মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, March 4, 2022

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation

 

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation
থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation

থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ আগাথা ক্রিস্টি বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation

অধ্যায় ১ :

রাস্তার দিকে কিছুটা পিছিয়ে এসে গেটের পাশে নতুন রং করা বোর্ডের দিকে তাকালো মলি ডেভিস।

Monkswell Manor

Guest House

সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। Guest House লেখাটার T' একটু ওপরে ওঠা, এবং Manor শব্দের বর্ণগুলোর মধ্যে ফাক কম থাকার কথা বাদ দিলে বাকিসব একদম ঠিকঠাক। পেশাদার পেইন্টারের মতোই চমৎকার কাজ করে দেখিয়েছে জাইলস। অবশ্য খুঁত ধরার মতো লোকের অভাব নেই, কেউ কেউ আবার প্রায় পেশাদারী বলতে পারে। জাইলস আসলেই খুব বুদ্ধিমান। অনেক কিছুই করতে পারে। প্রতিনিয়ত নিজের স্বামীর নতুন সব গুণ আবিষ্কার করে মলি। যদিও নিজের ব্যাপারে খুব একটা মুখ খোলে না জাইলস। তার স্ত্রী যে তার এত গুণ গান গায়, তা কেবল একগাদা ডিগ্রির কারণেই। জাহাজের এই প্রাক্তন কর্মচারিকে বেশ কাজের লোক বলেই ডাকে সবাই।

যাই হোক, নিজেদের নতুন জীবনযাত্রায় এখন সব প্রতিভার দরকার পড়বে জাইলসের। গেস্ট হাউজ চালানোর ব্যবসায় দুজনের অভিজ্ঞতা একেবারে শূন্যের কোঠায়। তবুও ব্যাপারটা বেশ আনন্দদায়ক হবে বলেই ভাবছে তারা। তাছাড়া নিজেদের থাকার জায়গা নিয়ে যে বড়োসড়ো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তাও মিটিয়ে দিয়েছে এটা।

বুদ্ধিটা অবশ্য মলির মাথা থেকেই বেরিয়েছে। আন্ট ক্যাথরিন মৃত্যুর আগে মঙ্কসওয়েল ম্যানরটা তাদের নামে করে দিয়ে গেছেন। আর উকিল নোটিশ মারফত যখন খবরটা তাদের কাছে এলো, তখন স্বভাবতই কম

বয়সি এই দম্পতি তাৎক্ষণিকভাবে সেটাকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জাইলসের প্রশ্ন ছিল, ওটা দেখতে কেমন?

জবাবে মলি বলেছিল, 'ওহ, আদ্যিকালের ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার ভর্তি, বেশ পুরনো আর জগাখিচুড়ি মার্কা একটা বাড়ি। একেবারে ঘিঞ্জি এলাকা। ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার জায়গা পর্যন্ত নেই। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। অবশ্য সুন্দর একটা বাগান আছে বটে, তাও যুদ্ধের পর থেকে আর যত্ন নেওয়া হয়নি বলে ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে। কারণ একমাত্র বুড়ো মালির পক্ষে সবকিছু সামলানো সম্ভব হয়নি। বাড়ি বিক্রির আগে গুটিকয়েক ফার্নিচার রেখে দেবে বলে ঠিক করে তারা। যাতে নিজেদের ছোটো কটেজ বা ফ্ল্যাট সাজাতে পারে। কিন্তু তাতে দুইটা সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, ছোটো কোনো ফ্ল্যাট পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ একেকটা ফার্নিচার রীতিমতো বিশাল আকারের, আর এটাই হচ্ছে দ্বিতীয় সমস্যা।

আচ্ছা, একরকম হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিল মলি। মনে হচ্ছে আমাদেরকে একেবারে সবকিছু বেচে দিতে হবে। কেনার মতো কেউ আছে নাকি?

শেষমেশ, আইনজীবী তাদেরকে এটা বলে নিশ্চিত করলেন যে, বাজারে আজকাল যে-কোনো কিছুই বিক্রি করা যায়।  

খুব সম্ভবত, বলেছিলেন তিনি, কেউ এটাকে হোটেল বা গেস্ট হাউজ বানানোর জন্য কিনবে। আর তাতে সবগুলো ফার্নিচারই নিতে চাইবে সে। সৌভাগ্যবশত, বাড়িটা খুব ভালোভাবেই মেরামত করা। প্রয়াত মিস ইমোরি ঠিক যুদ্ধের আগেই এটাকে মেরামত করে আধুনিক বানিয়ে তুলেছিলেন। তাছাড়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব কম, গড়নও বেশ ভালো।

আর ঠিক তখনই বুদ্ধিটা পায় মলি। জাইলস,' বলেছিল সে, আমরা নিজেরাই কেন এটাকে গেস্ট হাউজ বানাচ্ছি না?

প্রথম প্রথম ওর স্বামী এটাকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু গোঁ ধরে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলো মলি।

শুরুতেই খুব বেশি মানুষ নেবো না আমরা। বেডরুমে একইসাথে গরম ও ঠান্ডা পানি আছে, হিটার আছে, গ্যাস কুকার আছে। নিজেরাই হাঁসমুরগী পালন করে ডিমের ব্যবস্থা করতে পারব, আবার শাকসবজি চাষের জন্য বাগান তো আছেই, একটু থেমে বলেছিল সে, খুব সহজেই কিন্তু গেস্ট হাউজ বানানো যায় এটাকে। আর দুনিয়ার সব কাজকর্ম কে করবে? তাছাড়া চাকরবাকরের ব্যবস্থা করাও কম ঝামেলার নয়।  

ওহ, কাজকর্ম আমাদেরকেই করতে হবে। দেখ, যেখানেই থাকি না কেন, ঘরের কাজ তো করতেই হয়। সেখানে দুয়েকজন অতিরিক্ত মানুষ হলে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আর ব্যবসা জমে উঠলে পরে না হয় দেখেশুনে একজন বুয়া ঠিক করব। পাঁচজন মানুষকে থাকতে দিলে যদি তারা প্রত্যেকে সপ্তাহে সাত গিনি করে দেয়, তাহলে...' বড়ো আশা নিয়ে মনে মনে অঙ্ক কষতে শুরু করেছিল মলি।

ভেবে দেখ, জাইলস, অবশেষে বলে সে, এটা আমাদের বাড়ি হবে। এখানে যা কিছু আছে, তাও আমাদের। তাছাড়া আমার তো মনে হয় না, কয়েক বছরেও থাকার জন্য ভালো কোনো জায়গা খুঁজে পাব।

কথাটা যে সত্য, তাতে পুরোপুরি একমত হয় জাইলস।

তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করার পর থেকে একসঙ্গে থাকার মতো খুব কম সময়ই পেয়েছে দুজনে। থিতু হওয়ার জন্য একটা বাড়ির খুব দরকার ছিল। যাই হোক, শেষমেশ নিজেদের চিন্তা-ভাবনা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তাই টাইমসসহ স্থানীয় কয়েকটা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দেয়, এবং শীঘ্রই বেশকিছু জবাব আসে তাদের কাছে।

অবশেষে, আজ তাদের অতিথিদের মধ্যে প্রথমজন আসতে যাচ্ছে। সকাল সকাল উঠে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জাইলস, উদ্দেশ্য হলো কাউন্টির অপর প্রান্তে কিছু আর্মি নেটিং বিক্রির যে বিজ্ঞাপনটা দেখেছিল সেগুলো কিনে আনা। অতিথিদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবই আনা হয়েছে। আর যেসব জিনিস কেনা বাকি ছিল, সেগুলো কিনতে জাইলসের পরপরই গ্রাম্য বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল মলি।

