বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি,আগাথা ক্রিস্টি রচনাসমগ্র pdf, আগাথা ক্রিস্টি সমগ্র, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie।
৩য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – বাংলা
থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 4
৪র্থ পর্ব শুরু ‘তাহলে কেন...’
‘এরকম নাম বেছে নিয়েছি?’ মাঝখানে বলে উঠল ক্রিস্টোফার।
‘ঝোঁকের বশে বলতে পারো।
স্কুলে সবাই ক্রিস্টোফার রবিন বলে ক্ষ্যাপাতো আমাকে, হাসাহাসি করত আমাকে নিয়ে। রবিন...রেন,
এই বানিয়ে নিলাম আর কী।’
‘আসল নাম কী তোমার?’
শান্ত স্বরে বলল ক্রিস্টোফার, ‘মনে হয় না ওটা কোনো
কাজে আসবে। সত্যি বলতে, আমি কোনো আর্কিটেক্ট নই, আর্মি থেকে পালিয়ে আসা একজন।’
এক মুহূর্তের জন্য মলির চোখে ফুটে ওঠা ভয় দৃষ্টি
এড়ালো না ক্রিস্টোফারের। ‘হ্যাঁ, বলল সে। ঠিক অচেনা খুনির মতোই। আর এজন্যই
তোমাকে বলেছিলাম, খুনির বর্ণনা পুরোপুরি মিলে যায় আমার সঙ্গে।’
‘বোকার মতো কথা বলো না,’ বলল মলি। ‘আমি বলেছি তোমাকে, তুমি
যে খুনি এটা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। সবকিছু খুলে বল আমাকে। পালিয়ে এসেছিলে কেন?’
‘ভয় পেয়ে পালিয়েছি
ভাবছো? না, মোটেও সেরকম কিছু নয়। বাকিরা যেমন ভয় পেত, আমিও ঠিক ততটাই ভয় পেতাম-তার
বেশি নয়। আসলে অনেক বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারার সুনাম ছিল আমার। পালিয়ে আসার
কারণটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন- আমার মা।’
‘তোমার মা?’
‘হ্যা, বিমান হামলার
সময় নিহত হন তিনি। মাটির নিচে চাপা পড়েছিলেন, খুঁড়ে বের করতে হতো তাঁকে। আমি...আমি
ঠিক বোঝাতে পারব না, খবরটা শোনার পর ঠিক কেমন লাগছিল আমার। একেবারে পাগলের মতো হয়ে
গিয়েছিলাম। তখন শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল মাথায়-যেভাবেই হোক, বাড়িতে যেতে
হবে আমাকে। আর...আর কবর খুঁড়ে বের করতে হবে মা’কে। বোঝাতে পারব না
আসলে,’ গলা খাদে নামিয়ে ফেলল
সে। অনেকদিন ধরে পাগলের মতো তাঁকে খুঁজলাম নাকি নিজেকে ঠিক জানি না আমি। তারপর যখন
মনটা শান্ত হলো, তখন আর ফিরে যাওয়ার সাহস পাইনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, গিয়ে কী রিপোর্ট
দেবো, কী ব্যাখা দেবো সবাইকে। তারপর থেকে আমি...আমি আর কিছুই না।’
ওর দিকে তাকালো সে। কচি মুখটায় ফুটে উঠেছে নিদারুণ
যন্ত্রণা আর হতাশার ছাপ।
‘এভাবে ভাবা উচিত নয়,
নিচু গলায় বলল মলি। সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে পারো।’
‘আদৌ কি কখনো এটা পারে
কেউ?’
‘অবশ্যই, তোমার বয়স
এখনো যথেষ্ট কম।’
‘হ্যা, কিন্তু...কিন্তু
সবকিছু শেষ হয়ে গেছে এখন।’
‘না, বলল মলি। এটা তোমার
ভুল ধারণা। এখনো শেষ হয়নি সবকিছু। আমি জানি, জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে এসে প্রত্যেকেই
ভাবে, এটাই শেষ। আর এক পাও এগুতে পারব না আমি। কিন্তু না, হয়তো যেটাকে পথের শেষ বলে
মনে হচ্ছে, সেই নতুন কোনো পথের সূচনা।’
‘তুমিও নিশ্চয়ই এমন
পরিস্থিতিতে পড়েছো, মলি। নাহলে এভাবে বলতে পারতে না। তাই না?’
‘হ্যা।’
‘তোমার গল্পটা কী, মলি?’
‘আমার গল্পটা আরও অনেকের
মতোই। এক ফাইটার পাইলটের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হত্যা করা হয় তাকে।’
‘আর কেউ ছিল না তখন?’
‘হয়তো ছিল। ছোটোবেলায়
অনেক বড়ো একটা শক পেয়েছি। যার কারণে জীবনটাকে ভয়ংকর ভাবতে বাধ্য হই। আর জ্যাককে হারানোর
পর পুরোপুরি নিশ্চিত হই-জীবনটা আসলেই বড্ড বেশিই নিষ্ঠুর আর বিশ্বাসঘাতক।’
‘আমি জানি, তারপর...,’ ওকে লক্ষ্য করে বলল
ক্রিস্টোফার, ‘...তারপর হয়তো জাইলস আসে তোমার জীবনে।’
‘হা,’ মুখের হাসি লুকাতে
পারল না সে। প্রায় লাজুক ভঙ্গিতে কথাটা বলতে কেঁপে উঠল খানিকটা। ‘জাইলস এলো...আর তারপর
থেকেই আগের মতো হয়ে গেল সবকিছু, নিজেকে একদম সুখী আর নিরাপদ মনে হলো। জাইলস!’
হাসি মিলিয়ে গেল ওর মুখ থেকে। চোখে মুখে জায়গা
করে নিলো আহত অভিব্যক্তি। এমনভাবে কেঁপে উঠল যে, মনে হলো ঠান্ডা লাগছে খুব।
‘কী ব্যাপার, মলি? ভয়
পাচ্ছো কেন? ভ...ভয় পাচ্ছো তুমি, তাই না?’
কিছু না বলে দুদিকে মাথা নাড়লো সে।
‘সেটা কি জাইলসের জন্য?
জাইলস কি এমন কিছু বলেছে বা করেছে...’
‘না, জাইলস নয়। ঐ ভয়ংকর
লোকটা!’
‘কোন লোক?’ চমকে উঠল ক্রিস্টোফার।
প্যারাভিসিনি’
‘না, না। সার্জেন্ট ট্রটার।’
‘সার্জেন্ট ট্রটার?’ ভ্রু কুঁচকে ফেলল ক্রিস্টোফার।
‘জাইলসকে নিয়ে কী সব
উল্টাপাল্টা বকবক করে গেল। ভয়ংকর সব কথাবার্তা ঢুকিয়ে গিয়ে গেল আমার মাথায়। আমি
নাকি জাইলসকে চিনি না।’
‘...ওহ!’ চোখ কপালে উঠে গেল
ক্রিস্টোফারের। ‘জাইলস? হ্যা, হ্যা... জাইলস। তাকে দেখে আমার
চেয়ে বয়স্ক মনে হয়। কিন্তু আমার মনে হয় না আসলে ততটা বয়স্ক সে। সে তো...ওহ নো,
আমার বয়সিই হবে। যার মানে সেও খুনি হতে পারে। কিন্তু...মহিলা যেদিন লন্ডনে খুন হয়,
সেদিন তো জাইলস এখানে...তোমার সঙ্গেই ছিল।’
জবাব দিলো না মলি।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলো ক্রিস্টোফার, ‘ছিল না?’
