মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, March 4, 2022

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation - 3

বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie।

বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি,আগাথা ক্রিস্টি রচনাসমগ্র pdf, আগাথা ক্রিস্টি সমগ্র, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie


২য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – বাংলা অনুবাদ - Bangla

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ আগাথা ক্রিস্টি বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 3

৩য় পর্ব শুরু 

অধ্যায় ৪

রান্নাঘরে মলির সঙ্গে দেখা করল সার্জেন্ট ট্রটার। একটু লাইব্রেরিতে আসলে কৃতজ্ঞ থাকব, মিসেস ডেভিস। বাকিদের সঙ্গে কথা বলব আমি। মিস্টার ডেভিস সবকিছু ঠিক করতে গেছেন।

সমস্যা নেই, আলুটা কেটে নিয়েই আসছি আমি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ভাবি, স্যার ওয়াল্টার র‍্যালে যদি এই জঘন্য জিনিসটা কখনো আবিষ্কারই না করতেন!  

নিরবতা বজায় রাখলো সার্জেন্ট ট্রটার। মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট অসম্মতি ফুটে উঠেছে তার। পরিস্থিতি গম্ভীর বুঝতে পেরে দ্রুত কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে মলি বলল, না মানে, আমি আসলে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। কেমন অদ্ভুত।

মোটেও অদ্ভুত কিছু নয়, মিসেস ডেভিস, খুব সাধারণ একটা বিষয়।

এবার প্রসঙ্গ পাল্টে কৌতূহলী হয়ে উঠল মলি লোকটার বর্ণনা জানেন?

মাঝারি উচ্চতা, পাতলা গড়ন, লম্বা ওভারকোট ও ধূসর টুপি পরা, এবং গলার স্বর ফিসফিসে। আর হ্যাঁ, মুখটা মাফলার দিয়ে ঢাকা ছিল। যার মানে, যে কেউই হতে পারে। একটু বিরতি নিয়ে যোগ করল সে, আপনাদের হল রুমে তিনটা কালো ওভারকোট ও ধূসর টুপি ঝোলানো, মিসেস ডেভিস।

আমার মনে হয় না এদের মধ্যে কেউ লন্ডন থেকে এসেছে।  

তাই নাকি, মিসেস ডেভিস? খুব ধীর লয়ে ড্রেসারের দিকে এগিয়ে গেল সার্জেন্ট ট্রটার, একটা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ালো সে। উনিশ ফেব্রুয়ারির দ্য ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, মানে দুদিন আগের পত্রিকা। কেউ না কেউ তো এটা এনেছেই, মিসেস ডেভিস।  

আজব তো, স্থির দৃষ্টি দিলো মলি। ভ্রু কুঁচকে স্মৃতি হাতড়ে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা চালালো। এটা কোত্থেকে এলো আবার?

সবসময় শুধু চোখের দেখায় মানুষকে বিশ্বাস করা উচিত নয়, মিসেস ডেভিস। আপনার বাড়িতে কারা থাকছে, তাদের ব্যাপারে একেবারে কিছুই জানেন না দেখছি। বলল সে, মনে হচ্ছে, গেস্টহাউজ বিজনেসেও আপনি আর মিস্টার ডেভিস একেবারে নতুন। তাই না?

হ্যা, স্বীকার করে নিলো মলি। আচমকাই নিজেকে একেবারে ছোটো বাচ্চার মতো গর্দভ আর বোকার হদ্দ মনে হলো ওর।  

সম্ভবত, বিয়ে করেছেন যে-সেখানেও খুব বেশিদিন হয়নি।

মাত্র একবছর, গাল রক্তিম হয়ে উঠল মলির। একেবারে হঠাৎ করেই।

লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট, সহানুভূতির ভঙ্গিতে বলল সার্জেন্ট ট্রটার, প্রথম দর্শনেই প্রণয়।

মলির মনে হচ্ছিল, লোকটাকে বোঝাতে ব্যর্থ সে। হ্যা, বলেই কয়েকগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে যোগ করল, মাত্র দুসপ্তাহের মতো পরিচয় ছিল আমাদের।  

মুহূর্তেই ফিকে হয়ে যাওয়া অতীতের হাজারটা রঙিন স্মৃতি ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে। কোনো সন্দেহ নেই, একজন অপরজনকে জানত খুব ভালো করেই। যেন পরিচয় ছিল দীর্ঘদিনের। হতাশা আর যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া একটা পৃথিবীতে অলৌকিকভাবেই পরস্পরের হাত ধরেছিল তারা। অজান্তেই ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠল মলির।

পরক্ষণেই সার্জেন্ট ট্রটারের অসংলগ্ন দৃষ্টির কথা মনে পড়তেই বাস্তবে ফিরে এলো সে।

আপনার স্বামী তো এই জায়গাগুলোর কোনোটা থেকে আসেননি, তাই না?

না, অস্ফুট স্বরে জবাব দিলো মলি। ও লিঙ্কনশায়ারে থাকত।  

জাইলসের শৈশব কিংবা বেড়ে ওটা নিয়ে বলতে গেলে কিছুই জানা নেই ওর। শুধু এটুকু জানে যে, বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে জাইলস। আর বরাবরই নিজের শৈশবের দিনগুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না সে। মলির ধারণা, ছোটবেলায় খুব কষ্টে ছিল জাইলস।

আমি যদি ভুল না বলি, এরকম একটা জায়গার দেখাশোনা কিংবা গেস্টহাউজ চালানোর মতো যথেষ্ট বয়স হয়নি আপনাদের। সার্জেন্ট ট্রটার বলল।

আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার বয়স বাইশ চলছে, আর—’  

দরজা খুলে যেতেই কথার মাঝখানেই থেমে গেল সে। খোলা দরজা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ভেতরে পা রাখল জাইলস। সবকিছু ঠিকঠাক, সবাইকে টুকটাক কিছু কথা বলেছি আমি, বলল সে। সার্জেন্ট, আশা করি কিছু হবে না এতে।

না না, সময় বাঁচিয়ে দিয়েছেন বরং, ট্রটার বলল। আপনি তৈরি তো, মিসেস ডেভিস?

লাইব্রেরির দরজায় সার্জেন্ট ট্রটারের পা পড়তে না পড়তেই একসূঙ্গে চারজন কথা বলে উঠল।

সবথেকে উঁচু ও খনখনে গলায় চিৎকার করল ক্রিস্টোফার রেন। হড়বড় করে শুধু এটাই বলতে লাগল, সবকিছু এত বেশি রোমাঞ্চকর যে, আজ রাতে আমি একফোঁটাও ঘুমাবো না। আর প্লিজ প্লিজ, সব কিছু খুলে বলবেন আমাদেরকে?