আর এখন, বলতে গেলে প্রায় সবকিছুই ঠিকঠাক। একমাত্র সমস্যা কেবল আবহাওয়াই। গত দুদিন ধরে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ছে, তার ওপর এখন আবার বরফও পড়তে শুরু করেছে।

ড্রাইভ ধরে দ্রুত পা চালাচ্ছে মলি। তার ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট এবং উজ্জ্বল সোনালি চুলের ওপর ক্রমশ মিহি বরফের আস্তরণ জমা হচ্ছে। বড় বেশিই বিষন্ন হয়ে পড়েছে প্রকৃতি। চারদিকে সবকিছুর কেমন যেন নেতিয়ে পড়া ভাব। বলতে দ্বিধা নেই, বড়োসড়ো তুষারঝড়ের আশঙ্কায় আছে সবাই। মলি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এটা ভেবে যে, পাইপগুলো সব জমে যাবে কিনা। শুরুতেই এত বড়ো সমস্যা দেখা দিলে কপালে শনি আছে। মহা বিপাকে পড়তে হবে পরে। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। নাস্তা খাওয়ার সময়টা পেরিয়ে গেছে। জাইলস কি ফিরেছে এতক্ষণে? ও কোথায় গেছে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না তো?

সে হয়তো বলবে, আর বলো না, কিছু জিনিস আনতে ভুলে গিয়েছিলাম, সেগুলোই আনতে গেছি।

আর যথারীতি হয়তো হেসে উঠবে জাইলস, আরও টিন আনতে গিয়েছিলে নাকি?

জরুরি প্রয়োজনে যাতে বিপদে পড়তে না হয়, সেজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের টিন জমা করা হয়েছে। তবুও নিশ্চিত হতে পারছে না মলি। আর তাই খাবারের টিন নিয়ে ক্রমাগত ওর কথা বলার কারণে টিন শব্দটাই হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে এখন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মলি। কপালে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার বলিরেখা। কেন যেন মনে হচ্ছে, খুব শীঘ্রই এই জরুরি প্রয়োজনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা। খাখা করছে পুরো বাড়ি। তার মানে, এখমেফিরে আসেনি জাইলস। প্রথমে রান্নাঘরটা দেখে তারপর ওপর তলায় নতুন করে সাজানো বেডরুম দেখতে গেল মলি। শামিয়ানা টাঙানো মেহগনি খাটওয়ালা দক্ষিণ দিকের রুমটা মিসেস বয়েলের, ওক খাটওয়ালা নীল রুমটা মেজর মেটকাফের, এবং পূর্বদিকের বড়ো জানালা-ওয়ালা রুমটা মিস্টার রেনের জন্য। সবগুলো রুমই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এটা ভেবে মলির খুব ভালো লাগল যে, প্রচুর কাপড়চোপড় আছে আন্ট ক্যাথরিনের। একটা বিছানার চাদর হালকা টেনে ঠিক করে দিয়ে আবারও নিচতলায় ফিরে এলো সে।

প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। আচমকাই একেবারে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো পুরো বাড়িতে। কেমন যেন গুমোট একটা অনুভূতি আকড়ে ধরল ওকে। সেই সঙ্গে ঘিরে ধরেছে প্রচণ্ড একাকীত্ব। বাড়িটা গ্রাম থেকে দুমাইল দূরে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সবকিছু থেকেই দুমাইল পিছিয়ে আছে।

আগেও অনেকবার বাড়িতে একা কাটিয়েছে সে। কিন্তু আজকের মতো কখনো এতটা নিঃসঙ্গ মনে হয়নি নিজেকে। জানালার কাঁচে ভারী বরফ আছড়ে পড়ায় মাঝে মাঝেই অস্বস্তিকর শব্দ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, জাইলস ফিরে আসতে পারছে না। বরফের মাঝ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে পারবে তো? আবার মনে হচ্ছে, বেশ কিছু দিন ধরেই যেন একা কাটাতে হবে।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই বিশালাকার রান্নাঘরের দিকে তাকালো সে। দেখে মনে হচ্ছে, উঁচুদরের কোনো রাঁধুনী পরমযত্নে সাজিয়ে তুলেছে ওটাকে। সে নিজেই হয়তো হতে পারত এই বিশাল বাড়িটার একচ্ছত্র অধিকত্রী। রান্নাঘরের বড়ো টেবিলে যে লম্বা ও বয়স্ক সঙ্গী নিয়ে বসত। আর রক কেক চিবানোর কারণে যার চোয়াল ওঠানামা করত নির্দিষ্ট কোনো ছন্দে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তারা মেতে উঠতে পারত স্মৃতিচারণের গল্পে। তাদের ঘিরে থাকত কোনো চাকরানি, এবং রান্নাঘরের শেষ মাথায় ভীরু চাহনিতে অপেক্ষা করতে থাকা কোনো রাধুনী।।

কিন্তু তার বদলে সম্পূর্ণ একা সে। মলি ডেভিস, মনে হচ্ছে এমন একটা দুর্বোধ্য চরিত্রের হয়ে অভিনয় করছে, যেটার ওপর কোনো হস্তক্ষেপ নেই ওর। আর এই মুহূর্তে নিজের পুরো জীবনটাই খুব অবাস্তব মনে হচ্ছে। জাইলসকেও মনে হচ্ছে অবচেতন মনের কল্পনায় গড়ে নেওয়া কোনো একজন। মনে হচ্ছে, অধিকারহীন হয়ে যেন শুধু একটি চরিত্রে অভিনয় করছে সে। শুধুই অভিনয়।

আচমকা জানালার কাঁচে একটা ছায়া পড়তেই লাফ দিয়ে উঠল সে। বরফ মাড়িয়ে কেউ একজন ক্রমশ এদিকেই আসছে। দরজা খোলার খুটখাট শব্দ ভেসে এলো, আর পরক্ষণেই অন্ধকারে খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো অচেনা কোনো আগন্তক। এবার গায়ের বরফ ঝেড়ে পরিষ্কার করে খালি বাড়িতে ঢুকে পড়লো সে।

তারপর, হঠাৎ করেই, কল্পনার রাজ্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো মলি।

ওহ, জাইলস!' চিৎকার করে উঠস সে, তুমি আসায় খুব ভালো লাগছে, চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার।

সুইটহার্ট! কী জঘন্য আবহাওয়া বাইরে। ও খোদা, একেবারে জমে গেছি।

কোট খুলে ছুঁড়ে দিতেই সেটা ধরে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দিলো মলি। পকেট থেকে বের করে আনলো মাফলার, একটা পত্রিকা, প্যাচানো দড়ির বল এবং সকালে দলা পাকিয়ে পকেটে ঢোকানো একটা চিঠি। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো ওসব। তারপর চুলায় কেটলি চাপিয়ে প্রশ্ন করল, নেটিং পেয়েছো?