প্রায় দম আটকে খুব ধীরে ধীরে মুখ খুলল মলি।
প্রতিটি শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি শব্দ। অসংলগ্নভাবে বিড়বিড় করে বলল, ‘সারাদিন বাইরে ছিল...গাড়িতে...কাউন্টির
অন্য পাশে ওয়্যার নেটিং কিনতে গিয়েছিল... অন্তত আমি এটাই জানতাম...যতক্ষণ না...যতক্ষণ
না...’
‘যতক্ষণ না কী?’
খুব আস্তে আস্তে হাত তুলল মলি, দেখতে দেখতে টেবিলের
ওপর পড়ে থাকা ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের তারিখের ওপর রাখল একটা আঙুল।
সেদিকে তাকিয়ে মুখ খুলল ক্রিস্টোফার, ‘দুদিন আগের লন্ডন এডিশন।’
‘জাইলস যখন ফিরে আসে,
তখন এটা ওর পকেটে ছিল। ও...ও নিশ্চয়ই লন্ডনে গেছে।’
স্থির দৃষ্টি দিলো ক্রিস্টোফার। একবার কাগজ আবার
মলির দিকে তাকাতে লাগল শূন্যদৃষ্টিতে। ঠোট গোল করে আচমকাই শিস দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু
পরক্ষণেই এই মুহূর্তে ভয়ানক সুর তোলা ঠিক হবে না ভেবে সামলে নিলো নিজেকে। অনেকক্ষণ
ভেবে খুব সাবধানে বাছাই করল শব্দগুলো, ‘তুমি...ঠিক কতটা জানো
জাইলসের ব্যাপারে?’
‘না,’ চিৎকার করে উঠল মলি,
‘এটা জিজ্ঞেস করো না!
হারামী ট্রটারও ঠিক এটাই বোঝাতে চেয়েছে, এটাই ইঙ্গিত করেছে সে। বোঝাতে চেয়েছে যুদ্ধের
সময় যেসব বিয়ে হয়েছে, সেখানে স্ত্রীরা নাকি তাদের স্বামীর ব্যাপারে কিছুই জানে না।
তারা...তারা নাকি শুধু পুরুষের মুখের কথায় বিশ্বাস করে নিয়েছে।’
‘কথাটা পুরোপুরি মিথ্যাও
নয়।’
‘তুমিও এটা বলো না! সহ্য
করতে পারবনা আমি। আমরা সবাই স্রেফ পরিস্থিতির স্বীকার। সেখানে এসব মনগড়া কথাবার্তা
বিশ্বাস করা...ওহ, পারব না। আমি...আমি...’
হঠাৎ রান্নাঘরের দরজা খুলে যাওয়ায় থেমে যেতে
হলো ওকে। ভেতরে প্রবেশ করল জাইলস। তীব্র রাগে রীতিমতো ফোঁসফোঁস করছে।
‘কথার মাঝখানে বাগড়া
দিলাম নাকি?’
উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে খানিকটা সরে গেল ক্রিস্টোফার।
‘রান্না শিখছিলাম,’ বলল সে।।
‘তাই নাকি? বেশ, তাহলে
শোনো রেন, মারপিট খুব একটা স্বাস্থক্যর নয় এই মুহূর্তে। কিচেন থেকে দূরে দূরে থাকবে,
বুঝেছো?’
‘অবশ্যই, কিন্তু...’
‘আমার বৌয়ের থেকেও দূরে দূরে থাকবে, রেন। পরবর্তী
শিকার হতে যাচ্ছে না ও।’
‘সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তা করছি আমি।’ ক্রিস্টোফার
বলল।
কথাটার গুরুত্ব থাকলেও সেদিকে বিন্দুমাত্র ভুক্ষেপ
করল না জাইলস। মুখটা আরও কালো আর গম্ভীর করে বলল, ‘দুশ্চিন্তা আমি করব,’ বলল সে। ‘আমার বৌয়ের খেয়াল
আমিই রাখতে পারব। তোমাকে নাক গলাতে হবে না, বের হও এখান থেকে।’
‘যাও, ক্রিস্টোফার। প্লিজ!’ শান্ত গলায় বলল মলি।
আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ক্রিস্টোফার।
‘বেশি দূরে যাব না,’ নির্দিষ্ট অর্থ বুঝিয়ে মলির উদ্দেশ্যে বলল
সে।
‘তুমি যাবে এখান থেকে?’
বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠল ক্রিস্টোফার।
‘জি জি...যাচ্ছি, কমান্ডার।’
দরজা বন্ধ হলে মলির দিকে ফিরল জাইলস। ‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে
গেছে, মলি? একটা ভয়ংকর খুনির সঙ্গে একা বসে আছো!’
‘সে আসলে...,’ ঠিক হবে না ভেবে দ্রুত শব্দটা পাল্টে দিলো সে,
‘...ভয়ংকর নয়। যাই
হোক, আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারি।’
অস্বস্তি নিয়ে হাসলো জাইলস, মিসেস বয়েলও পারতেন।
‘ওহ, থামো, জাইলস।’
‘স্যরি, মলি। মেজাজ খারাপ
হয়ে গিয়েছিল। আমার মাথায়ই ধরছে না, ঐ বাজে ছেলেটার মধ্যে কী পেয়েছো তুমি।’
আস্তে আস্তে মুখ খুলল মলি, ‘খারাপ লাগছে ওর জন্য।’
‘একটা উন্মাদ খুনির জন্য?’ উৎসুক দৃষ্টি দিলো
মলি, ‘উন্মাদ খুনির জন্য খারাপ
লাগে আমার।’
‘ক্রিস্টোফার বলেও ডাকা
হচ্ছে তাকে। কবে থেকে খ্রিস্টান-নামের নিয়ম মেনে চলছো আবার?’
‘জাইলস, পাগলামী করো
না। তুমি নিজেও জানো, আজকাল প্রত্যেকেই সবসময় খ্রিস্টান নাম ব্যবহার করে।’
‘এমনকি দুদিনের পরিচয়েও?
অবশ্য পরিচয়টা অনেক দিনেরও হতে পারে। ক্রিস্টোফার রেন, ঐ ভণ্ড আর্কিটেক্টকে আগে থেকেই
চেনো তুমি, তাই না? হয়তো তুমি নিজেই এখানে আসতে বলেছো তাকে? হয়তো এত নাটকও দুজনে
মিলেই সাজিয়েছো, নাকি?’
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মলি। ‘জাইলস, মাথা খারাপ হয়ে
গেছে নাকি তোমার? কী বলছো এসব?’
‘আমি শুধু এটাই বলছি
যে, ক্রিস্টোফার রেন তোমার পুরোনো বন্ধু। আমার সামনে যতটা প্রকাশ করছো, ঠিক তার চেয়ে
অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ তোমরা!’
‘জাইলস!’ বিস্ফোরিত দৃষ্টি দিলো
মলি। ‘পাগল হয়ে গেছো তুমি।’
‘মহিলাদের প্রতি এই ধরনের
খুনির প্রচণ্ড আকর্ষণের কথা অনেক পড়েছি আমি। কীভাবে চেনো ওকে? আর কতদিন ধরে চলছে এসব?’