অন্যদিকে মেঘের গর্জনের মতো গুজগজ করতে লাগলেন মিসেস বয়েল। একেবারে যন্ত্রণা-যত্তসব অপদার্থের দল-পুলিশের কোনো কাজ নেই মনে হচ্ছে। আজকাল গ্রামের মধ্যেও খুনি খুঁজে বেড়ায়।  

মিস্টার প্যারাভিসিনি মূলত তার হাত নেড়েই কথা বলেছে। মুখের চাইতে বেশি বাকপটু মনে হলো তার হাতকেই। কালেভদ্রে মুখ দিয়ে যে দুয়েকটা শব্দ বের হলো, সেটাও ঢাকা পড়ে গেল মিসেস বয়েলের চেঁচামেচির নিচে। মেজর মেটকাফ যেন একেবারে সংযত রেখেছেন নিজেকে। কেবল ছাড়াছাড়াভাবে কিছু একটা বললেও ততটা জোর দিলেন না মনে হলো। হুটহাট কেবল গর্জে উঠে আসল কথাটা জানতে চাইলেন তিনি।

সবকিছু দেখে কয়েক মুহূর্ত ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করল ট্রটার। তারপর ধীরে ধীরে কর্তৃত্বপূর্ণভাবে একটা হাত উঁচু করতেই অদ্ভুতভাবেই পিনপতন নিরবতা নেমে এলো সবার মাঝে।

ধন্যবাদ, বলল সে। মিস্টার ডেভিস এতক্ষণে আমার এখানে আসার কারণটা বলেছেন আপনাদেরকে।  আমি শুধু একটা কথাই জানতে চাই-শুধু একটা কথাই, এবং সেটা অবশ্যই খুব দ্রুত। আপনাদের মধ্যে কার লংগ্রিজ ফার্ম কেসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?  

স্থির পানিতে আচমকা ঢিল পড়লে যেমন আন্দোলিত হয়, তেমনি ঘরের সবার মাঝেই মনে হলো মুহুর্তেই আলোড়ন বয়ে গেল। অভিব্যক্তিহীন চারজোড়া চোখ শূন্য দৃষ্টি দিলো সার্জেন্ট ট্রটারের দিকে। চোখেমুখে একইসঙ্গে খেলে যাওয়া উত্তেজনা, রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা, জিজ্ঞাসা এমনভাবে মুছে গেল যে-মনে হচ্ছিল, কালো স্লেট থেকে ভেজা স্পঞ্জ দিয়ে চকের দাগ মুছে দেওয়া হয়েছে যেন।

আবারও কথা বলে উঠল সার্জেন্ট ট্রটার, আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করুন। আপনাদের মধ্যে কেউ একজন খুব বিপদের মধ্যে আছেন। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে জানতে হবে, তিনি কোন জন।

এবারও কারো মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হলো না। এমনকি নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল যেন। এমন ঠান্ডা অভ্যর্থনায় নিজের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল সার্জেন্ট ট্রটার। এবার খানিকটা রাগের সঙ্গেই বলল, বেশ, একজন একজন করে প্রশ্ন করব আমি। মিস্টার প্যারাভিসিনি?

আবছা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল প্যারাভিসিনির ঠোটে, প্রতিবাদী ভঙ্গিতে হাত তুলল সে। দেশের এই প্রান্তে আমি তো একেবারে নতুন, ইন্সপেক্টর। গত কয়েক বছরেও কী হয়েছে না হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। কিচ্ছু না!

একমুহূর্তও অপেক্ষা করল না ট্রটার। চট করে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো মিসেস বয়েলের দিকে। মিসেস বয়েল?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না-সত্যিই বুঝতে পারছি না, এরকম একটা আপদের সঙ্গে আমার কাজ কী?

মিস্টার রেন?

কর্কশ কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠল মিস্টার রেন। ওই সময় একেবারে বাচ্চা ছিলাম আমি, এমনকি কিছু শুনেছি বলেও তো মনে পড়ছে না।

মেজর মেটকাফ?

চট করে জবাব দিলেন মেজর মেটকাফ, এডিনবার্গে থাকার সময় পত্রিকায় পড়েছিলাম কেবল।

তাহলে আর কিছু বলার নেই আপনাদের?  

আবারও সেই নিস্তব্ধতা। তীব্র রাগে ফুঁসতে ফুসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্রটার। যদি আপনাদের মধ্যে কেউ খুন হয়, বলল সে, তাহলে তার জন্য আপনারা নিজেরাই দায়ী হবেন।

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বন্ধুগণ, ক্রিস্টোফার বলল। কী চমৎকার নাটক হলো! একটু থেমে আবার বলল, লোকটা খুব হ্যান্ডসাম, তাই না? যাই হোক, পুলিশদের খুব সম্মান করি আমি, বেশ শক্ত আর চালাক তারা। আর এইমাত্র যা হলো, ওহ, এক কথায় থ্রিলিং! থ্রি ব্লাইন্ড মাইস, সুরটা কেমন যেন?

নরম সুরে শিস বাজাতে শুরু করতেই আর্তনাদ করে উঠল মলি। ওহ, থামুন!

চট করে মলির দিকে ফিরে হেসে উঠল সে। কিন্তু, ডার্লিং, বলল সে, এটা তো আমার সিগনেচার টিউন। কোনো খুনির কাছ থেকে ধার নিইনি, তাই সবকিছু হাস্যকর লাগছে আমার কাছে।  

যত্তসব নাটক! মিসেস বয়েল বললেন। এসব হাবিজাবি একটুও বিশ্বাস করি না আমি।

ঠোটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ক্রিস্টোফার, দৃষ্টিতে শয়তানী একটা ভাব ফুটে উঠেছে তার। দাঁড়ান দাঁড়ান, মিসেস বয়েল, গলা খাঁদে নামিয়ে বলল সে, যতক্ষণ না আমি চুপিচুপি আপনার পেছনে দাঁড়াই, এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনার গলা টিপে ধরি।

মলি আঁতকে উঠতেই রেগে গেল জাইলস। আমার স্ত্রীকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন আপনি। যাই হোক, এখন জোক করার সময় না।

মোটেও জোক নয় এটা, মেজর মেটকাফ বললেন।

অবশ্যই জোক, ক্রিস্টোফার বলল। অ্যা ম্যাডম্যানস জোক-পাগলের কৌতুক, আর ঠিক এই কারণেই খুব ভয়ংকর।  

থম মেরে থাকা সবার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল সে।

আপনাদের মুখগুলো যদি দেখতে পারতেন!