আরে ধুর, বাজে জিনিস, আমাদের কোনো কাজে আসত না। অন্য একটা জায়গায়ও দেখেছি, সেটাও সুবিধার না,' জাইলস বলল, তো, তুমি কী কী করলে সারাদিন? কেউ তো এখনো আসেনি মনে হচ্ছে।

মিসেস বয়েল কালকের আগে আসবেন না।

মেজর মেটকাফ আর মিস্টার রেন তো আজকেই আসার কথা।

মেজর মেটকাফ একটা কার্ড পাঠিয়ে বলেছেন, তিনিও কালকের আগে আসতে পারবেন না।

আচ্ছা, রাতে তাহলে আমাদের সঙ্গে শুধু মিস্টার রেন খাবে। কী মনে হয়, কী পছন্দ করতে পারে সে? লোকটা বোধহয় রিটায়ার্ড করা কোনো সিভিল সার্ভেন্ট।

উঁহু, আমার তো তাকে আর্টিস্ট বলে মনে হয়।

তাহলে,' বলল জাইলস, আমরা বরং এক সপ্তাহের ভাড়া অগ্রীম নিয়ে নিই।

একদম না, জাইলস। লাগেজ আনবে তারা পেমেন্ট না করলে তখন নাহয় সেগুলো আটকে রাখতে পারব।

তোমার কি মনে হয়, লাগেজ ভর্তি খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো রত্নপাথর থাকবে? দেখ, মলি, সত্যি বলতে আমরা দুজনের একজনও জানি কাদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। আশা করি আমরা যে একেবারে নতুন, এটা লক্ষ্য করবে না তারা।

আমি নিশ্চিত, মিসেস বয়েল ঠিকই বুঝবেন, মলি বলল, সেরকমই মহিলা তিনি।

এতটা নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে? তাকে তো আর দেখনি তুমি।

জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো মলি। তারপর টেবিলের ওপর একটা পত্রিকা বিছিয়ে পনির নিয়ে কাটতে শুরু করল ওটার ওপর। 

এটা কী? আবারও প্রশ্ন করল জাইলস।

ওয়েলস। মানে পনির-ভাজা, মলি বলল। পাউরুটি, আলুর ভর্তা আর এটার নামকে স্বার্থক করার জন্য সামান্য চিজ।

বেশ বুদ্ধিমান রাধুনী তুমি, প্রশংসার সুরে বলল ওর স্বামী।

এটা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে আমার, ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল মিল। আমি একেবারে একটার বেশি জিনিস বানাতে পারি না। তার জন্য প্রচুর চর্চার দরকার হয়। সকালের নাস্তা বানানোর কাজটা সবথেকে জঘন্য!

কেন? অবাক হলো জাইলস।

একসঙ্গে দুনিয়ার কাজ করতে হয় তখন। ডিম, বেকন, গরম দুধ, কফি, টোস্ট সব মিলিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। কিন্তু কাজের কাজ আর হয় না। দুধ উতলে পড়বে, বেকন কুঁচকে যাবে, টোস্ট পুড়ে যাবে, নাহলে ডিম বেশি শক্ত হয়ে যাবে,' বিড়বিড় করে বলল মলি। সবকিছু একসঙ্গে দেখতে গেলে সারা গায়ে ছ্যাকা লাগা বিলাই হওয়া লাগবে।

হেসে উঠল জাইলস, তাহলে তো আমাকে কাল লুকিয়ে লুকিয়ে বিলাইটাকে দেখতে আসতে হবে।

পানি গরম হয়েছে, মলি বলল। ট্রে নিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে ওয়্যারলেস শুনি আমরা? খবরের সময় হয়ে এসেছে প্রায়।

দেখে যেহেতু মনে হচ্ছে প্রায় পুরো সময়টা আমরা রান্নাঘরেই কাটাবো, তাই রান্নাঘরের জন্যেও আরেকটা ওয়্যারলে লাগবে।

আসলেই, কী সুন্দর রান্নাঘর! আমার তো মনে হচ্ছে সারা বাড়িতে এটাই সবথেকে সুন্দর রুম। ড্রেসার, প্লেট সবকিছু পছন্দ হলেও এই রান্নাঘরে এসে যে উদার অনুভূতি পাই, সেটাকে আমি খুব ভালোবাসি। তবে হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এখানে কখনো রান্না করতে হয়নি আমাকে।

পুরো একবছরের জ্বালানী এক দিনেই শেষ হয়ে যেত তাহলে।

এই ব্যাপারে খুব একটা সন্দেহ নেই আমার, মলি বলল। কিন্তু ভেবে দেখ, কী বিপুল পরিমাণ গরুর মাংস রান্না করা হতো এখানে। তাছাড়া বিশালাকার কপার প্রিজার্ভিং পাতিলভর্তি হোমমেড স্ট্রবেরি জ্যামের কথাই ধর, কয়েক পাউন্ড চিনি মেশানো হতো ওগুলোতে। কী চমৎকার আর আরামদায়ক ছিল ভিক্টোরিয়ান এইজটা! ওপরতলার ফার্নিচারগুলো দেখ, কত বড়ো আর সূক্ষ্ম নকশা করা। একেবারে সলিড জিনিস। একেকজনের জন্য একেকটা রুমে দুনিয়ার কাপড়চোপড়। ড্রয়ারগুলোও খুলতে আর বন্ধ করতে কত আরাম!

একটু থেমে আবার বলল সে। আমাদের সেই আধুনিক ফ্ল্যাটটার কথা মনে আছে? সবকিছু নামেমাত্র স্লাইডিং হলেও সবসময় জ্যাম ধরে থাকত। দরজার অবস্থা তো আরও খারাপ-একবার বন্ধ হলে সহজে খুলতে চাইতো না, আবার একবার খুললেও বন্ধ করতে বারোটা বাজতো।

হাঁ, কলকব্জার এটাই সব থেকে বড়ো অসুবিধা। নষ্ট হলে একেবারে ডুবিয়ে ছাড়বে তোমাকে।

যাই হোক, চল, খবরটা শুনি গিয়ে।

স্বভাবতই খবরের বেশিরভাগ জুড়ে বৈরি আবহাওয়ার কারণে বিভিন্ন সতর্কতা শোনানো হলো। এছাড়া রোজকার মতো বৈদেশিক সম্পর্কের অচলাবস্থা, সংসদীয় নানা বাকবিতণ্ডার পাশাপাশি প্রচার করা হলো কালভার স্ট্রিট, প্যাডিংটনে হওয়া একটা খুনের ঘটনাও।

ওহ! সুইচ অফ করে বলল মলি। মহাযন্ত্রণায় পড়লাম তো। আবারও সেই জ্বালানী অর্থনীতি নিয়ে আপিল টাপিল শুনতে পারব না। লোকগুলো আসলে চায়টা কী, ঘরে বসে থেকে জমে বরফ হয়ে যাই? ধুর, এই শীতের মধ্যে গেস্টহাউজ খোলাই ঠিক হয়নি। গ্রীষ্ম পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। একটু থেমে সম্পূর্ণ অন্য গলায় যোগ করল সে, ভাবছি, খুন হওয়া মহিলাটা ঠিক কেমন ছিল।

মিসেস লিওন?

মহিলার নাম কি এটাই? যাই হোক, কে আর কেনই বা মারবে তাকে!

ফ্লোরবোর্ডের নিচে হয়তো কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিল সে।

শুনেছি, আশেপাশেই দেখা যাওয়া একটা লোককে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে বলছিল পুলিশ। সে-ই খুনি নাকি?