‘তোমার মাথা পুরোপুরি
খারাপ হয়ে গেছে, জাইলস। এখানে আসার আগ অবধি ক্রিস্টোফার রেনকে কখনো দেখিনি আমি।’
‘দুদিন আগে ওর সঙ্গে
দেখা করতে লন্ডন যাওনি তুমি? তারপর এখানে অপরিচিত মানুষ হিসাবে আসতে বলনি?’
‘তুমি খুব ভালো করেই
জানো, জাইলস। কয়েক সপ্তাহ হলো লন্ডনের মুখ দেখিনি আমি।’
‘তাই নাকি? দারুণ তো।’ পকেট থেকে দোমড়ানো
মোচড়ানো একটা গ্লাভস বের কররে আনলো সে। ‘পরশু এই গ্লাভটাই তো
পরেছিলে তুমি, তাই না? যেদিন আমি সেইলহামে নেটিং কিনতে গিয়েছিলাম?’
‘হ্যা,’ সরাসরি জাইলসের দিকে
তাকিয়ে বলল মলি, ‘তুমি যেদিন সেইলহ্যামে নেটিং কিনতে গেছো, সেদিন
বাইরে যাওয়ার সময় এই গ্লাভটাই পরেছি আমি।’
‘আমাকে বলেছো, গ্রামে
যাচ্ছো। সত্যি যদি সেদিন গ্রামে গিয়ে থাকো, তাহলে এটা কী করছে এখানে?’
অভিযোগের সুরে কথাটা বলেই গোলাপী রংয়ের একটা
বাস টিকেট বের করে আনলো সে। মুহূর্তেই পিনপতন নিরবতা নেমে এলো পুরো রুমে।
‘লন্ডনে গিয়েছিলে তুমি,’ জাইলস বলল।
‘বেশ,’ চট করে শিরদাঁড়া টানটান
করে ফেলল মলি। ‘লন্ডনে গেছি আমি।’
‘ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে
দেখা করতে।’
‘না, ক্রিস্টোফারের সঙ্গে
দেখা করতে নয়।’
‘তাহলে কেন গিয়েছিলে?’
‘দাঁড়াও, জাইলস,’ বলল মলি। ‘সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন
মনে করছি না।’
‘তার মানে, আরও সময়
নিয়ে চমৎকার কোনো গল্প বানাতে যাচ্ছো!’
‘মনে হচ্ছে,’ বলল মলি, ‘তোমাকে ঘৃণা করি আমি!’
‘আমি ঘৃণা করি না তোমাকে,’ ধীরে ধীরে বলল জাইলস।
‘কিন্তু এর মধ্যেই ঘৃণা
করলে ভালো হতো ভাবছি। আজ একেবারে অচেনা মনে হচ্ছে। তোমাকে। যেন...যেন কিছুই জানি না
তোমার ব্যাপারে।’
‘আমারও ঠিক একই অনুভূতি
হচ্ছে,’ মলি বলল। ‘নিছক এক আগন্তুক ছিলে
তুমি। যে এতদিন ধরে শুধু মিথ্যাই বলেছে আমাকে...’
‘আমি আবার কখন মিথ্যা
বলেছি তোমাকে?’
হেসে উঠল মলি। ‘তোমার কি মনে হয়, নেটিং
কিনতে যাওয়ার গল্পটা বিশ্বাস করেছি আমি? তুমি নিজেও লন্ডনেই ছিলে সেদিন।’
‘মনে হচ্ছে আমাকে দেখেছো
তুমি,’ বলল জাইলস। ‘যথেষ্ট বিশ্বাস নেই
আমার ওপর...’
‘বিশ্বাস? জীবনে আর কখনো
কাউকে বিশ্বাস করব না আমি।’
দুজনের কেউই লক্ষ্য করেনি যে, আস্তে আস্তে দরজা
খুলে গেছে। মনোযোগ আকর্ষণ করতে মৃদু শব্দ করে কাশি দিলে মিস্টার প্যারাভিসিনি।
‘খুবই জটিল ব্যাপার,’ বিড়বিড় করে বলল সে।
‘আশা করি তোমরা দুজনেই
যেটা বোঝাতে চাও, তার বেশি একটা কথাও বলছো না। এই প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়ায় কেউ না
কেউ সবসময়ই ঠিক থাকে।’ ‘প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়া,
উপহাসের ভঙ্গিতে বলল জাইলস। ‘খারাপ না।’
‘ঠিক, ঠিক,’ মিস্টার প্যারাভিসিনি
বলল। ‘আমি জানি তোমাদের কেমন
লাগছে। যুবক বয়সে হরহামেশাই এরকম ঝগড়া করেছি। যাই হোক, আমি বলতে এসেছি, ইন্সপেক্টর
লোকটা ড্রয়িং রুমে ডাকছে সবাইকে। মনে হচ্ছে একটা বুদ্ধি পেয়েছে,’ মুখ টিপে হাসল মিস্টার
প্যারাভিসিনি। ‘পুলিশ সবসময় ক্লু-ই পায়। কিন্তু বুদ্ধি? এই ব্যাপারে যথেষ্ট
সন্দেহ রয়েছে আমার। আমাদের অফিসার, মানে সার্জেন্ট ট্রটার খুব করিৎকর্মা আর কষ্ট সহ্য
করা মানুষ হলেও, মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু আছে বলে তো মনে হয় না।’
‘তুমি যাও, জাইলস,’ বলল মলি। ‘রান্না বাকি আছে এখনো,
আমাকে ছাড়াই চালিয়ে নিতে পারবেন সার্জেন্ট ট্রটার।’
‘রান্নার কথা মনে পড়লো,’ কথাটা বলেই দ্রুত মলির
পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মিস্টার প্যারাভিসিনি। মুরগির কলিজা দিয়ে টোস্ট খেয়েছো কখনো-যেটার
ওপর ভারি করে দেওয়া ফয়ে গ্রাস, বেকন মেশানো ফ্রেঞ্চ সরিষা বাটা লেপে দেওয়া থাকে?’
‘আজকাল ফয়ে গ্রাস খুব
একটা পাওয়া যায় না,’ জাইলস বলল। ‘আসুন, মিস্টার প্যারাভিসিনি।’
‘আমি কি সাহায্য করব
তোমাকে?’ মলির উদ্দেশ্যে বলল
প্যারাভিসিনি।।
‘আপনি আমার সঙ্গে ড্রয়িং
রুমে আসুন, মিস্টার প্যারাভিসিনি,’ বলল জাইলস।
আস্তে হেসে উঠল মিস্টার প্যারাভিসিনি। ‘তোমার স্বামী, ভয় পাচ্ছে
তোমাকে নিয়ে। স্বাভাবিক। আমার সঙ্গে একা ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছে না
সে। হার মানছি আমি।’ নিচু হয়ে নিজের হাতের আঙুলের ডগায় চুমু খেল
সে।’
অস্বস্তি নিয়ে মুখ খুলল মলি, ‘ইয়ে মানে, মিস্টার
প্যারাভিসিনি, আমি নিশ্চিত...’