মুখে হাসি নিয়েই বেরিয়ে গেল সে। সবার আগে ধাক্কা সামলে উঠলেন মিসেস বয়েল। একেবারে অভদ্র আর মাথা খারাপ ছেলে, তিনি বললেন। সম্ভবত একটা কনশিয়েনশাস অবজেক্টর।  

লোকটা আমাকে বলেছে, এয়ার রেইডের সময় উদ্ধারের আগ পর্যন্ত নাকি পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল সে, মেজর মেটকাফ বললেন। হয়তো সেই কারণেই এরকম আচরণ করে।

অপরাধ ঢাকতে অজুহাতের অভাব হয় না মানুষের, তীব্রভাবে বললেন মিসেস বয়েল। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, যুদ্ধের সময় যতটা সম্ভব অনেককে সাহায্য করেছি। অভিজ্ঞতা তো আর কম হয়নি। তাই নার্ভ এখনো যথেষ্ট শক্ত আছে, এত সহজে ভয় পাই না।  

হয়তো তার এই অবস্থার কারণে আপনি নিজেও দায়ী, মিসেস বয়েল। মেজর মেটকাফ বললেন।

কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?

শান্ত ভঙ্গিতে মুখ খুললেন মেজর মেটকাফ। উনিশশ চল্লিশ সালে এই এলাকার সৈন্য ও শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্বে কিন্তু আপনিই ছিলেন, মিসেস বয়েল। মলির দিকে ফিরলে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। বিলেটিং অফিসার, তাই না?

রাগে মুখের পেশি শক্ত হয়ে গেল মিসেস বয়েলের। খেকিয়ে উঠলেন তিনি, তাতে কী হয়েছে?

আবারও স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন মেজর মেটকাফ। ঐ তিন বাচ্চাকে লংগিজ ফার্মে কিন্তু আপনিই পাঠিয়েছিলেন, আর তাই সবকিছুর জন্য দায়ী আপনি নিজেই।  

কী হয়েছে না হয়েছে তার জন্য আমি সত্যিই নিজের কোনো দোষ দেখছি না, মেজর মেটকাফ। ফার্মের লোকজনকে দেখে খুবই ভালো আর ছেলেমেয়ের জন্য সবথেকে বেশি পাগল মনে হয়েছিল। কোনোভাবেই নিজেকে দায়ী করতে পারছি না আমি- না তো আমি দায়ী... থেমে গেলেন তিনি। এবার তীক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল জাইলস, এই কথাগুলো সার্জেন্ট ট্রটারকে বলেননি কেন?

পুলিশকে মাথা ঘামাতে হবে না, খিটমিট করে উঠলেন মিসেস বয়েল। আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে জানি।

আপনি বরং সাবধানে থাকুন, শান্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন মেজর মেটকাফ।

হা হা, বিড়বিড় করে বলল মলি, আমার মনে পড়ছে, আপনিই বিলেটিং অফিসার ছিলেন।

মলি, তুমি জানতে এসব? চোয়াল ঝুলে পড়লো জাইলসের।

জাইলসের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মিসেস বয়েলের দিকেই তাকিয়ে রইলো মলি। মাঠের ওপরের বড়ো বাড়িটাতে থাকতেন, তাই না?

বিশেষ প্রয়োজন দখল করা, মিসেস বয়েল বললেন। আর একেবারে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা বাড়ি। তারপর আরও জেদের সঙ্গে যোগ করলেন, বিধ্বস্ত, জঘন্য!

খুব আস্তে আস্তে হাসতে শুরু করল মিস্টার প্যারাভিসিনি। মনে হচ্ছিল, হাসি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। তারপর চট করে মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে পাগলের মতো হাসতে শুরু করুর অনিয়ন্ত্রিত ভাবে। মাফ করবেন, বলল সে। সবকিছু কিন্তু মজাই লাগছে আমার কাছে। মানে, এতকিছুর পরও নিজেকে উপভোগ করছি আমি।

পুনরায় আগমন ঘটলো সার্জেন্ট ট্রটারের, ভেতরে পা রেখেই প্যারাভিসিনির দিকে কড়া দৃষ্টি দিলো সে। আমি খুব খুশি যে... কিড়মিড় করে বলল সে, ...সবার কাছে এটাকে খুব মজার বিষয় বলে মনে হচ্ছে।

ক্ষমা চাচ্ছি, ইন্সপেক্টর, সত্যিই দুঃখিত। আপনার ভয়ংকর সতর্কতার প্রভাবটা একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছি আমি।

কাঁধ নাচালো সার্জেন্ট ট্রটার। আমার কাজ আমি যতটা সম্ভব ঠিকঠাক করেছি, বলল সে। আর আমি কোনো ইন্সপেক্টর নই, সাধারণ একজন সার্জেন্ট। একটা ফোন করতে চাই, মিসেস ডেভিস।

ধিক্কার জানাই নিজেকে, প্যারাভিসিনি বলল। এই নাকে খত দিচ্ছি।

নাকে খত দেওয়া তো দূরের কথা, মাথাটাও নিচু করল না সে। বরং স্বভাবসুলভ দৃঢ় ও ঋজু ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল চঞ্চল পা ফেলে, যেটা মলি আগেও লক্ষ্য করেছে।

আজব একটা মানুষ, বলল জাইলস। অপরাধীর মতো, ট্রটার বলল। একটুও বিশ্বাস নেই।  

আচ্ছা, মুখ খুলল মলি। আপনি তাহলে উনাকে সন্দেহ- কিন্তু উনার তো আবার বয়স বেশি কিংবা সেরকম মনে হয়। আসলে মেকআপ করে চেহারা লুকিয়ে রাখেন উনি, একটু বেশিই করেন সেটা। কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি এখনো যুবকদের মতো। সম্ভবত, নিজেকে বয়স্ক দেখানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু কেন? সার্জেন্ট ট্রটার, আপনি কি মনে করছেন...

মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিলো সার্জেন্ট ট্রটার। আমি নিশ্চিত না হয়ে খামোখা কোনো গালগল্প বানাচ্ছি না, মিসেস ডেভিস। বলল সে, সুপারিন্টেন্ডেন্ট হোগবেনকে রিপোর্ট করতে হবে।

কথাটা বলেই টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল সে।। সেটা আর হচ্ছে না, মলি বলল। টেলিফোন লাইন নষ্ট হয়ে গেছে।  

কী? চট করে ঘুরে দাঁড়ালো সে। কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টি দিয়ে কী যেন মেপে নিলো, তারপর মুখ খুলতেই স্পষ্ট আশঙ্কা প্রতিধ্বনিত হলো গলার স্বরে। নষ্ট? কখন থেকে?  

ঠিক আপনি আসার একটু আগেই কল করতে গিয়েছিলেন মেজর মেটকাফ, কিন্তু তখন এটাকে নষ্ট দেখেন উনি।  

কিন্তু তার আগে তো এটা ঠিকই ছিল, সুপারিন্টেন্ডেন্ট হোগবেনের মেসেজও পেয়েছিলেন আপনি। তাই না?

