মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, July 16, 2021

জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা - সত্যজিৎ রায় - গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo (Part 2 of 3)

 

feluda series,feluda samagra,feluda somogro,জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা,সত্যজিৎ রায়,গোয়েন্দা গল্প,Jahangirer Swarnamudra,Satyajit Ray,goyenda golpo

Part 1 link : জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা 

জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা সত্যজিৎ রায় গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo (Part 2 of 3)


সেও কাল অবধি কিছুই জানত না,' বললেন শঙ্করবাবু, কাল আপনাকে ইনভাইট করার পর ওকে বলি 

উনি কী বললেন? 

খুব চোটপাট করল বললতুমি অ্যাদ্দিন চেপে রেখেছে ব্যাপারটাতখন-তখনই পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল এক বছর পরে কি মিঃ মিত্তির কিছু করতে পারবেন, ইত্যাদি 

একটা কথা বলব মিঃ চৌধুরী? 

বলুন

আপনি মানুষটা এত নরম বলেই কিন্তু চোর তার সুযোগটা নিয়েছিল অতিথিকে চুরির অপবাদ দিতে সবাই পেছপা হত না 

সেটা জানি সেই জন্যই আপনাকে ডাকা আমি যেটা পারিনি, সেটা আপনি পারবেন আশা করি 

 

।। ২ ।।

সর্ষে বাটা দিয়ে চমৎকার গঙ্গার ইলিশ সমেত দুপুরের খাওয়াটা হল ফার্স্ট ক্লাস জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আলাপ হল খাবার টেবিলেই ইনি মাঝারি হাইটের চেয়েও কম, বেশ সুখী সবল মানুষ শঙ্করবাবুর পার্সোনালিটি এর নেই, কিন্তু বেশ হাসিখুশি চালাক চতুর লোক 

খাবার পর শঙ্করবাবু বললেন, আপনাদের এখন আর ডিস্টার্ব করব না, যা মন চায় করুন আমি একটু গড়িয়ে নিই বিকেলে চায়ের সময় বারান্দায় আবার দেখা হবে 

আমরা জয়ন্তবাবুর সঙ্গে বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখব বলে বেরোলাম 

পশ্চিম দিকে একটানা একটা নিচু থামওয়ালা পাঁচিল চলে গেছে নদীর ধার দিয়ে পাঁচিলের পরেই জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে জল অবধি এই পাঁচিলই বাকি তিনদিকে হয়ে গেছে দেড় মানুষ উঁচু জয়ন্তবাবুর ফুলের শখ, তাই তিনি আমাদের বাগানে নিয়ে গিয়ে গোলাপ সম্বন্ধে একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিয়ে দিলেন গোলাপ যে তিনশো রকমের হয় তা এই প্রথম জানলাম 

বাড়ির উত্তরে গিয়ে দেখলাম সেদিকে আরেকটা গেট রয়েছে শহরের কোথাও যেতে হলে এই গেটটাই নাকি ব্যবহার করা হয় আরেকটা সিঁড়িও রয়েছে এদিকে জয়ন্তবাবু বললেন খুড়ীমা, মানে ওঁর মা, গঙ্গাস্নানে যেতে ওটাই ব্যবহার করেন একতলায় নদীর দিকে আর গঙ্গার দিকে চওড়া বারান্দা, দুদিক দিয়েই সিঁড়ি রয়েছে নিচে নামার জন্য  

দেখা শেষ হলে পর আমরা ঘরে ফিরে এলাম জয়ন্তবাবু কাচের ঘরে চলে গেলেন অর্কিড দেখার জন্য

আমাদের থাকার জন্য একতলায় একটা প্যাসেজের এক দিকে পর পর দুটো ঘর দেওয়া হয়েছে উল্টোদিকে আরো তিনটে পাশাপাশি ঘর দেখে মনে হল তাতেই বোধহয় তিনজন অতিথি থাকবেন ঘরে ঢুকে খাটে নরম বিছানা দেখে লালমোহনবাবু বোধহয় দিবানিদ্রার তাল করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললেন, পাখির বইগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার। 

আমি একটা কথা ফেলুদাকে না জিগ্যেস করে পারলাম না 

আচ্ছা, এক বছর আগে যে লোক চুরি করেছে, সে যদি এবার আর চুরি না করে, তাহলে তুমি চোর ধরবে কি করে?  