দুদিকে সমানে মাথা নাড়লো মিস্টার প্যারাভিসিনি।
তারপর জাইলসের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুমি খুব বুদ্ধিমান, ভাই। কোনো সুযোগ
দিতে রাজী নও। অবশ্য আমিও কি আর তোমার কাছে কিংবা ইন্সপেক্টরের কাছে নির্দোষ প্রমাণ
করতে পারব নিজেকে? না, নেগেটিভ জিনিস প্রমাণ করা খুব কঠিন।’
কথাটা বলেই শিস দিয়ে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে
উঠল মলি। ‘প্লিজ, মিস্টার প্যারাভিসিনি-এই ভয়ংকর সুরটা বাজাবেন না।’
‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস’-তো এটাই সেই সুর! একেবারে
মাথায় ঢুকে গেছে আমার। যাই হোক, এটা নিয়ে কিছুটা ভেবেছি আমি। মোটেও সুন্দর নয়, বরং
ভয়ানক একটা ছড়া। আর কখনো লক্ষ্য করনি, বাচ্চারা কিন্তু ভয়ানক জিনিসই ভালোবাসে? ‘শি কাট অফ দেয়ার টেইলস
উইথ অ্যা কার্ভিং নাইফ,’ কার্ভিং নাইফ দিয়ে সে তাদের লেজ কেটে দিয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, বাচ্চারা এরকম জিনিসই ভালোবাসবে-ওদের ব্যাপারে অনেক কিছু বলতে পারি
আমি...’
‘দয়া করে থামুন,’ অস্ফুটস্বরে বলল মলি,
‘আমার তো মনে হচ্ছে,
আপনি নিজেও খুব ভয়ানক একটা মানুষ। পরক্ষণেই হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চিৎকার করে উঠল
সে। আপনি শুধু হাসেন আর হাসেন, সবকিছুতেই মজা! আপনি আসলে...আসলে ইঁদুর নিয়ে খেলতে
থাকা একটা বিড়ালের মতো...’
কথাটা বলেই রুমের বদ্ধ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে
লাগল সে।
‘শান্ত হও, মলি,’ জাইলস বলল। ‘আমরা বরং একসঙ্গে যাই
ড্রয়িং রুমে। দেরি হলে আবার অধৈর্য হয়ে পড়বেন ট্রটার। রান্না-বান্না নিয়ে পরে ভাবলেও
চলবে। আপাতত খাবারের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খুন।’
‘একমত হতে পারছি না,
মিস্টার প্যারাভিসিনি বলল। এখন প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে ওদেরকে অনুসরণ করছে সে। মরার
আগ মুহূর্তে হলেও ভালো খাবার চাই। খাওয়ার জন্যই তো বেঁচে থাকা।’
হলরুমে সবার সঙ্গে যোগ দিলো ক্রিস্টোফার রেন।
জাইলসের চোখ রাঙানি দেখতেই দ্রুত মলির দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় সে চোখে মুখে উদ্বিগ্ন
ভাব ফুটে উঠেছে তার। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই মলির। ঘাড় সোজা করে
টানটান শরীরটা একেবারে নাক বরাবর টেনে নিতে লাগল সে। মিছিলের মতো হলের দরজায় এসে উপস্থিত
হলে সবাই। খানিকটা পিছিয়ে পড়লেও মোটামুটি লাফিয়ে দূরত্বটা কমিয়ে ফেলল প্যারাভিসিনি।
সার্জেন্ট ট্রটার ও মেজর মেটকাফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
অপেক্ষা করছিল সবার জন্য। মেজর মেটকাফকে দেখে মনে হচ্ছে, মুখে যেন কালি লেপে দিয়েছে
কেউ। স্বভাবসুলভ গম্ভীর অভিব্যক্তি এখন আরও বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে তার। কিন্তু তার বিপরীতে
সার্জেন্ট ট্রটারের অভিব্যক্তি বেশ উজ্জ্বল। রীতিমতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে তার চেহারা।
‘চমৎকার, ওরা ভেতরে পা
রাখতেই বলে উঠল সে। আপনাদের সবাইকে এক সঙ্গেই দেখতে চেয়েছি। একটা এক্সপেরিমেন্ট করব
আমি। তার জন্য আপনাদের সবার সাহায্য লাগবে।’
‘বেশি দেরি হবে?’ জিজ্ঞেস করল মলি। রান্নাঘরে
কাজ পড়ে আছে আমার। আর যাই হোক, খাওয়াদাওয়া তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না।’
‘সেটা ঠিক, ট্রটার বলল।
কিন্তু মিসেস ডেভিস, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। এখানে যে খাওয়া দাওয়ার চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে! মিসেস বয়েল অন্তত আবার খেতে আসছেন না।’
‘আসলেই, সার্জেন্ট,’ মেজর মেটকাফ বললেন।
এভাবে সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঠিক করছেন না আপনি।’
‘দুঃখিত, মেজর মেটকাফ,
ট্রটার বলল। কিন্তু আমি চাচ্ছি, আপনারা সবাই সাহায্য করুন আমায়।’
‘আপনার স্কি খুঁজে পেয়েছেন?’ জিজ্ঞেস করল মলি।
খানিকটা লজ্জা পেয়ে মুখ লাল হয়ে গেল যুবকের।
বলল, ‘এখনো পাইনি, মিসেস ডেভিস।
কিন্তু কে নিয়েছে, আর কেন নিয়েছে-সেই ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত একটা সন্দেহ আছে আমার।
এই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
‘প্লিজ, ভুলেও সেটা করবেন
না, প্রার্থনার সুরে বলল মিস্টার প্যারাভিসিনি। সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ একেবারে শেষ অধ্যায়ে
থাকা উচিত।’
‘এটা কোনো গেইম নয়,
স্যার।’
‘তাই নাকি? কিন্তু আমার
তো মনে হচ্ছে আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কারো না কারো কাছে তো এটা গেইমই।’
‘খুব মজা পাচ্ছে খুনি,’ বিড়বিড় করে উঠল মলি।
চট করে ঘরের সবকটা দৃষ্টি স্থির হলো ওর ওপর। থতমত খেয়ে দ্রুত বলে উঠল, ‘আমি তো শুধু সার্জেন্ট
ট্রটারের কথাটাই পুনরাবৃত্তি করলাম।’
এই কথায় খুব একটা খুশি মনে হলো না সার্জেন্ট
ট্রটারকে। ‘মিস্টার প্যারাভিসিনির কথা শুনে মনে হচ্ছে, এটা কোনো মিস্ট্রি
থ্রিলার। যেখানে সব রহস্যের সমাধান একেবারে শেষ অধ্যায়ে থাকে।’ বলল সে। ‘কিন্তু না, এটা একটা
জলজ্যান্ত বাস্তব ঘটনা।’
‘যতক্ষণ না,’ আঙুল দিয়ে সাবধানে নিজের গলা স্পর্শ করল বলল
ক্রিস্টোফার রেন, ‘এটা আমার সঙ্গে হচ্ছে।’
‘তাহলে, মুখ খুললেন মেজর
মেটকাফ, ‘সব বাদ দিন, বন্ধুরা।
এবার সার্জেন্ট ট্রটার আমাদেরকে বলবেন, কেন সবাইকে এখানে জড়ো করেছেন তিনি।’
লম্বা আলোচনার প্রস্তুতিস্বরূপ গলা পরিষ্কার
করে নিলো সার্জেন্ট ট্রটার। গলার স্বর হয়ে উঠল কর্তৃত্বপূর্ণ। ‘অল্প কিছু সময় আগে
মোটামুটি সবার কথাই শুনেছি আমি,’ বলল সে। ‘যেখানে আপনারা মিসেস
বয়েলের খুনের সময় নিজ নিজ অবস্থানের কথা বলেছিলেন। মিস্টার রেন ও মিস্টার ডেভিস ছিলেন
নিজেদের শোবার ঘরে। মেজর মেটকাফ সেলারে, এবং মিস্টার প্যারাভিসিনি তখন নিজের রুমে...’