হ্যা। মনে হচ্ছে ঠিক তার পরপরই বরফের নিচে পড়ে গেছে লাইন।  

কিন্তু ট্রটারের অভিব্যক্তি বলছে অন্যকথা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে.... বলল সে। লাইনটা কেটে দেওয়া হয়েছে।

দৃষ্টি বিস্ফোরিত হলো মলির। কী?

নিশ্চিত হতে হবে আমাকে। কথাটা বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জাইলসও অনুসরণ করল তাকে।

চিৎকার করে উঠল মলি, সর্বনাশ! দুপুর হয়ে এলো, রান্না না বসালে সবাইকে উপোস করতে হবে।

গটগট পা ফেলে মলি বেরিয়ে যেতেই আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন মিসেস বয়েল। অপদার্থ মেয়ে কোথাকার! উঁহু, এরকম জায়গায় থেকে তো সপ্তাহে সাত গিনি করে দেবো না আমি। কখনো না!

----------------------

উবু হয়ে টেলিফোনের তার পরীক্ষা করতে লাগল সার্জেন্ট ট্রটার। এক্সটেনশন আছে নাকি? জাইলসকে জিজ্ঞেস করল সে।।

হ্যাঁ, ওপরতলায় আমাদের বেডরুমে। গিয়ে দেখে আসব?

যদি কষ্ট না হয়।

জাইলস দ্রুত ওপরতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে জানালা খুলে বরফ পরিষ্কার করায় মন দিলো ট্রটার।

মিস্টার প্যারাভিসিনি তখন বিশালাকার ড্রয়িং রুমে। অলস ভঙ্গিতে গ্র্যান্ড পিয়ানোর দিকে এগিয়ে গিয়ে ঢাকনা খুলল সে। তারপর টুলের ওপর বসে এক আঙুলে ধীর লয়ে বাজাতে লাগল একটি সুর।

 

থ্রি ব্লাইন্ড মাইস,

সি হাউ দে রান...

 

ক্রিস্টোফার রেন তখন নিজের ঘরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে। সেই সঙ্গে জোরে জোরে একই গানের শিস বাজিয়ে চলেছে। কয়েক মুহূর্ত এভাবে ইতস্তত ঘোরাঘুরির পর আচমকাই ক্ষীণ হয়ে এলো শিসের শব্দ। দেখতে দেখতে পুরোপুরি মিলিয়েও গেল সেটা। এবার থপ করে বিছানায় বসে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল সে। বিড়বিড় করতে লাগল বাচ্চাদের মতো, পারব না আমি।

পরক্ষণেই অভিব্যক্তি পাল্টে গেল তার চটকরে দাঁড়িয়ে টানটান করল শরীর। কিন্তু পারতে হবে, বলল সে। এরকম পরিস্থিতিতে পড়তেই হতো আমাকে।

--------------------

নিজেদের রুমে এসে টেলিফোনের পাশে দাঁড়ালো জাইলস। চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে টেলিফোনের কিনারায় খানিকটা ঝুঁকতেই মলির একটা গ্লাভস চোখে পড়ল। কী মনে করে যেন ওটাকে হাতে নিলো সে। ঠিক তখনই ভেতর থেকে গোলাপী একটা বাসের টিকেট বের হয়ে এলো। আর ধরার আগেই বাতাসে পাক খেতে খেতে ক্রমশ নিচে বরফে ঢাকা আঙিনায় গিয়ে পড়লো ওটা। একদৃষ্টিতে পতনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বদলে গেল তার মুখের অভিব্যক্তি। খুব ধীরে ধীরে কেউ একজন এগিয়ে আসছে।

দরজার দিকে। হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ঘোরের মধ্যে আছে যেন। অলসভঙ্গিতে দরজা খুলে করিডরের দিকে স্থিরদৃষ্টি দিলো আগন্তুক, ঠিক যেখান থেকে ওপরতলার সিঁড়ি শুরু হয়েছে। ঘাড়ের লোম অজান্তেই সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল জাইলসের। কারণ সম্পূর্ণ অচেনা আর অন্যরকম লাগছে আগন্তুককে।

-------------------

আলু কাটা শেষ হলে সেগুলো পটে নিয়ে দ্রুত চুলায় বসিয়ে দিলো মলি। এর মাঝেই চোখের কোণা দিয়ে তাকালো ওভেনের দিকে-সবকিছু ঠিকঠাক। একদম পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছে।

রান্নাঘরের টেবিলের ওপর দুদিন আগের ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের একটা কপি পড়ে আছে। ওটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। রীতিমতো চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে মস্তিষ্কে। শুধু একবার যদি মনে করতে পারে

আচমকাই চোখের সামনে চলে এলো দুহাত। না আর্তনাদ করে উঠল সে। ওহ না না!  

তারপর খুব আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে আনলে চোখের সামনে থেকে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলো রান্নাঘরের চারদিকে। মনে হলো যেন, সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। আবিষ্ট করে রাখা উষ্ণতা আর আরামদায়ক অনুভূতি, সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে থাকা রান্নার সুঘ্রাণ সবকিছু বড় অচেনা ঠেকছে।

ওহ! না, অস্ফুট স্বরে আবারও বলল সে।  

ঘুমের ঘোরে হাঁটার মতো খুব ধীর লয়ে এগিয়ে গেল হলরুমের দরজার দিকে। যন্ত্রের মতো হাত দিয়ে খুলল সেটা, তারপর শূন্য দৃষ্টি দিলো খা খা করতে থাকা হলরুমে। মৃদু শিসের শব্দ ছাড়া কবরের নিস্তব্ধতা ঝুলে আছে সম্পূর্ণ বাড়ির বদ্ধ বাতাসে।

এই সুরটা...

আঁতকে উঠে ভয়ে প্রায় জমে গেল মলি, শক্ত হয়ে এলো শরীরের প্রতিটি অঙ্গ। দুয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আবারও পরিচিত রান্নাঘরের দিকে তাকালো সে। সবকিছুই সাজানো-গোছানো, নির্দিষ্ট ছন্দে ঠিকঠাকভাবেই

চলছে সব। আবারও রান্নাঘরের দরজার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

-------------

বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পেছনের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন মেজর মেটকাফ। হল রুমে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর যতটা সাবধানে সিঁড়ির নিচের বড়ো কাপবোর্ডটা খুলে উঁকি দিলেন ভেতরে। সবকিছু একেবারে চুপচাপ, আশেপাশেও নেই কেউ। তিনি যা করতে যাচ্ছেন, তার জন্য একদম মোক্ষম সময়...