পুলিশের অভ্যাসই তো এটা। সাধারণত, কূলকিনারা না পেলে ভদ্রভাবে কোনোরকম একটা সমাধান দিয়ে দেয়।

আচমকা বেল বাজতেই লাফিয়ে উঠল দুজনে।

সামনের দরজা, জাইলস বলল। তারপর হাসতে হাসতেই যোগ করল, যেখান দিয়ে খুনি প্রবেশ করে।

হু, নাটক সিনেমায় এরকমই হয়। তাড়াতাড়ি কর, মিস্টার রেন এসেছে মনে হয়। দেখা যাক কার কথা ঠিক, তুমি নাকি আমি।

গাভর্তি বরফ নিয়ে একরকম ঝাঁপিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল মিস্টার রেন। লাইব্রেরির দরজার সামনে থেকে মলির চোখে শুধু বাইরের বরফে ঢাকা পৃথিবীর বিপরীতে দাঁড়ানো একজন আগন্তুকের ছায়াই পড়ছে।

সভ্য পোশাকে সব পুরুষের মধ্যে কত মিল, ভাবল সে। কালো ওভারকোট, ধূসর টুপি আর গলায় জড়ানো মাফলার।

পরক্ষণেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো জাইলস। অনবরত কথা বলতে বলতেই স্যুটকেস নামিয়ে রেখে মাফলার আলগা করল মিস্টার রেন, একইসঙ্গে টুপি খুলে বরফ ঝাড়তে শুরু করেছে। লোকটার গলা বেশ উঁচু, প্রায় ঝগড়াটে। ছায়া মাড়িয়ে হলওয়ের আলোতে আসতেই কমবয়সি, রোদে পোড়া ত্বক, উশকোখুশকো চুলের মানুষটাকে চোখে পড়লো ওদের। বিবর্ণ চোখ সমানে চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে তার।

ভয়ংকর...খুবই ভয়ংকর, বলতে লাগল সে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবথেকে জঘন্য শীত পড়ছে এবার। বাইরে পা রাখতে হলে বিশালাকার বুকের পাটা লাগবে। কী বলেন আপনারা? আর আমি তো সারাদেশ পাড়ি দিয়ে, সেই ওয়েলস থেকে এসেছি। আপনিই মিসেস জেভিস? আহা, কী আনন্দের বিষয়!

ঝট করে কাঁপতে কাঁপতে দুহাত ভাঁজ করে ফেলল মলি। যেরকম ভেবেছিলাম, একদমই তেমন নন দেখছি। জানেন তো, ইন্ডিয়ান আর্মি জেনারেলের কোনো এক বিধবা বৌয়ের মতো কল্পনা করেছিলাম আপনাকে-ভয়ংকর ও মেমসাহেব আর্কা। একেবারে সত্যিকারের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন। আহ, ভাবা যায়! আচ্ছা, আপনার কাছে কি ওয়াক্স ফ্লাওয়ার আছে? কিংবা বার্ডস অব প্যারাডাইজ? এই জায়গাটা তো দারুণ লাগছে। জানেন, খুব চিন্তায় ছিলাম আমি। ভেবেছি, আদ্যিকালের কোনো ম্যানর হাউজ হবে এটা। কিন্তু এখন দেখছি...ওহ ঈশ্বর, একেবারে স্বর্গীয় জিনিস, সত্যিকারের ভিক্টোরিয়ান যুগের! দয়া করে বলুন, আপনাদের কাছে কি সত্যিই ফলের ছবি অঙ্কিত, অসাধারণ ওসব মেহগনি কাঠের... পার্পল মেহগনি কাঠের টেবিল আছে?

জি, কোনোরকমে বলল মলি। এই তুমুল শব্দস্রোতে রীতিমতো খাবি খাচ্ছে সে। আছে।

অসম্ভব! ওহ, আমি কি দেখতে পারি? শুধু একবার। এখানেই আছে? লোকটা এত দ্রুত নড়াচড়া করছে যে, বোঝাই যাচ্ছে না কোনদিক থেকে কোনদিকে যাবে। ওদের কারো জবাবের অপেক্ষা না করেই ডাইনিং রুমের দরজা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। তাকে অনুসরণ করে ভেতরে পা রাখল মলি। যদিও পেছনে জাইলসের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠা অসম্মতি দৃষ্টি এড়ায়নি ওর। মিস্টার রেন এদিকে উত্তেজনায় প্রায় পাগল হয়ে গেছে যেন। প্রকাণ্ড টেবিলের নকশার ওপর নিজের লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে, আর ক্রমাগত প্রশংসাসূচক বাণ ছুঁড়ছে সে। কিছুক্ষণ এভাবে উন্মাদের মতো ধাপাধাপির পর বাড়ির মালিকদের দিকে তাকালো কাধের ওপর দিয়ে।

বড়ো কোনো মেহগনি ডাইনিং টেবিল নেই? তার বদলে এই ছোটো ছোটো কয়েকটা?

আমরা ভেবেছি, লোকজন এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। জবাব দিলো মলি।

ওহ হো, একদম ঠিক বলছেন আপনি। ওরকম টেবিল থাকলে চারপাশে অবশ্যই টেবিলের যোগ্য পরিবারের সদস্য থাকতে হবে। বাপটা হবে মুখে দাড়িসহ কড়া ও সুদর্শন গোছের। মায়ের মুখে থাকবে বিবর্ণ, দুঃখী দুঃখী ভাব। বাপের ভয়ে গুটিসুটি মেরে থাকা এগারোটা ছেলেমেয়ে। আর সবার ওপরে থাকবে ভয়ংকর রাগী কোনো অভিভাবক। এছাড়া বেচারা হ্যারিয়েট নামে কোনো দুঃসম্পর্কের আত্মীয় গোছের একজন। যে কিনা এত সুন্দর বাড়িতে দয়া করে থাকতে দিয়েছে বলে সারাদিন মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, আর প্রতিটা কাজে যেচে সাহায্য করতে আসে। এই যে, বড়ো চুলাটার দিকে তাকিয়ে চিমনি বেয়ে ওঠা আগুনের কথাই ভাবুন না। সারাদিন ওটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সেই বেচারা হারিয়েটের পাছায় ফোস্কা পড়ে যেত।

আমি আপনার স্যুটকেস ওপরে নিয়ে যাচ্ছি, মাঝখানে অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বলে উঠল জাইলস। পূর্বদিকের রুমটাই তো?

হ্যা, বলল মলি।

আবারও থপথপ পা ফেলে হল রুমে চলে এলো মিস্টার রেন। ওখানে কি রঙিন শামিয়ানা টাঙানো খাট আছে? জিজ্ঞেস করল সে।

না, নেই। কথাটা বলেই সিড়ির বাঁকের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেল জাইলস। আপনার স্বামী মনে হয় না আমাকে খুব একটা পছন্দ করবেন, মলির উদ্দেশ্যে বলল মিস্টার রেন। কোথায় ছিলেন উনি? নেভি?

হাঁ।

আমারও এটাই মনে হয়েছিল। আর্মি আর এয়ারফোর্সের চেয়ে বেশি ধৈর্য্য থাকে এদের। যাই হোক, আপনারা কতদিন হলো বিয়ে করেছেন? উনাকে খুব ভালোবাসেন বুঝি?

ওপরে এসে বরং আপনার রুমটা দেখতে পারেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। দেখুন, আমি জানি, এভাবে জিজ্ঞেস করা ঠিক ভদ্রতার আওতায় পড়ে না। তবুও খুব জানতে ইচ্ছা করছে। মানে, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? এই যে, কারো সম্পর্কে জানা, তাদের অনুভূতি বুঝতে পারা, তারা কী ভাবছে সেটা জানা। তারপর ধরুন, তাদের কাজকর্ম, চলাফেরা স্বাভাবিকভাবে যেরকম দেখতে হয়, আড়ালে কি তারা সত্যিই তেমন হয়? এই জিনিসগুলো ইন্টারেস্টিং মনে হয় না আপনার কাছে?