বিরতি নিয়ে তারপর আবারও বলতে লাগল সে। ‘এগুলো হচ্ছে আপনাদের
নিজেদের বয়ান, যেটার সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোনো উপায় আমার হাতে নেই। অর্থাৎ, আপনাদের
কথা সত্য হতেও পারে, আবার নাও পারে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, এখানে চারজনের বক্তব্য
ঠিক, অন্যটি ভুল। তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, ভুল কোনটি?’
সবার মুখের ওপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলো সে। কিন্তু
টু শব্দটিও বেরুলো কারো মুখ থেকে।
‘আপনাদের মধ্যে চারজন
সত্য বলেছেন, আর অন্য একজন সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাই আমি এমন একটি পরিকল্পনা করেছি, যেটা
আমাকে মিথ্যাবাদী পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করবে। আর যদি আমি জানতে পারি আপনাদের মধ্যে
কে মিথ্যা বলেছেন, তাহলে আমিও বলতে পারব-খুনি কে।’
স্পষ্ট গলায় বলে উঠল জাইলস। ‘কিন্তু সেটা পুরোপুরি
ঠিক নাও হতে পারে। কেউ একজন হয়তো অন্য কোনো কারণে মিথ্যা বলেছে।’
‘সেই ব্যাপারে আমার সন্দেহ
আছে,’ মিস্টার ডেভিস।
‘কিন্তু পরিকল্পনাটা
কী, ভাই? এইমাত্রই বলেছেন, বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোনো উপায় নেই আপনার
হাতে।’
‘হ্যা, নেই। তবে প্রত্যেককে
দিয়ে তার পূর্বের কাজটা আবার করানোর কথা ভাবছি।’
‘বাহ,’ তাচ্ছিল্যের স্বরে
বললেন মেজর মেটকাফ। ‘অপরাধের পুনর্গঠন। বিদেশী পদ্ধতি।’
‘অপরাধের পুনর্গঠন নয়,
মেজর মেটকাফ। এটাকে বরং আপাতদৃষ্টিতে নিরপরাধ মনে হওয়া সবার গতিবিধি পুনরায় দেখা
বলতে পারেন।’
‘বেশ। তো এটা দেখে ঠিক
কী বুঝতে চাচ্ছেন আপনি?’
‘ক্ষমা করবেন, এই মুহূর্তে
সেটা খুলে বলছি না।’
‘আপনি তাহলে,’ জিজ্ঞেস করল মলি, ‘সবগুলো কাজের পুনরাবৃত্তি
চাচ্ছেন?’
‘ঠিক তা নয়। বরং একটু
কম বা বেশি দেখতে চাচ্ছি, মিসেস ডেভিস।’
এটা একটা ফাঁদ, ভাবলো মলি। ‘এটা একটা ফাঁদ, কিন্তু
আমি বুঝতে পারছি না-আচ্ছা, আপনি তাহলে চারজন নিরপরাধ মানুষ ও একজন অপরাধীর বদলে রুমের
পাঁচজনকেই অপরাধী ভাবছেন।’
খুব নির্দোষ টাইপ বুদ্ধি দেওয়া মানুষটার মুখে
হাসি ফুটে উঠেছে এখন। রুমে থাকা পাঁচজোড়া চোখ স্থির হয়ে আছে তার ওপর। খানিকবাদেই
চিৎকার করে উঠল ক্রিস্টোফার। ‘আমি...আমি ঠিক বুঝতে পারছি
...সত্যিই মাথায় ধরছে না, সবাইকে একই কাজ আবার
করতে দিয়ে…দিয়ে কীসের আশা করছেন আপনি। যত্তসব পাগলামী!’
‘তাই নাকি, মিস্টার রেন?’
‘অবশ্যই, ধীরে ধীরে বলল
জাইলস। আপনি যা বলছেন, তাই হবে, সার্জেন্ট। আমরা সবাই সাহায্য করব আপনাকে। আগে ঠিক
যা যা করেছি, এখনও কি সেগুলোই করতে হবে?’
‘হ্যা, হুবুহু একইরকম
কাজ করতে হবে।’
কথাটায় অস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠা দ্ব্যর্থতার দরুণ
ঝট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেন মেজর মেটকাফ। ওদিকে নিজের মতো বলে যাচ্ছে সার্জেন্ট। ‘মিস্টার প্যারাভিসিনি
বলেছেন, তিনি পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। এখন আপনি কি দয়া করে সেটা আরেকবার করে দেখাবেন
মিস্টার প্যারাভিসিনি?’
কিছু না বলে দ্রুত পিয়ানোর কাছে গিয়ে টুলে
বসে পড়লো মিস্টার প্যারাভিসিনি।
‘সঙ্গীতের রচয়িতা এখন
একটি খুনের সিগনেচার টিউন বাজাবে।’
ঝঙ্কার দিয়ে বলল সে। পরক্ষণেই এক আঙুলে বাজাতে লাগল ‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস
সুরটি।’
মজা পাচ্ছে সে, ভাবলো মলি। খুব মজা পাচ্ছে।
কোমল সুরটা মুহূর্তের মধ্যেই পুরো রুমের পরিবেশ
পাল্টে গুমোট ও ভূতুড়ে করে দিলো।
‘ধন্যবাদ, মিস্টার প্যারাভিসিনি।’ সার্জেন্ট ট্রটার বলল।
‘তাহলে ধরে নিচ্ছি, ঠিক
এই সুরটাই বাজিয়েছিলেন তখন। তাই তো?’
‘হ্যা, সার্জেন্ট, ঠিক
এটাই। তিনবার রিপিট করেছিলাম মোট।’
এবার মলির দিকে ফিরল সার্জেন্ট ট্রটার। ‘আপনি পিয়ানো বাজাতে
পারেন, মিসেস ডেভিস?’
‘পারি।’
‘মিস্টার প্যারাভিসিনি
যেরকম বাজালেন, হুবুহু একইরকম করে বাজাতে পারবেন?’
‘অবশ্যই পারব।’
‘তাহলে, আপনি কি একটু
পিয়ানোর কাছে গিয়ে আমার নির্দেশের অপেক্ষা করবেন?’
পুরোপুরি হতভম্ব দেখালো মলিকে। তারপর নিজেকে
সামলে নিয়ে পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গেল সে।
খানিকটা আপত্তি নিয়েই উঠে দাঁড়ালো মি. প্যারাভিসিনি।
‘কিন্তু সার্জেন্ট, আমি
তো ভেবেছি, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাবো। আমি পিয়ানোর কাছে ছিলাম,
তাহলে...’