---------------

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রেডিওর নব ঘোরালেন মিসেস বয়েল, লাইব্রেরিতে বসে আছেন তিনি। একেবারে প্রথমেই ভেসে এলো নার্সারি রাইমের উৎপত্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কিত আলোচনার শব্দ। আলোচনা এখন মাঝামাঝি অবস্থায়। এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। অধৈর্য্য ভঙ্গিতে ঘোরাতে লাগলেন তিনি। রেডিও থেকে ভেসে আসা একটা মার্জিতুকণ্ঠ এবার তাঁকে জানালো, ভয় হচ্ছে মানুষের সবথেকে আদিম অনুষ্ঠিত বিষয় আর খুব পরিষ্কারভাবেই এটার সাইকোলজি বুঝতে হবে আমাদেরকে। নিজেকে একটি রুমে সম্পূর্ণ একা অবস্থায় কল্পনা করুন। ঠিক তখনই খুব আস্তে আস্তে খুলে গেল। আপনার পেছনের একটি দরজা...।  

সত্যি সত্যিই খুলে গেল একটি দরজা।

অজান্তেই জান্তব গোঙানি বেরিয়ে এলো মিসেস বয়েলের গলা থেকে, এক পাক খেয়ে ঘুরে গেলেন তীক্ষ্ণভাবে।

ওহ! আপনি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন তিনি। কী সব আজেবাজে প্রোগ্রাম চালিয়ে রেখেছে, শোনার মতো আর কিছু পেলামও না।

ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, মিসেস বয়েল।

নাক সিঁটকালেন মিসেস বয়েল। এছাড়া আর কীই বা করব এখানে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। হাত-পা গুটিয়ে বাড়ির মধ্যে বসে থাকবে, তাও যেখানে হয়তো কোনো খুনি-না না, ওসব গল্পটল্প একটুও বিশ্বাস করি না আমি।

একটুও না, মিসেস বয়েল?

কেন...কী বলতে চান আপনি...

রেইনকোটের বেল্টটা এত দ্রুত তাঁর গলা পেঁচিয়ে ধরল যে, মুহূর্তেই অনুভূতির উর্ধ্বে চলে গেলেন তিনি। বুঝতেই পারলেন না তার প্রশ্নের জবাবে বেল্টের কী দরকার ছিল। রেডিওর শব্দ ততক্ষণে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বক্তা এখন রীতিমতো চিৎকার করে আলোচনা করছে ভয়ের মনস্তত্ব। গমগম করছে বদ্ধ রুম। এদিকে শব্দের মাঝেই ক্রমশ দ্রবীভূত হতে লাগল মিসেস বয়েলের ছটফটানির শব্দ। তারপর থেমে গেল সব, শব্দের মাঝে ঠাই ঝুলে রইলো ভয়ংকর নিস্তব্ধতা।

এসব ব্যাপারে খুনি বেশ পারদর্শী।

 

অধ্যায় ৫

 

রান্নাঘরে জড়ো হলো সবাই। টগবগ করে ফুটছে গ্যাস কুকারে বসানো আলুর তরকারি। ওভেনে থাকা স্টিক ও কিডনি পাইয়ের ঘ্রাণ মনে হচ্ছে, এই প্রথমবার এত তীব্র হয়ে নাকে ধাক্কা মারছে। চারজোড়া চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একে অপরের দিকে। পঞ্চম জন, অর্থাৎ মলি কাঁপতে কাপতে খানিকটা হুইস্কি ঢাললো গলায়। তাও স্বেচ্ছায় নয়, ষষ্ঠ জন অর্থাৎ সার্জেন্ট ট্রটার জোর করছে বলে।।

মুখটা পাথরের মতো শক্ত করে রেখেছে সে। রাগে ফুঁসছে রীতিমতো। মলির আতঙ্কিত চিৎকার শুনে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই, সার্জেন্টের সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে লাইব্রেরিতে।

মিসেস ডেভিস, ঠিক আপনি আসার আগ মুহূর্তেই খুন হয়েছেন তিনি, সার্জেন্ট বলল। আপনি নিশ্চিত, হল রুম দিয়ে আমার সময় কাউকে দেখেননি বা কিছু শোনেননি?   

শিসের শব্দ, অস্ফুট স্বরে বলল মলি। কিন্তু সেটা আরও আগের কথা। আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু মনে হচ্ছেমনে হচ্ছে লাইব্রেরিতে ঢোকার পর খুব আস্তে দরজা বন্ধ করার শব্দ পেয়েছি।  

কোন দরজা?

জানি না।

ভাবুন, মিসেস ডেভিস, মনে করার চেষ্টা করুন। ওপরতলায়-নিচে ডানে, বায়ে?

বলেছি তো, জানি না, চিৎকার করে উঠল মলি। আমি তো শব্দ শুনেছি কিনা সেটাও নিশ্চিত নই।  

ওকে না জ্বালালে হয় না? ঘেঁকিয়ে উঠল জাইলস। দেখছেন না, ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে?  

আমি একটা খুনের তদন্ত করছি, মিস্টার ডেভিস-ক্ষমা করবেন, কমান্ডার ডেভিস।

যোদ্ধার পদবী আমি ব্যবহার করি না, সার্জেন্ট।  

বেশ, বিরতি নিলো সার্জেন্ট, মনে হলো কোনো গোপন ব্যাপার বুঝতে পেরেছে সে। তাহলে, সেই শুরু থেকে বারবার বলছি, আমি একটা খুনের তদন্ত করতে এসেছি। অথচ এখন পর্যন্ত আপনারা একজনও গুরুত্ব দেননি সেটা। হ্যাঁ, মিসেস বয়েলও গুরুত্ব দেননি। কথা গোপন করেছিলেন তিনি, আপনারা সবাই গোপন করেছেন। আর এখন মিসেস বয়েল মৃত। যদি না সবকিছু খুব দ্রুত সামনে আনতে পারি, তবে খুব শীঘ্রই আরেকটি লাশ পড়বে। মাথায় রাখুন এটা।

আরেকটা? যত্তসব, কিন্তু কেন?

কেননা, গম্ভীর স্বরে বলল সার্জেন্ট ট্রটার। অন্ধ ইঁদুরের সংখ্যা তিন।

প্রত্যেকের জন্য একটি মৃত্যু? অবিশ্বাস ফুটে উঠল জাইলসের গলায়। কিন্তু...মানে...তাহলে তো কেসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে।  

হ্যা, সেরকম হওয়ার কথা।

কিন্তু এখানে কেন আরেকটি খুন হবে?

কারণ নোটবুকে শুধু দুইটা ঠিকানা ছিল। সেভেন্টি-ফোর কালভার স্ট্রিটে থাকা সম্ভাব্য একজন ভিক্টিম এখন মৃত। কিন্তু মঙ্কসওয়েল ম্যানরে খুনির বিচরণের জায়গা আরও বড়ো।

বাজে কথা, সার্জেন্ট ট্রটার। লংগ্রিজ ফার্ম কেসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এরকম দুজন ব্যক্তিই এখানে এসে উঠবে-এটা খুবই অস্বাভাবিক একটা কাকতালীয় ঘটনা হবে।

কিছু পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলে মোটেও খুব একটা কাকতালীয় হবে। ভেবে দেখুন, মিস্টার ডেভিস। এবার বাকিদের দিকে ঘুরল সে। মিসেস বয়েলের খুনের সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন, সব শুনেছি। তবুও চেক করে দেখব। মিসেস ডেভিস যখন চিৎকার করেন, তখন তো আপনি নিজের রুমেই ছিলেন। তাই না, মিস্টার রেন?