আপনি, সংযত ও গম্ভীর গলায় বলল মিল, মিস্টার রেন, তো?

চট করে নড়াচড়া থামিয়ে দিলো তরুণ লোকটি। দুহাত মাথার চুলে চালিয়ে দিয়ে বিব্রতভঙ্গিতে হাসলো খানিকটা। দেখুন কী আজব মানুষ আমি! আগের কাজ আগে না করে কত কথা বলে ফ্রেললাম, বলল সে। হ্যাঁ, আমিই ক্রিস্টোফার রেন। যাই হোক, যেটা বলেছিলাম, আমার বাবা মা খুবই রোমান্টিক কাপল ছিলেন। তাদের অনেক আশা ছিল, নামকরা একজন আর্কিটেক্ট হবো আমি। তাই শক্ত করে আমার নাম ক্রিস্টোফার রেখেছেন।

তার মানে, আপনি আর্কিটেক্ট? হাসি দমিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল মলি। শেষ পর্যন্ত ঠোটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল ওর।

হ্যা, গর্বভরে বলল মিস্টার রেন। অন্তত সেরকমই একজন হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এটা ঠিক যে, এখনো উপযুক্ত যোগ্যতা নেই আমার, আর না তো ভারী অভিজ্ঞতার ঝুলি। তবুও স্বপ্ন ধরা দেবে বলে বিশ্বাস করতে পারাও কিন্তু লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য। আপনাকে মনে করিয়ে দিই, সত্যি বলতে এই নামটা কিন্তু অসুবিধায় ফেলবে। আমি কখনো ক্রিস্টোফার রেন হতে পারব না। জনপ্রিয়তা যদি পায়, তাহলে সেটা হয়তো ক্রিস রেনের তৈরি স্থাপত্যই পাবে।  

সিঁড়িতে জাইলসের পদ শব্দ শুনে সেদিকে তাকালো মলি। নিচে নেমে আসছে সে।

আসুন, মিস্টার রেন, আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিচ্ছি।

কয়েক মিনিট পর নিচে নেমে আসতেই জাইলস বলল, তো, চমৎকার সব ওক ফার্নিচার পছন্দ হয়েছে লোকটার?

শামিয়ানা টাঙানো রুমটার জন্য বেতাল হয়ে পড়েছে সে, তার বদলে শেষমেশ রোজরুমটা দিয়েছি।

ঘোঁৎঘোৎ শব্দ করে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল জাইলস, যেটা শেষ হলো-অসভ্য ব্যাটা দিয়ে।।

আমার দিকে তাকাও, জাইলস, হাবভাব স্পষ্ট বুঝতে পেরে মুখ খুলল মলি। আমরা কোনো হাউজপার্টির গেস্টের দেখাশোনা করছি না, এটা আমাদের ব্যবসা। ক্রিস্টোফারকে তুমি পছন্দ কর বা না কর...

করি না, মাঝখানে বলে উঠল জাইলস।  

...তাতে কিছু আসে যায় না। সপ্তাহে সাত গিনি দেবে সে, আর আমাদের মাথাব্যথা শুধু এটা নিয়েই।

যদি দেয় আর কী।  

সাত গিনি করে দিতে রাজী আছে সে। আমরা তার চিঠি পেয়েছি, জাইলস।  

তুমি নিজে কি রোজরুমে তার স্যুটকে টেনে নিয়েছো?

না, সে নিজেই নিয়েছে।

আহা! খুব মহৎ! মুখ বিকৃত করল জাইলস। ওটা টেনে নিতে সামান্য কষ্টও হতো না তোমার। খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া রত্নপাথর তো দূরে থাক, স্যুটকেস এত হালকা যে, আমার তো মনে হচ্ছে ওটার ভেতরে কিছুই নেই।  

শশশ...আসছে সে, সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলল মলি। লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালো ক্রিস্টোফার রেন। বড়ো বড়ো চেয়ার আর ফায়ারপ্লেসওয়ালা এই রুমটা বেশ ভালোই লাগে মলির। আধঘণ্টার মধ্যে রাতের খাবার তৈরি হয়ে যাবে বলে জানায় সে। নানা কথাবার্তার মাঝে কোনো একটা একটা প্রশ্নের উত্তরে অতিথিকে সে জানায়, এই মুহূর্তে আর কোনো অতিথি নেই এখানে। তাছাড়া আজ আর গেস্টহাউজে কেউ আসবেও না। এক্ষেত্রে ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো, রান্নাঘরে ওকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা।  

আপনি চাইলে অমলেট বানাতে পারি আমি, আমুদে গলায় বলে সে।

পরে সত্যিই সত্যিই থালাবাসন ধুতে ওকে সাহায্য করল ক্রিস্টোফার। কীভাবে যেন অনুভব করতে পারলো মলি, সাধারণত গেস্টহাউজের যাত্রা কখনো এভাবে শুরু হয় না। তাছাড়া জাইলস মোটেও ভালো চোখে দেখছে এটাকে।

আরে ধুর, ঘুমে ভারী হওয়া দুচোখের পাতা এক করার আগে ভাবলো সে, আগামীকাল বাকি গেস্টরা আসলে পাল্টে যাবে পরিস্থিতি।

 

পরদিন সকালটা দোড়গোড়ায় হাজির হলো অন্ধকার আকাশ আর মিহি বরফে ঢাকা প্রকৃতি নিয়ে। জাইলসকে দেখে মনে হচ্ছে, মৌনব্রত পালন করছে যেন। কোনো উত্তেজনা নেই, কেবল গম্ভীর হয়ে আছে। কিন্তু মলির

অবস্থা শোচনীয়, দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়েছে সে। আবহাওয়া মনে হচ্ছে সবকিছুর একেবারে ভরাডুবি ঘটাবে। চলাফেরাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায়ই চাকায় শিকলওয়ালা স্থানীয় এক ধরনের ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলেন মিসেস বয়েল। আর এলাকার রাস্তাঘাটের যে করুণ দশা, গলায় একরাশ হতাশা নিয়ে সেসব বর্ণনা করল ট্যাক্সির চালক।  

সন্ধ্যার আগেই ঝড় হবে, ভবিষ্যতবাণী করল সে।

মিসেস বয়েল নিজেও এই বিষন্ন পরিবেশকে খুব একটা উষ্ণ করতে পারেননি। গায়ে গতরে বিশালাকার ও কড়া দর্শনের এই মহিলার কণ্ঠস্বর খালি কাঠের বাক্সে লাঠি দিয়ে পেটালে যেরকম হয়, একদম সেরকম। চালচলনেও ফুটে ওঠে কর্তৃত্বপরায়ণ ভাব। তার স্বভাবগত এই উদ্ধত আচরণকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অধ্যাবসায় ও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজন সম্পর্কিত একটি সশস্ত্র পেশা।

সবে যাত্রা শুরু হওয়া নতুন গেস্ট হাউজ জানলে জীবনেও এখানে পা রাখতাম না আমি, বললেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই এটাকে ঠিকঠাকভাবে গড়ে তোলা গেস্টহাউজ ভেবেছি আমি।

সন্তুষ্ট না হলে এখানে থাকার জন্য আপনার কোনো দায় পড়েনি, মিসেস বয়েল, শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো জাইলস।