‘একই কাজের পুনরাবৃত্তি
হবে। তবে সেটা নির্দিষ্ট করে একই ব্যক্তিকে দিয়ে নয়।’
‘বুঝতে পারছি না কিছু,’ বলল জাইলস। ‘কী হচ্ছে এসব?’
‘বলছি, এটা আসলে মূল
বক্তব্যগুলো পরীক্ষা করে দেখা। যার জন্য হয়তো যে-কোনো একটি নির্দিষ্ট বক্তব্য বেছে
নেবো আমি। তাহলে, এবার আমি আপনাদেরকে নিজ নিজ গন্তব্য বলে দিচ্ছি। মিসেস ডেভিস এখানে
পিয়ানোর কাছে থাকবেন। মিস্টার রেন দয়া করে একটু রান্নাঘরে যাবেন? তেমন কিছু করতে হবে
না, শুধু মিসেস ডেভিসের ডিনারের ওপর নজর রাখবেন। মিস্টার প্যারাভিসিনি, আপনি কি একটু
মিস্টার রেনের ঘরে যাবেন? শিস দিয়ে আপনার সঙ্গীত প্রতিভা যাচাই করতে পারেন। আর হ্যাঁ,
সুরটা কিন্তু উনার কথামতো থ্রি ব্লাইন্ড মাইসই হবে। মেজর মেটকাফ, আপনি ওপরে মিস্টার
ডেভিসের ঘরে গিয়ে টেলিফোন লাইন পরীক্ষা করে দেখুন। আর মিস্টার ডেভিস, আপনার কাজ হচ্ছে
কাপবোর্ডের ওখানে গিয়ে নিচে সেলারের পথ ধরা।’
কয়েকমুহূর্তের জন্য পিনপতন নিরবতা নেমে এলো
পুরো রুমে। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল চারজন। সবাইকে অনুসরণ করল সার্জেন্ট ট্রটার।
কাঁধের ওপর দিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে মলির উদ্দেশ্যে বলল, ‘পঞ্চাশ পর্যন্ত গুণে
তারপর বাজানো শুরু করবেন, মিসেস ডেভিস।’
বাকিদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল সে। দরজা বন্ধ হওয়ার
আগে মিস্টার প্যারাভিসিনির গলা শুনতে পেল মলি। খনখনে গলায় সে বলছে, ‘পুলিশের লোকও যে লুকোচুরি
খেলা পছন্দ করে, জানতাম নাতো।’
অধ্যায় ৬
‘আটচল্লিশ...উনপঞ্চাশ...পঞ্চাশ।’
নির্দেশনা মতে গোনা শেষ হতেই বাজাতে শুরু করল
মলি। আরও একবার নির্মম সুরের ফলা এফোঁড়ওফোর করে দিলো রুমের বাতাসকে। ভূতুড়ে সুরটা
প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চার দেয়ালের মাঝে।
থ্রি ব্লাইন্ড মাইস
সি হাউ দে রান...
বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ টের পাচ্ছে মলি। মিস্টার
প্যারাভিসিনি যেরকম বলেছে, সত্যি সত্যিই এই ছড়ায় যেন লুকিয়ে আছে চাপা নিষ্ঠুরভা।
শিশুর অবোধ মনের বিপরীতে প্রাপ্তবয়স্কদের সামনে এই সুরেৱ নির্মমতা উলঙ্গ হয়ে পড়ে।
ক্ষীণভাবে ওপর থেকে ঠিক একইরকম সুর ভেসে এলো।
মিস্টার প্যারাভিসিনি এখন অভিনয় করছে ক্রিস্টোফার রেনের চরিত্রে। আচমকাই ভেসে এলো
টেলিফোন লাইনের খুটখাট শব্দ। সার্জেন্ট ট্রটার নিশ্চয়ই সেখানে এখন, যে স্থলাভিষিক্ত
হয়েছে মিসেস বয়েলের চরিত্রে।
কিন্তু কেন? এতকিছুর মানে কী? মলি অন্তত নিশ্চিত,
ওদের সবার জন্য এটা একটা ফাঁদ ছিল। তাহলে এখন কোথায় সেই ফাঁদ?
এক পশলা ঠান্ডা বাতাস ওর ঘাড় ছুঁয়ে যেতেই চমকে
ওঠে পেছনে তাকালো। নিশ্চয়ই দরজা খুলে গেছে, কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। কিন্তু
না, কেউ নেই। উপহাস করে উঠল যেন পুরো রুমের অনিঃশেষ শূন্যতা। হঠাৎই অস্বস্তি ঘিরে ধরল
তাকে, অজানা ভয় জেঁকে বসেছে চারপাশে। চোখের সামনে ভেসে উঠল টুকরো কিছু ছবি।
নিচে নেমে এসেছে মিস্টার প্যারাভিসিনি। বিড়ালের
মতো সংযত পা আর অভিব্যক্তিতে হিংস্রতা নিয়ে পার হলো হলরুমের দরজা। তারপর এগিয়ে এলো
পিয়ানোর দিকে, ওঠানামা করছে তার লম্বা লম্বা আঙুল।
‘তাহলে, নিজের মৃত্যু
সংগীত বাজাচ্ছো নাকি, মেয়ে...একটা সুখের স্মৃতি...।’
ওহ, থাম, গাধার মতো আজেবাজে জিনিস ভাবিস না।
যেখানে তোর মাথার ওপরেই শিস বাজাচ্ছে লোকটা, শুনতেও পাচ্ছিস তুই।
চিন্তাটা উঁকি দিতেই পিয়ানো থেকে আঙুল প্রায়
সরিয়েই ফেলল সে। মিস্টার প্যারাভিসিনিকে পিয়ানো বাজাতে শোনেনি কেউ। এটাই কি তাহলে
সেই ফাঁদ? হতে পারে মিস্টার প্যারাভিসিনি পিয়ানো বাজায়ইনি। এমনকি ড্রয়িং রুমেই ছিল
না সে। বরং লাইব্রেরিতে... শ্বাসরোধ করে খুন করছিল মিসেস বয়েলকে!
ট্রটার যখন ওকে বাজানোর কথা বলে, তখন খুব রেগে
গিয়েছিল লোকটা। খুব বেশিই রেগে গিয়েছিল। আর এবার বাজানোর সময় খুব সাবধান ছিল সে।
সুরের কোমলতার ওপর এত বেশি জোর দিচ্ছিল যে, বাইরে থেকে শোনাই যাবে না। কারণ এবার যদি
বাইরে থেকে শোনা যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে-আগেরবার কেন শোনা যায়নি।
ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে যেতেই চিন্তায় ছেদ
পড়লো মলির। প্যারাভিসিনিকে দেখবে ভেবে ঘুরে দাঁড়াতেই মুখখামুখি হলো সার্জেন্ট ট্রটারের।
ঠিক কিছুক্ষণ আগেই তৃতীয়বারের মতো সুরটা বাজিয়ে শেষ করেছে সে।
‘ধন্যবাদ, মিসেস ডেভিস,’ ট্রটার বলল। দেখে মনে
হলো প্রচণ্ড আত্মতৃপ্তি পেয়েছে। অভিব্যক্তিতেও ফুটে উঠেছে চরম আত্মবিশ্বাস ও স্বস্তি।
কীবোর্ড থেকে আঙুল সরিয়ে নিলো মলি। ‘যেটা চেয়েছেন সেটা
কি পেয়েছেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘হ্যাঁ, অবশেষে,’ বিজয়ী ভঙ্গিতে বলল
সে। ‘একদম যা চেয়েছি, তাই
পেয়েছি।’
‘কী সেটা? কোন জন?’