হা, সার্জেন্ট।

মিস্টার ডেভিস, আপনি ওপরতলায় নিজের রুমে তখন টেলিফোন এক্সটেনশন দেখছিলেন?

হ্যা, বলল জাইলস।

আর মিস্টার প্যারাভিসিনি তখন ড্রয়িং রুমে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। যাই হোক, কেউ কি আপনাকে পিয়ানো বাজাতে শুনেছে, মিস্টার প্যারাভিসিনি?

আমি খুব আস্তে আস্তে বাজাচ্ছিলাম, সার্জেন্ট, প্যারাভিসিনি বলল, শুধু এক আঙুলে।  

সুরটা বলবেন?

থ্রি ব্লাইন্ড মাইস, সার্জেন্ট, হেসে বলল সে। ঠিক একই সুর, যেটা মিস্টার রেন ওপরতলায় শিস বাজাচ্ছিলেন। ঠিক একই সুর, যেটা এখন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।  

জঘন্য সুর, মলি বলল।

টেলিফোন লাইনের কী খবর? জিজ্ঞেস করলেন মেজর, মেটকাফ। একেবারে কেটে দিয়েছে নাকি?

হ্যাঁ, মেজর মেটকাফ। ডাইনিং রুমের জানালার ধারের একটা সেকশন কেটে দিয়েছে। ঠিক মিসেস ডেভিসের চিহকার শোনার আগ মুহূর্তেই ওটা লক্ষ্য করি আমি।

কিন্তু এটা তো হাস্যকর। খুনি জানালা দিয়ে পালানোর কথা ভাবল কীভাবে? খনখনে গলায় প্রশ্ন করলো ক্রিস্টোফার।

জবাব দেওয়ার আগে সাবধানী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকে মেপে নিলো সার্জেন্ট।

হয়তো ওসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়নি সে, বলল সে। অথবা সে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল, আমাদের বিরুদ্ধে খুব চালাকি করে চলতে হবে তাকে। খুনিরা সাধারণত এরকমই হয়। একটু বিরতি নিলো সে। জানেন তো, আমাদের ট্রেনিংয়ের সময় সাইকোলজির কোর্স করানো হয়। একজন সিজোফ্রেনিকের মানসিকতা কিন্তু বেশি ইন্টারেস্টিং।

এসব ভারী কথা না বললেই নয়? বলল জাইলস।

অবশ্যই, মিস্টার ডেভিস। আপাতত শুধু দুটি শব্দ নিয়েই ভাববো আমরা। প্রথমটি হলো খুন, আর অন্যটি ঝুঁকি। তাহলে, মেজর মেটকাফ, এবার আপনার গতিবিধিটা একটু পরিষ্কার করে বলুন। আপনি বলেছেন, আপনি সেলারে ছিলেন...কিন্তু কেন?

এমনি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, মেজর বললেন। সিঁড়ির নিচের কাপবোর্ডে একটা দরজা দেখি আমি। কৌতূহলী হয়ে ওঠা খোলর পর দেখলাম, সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। তাই ওটা বেয়েই নামতে শুরু করলাম। দারুণ সেলার কিন্তু, জাইলসের উদ্দেশ্যে বলল সে। বলা যায়, পুরোনো আমলের আশ্রমের সমাধিগৃহ।

আমরা কোনো অ্যান্টিক রিসার্চ অভিযানে আসিনি, মেজর মেটকাফ। খুনের তদন্ত হচ্ছে এখানে। মিসেস ডেভিস, আমি রান্নাঘরের দরজা খোলা রাখছি, আপনি একটু শুনুন তো। কথাটা বলেই বেরিয়ে গেল সে, খানিকবাদেই দরজা বন্ধ করার মৃদু একটা ক্যাচক্যাচ শব্দ ভেসে এলো। পর মুহূর্তেই পুনরায় আবির্ভূত হলো সে, আপনি কি ঠিক এটাই শুনেছিলেন, মিসেস ডেভিস?

আমি...না...মানে...হ্যাঁ, এরকমই ছিল শব্দটা।  

ওটা সিড়ির নিচের কাপবোর্ডের দরজা। হতে পারে, খুন করার পর হল রুম দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার পায়ের আওয়াজ শোনে খুনি। তারপর কাপবোর্ডের ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

তাহলে তো কাপবোর্ডের ভেতরে তার আঙুলের ছাপ থাকবে, চিৎকার করে উঠল ক্রিস্টোফার।

ইতিমধ্যেই আমার আঙুলের ছাপ আছে সেখানে, নিরসভাবে মেজর মেটকাফ বললেন।

তাই তো, সার্জেন্ট ট্রটার বলল। তারপর নরম সুরে যোগ করল, কিন্তু সেগুলোর জন্য তো উপযুক্ত ব্যাখ্যা আছে আমাদের কাছে।  

দেখুন, সার্জেন্ট, মুখ খুললো জাইলস, এটা ঠিক যে, আপনি এই কেসের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু তবুও এটা আমার বাড়ি, তাই বাড়িতে যারা থাকে তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকারও আমার আছে।  

যেমন?  

বেশ, ভনিতা না করে সরাসরি বলছি। আমার মনে হয় আপাতত আমাদের প্রধান সন্দেহভাজনকেই ধরা উচিত।  

সোজা ক্রিস্টোফার রেনের দিকে তাকালো সে। দৃষ্টি বিস্ফোরিত হলো ক্রিস্টোফার রেনের। এক পা এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ আর উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠল সে। অনবরত কাঁপতে লাগল হিস্টিরিয়া রোগীর মতো। সব মিথ্যা! সব! সবাই মিলে ফাসাচ্ছেন আমাকে। সবসময় আমার বিরুদ্ধে যায় সবাই। আপনারা এখন বন্দী করবেন আমাকে, তাই তো? এটা...এটা নির্যাতন....  