সেরকম হলে থাকার কথা ভাবতেও যাচ্ছি না আমি।

মিসেস বয়েল, বলল জাইলস, রাস্তা এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি, আপনি চাইলে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিতে পারেন। কোনো সমস্যা হলে বা ভালো না লাগলে যাতে সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। একটু থেমে আবার যোগ করল, এমনিতে আমাদের কাছে প্রচুর দরখাস্ত জমা পড়েছে। তাই অন্য কাউকে দিয়ে খুব সহজেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারব। তাছাড়া ভবিষ্যতে ঘরভাড়া বাড়ানোর কথাও ভাবছি আমরা।

ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মিসেস বয়েল। নিজ চোখে সবকিছু না দেখে এখান থেকে এক পা-ও নড়ছি আমি। তারচেয়ে বরং আমাকে একটা বড়ো তোয়ালে দিন, মিসেস ডেভিস। গোসল সেরে একটা রুমাল দিয়ে তো আর গা মোছা সম্ভব নয়।

মিসেস বয়েলের প্রত্যুত্তর শুনে মলির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো জাইলস।

দারুণ! হেসে বলল মলি, ভালোই জব্দ করেছো মহিলাকে।

জায়গামতো হাত পড়লে সব তর্জনগর্জনই পালিয়ে যায়, পাল্টা জবাব দিলো জাইলস।

ওহ, বলল মলি, আমি ভাবছি, মিস্টার প্লেনের সঙ্গে এই মহিলা মানিয়ে চলবে কীভাবে।

বনিবনা হবে না।  

আর ঠিক সেদিন বিকালেই মলির কানে কথাটা তুললেন মিসেস বয়েল। এই ব্যাটাছেলের আচরণ খুবই সন্দেহজনক। কণ্ঠে স্পষ্ট অপছন্দ ফুটে উঠল তার।

বেকারির লোকটাকে দেখে মনে হলো, কিছু একটার খোঁজে উত্তর মেরু চষে বেড়াচ্ছে যেন। রুটি দিয়ে যাওয়ার সময় এটা বলে সতর্ক করে দিয়ে গেল যে, আগামী দুদিনেও কোনো অর্ডার কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঘোষণা করার সুরে বলল সে। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার জমা আছে তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে, জবাব দিলো মলি। অনেক খাবারের টিন রেখেছি আমরা। যদিও অতিরিক্ত আটা নেবো কিছু।  

অস্পষ্টভাবে মনের কোণে আইরিশদের বানানো সোডা ব্রেডের কথা পুষে রেখেছে সে। পরিস্থিতি যদি খুব বেশি খারাপকেও ছাড়িয়ে যায়, তখন হয়তো ওটা বানাতে পারবে। কয়েকটা পত্রিকাও নিয়ে এসেছে বেকারির লোকটা, হলের টেবিলে সেগুলো ছড়িয়ে রাখল মলি। বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে যে তুমুল আলোচনা ছিল, সেটা এখন আবহাওয়া ও মিসেস লিওন হত্যার খবরের ভীড়ে হারিয়ে গেছে। একেবারে প্রথম পাতায় মৃত মহিলার প্রায় ঝাপসা একটা ছবির দিকে তাকিয়ে ছিল সে। ঠিক তখনই মিস্টার রেনের আওয়াজ আসে পেছন থেকে। নোংরা একটা খুন, তাই না? মহিলাকে দেখে পতিতাগোছের মনে হয়, খুনও হয়েছে নোংরা একটা স্ট্রিটে। আদৌ এটার পেছনে কোনো গল্প থাকতে পারে বলে ভাবছে কেউ?

আমার কোনো সন্দেহ নেই, রাগের চোটে নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বললেন মিসেস বয়েল, ঠিক এটাই প্রাপ্য ছিল মহিলার।

আচ্ছা, দৃষ্টি তার দিকে ঘুরিয়ে বেশ আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো মিস্টার রেন, তার মানে এটাকে যৌনাপরাধ সংশ্লিষ্ট কিছু মনে হচ্ছে আপনার?

আমি ওরকম কিছু বোঝাইনি, মিস্টার রেন। 

কিন্তু গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা হয়েছিল তাকে তাই না? ভাবছি...

নিজের ফর্সা লম্বা হাতটা বের করে আনলো সে, কাউকে গলা টিপে মারতে কেমন লাগে!

তাই নাকি, মিস্টার রেন? ভ্রু কুঁচকে ফেললেন মিসেস বয়েল।

আরেকটু কাছে ঘেঁষে এসে গলা নামিয়ে ফেলল ক্রিস্টোফার। আচ্ছা, মিসেস বয়েল, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, শ্বাসরোধ হয়ে মরতে কেমন লাগে?

মিসেস বয়েল আবারও সেই একইরকম ঘৃণার সুরে বললেন, তাই নাকি, মিস্টার রেন?

এদিকে দ্রুত পড়তে লাগল মলি, পুলিশ যে লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, তার উচ্চতা স্বাভাবিক। পরনে ছিল কালো ওভারকোট, হালকা রংয়ের হোমবার্গ হ্যাট ও একটি উলের স্কার্ফ।

সত্যি বলতে..., ক্রিস্টোফার রেন বলল, ...সে দেখতে একদম আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। কথাটা বলেই হেসে উঠল সে।  

হু, সায় দিলো মলি। একদম আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই।  

 

অধ্যায় ২

 

অন্যদিকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, নিজের ঘরে তখন ডিটেক্টিভ সার্জেন্ট কেইনের উদ্দেশ্যে মুখ খুলল ইন্সপেক্টর পার্মিন্টার। শ্রমিক দুজনের সঙ্গে কথা বলব এবার।

জি, স্যার।

কেমন ওরা?  

মানুষ হিসাবে বেশ ভদ্র, স্যার। চলাফেরায় একটু ধীরস্থির হলেও আস্থা রাখা যায় ওদের ওপর।

রাইট, মাথা নেড়ে সায় দিলো ইন্সপেক্টর পার্মিন্টার।।  

পরক্ষণেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দুটো লোক প্রবেশ করল ঘরে। দেখে মনে হচ্ছে দুজনেই নিজেদের সবথেকে ভালো পোশাকটা বেছে নিয়েঁছে পরার জন্য। দৃষ্টি দিয়ে তাদেরকে খানিকটা মেপে নিলো পার্মিন্টার। পুলিশের সামনে যে কেউই সাধারণত একটু বিভ্রান্ত কিংবা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়, যার দরুন জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। তাই তাদেরকে সহজ হতে দেওয়া জরুরি, আর এই কাজে বেশ দক্ষত রাখে সে।।

তো আপনাদের মতে, আপনারা এমন কিছু জানেন যেটা লিওনের কেসে আমাদেরকে সাহায্য করবে, বলল সে। আসার জন্য ধন্যবাদ। বসুন। সিগারেট চলবে?

সম্মতি দিয়ে দুজনেই সিগারেটে আগুন দেওয়া অবধি অপেক্ষা করল সে। তারপর বলল, আবহাওয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।  

জি, স্যার।

ঠিক আছে, কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন আপনারা? নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল লোকদুটো। চোখে মুখে ফুটে ওঠা স্পষ্ট বিভ্রান্তিই প্রকাশ করছে যে, মুখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।

বল, জো, অপেক্ষাকৃত বড়ো জন বলল।

সঙ্গীর উৎসাহ পেয়ে বলতে লাগল জো, সেদিনও এরকমই সিগারেট খেতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাদের কাছে কোনো ম্যাচ ছিল না।

জায়গাটা ঠিক কোথায়?

