তিনটা বাচ্চা ছিল। তাই না?

একটা মেয়ে আর বারো বছরের একটা ছেলে, যে কিনা পরবর্তীতে মারা যায়।'

আর বাকি দুজন? 

অনেক খুঁজেও মেয়েটার কোনো হদিস পাইনি আমরা। মনে হচ্ছে দত্তক নিয়েছে কেউ। আর ছেলেটার বয়স এখন তেইশ হবে, তারও কোনো ট্রেস পাওয়া যায়নি। আঠারো বছর বয়সে আর্মিতে যোগ দেয় সে। তখন থেকেই খাপছাড়া আর অদ্ভুত আচরণ করত। যাই হোক, পরে আর্মি থেকেও সরে যায়। আর ঠিক তখনই পুরোপুরি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় যেন। আর্মির সাইকিয়াট্রিস্টের মতে, মোটেও স্বাভাবিক ছিল না ছেলেটা।

তাহলে আপনারা ছেলেটাকেই মিসেস লিওনের খুনি মনে করছেন, বলল জাইলস। যে কিনা এখন বিকারগ্রস্ত খুনিতে পরিণত হয়েছে এবং অজ্ঞাত কোনো কারণে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই তো?

আমাদের মনে হচ্ছে, লংগ্রিজ ফার্মের সঙ্গে এখানকার কারো না কারো অবশ্যই কোনো সম্পর্ক আছে। আর একবার সেই সম্পর্কটা বের করতে পারলেই খুনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব আমরা। যাই হোক, স্যার, আপনি এখন আমাকে শুধু এটুকু নিশ্চিত করুন যে, ঐ ফার্মের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। আর মিসেস ডেভিস, আপনিও।  

আমি...ওহ...হা...হা..না...কোনো সম্পর্ক নেই।

বেশ। এবার এটা বলুন, বাড়িতে আর কে কে আছে এখন?

একে একে সবার নাম বলল ওরা। মিসেস বয়েল, মেজর মেটকাফ, মিস্টার ক্রিস্টোফার রেন ও মিস্টার প্যারাভিসিনির নাম ধারাবাহিকভাবে নোটবুকে টুকে নিলো সার্জেন্ট। আর কাজের লোক?

কাজের লোক নেই আমাদের, বলল মলি। তাই মনে পড়ল, এক্ষুণই তাড়াতাড়ি গিয়ে আলু কাটতে হবে আমাকে।

কথাটা বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেল সে। তার পায়ের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসতেই জাইলসের দিকে ফিরলো ট্রটার। লোকগুলোর ব্যাপারে কী জানেন, স্যার?  

আ...আমরা, থেমে গেল জাইলস। তারপর লম্বা দম নিয়ে বলল, সত্যি বলতে, কিছুই জানি না, সার্জেন্ট ট্রটার। মিসেস বয়েল এক বোর্নমাউথ হোটেল থেকে চিঠি লিখেছিলেন, মেজর মেটকাফ লিখেছিলেন লিমিংটন থেকে, মিস্টার রেন লিখেছে সাউথ কেনসিংটনের এক প্রাইভেট হোটেল থেকে। আর মিস্টার প্যারাভিসিনি মাঝরাতে হঠাৎ করেই এখানে এসে উঠেছে, কাছেই কোথাও তুষারঝড়ে গাড়ি উল্টে গেছে বলল। মনে তো হয়, সবার কাছেই আইডি কার্ড, রেশন বুক এসব আছে।  

অফকোর্স, সবকিছু দেখব আমি।

ভাগ্য ভালো যে, আবহাওয়া খুব খারাপ, বলল জাইলস। এই অবস্থায় খুনি এখানে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।

হয়তো তার কোনো প্রয়োজনই নেই, মিস্টার ডেভিস।

মানে?

খানিকটা ইতস্তত করল সার্জেন্ট ট্রটার। তারপর মনে হলো যেন একান্ত অনিচ্ছায় মুখ খুলল সে, ভেবে দেখুন, স্যার। হয়তো সে এর মধ্যেই এখানে চলে এসেছে।  

খাবি খেল জাইলস। কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টি দিয়ে আবারও সেই একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করল। মানে?

মিসেস গ্রেগ খুন হয়েছেন দুদিন আগে। আর আপনার সব অতিথি কিন্তু হাজির হয়েছে ঠিক তার পরপরই।

বুঝলাম। কিন্তু সবাই তো আগেই-মানে, খুনের আগেই রুম বুক করে রেখেছিলেন-অবশ্য মিস্টার প্যারাভিসিনি ছাড়া।  

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মুখ খুলল সার্জেন্ট ট্রটার। সবগুলো খুনের পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল।

খুন গুলো মানে? সবে একটা খুন হয়েছে। তাহলে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কেন যে, আরও হবে?  

হবে-না না, আশা করি তার আগেই আটকাতে পারব। তবে খুন করার চেষ্টা হলেও করবে সে-হাঁ, এটাই। চেষ্টা করবে খুনি।

যদি আপনার কথা ঠিক হয়, উত্তেজিত হয়ে পড়লো জাইল, তাহলে খুনির বয়সি মাত্র একজনই আছে এখানে-ক্রিস্টোফার রেন।  

২য় পর্ব শেষ। 

বাকি তিনটি পর্বের লিঙ্কঃ 

১ম পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation 
২য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 2 of 4
৩য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 3 of 4

৪র্থ পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 4

Tags: বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie

No comments:

Post a Comment

Popular Posts