‘আপনি জানেন না, মিসেস
ডেভিস? এখন আর মোটেও কঠিন নয় সেটা। যাই হোক, অনেক বড়ো বোকা আপনি, তৃতীয় শিকারের খোঁজ
পেতে সাহায্য করেছেন আমাকে। তাতে বিপদটা আপনারই বেড়েছে।’
‘আমি?’ বুঝতে পারছি না কী
বলছেন এসব।
‘আপনি আমাকে পুরোপুরি
সত্য বলেননি, মিসেস ডেভিস। মিসেস বয়েলের মতোই কথা চেপে গেছেন।’
‘বুঝিনি।’
‘ওহ, আমি জানি খুব ভালো
করেই বুঝতে পারছেন। আমি যখন প্রথম লংগ্রিজ ফার্ম কেসের কথা বলি, তখন সবকিছুই জানতেন
আপনি। ভেঙে পড়েছিলেন তখন। আর মিসেস বয়েল যে এই এলাকার বিলেটিং অফিসার ছিলেন, সেটাও
আপনিই নিশ্চিত করে বলেছিলেন আমায়। আপনারা দুজনেই সেখান থেকে এসেছেন। তাই যখন তৃতীয়
ভিক্টিমের খোজ করছিলাম, তখন চট করেই আপনার কথা মাথায় আসে আমার। লংগ্রিজ ফার্ম বিজনেসের
জ্ঞানটা আপনি এখানে কাজে লাগানোর কথা ভাবেন। জানেন তো, আমরা পুলিশের লোকেরা দেখতে যতটা
আলোভোলা, ঠিক ততটাও কিন্তু নই।’
নিচুস্বরে মলি বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না।
ওসব মনে করতে চাইনি আমি।’
‘আমি বুঝি সেটা।’ গলার স্বর পাল্টে গেল তার। ‘বিয়ের আগে আপনার পদবী
ওয়েইনরাইট ছিল। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর আপনাকে যতটা মনে
হয়, আপনার বয়স কিন্তু তার থেকে খানিকটা বেশি। উনিশ শ চল্লিশ সালে, অর্থাৎ যখন এত
কিছু ঘটে, তখন আপনি অ্যাবিভেল স্কুলের টিচার ছিলেন।’
‘না!’
‘ওহ, আপনি টিচার ছিলেন,’ মিসেস ডেভিস।
‘বলেছি তো-না।’
‘যেই ছেলেটা মারা যায়,
সে কোনোরকমে একটা পোস্টকার্ড চুরি করে, তারপর অনেক কষ্টে চিঠি পাঠায় আপনাকে। চিঠিতে
নিজের দয়ালু শিক্ষকের সাহায্য ভিক্ষা করে সে। একটা বাচ্চা কেন স্কুলে আসে না, সেটা
দেখার দায়িত্ব একজন শিক্ষকের কাঁধেই বর্তায়। কিন্তু আপনি খুঁজে দেখেননি ওকে, অবহেলা
করেছিলেন একটা গরীব বাচ্চার আর্তনাদকে।’
‘চুপ করুন,’ গরম হয়ে উঠল মলি।
‘আপনি আমার বোনের সঙ্গে
গুলিয়ে ফেলছেন আমাকে। সে-ই স্কুলের টিচার ছিল। আর সে মোটেও অবহেলা করেনি চিঠিটাকে।
অসুস্থ ছিল বলে কিছু করতে পারেনি, নিউমোনিয়ায় ভুগছিল বেচারি। প্রচণ্ড আবেগী ছিল বলে
খুব ভেঙে পড়ে সে, কিছু করতে না পারার আক্ষেপে দিনরাত হাহুতাশ করত। এত ভয়ানক স্মৃতি
যে, সেটাকে মনে করতেও ভয় হয় আমার। সবকিছু ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন আমার কাছে। সবসময়।’
দুহাতে চোখ ঢেকে ফেলল সে। কিছুক্ষণ পর হাত সরাতেই
দেখল এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে ট্রটার।
আস্তে আস্তে সে বলল, ‘তাহলে ওটা আপনার বোন
ছিল। যাই হোক...,’ কুৎসিত একটা হাসি দিলো সে। ‘...এটা এখন আর কোনো
ব্যাপার নয়, তাই না? আপনার বোন...আমার ভাই...’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে
কিছু একটা বের করে আনলো সে। হাসছে। চোখে মুখে ঝিলিক দিয়ে উঠছে বিকৃত খুশি।
হাতে ধরে রাখা বস্তুটার দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টি
দিলো মলি। বলল, ‘আমি তো জানতাম পুলিশের কাছে রিভলভার থাকে না।’
‘পুলিশের কাছে থাকে না,’ একটু থেমে বলতে লাগল
যুবক। ‘কিন্তু আমি তো কোনো
পুলিশ নই, মিসেস ডেভিস। আমি জিম, জর্জির ভাই। গ্রামের কলবক্স থেকে ফোন করে আমিই সার্জেন্ট
ট্রটার আসার খবর দিই। তাই আমাকে পুলিশ ভেবে নেন আপনি তারপর এখানে এসে বাইরে টেলিফোনের
লাইন কেটে দিই, যাতে পুলিশ স্টেশনে দ্বিতীয়বার কল করতে না পারেন।’
পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে মলির, স্থির দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে সে। রিভলভার এখন সোজা ওর দিকেই তাক করা। কোনো নড়াচড়া নয়, কোনো চিৎকার
নয়, মিসেস ডেভিস। ট্রিগার টানতে খুব বেশি সময় লাগবে না তাহলে।
এখনো হাসি লেগে রয়েছে তার মুখে। চট করে একটা
বাচ্চার হাসি মনে পড়লো মলির, অজান্তেই ভয়ে শিউরে উঠল সে। আর যখন কথা বলার জন্য মুখ
খুলল, তখন যেন দূর থেকে ভেসে আসা কোনো বাচ্চার গলার আওয়াজই মনে হলো।
‘হ্যা,’ বলল সে, ‘আমিই জর্জির ভাই, লংগ্রিজ
ফার্মে মারা গিয়েছিল আমার ভাই। ঐ শয়তান মহিলা সেখানে পাঠিয়েছে আমাদেরকে, আর চাষার
বউটা কুকুরের মতো আচরণ করেছে আমাদের সঙ্গে। অথচ কোনো সাহায্য করোনি তোমরা-তিনটা অসহায়
ছোট্ট বাচ্চা! বড়ো হলে তোমাদের খুন করব বলি আমি, মন থেকেই বলেছিলাম। সেদিন থেকে মাথায়
ঘুরছে। এসব। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। সম্বোধনেও এসেছে পরিবর্তন। আর্মিতে জ্বালিয়ে মেরেছে
আমাকে। ঐ হারামী ডাক্তার এত্ত বেশি প্রশ্ন করত যে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হই। ভয় হতো,
হয়তো আমার কাজে বাধা দেবে তারা। কিন্তু এখন আমি বড়ো হয়েছি, আর বড়োরা যা খুশি তাই
করতে পারে।’
নিজেকে তৈরি করে নিলো মলি। ভাবনা অন্যদিকে সরাও
ওর, নিজেকে বলল সে। ব্যস্ত রাখ ওকে।
‘শোনো, জিম,' বলল সে।
‘এখান থেকে বেঁচে ফিরতে
পারবে না তুমি।’