জার্মান স্ট্রিটে, স্যার। আমরা তখন গ্যাস পাম্পের প্রধান অংশে কাজ করছি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ইন্সপেক্টর পার্মিন্টার। পরে একদম ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে ঢু মেরে আসবে সে। ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে অর্থাৎ কালভার স্ট্রিট যে জার্মান স্ট্রিটের বেশ কাছেই, এটা খুব ভালো করেই জানে সে। আপনাদের কাছে কোনো ম্যাচ ছিল না। উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিতে কথাটা পুনরাবৃত্তি করল সে।

না, আমার যেটা ছিল, ওটা শেষ হয়ে যায়। আর বিলের লাইটারও কাজ করছিল না। তাই পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা লোকের সঙ্গে কথা বলি আমি। আপনার কাছে ম্যাচ আছে, ভাই? কোনোকিছু না ভেবে শুধু এটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। অন্তত তখন পর্যন্ত অন্য কিছু ভাবিনি। বাকি আরও অনেকের মতোই হেঁটে যাচ্ছিল সে। আর ঘটনাক্রমে তাকে প্রশ্ন করি আমি।

আবারও কিছু না বলে মাথা নাড়লো পার্মিন্টার।

যাই হোক, একটা ম্যাচ বাড়িয়ে দিলো সে কিছু না বলে সেটা হাতে নিয়েছিলাম আমি। বিলই কথা বলে লোকটার সঙ্গে, মারাত্মক ঠান্ডা, ভাই! লোকটা উত্তর দেয়, হ্যাঁ, আসলেই। এত আস্তে আর ফিসফিস করে কথা বলল যে, আমি ভাবলাম বুকে ঠান্ডা লেগেছে হয়তো। আগাগোড়া নিজেকে পোশাকে একেবারে মুড়িয়ে রেখেছিল সে। যাই হোক, ধন্যবাদ, ভাই! বলে তাকে তার ম্যাচটা ফিরিয়ে দিই আমি। ম্যাচটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে ওখান থেকে সরে গেল লোকটা। এত জোরে হেঁটে গেছে যে, তার পকেট থেকে কিছু একটা পড়ে গেছে দেখার পর আর পেছনে ডাকার সুযোগ পাইনি। ভালো করে চেয়ে দেখি, ওটা একটা নোটবুক। পকেট থেকে ম্যাচ বের করার সময় ভুল করে ফেলে রেখে গেছে। একটু থেমে আবারও বলল সে, যাই হোক, ও ভাই, আপনার নোটবুক! বলে অনেক ডাকলাম। কিন্তু মনে হয় একটুও শোনেনি। দ্রুত হেঁটে একটা মোড়ের কাছে গায়েব হয়ে গেল। তাই না, বিল?

একদম, সম্মতি দিলো বিল। দ্রুতবেগে ছোটা কোনো ইদুর মনে হচ্ছিল তাকে।  

হ্যারো রোডের দিকে চলে গিয়েছিল সে। মনে হচ্ছিল না দৌড়ে গেলেও নাগাল পাব। শেষমেশ এটা ভেবে হাল ছেড়ে দিলাম যে, ওয়ালেট টোয়ালেট তো না, সামান্য একটা নোটবুক, খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় হয়তো। আজব মানুষ, বলেছিলাম আমি। টুপিটাও একেবারে নাকের ওপর। কাপড়চোপড়ে এত ফিটফাট আর ঢাকা যে, মনে হচ্ছে কোনো দাগী আসামী। বিলকে এটাই বলেছি আমি। তাই না, বিল?

ঠিক এটাই বলেছো তুমি, আবারও সম্মতি দিলো বিল।  

আজব বলেছি ঠিক আছে, তবে কোনো কিছু সন্দেহ করেছি বললে ভুল হবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছে ভেবে তাকে আর দোষ দিইনি। তার ওপর যেই ভয়ংকর ঠান্ডা পড়ছিল সেদিন!

আসলেই! একমত হলো বিল।

তারপর আমি বিলকে বললাম, আচ্ছা, নোটবুকটা গুরুত্বপূর্ণ কিনা দেখি। কথা মতো ওটা হাতে নিই, স্যার। দুইটা ঠিকানা লেখা, বিলকে বললাম আমি। সেভেন্টি-ফোর কালভার স্ট্রিট এর একটা নিচু মানের ম্যানর হাউজ।

বিলাসবহুল, অসম্মতিতে নাক দিয়ে শব্দ করল বিল। আবারও নিজের গল্পে ফিরে গেলেও জোকে দেখে মনে হচ্ছে, এইমাত্র জখম হয়েছে যেন।

সেভেন্টি-ফোর কালভার স্ট্রিট, বিলকে বললাম আমি। এই মোড়টা পেরিয়ে গেলেই পড়ে জায়গাটা। তারপর পৃষ্ঠার ওপরে একটা লেখা একটা চোখে পড়ে আমার। এটা কী? বিলকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। বিল তখন আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়ে শোনায়।

থ্রি ব্লাইন্ড মাইস-হয়তো লোকটার দরজার বেলে এই গানটা বাজে, বলল বিল। আর ঠিক তখনই, জি স্যার, ঠিক তখনই কিছু মহিলার চিৎকার শুনতে পাই আমরা। খুন! খুন! দুইটা রাস্তার ওপাশ থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল তারা।

নাটকীয় ভঙ্গিতে ঠিক চমকের জায়গায় এসে বিরতি নিলো জো। তারপর আবার বলতে লাগল, চিৎকার শুনেই সতর্ক হয়ে যাই আমরা, তাই না? ওখানে বিলকে বলি আমি, একটু গিয়ে দেখ তো। কথামতো বিল দেখতে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানায়, পুলিশসহ অনেক মানুষের জটলা। এক মহিলার গলা কাটা হয়েছে নাকি ফাঁস দিয়ে মারা হয়েছে বলল। জায়গাটার মালকিনই লাশটা দেখে পুলিশে খবর দেয়। কোথায়? বিলকে জিজ্ঞেস করি আমি। কালভার স্ট্রিটে, বলল সে। কত নাম্বার রোড? আবারও উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু বিল বলল, ওটা খেয়াল করেনি সে।

কাশি দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়ের অবস্থান বদল করল বিল। মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, নিজের এই অসতর্কতার কথা প্রকাশ করে অবিচার করা হচ্ছে তার ওপর।

তাই আমি বললাম, আমরা বরং দেখে নিশ্চিত হয়ে আসি। আর যখন দেখলাম, আমরা যেই ঠিকানা নিয়ে কথা বলছিলাম অর্থাৎ সেভেন্টি ফোর, তখন বিল বলল, হয়তো এই নোটবুকের লেখার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। আর আমি বললাম, হয়তো আছে। যাই হোক, নিজেদের মধ্যে অনেক শলাপরামর্শ করেছি আমরা। তখনই জানতে পারি, ঠিক খুনের সময় ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছে পুলিশ। তাই এসে জানতে চাইলাম, যিনি কেসটার দায়িত্বে আছেন, তার সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা। একটু থেমে আবারও বলল জো, আশা করি, আপনার সময় নষ্ট করছি না আমরা।

না না, একদম ঠিক কাজ করেছেন আপনারা, সম্মতি দিলো পার্মিন্টার। নোটবুকটা সাথে এনেছেন? আহ, ধন্যবাদ। এবার...  