শান্ত হও, ছেলে, মেজর মেটকাফ বললেন।

কিছু হয়নি, ক্রিস, সামনে এগিয়ে এসে রেনের কাঁধে হাত রাখল মলি। কেউ ফাঁসাচ্ছে না তোমাকে। বোঝান ওকে, শেষের কথাটা সার্জেন্ট ট্রটারের উদ্দেশ্যে বলল সে। মুহূর্তের গম্ভীর পরিবেশেই সম্বোধনে পরিবর্তন এলো, পরস্পরের জন্য জন্ম নিলো সহানুভূতি।

আমরা কাউকে বন্দি করি না। সার্জেন্ট ট্রটার বলল।

ওকে বলুন যে, আপনি ওকে গ্রেপ্তার করছেন না।  

কাউকেই গ্রেপ্তার করছি না আমি। তার জন্য প্রমাণ লাগবে, আর আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই- ঠিক এই মুহূর্তে নেই।

চিৎকার করে উঠল জাইলস। পাগল হয়ে গেছো, মলি। আপনি নিজেও, সার্জেন্ট। শুধুমাত্র এই একজনই আছে, যাকে সব দিক থেকে সন্দেহ করা যায়। আর...।  

দাঁড়াও দাঁড়াও-থামো, জাইলস, মাঝখানে বলে উঠল মলি।

ওহ, চুপ কর। সার্জেন্ট ট্রটার, আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

আমি কোথাও যাচ্ছি না এখান থেকে, জাইলস বলল। না, জাইলস। তুমিও যাও, প্লিজ!

বিমর্ষ আর থমথমে হয়ে গেল জাইলসের চেহারা। বলল, মলি, আমার মাথায়ই ধরছে না, তোমার কী হয়েছে। কথাটা বলেই বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে বাকিদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল সে।

তো, কী বলতে চাচ্ছেন, মিসেস ডেভিস?

সার্জেন্ট ট্রটার, আপনি যখন আমাদেরকে লংগ্রিজ ফার্ম কেস সম্পর্কে বলছিলেন, তখন আপনার ধারণা ছিল, এই সবকিছুর জন্য সব থেকে বড় ছেলেটা দায়ী। কিন্তু আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন, তাই না?

একদম ঠিক, মিসেস ডেভিস। কিন্তু আর্মির সাইকিয়াট্রিস্টের রিপোর্ট অনুয়ারী এটা হওয়ার সম্ভাবনাই সবথেকে বেশি।

ওহ, আমি জানি, ঠিক এই কারণেই সবকিছু ক্রিস্টোফার রেনের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না যে, ক্রিস্টোফারের কোনো হাত আছে এসবে। অন্য কোনো সম্ভাবনা তো থাকবেই। ঐ তিন বাচ্চার কোনো সম্পর্ক ছিল না? কোনো আত্মীয়...বাবা-মা কিংবা অন্য কেউ?

ছিল, মা অনেক আগেই মারা গেছে। আর বাবা তো বিদেশে কোথাও কাজ করত।

বেশ, তার ব্যাপারে কী ভাবছেন? এখন কোথায় সে?

সেই ব্যাপারে কিছু জানি না আমরা। গতবছরই অবসরের কাগজপত্র পেয়েছে লোকটা।

ছেলে যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়, তাহলে হয়তো বাবা নিজেও ঠিক তাই।

হতে পারে।

যার মানে দাঁড়াচ্ছে, খুনি মাঝবয়সি কেউ হবে, সার্জেন্ট। মেজর মেটকাফের কথাই ধরুন না। আমি যখন তাকে পুলিশ ফোন করেছে বললাম, তখন প্রচণ্ড বিপর্যস্থ মনে হয়েছিল তাঁকে। সত্যি বলছি, খুব ভয় পেয়েছিলেন তিনি।

শান্তস্বরে মুখ খুলল ট্রটার। বিশ্বাস করুন, মিসেস ডেভিস। সেই শুরু থেকেই সবগুলো সম্ভাবনা মাথায় রেখেছি আমি। জিম নামের ছেলেটা, বাবা, মা-কাউকে বাদ দিইনি। খুনি কোনো পুরুষ না হয়ে মহিলাও তো হতে পারে, পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও এটাও একটা সম্ভাবনা। কোনোটাই বাদ দিচ্ছি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আজকাল কারো ব্যাপারে ঠিকঠাক খবর পাওয়া বেশ কঠিন। আমরা পুলিশরা কত ফাপড়ে পড়েছি, শুনলে অবাক হবেন। যুদ্ধের মধ্যে হুটহাট যে বিয়ে হয়েছে, তাদের বেশিরভাগেরই পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনের কোনো খবর নেওয়ার উপায় নেই। কিছু না জেনেই একজন আরেকজনকে মেনে নিয়েছে। দেখা যায়, একটা মেয়ে আহ্লাদ করে কোনো পাইলট বা আর্মি মেজরকে বিয়ে করল। কিন্তু দুয়েকবছর পরই দেখা যায়, লোকটা আসলে ব্যাংকের ক্লার্ক, নাহয় পালিয়ে আসা কোনো আর্মি, আর বউ-বাচ্চা তো থাকেই। একটি দম নিয়ে আবারও বলতে লাগল সে। আমি জানি আপনার মাথার মধ্যে ঠিক কী ঘুরছে, মিসেস ডেভিস। তবে এই মুহূর্তে আমি শুধু একটা কথাই বলব, আমাদের এই নাস্তানাবুদ অবস্থায় খুব মজা পাচ্ছে খুনি। উপভোগ করছে নিজের অপকর্মও, অন্তত এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত আমি। 

কথাটা বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে।

কয়েক মুহুর্ত পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মলি। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল স্টোভের দিকে। উবু হয়ে ওভেনের দরজা খুলতেই পরিচিত সেই মসলাদার গন্ধটা ধাক্কা মারলো নাকে। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। মনে হলো, হঠাৎ করেই আগের সেই স্বাভাবিক জীবন ফিরে এসেছে যেন। রোজকার গতানুগতিক কাজ, রান্না, গোছগাছ করা-সবকিছু মিলিয়ে একেবারে সাধারণ ও নিস্তরঙ্গ একটি জীবন।

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পুরুষদের জন্য রান্না করে আসছে নারীরা। হোক বাইরে যুদ্ধ-বিগ্রহ, উন্মত্ততা কিংবা বিধ্বস্ত পৃথিবী-রান্নাঘরের চার দেয়ালের মাঝেই যেন সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করে নারী।

রান্নাঘরের দরজা খুলে যাওয়ায় ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে পেছনে তাকালো সে। হাঁপাতে হাঁপাতে ক্রিস্টোফার রেন এসে দাঁড়িয়েছে ভেতরে।

কী বিপদ, বলল সে, সার্জেন্ট ট্রটারের স্কি চুরি হয়েছে।

সার্জেন্টের স্কি? কিন্তু কে চুরি করতে যাবে এসব? আর কেনই বা করবে?

বুঝতে পারছি না, খুনি স্কি চুরি করতে গেল কোন দুঃখে? সার্জেন্ট যদি চলে যেতে পারে তাহলে তো তারই সবার থেকে বেশি খুশি হওয়ার কথা। কোনো মানে হয় না এসবের, তাই না?