মুখটা কালো হয়ে গেল তার। কেউ একজন আমার স্কি
লুকিয়ে রেখেছে, খুঁজে পাইনি। পরক্ষণেই হেসে উঠল আবার। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! এটা
তোমার স্বামীর রিভলভার, তার ড্রয়ার থেকে নিয়েছি। সবাই ভাববে সেই মেরেছে তোমাকে। যাক
গে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, সবকিছু দারুণ মজা লাগছে আমার। ‘লন্ডনের মহিলাটা, ওহ,
আমাকে চিনতে পেরে তার মুখের যে কী হাল হয়েছিল। আর আজ সকালের শয়তান বুড়িটার মুখও!’ প্রবল আত্মতৃপ্তিতে
মাথা নাড়তে লাগল সে।
আচমকাই খুব পরিষ্কারভাবে শিসের শব্দ ভেসে এলো।
শিরশিরে ভূতুড়ে অনুভূতিটা ভয়ের স্রোত বয়ে দিলো শিরা-উপশিরায়। কেউ একজন থ্রি ব্লাইন্ড
মাইস-এর সুরে শিস বাজাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য বিব্রত হয়ে পড়লো ট্রটার, কেঁপে উঠল হাতে
ধরা রিভলভার। চিৎকার করে উঠল একটি গলা, ‘নিচু হোন, মিসেস ডেভিস।’
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো মলি। ততক্ষণে দরজার
পাশে থাকা সোফার আড়াল থেকে ট্রটারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মেজর মেটকাফ। বিকট শব্দে
গুলি গিয়ে লাগল প্রয়াত মিস এমোরির মেডিকোর অয়েল
পেইন্টিংয়ে।
খানিকবাদেই হট্টগোলে ভরে উঠল পুরো রুম। দৌড়ে
প্রবেশ করল জাইলস, তার পেছনেই ক্রিস্টোফার ও মিস্টার প্যারাভিসিনি।
ট্রটারকে শক্ত করে চেপে ধরে কথা বলতে লাগলেন
মেজর মেটকাফ। একেকটি বাক্য যেন বিস্ফোরকের মতো প্রভাব বিস্তার করল উপস্থিত সবার ওপর।
‘তোমার খেলার সময়ই এসে
পড়েছি...সোফার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম...শুরু থেকেই জানতাম কোনো পুলিশ নয় সে। কারণ
আমি একজন পুলিশ অফিসার, ইন্সপেক্টর ট্যানার। মেজর মেটকাফের সঙ্গে কথা বলে তার জায়গায়
আমি আসি। কেউ একজনের স্পটে থাকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তাহলে,
বাবুটা...,’ নিরীহ ট্রটারের উদ্দেশ্যে বলল সে। ‘তুমি এবার আমার সঙ্গে
আসো। একদম ঠিক হয়ে যাবে তুমি, আমরা দেখাশোনা করব তোমার।’
বাচ্চাদের মতো কাতর কণ্ঠে বলল তামাটে চেহারার
লোকটা, ‘জর্জি রাগ করবে না তো
আমার ওপর?’
‘না,’ মেজর মেটকাফ বললেন।
‘একটুও রাগ করবে না জর্জি।’
জাইলসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বিড়বিড়
করে তিনি বললেন, ‘ঘৃণায় একেবারে পাগল হয়ে গেছে। বেচারা!’
একসঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গেল তারা। ক্রিস্টোফারের
রেনের বাহু স্পর্শ করল মিস্টার প্যারাভিসিনি। বলল, তুমিও আমার সঙ্গে আসো, বন্ধু।
জাইলস ও মলিকে একা রেখে বেরিয়ে গেল সবাই। কয়েকমুহূর্ত
একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো তারা। পরক্ষণেই লিপ্ত হলো মধুর আলিঙ্গনে।
‘সোনা,’ জাইলস বলল, ‘ও আঘাত করেনি তো তোমাকে?’
‘না, না, আমি একদম ঠিক
আছি, জাইলস। একেবারে গুলিয়ে ফেলেছি সব। আমি তো আরও তোমাকে খুনি...ওহ, জাইলস, কেন লন্ডন
গিয়েছিলে সেদিন?’
‘কাল আমাদের অ্যানিভার্সারি।
তোমার জন্য একটা প্রেজেন্ট আনতে গিয়েছিলাম। আমি চাইনি আগে থেকেই ব্যাপারটা জেনে যাও
তুমি।’
‘হায় ঈশ্বর! আমিও তো
তোমার জন্য প্রেজেন্ট আনতে গিয়েছি। লন্ডনে।’
‘তোমাকে এ উন্মাদটার
সঙ্গে দেখে হিংসা হচ্ছিল। পাগল হয়ে গেছি, ক্ষমা করো আমায়।’
দরজা খুলে গেল আবারও। হাসিহাসি মুখ করে যথারীতি
লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে পা রাখল মিস্টার প্যারাভিসিনি।
‘ওহো, পুনর্মিলনে বাগড়া
দিলাম দেখছি। কী সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু এবার যে বিদায় বলতে হবে আমাকে। একটা পুলিশ জিপ
এসেছে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে বলব। মলির কানের কাছে ঝুঁকে এলো সে। তারপর
রহস্যময় ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল, ‘শীঘ্রই হয়তো কিছু ঝামেলায়
পড়ব আমি। তবে সামলে নিতে পারব, আত্মবিশ্বাস আছে। যদি কখনো রাজহাঁস, টার্কি, ফয়ে গ্রাসের
টিন, হ্যাম, নাইলন স্টকিং লাগে টাগে-তাহলে বলবে কিন্তু। ঠিক আছে? আমার পক্ষ থেকে পুরস্কার
হবে সেটা। মিস্টার ডেভিস,
হলের টেবিলে আছে আমার চেক।’
মলির হাতে চুমু খেয়ে দরজা পেরিয়ে গেল সে।
‘নাইলন?’ অনেকটা আপন মনে বিড়বিড়
করে বলল মলি, ‘ফয়ে গ্রাস? মিস্টার প্যারাভিসিনি আসলে কে? সান্টা ক্লজ?’
‘আমার তো কালোবাজারী
বলে সন্দেহ হচ্ছে,’ বলল জাইলস।
ক্রিস্টোফার রেন এসে দাঁড়ালো দরজায়। অভিব্যক্তিতে
দ্বিধা ফুটে উঠেছে তার। ‘ইয়ে, মানে,’ বলল সে, ‘আশা করি বিরক্ত করছি
না। রান্নাঘর থেকে বেশ পোড়া গন্ধ আসছে। আমি কি গিয়ে দেখব?’
থমথমে নিরবতা নেমে এলো প্রথমে, বোকার মতো দৃষ্টি
বিনিময় হলো সবার মাঝে। পরক্ষণেই, ‘সর্বনাশ! আমার পাই!’ বলে রুম থেকে ছুটে
বেরিয়ে গেল মলি।
- - - - - - - - শেষ - - - - - - -
বাকি তিনটি পর্বের লিঙ্কঃ
No comments:
Post a Comment