দ্রুত ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রশ্ন একের পর এক প্রশ্ন করে গেল সে। স্থান, সময় ও তারিখ সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পেলেও নোটবুক ফেলে যাওয়া লোকটার চেহারার কোনো বর্ণনা সে পায়নি। যেটুকু পেয়েছে, সেটা আগেই হিস্টিরিয়া রোগী ঐ মালকিন বলেছে-চোখ ঢেকে রাখা হ্যাট, বোতাম লাগানো কোট, মুখের নিম্নাংশে প্যাচানো মাফলার, ফিসফিসে গলার স্বর এবং গ্লাভস লাগানো হাত।

লোক দুটো চলে যাওয়ার পরও অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো না তার। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোটো নোটবুকের দিকে। শীঘ্রই দায়িত্বাধীন ডিপার্টমেন্টের কাছে চলে যাবে এটা, সেখানে পরীক্ষা করে দেখা হবে কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায় কিনা। যদিও এই মুহূর্তে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে নোটবুকে লেখা ঠিকানা দুটো ও পৃষ্ঠার ওপর দিকে ছোটোছোটো অক্ষরে লেখা লাইনটার ওপর।

ঘরের মধ্যে সার্জেন্ট কেইনের আগমনে মাথা তুলল সে। বলল, এসো, কেইন। এটা দেখ তো।

পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধের ওপর দিয়ে লেখাটা পড়েই শিস দিয়ে উঠল কেইন। থ্রি ব্লাইন্ড মাইস। ওয়েল, অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা।  

হ্যাঁ। একটা ড্রয়ার খুলে নোটবুকের একটা পৃষ্ঠার অর্ধেক বের করে আনলো পার্মিন্টার। তারপর ডেস্কের ওপর সেগুলোকে ছড়িয়ে দিলো নোটবুকের পাশেই। নিরীক্ষার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেগুলোর ওপর। খুন হওয়া মহিলার সঙ্গে খুব সাবধানে আটকে রাখা হয়েছিল এই কাগজটা।।

ওপরে লেখা, এটা প্রথম। তার ঠিক নিচেই বাচ্চাদের মতো কাঁচা হাতে তিনটা ইঁদুর ও একটা মিউজিক বারের ছবি আঁকা। সেদিকে তাকিয়ে আবারও মোলায়েম কণ্ঠে শিস দিয়ে গাইলো কেইন।

 

থ্রি ব্লাইন্ড মাইস

সি হাউ দে রান...

 

অল রাইট, এটা তাহলে সিগনেচার টিউন।  

উন্মাদ একটা, তাই না, স্যার?

হুঁ, ভ্রুকুটি করল পার্মিন্টার। মহিলার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে?

জি, স্যার। এই যে, এটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট। নিজেকে মিসেস লিওন বলে পরিচয় দিলেও তার আসল নাম ছিল মরিন গ্রেগ। দুমাস আগেই কারাভোগ করে হলওয়ে থেকে মুক্তি পেয়েছিল।  

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো পার্মিন্টার, মরিন লিওন পরিচয়ে সেভেন্টি-ফোর কালভার স্ট্রিটে উঠেছিল সে। মাঝে মাঝে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরতো, আর দুয়েকবার পুরুষ মানুষ সঙ্গে নিয়ে আসার কথাও শোনা গেছে। কোনোকিছুর প্রতিই ভয় ছিল না তার, এমনকি কোনো মানুষের প্রতিও নয়। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, কখনো নিজের কোনো বিপদের আশঙ্কা করেনি সে। লোকটা বেল বাজিয়ে তাকে চাইলে বাড়ির মালকিন তাকে দোতলায় উঠে যেতে বলেন। লোকটার চেহারা ভালো করে দেখেননি তিনি। শুধু জানেন, মাঝারি উচ্চতা ও ঠান্ডায় গলা বসে যাওয়ায় ফাসফেঁসে গলায় কথা বলছিল সে। যাই হোক, এরপর আবারও বেজমেন্টে নিজের কাজে ফিরে যান তিনি। তখন পর্যন্ত সন্দেহজনক কিছু শোনেননি বা লোকটাকেও বাইরে যেতে দেখেননি। দশ মিনিট বাদে কিংবা আরেকটু দেরিতে ভাড়াটিয়ার জন্য চা নিয়ে ওপরে গেলে তাকে শ্বাসরোধ করা অবস্থায় আবিষ্কার করেন। এটা মোটেও আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, কেইন। বরং খুবই সাবধানতার সঙ্গে পরিকল্পিত খুন। একটু বিরতি নিয়ে বেশ জোর গলায় যোগ করল সে, ভাবছি, ইংল্যান্ডে মঙ্কসওয়েল ম্যানর নামে ঠিক কতগুলো বাড়ি আছে?   

হয়তো শুধু একটাই, স্যার।

ভাগ্য তাহলে একটু বেশিই ভালো বলতে হবে। যাই হোক, খোজ নাও, নষ্ট করার মতো কোনো সময় নেই আমাদের হাতে।  

বিবেচনার ভঙ্গিতে নোটবুকের এন্ট্রি দুটির ওপর দৃষ্টি স্থির করল সার্জেন্ট

74 Culver Street;

Monkswell Manor

তাহলে আপনার মনে হয়...

অবশ্যই, তোমার মনে হয় না? দ্রুত বলে উঠল পার্মিন্টার 

হতে পারে। মঙ্কসওয়েল ম্যানর, কোথায় যেন দেখেছি... কোথায়... আচ্ছা, আপনি জানেন, স্যার? কসম করে বলতে পারি, খুব বেশিদিন হয়নি নামটা দেখেছি আমি।

কোথায়?

সেটাই তো মনে করার চেষ্টা করছি। এক মিনিট...পত্রিকা, টাইমস, ব্যাক পেইজ। দাঁড়ান দাঁড়ান, হোটেল অ্যান্ড বোর্ডিংহাউজ...আরেকটু, স্যার...পুরোনো পত্রিকা, ক্রসওয়ার্ড করছিলাম আমি। বিড়বিড় করতে করতেই প্রায় দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে। পরক্ষণেই মুখে রাজ্যজয়ের হাসি নিয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়লো ডেস্কের সামনে। এই যে, স্যার, পেয়েছি।

নির্দেশ করা আঙুলের দিকে তাকালো ইন্সপেক্টর। মঙ্কসওয়েল ম্যানর, হার্পল্যাডেন, বার্কস। 

 

নিজের দিকে টেলিফোন টেনে নিলো সে। বার্কশায়ার কান্ট্রি পুলিশের নাম্বার দাও আমাকে। 

১ম পর্ব শেষ। 

বাকি তিনটি পর্বের লিঙ্কঃ 

১ম পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation 
২য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ – আগাথা ক্রিস্টি – বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 2 of 4
৩য় পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 3 of 4

৪র্থ পর্বঃ থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ  আগাথা ক্রিস্টি  বাংলা অনুবাদ - Three Blind Mice - Agatha Christie – Bangla Translation – Part 4

Tags: বড় গল্প, থ্রিলার গল্প, গোয়েন্দা গল্প, আগাথা ক্রিস্টি রচনাসমগ্র pdf, গোয়েন্দা উপন্যাস, থ্রি ব্লাইন্ড মাইছ pdf, আগাথা ক্রিস্টি, বাংলা অনুবাদ, Three Blind Mice bangla pdf, Agatha Christie

No comments:

Post a Comment

Popular Posts