ওগুলো সিঁড়ির নিচে কাপবোর্ডে রেখেছে জাইলস।  

কিন্তু এখন আর নেই। ষড়যন্ত্র সব, তাই না? কথাটা বলে এমনভাবে হাসলো যে, মনে হচ্ছিল খুব মজা পেয়েছে যেন। সার্জেন্ট তো রেগে আগুন। বেচারা মেজর মেটকাফের পেছনে লেগেছে এখন। উনি বলছেন, মিসেস বয়েল খুন হওয়ার আগে স্কিগুলো কাপবোর্ডে ছিল কিনা, সেটা লক্ষ্য করেননি। কিন্তু ট্রটার বিশ্বাস করছে না। আর যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর, সামনে ঝুঁকে এসে গলা খাঁদে না নিচে ফেলল রেন। তাহলে বলব, এটা আসলে ট্রটারকে বিপদে ফেলার শুরু।  

আমাদের সবাইকেই বিপদে ফেলছে এটা, বলল মলি।

কিন্তু আমাকে নয়। বরং সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব আর মজার লাগছে আমার কাছে।  

রুঢ়ভাবে বলে উঠল মলি, মিসেস বয়েলের লাশটা প্রথম দেখলে এত মজা লাগত না। এখনো সবকিছু চোখে ভাসছে আমার। ফুলে যাওয়া লাল মুখ...কোটর ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে আসা চোখ...ওহ!  

কেঁপে উঠল সে। খানিকটা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল ক্রিস্টোফার। আমি জানি আমি একটা গাধা। দুঃখিত, অত কিছু ভেবে বলিনি কথাটা।

কান্না দলা পাকিয়ে উঠল মলির গলার কাছে। একটু আগেই সবকিছু ঠিক ছিল। এই রান্না...রান্নাঘর, জড়ানো গলায় এলোমেলোভাবে বলল সে। আর তারপর হঠাৎ করেই ফিরে এলো স্মৃতিটা...একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো।

মলির নত হওয়া মাথার দিকে তাকাতেই কৌতূহল ফুটে উঠল ক্রিস্টোফারের অভিব্যক্তিতে।

আচ্ছা...আচ্ছা, বলল সে, ঠিক আছে। দূরে সরে গেল সে। আমি চলে যাচ্ছি বরং, আর বিরক্ত করব না তোমাকে।  

চিৎকার করে উঠল মলি, না, যেও না।

ততক্ষণে দরজার হাতল স্পর্শ করেছে ক্রিস্টোফার। চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলো ওর। কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে আবারও ফিরে এলো ওর কাছে। সত্যিই?

কী সত্যি?

সত্যিই চাইছো না যে, আমি চলে যাই?

বলেছি তো, যেও না। একা হতে চাই না আমি, ভয় হয় খুব।  

কিছু না বলে চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে বসে পড়লো ক্রিস্টোফার। ওভেন থেকে পাই নিয়ে একটা উঁচু তাকে রাখল মলি। তারপর ফিরে এসে যোগ দিলো ক্রিস্টোফারের সঙ্গে।

ইন্টারেস্টিং, নিচু গলায় বলল সে।

কী?

এই যে, আমার সঙ্গে একা থাকতে ভয় করছে না তোমার।

দুদিকে মাথা ঝাঁকালো মলি, না, পাচ্ছি না।

কিন্তু কেন, মলি?

জানি না আমি, বলল মলি। সত্যিই জানি না।

আমারই খুনি হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি।  

না, বলল মলি। অন্য সম্ভাবনাও আছে। আর সেই ব্যাপারেই সার্জেন্ট ট্রটারের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমি।  

তিনি কি একমত হয়েছেন তোমার সঙ্গে?

অমত করেননি, বিরস ভঙ্গিতে বলল মলি।

ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কিছু শব্দই বারবার বিধ্বস্ত করে ফেলছে মলিকে। বিশেষ করে সার্জেন্টের শেষ কথাটা, আমি জানি আপনার মাথার মধ্যে ঠিক কী ঘুরছে, মিসেস ডেভিস।  

আসলেই কি তাই? সত্যিই কি ওর মনের কথা কোনোভাবে বুঝতে পেরেছে সে? সে বলেছে, সবকিছু উপভোগ করছে খুনি। এটা কি সত্য?

ক্রিস্টোফারের উদ্দেশ্যে মুখ খুলল সে, এইমাত্র যা বললে তা সত্ত্বেও, সত্যি সত্যি তো নিজেকে উপভোগ করছো না তুমি। তাই না?

ঈশ্বর! বিস্ফোরিত দৃষ্টি দিলো ক্রিস্টোফার। একদম না। কীসব আজব কথা বলছো!  

ওহ, আমি না। সব ঐ সার্জেন্ট ট্রটার, হাবিজাবি সব বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে আমার। সত্য-মিথ্যা সব মাথায় ঢুকিয়ে দেয় লোকটা।  

দুহাতে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলল মলি। সাবধানে হাত দুটো সরিয়ে নিলো ক্রিস্টোফার।

আমার দিকে তাকাও, মলি, বলল সে। কী হয়েছে?

ওকে সাবধানে কিচেন টেবিলের পাশে চেয়ারে বসিয়ে দিলো ক্রিস্টোফার। কাজটায় মোটেও বাধা দিল না মলি। ক্রিস্টোফারের আচরণ এখন আর বাচ্চাদের মতো নেই। না তো উন্মাদের মতো। বরং তাকে বেশ বুঝবান একজন মনে হচ্ছে এখন। কী হয়েছে, মলি। আবারও শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল সে।  

চোখ তুলে তাকালো মলি। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেপে নিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠল, আমি তোমাকে কদিন ধরে চিনি, ক্রিস্টোফার? দুদিন?

এরকমই। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো, এত অল্প সময়ের দেখা হলেও অনেক দিনের পরিচয় আমাদের। তাই তো?

হ্যা, ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

জানি না। আমাদের মধ্যে পরস্পরের জন্য সহানুভূতি রয়েছে। হয়তো তার কারণ এটা যে, এসব ঝামেলায় দুজনেই সমানভাবে মুষড়ে পড়েছি।

এটা কোনো প্রশ্ন নয়, বলে কথাটা উপেক্ষা করল মলি। তারপর খুব ধীরে ধীরে মুখ খুলল সে। আর এটাও যথারীতি কোনো প্রশ্ন নয়, কেবলই মনের ভাব। ক্রিস্টোফার রেন তোমার আসল নাম নয়।

না।

৩য় পর্ব শেষ। 

বাকি তিনটি পর্বের লিঙ্কঃ 

১ম পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation 
২য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 2 of 4
৩য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 3 of 4

৪র্থ পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 4

Tags: বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি,আগাথা ক্রিস্টি রচনাসমগ্র pdf, আগাথা ক্রিস্টি সমগ্র, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie

No comments:

Post a Comment

Popular Posts