ফেলুদা বলল, সেটা এই তিন ভদ্রলোককে স্টাডি না করে বলা শক্ত যার মধ্যে চুরির প্রবৃত্তি রয়েছে, তার সঙ্গে আর পাঁচটা অনেস্ট লোকের একটা সূক্ষ্ম তফাত থাকা উচিত চোখ কান খোলা রাখলে সে তফাত ধরা পড়তে পারে ভূলিস না, যে লোক চুরি করে তার বাইরেটা যতই পালিশ করা হোক না কেন তাতে আর ভদ্রলোক বলা চলে না সত্যি বলতে কি ভদ্রলোক সাজার জন্য তাকে যথেষ্ট অভিনয় করতে হয় 

বিকেলে পর পর দুটো গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বুঝলাম অতিথিরা এসে গেছেন বারান্দায় চায়ের আয়োজন হলে পর শঙ্করবাবুই আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তিন গেস্টের সঙ্গে আলাপ করানোর জন্যে 

ডাঃ সরকার এক মাইলের মধ্যেই থাকেন, ইনি হেঁটেই এসেছেন বছর পঞ্চাশ বয়স চোখে চশমা মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে গোফটা কাচা হলেও কানের পাশের চুলে পাক ধরেছে 

নরেশ কাঞ্জিলাল বিরাট মানুষ, ইনি সুট-টাই পরে সাহেব সেজে এসেছেন ফেলুদার পরিচয় জেনে বললেন, বনোয়ারিলালের জীবনী লেখার কথা আমি শঙ্করকে অনেকবার বলেছি আপনি কাজের ভারটা নিয়েছেন শুনে খুশি হলাম হি ওয়াজ রিমার্কেবল ম্যান  

মজার লোক হলেন কালীনাথ রায় এর কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে, তাতে হয়ত ম্যাজিকের সরঞ্জাম থাকতে পারে লালমোহনবাবুর সঙ্গে পরিচয় হতেই বললেন, পক্ষিবিন্দু যে মুরগীর ডিম পকেটে নিয়ে ঘোরে তা তো জানতুম না মশাই' কথাটা বলেই খপ করে লালমোহনবাবুর পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা মুরগীর ডিমের সাইজের মসৃণ সাদা পাথর বার করে দিয়ে আক্ষেপের সূরে বললেন, হে হে, যে দেখছি পাথর! আমি ফ্রাই করে খাবার মতলব করেছিলুম  

কথা হল রাত্তিরে খাবার পর কালীনাথবাবু তার হাতসাফাই দেখাবেন সূর্য হেলে পড়েছে, গঙ্গার জল চিক চিক করছে, ঝিরঝিরে হাওয়া, তাই বোধহয় নরেশবাবু আর কালীনাথবাবু নেমে গেলেন বাইরের শোভা উপভোগ করতে লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উসখুস্ করছিলেন, এবার বাইনোকুলার বার করে উঠে পড়ে বললেন, দুপুরে যেন একটা প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচারের ডাক শুনেছিলুম দেখি তো পাখিটা আশেপাশে আছে কিনা  

ফেলুদার গম্ভীর মুখ দেখে আমিও হাসিটা কোনোমতে চেপে গেলাম 

ডাক্তার সরকার চায়ে চুমুক দিয়ে শঙ্করবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আপনার ভ্রাতাটিকে দেখছি নাসে কি বাগানে ঘুরছে নাকি?  

ওর ফুলের নেশার কথা আপনি জানেন  

ওঁকে বলেছি মাথায় টুপি না পরে যেন রোদে না ঘোরেন সে আদেশ তিনি মেনেছেন কি? 

জয়ন্ত কি ডাক্তারের আদেশ মানার লোক? আপনি তাকে চেনেন না?

ফেলুদা যে চারমিনার হাতে আড়চোখে ডাক্তারের কথাবার্তা হাবভাব লক্ষ্য করে যাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি 

আপনার খুড়ীমা কেমন আছেন? শঙ্করবাবুর দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন ডাঃ সরকার 

এমনিতে ভালোই, বললেন শঙ্করবাবু, তবে অরুচির কথা বলছিলেন যেন আপনি একবার ঢু মেরে আসুন না  

তাই যাই  

ডাঃ সরকার চলে গেলেন খুড়ীমাকে দেখতে প্রায় একই সঙ্গে জয়ন্তবাবু ফিরে এলেন বাগান থেকে ঠোটের কোণে হাসি।। 

কী ব্যাপার? হাসির কি হল? জিজ্ঞেস করলেন শঙ্করবাবু 

জয়ন্তবাবু টি পট থেকে কাপে চা ঢেলে নিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আপনার বন্ধু কিন্তু চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে বেদম অভিনয় করে যাচ্ছেন পক্ষিবিদের  

ফেলুদাও হেসে বলল, অভিনয় আজ সকলকেই করতে হবে অল্পবিস্তর আপনার দাদার পরিকল্পনাটাই নাটকীয়  

জয়ন্তবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন আপনি কি দাদার পরিকল্পনা অ্যাপ্রুভ করেন?  

আপনি করেন না বলে মনে হচ্ছে? বলল ফেলুদা 

মোটেই না, বললেন জয়ন্তবাবু আমার ধারণা চোর অত্যন্ত সেয়ানা লোক সে কি আর বুঝবে না যে তার জন্য ফাঁদ পাতা হচ্ছে? সে কি জানে না যে দাদা অ্যাদ্দিনে টের পেয়েছে যে সিন্দুকের একটি মূল্যবান জিনিস গায়েব হয়ে গেছে?  

সবই বুঝি, বললেন শঙ্করবাবু, কিন্তু তাও আমি ব্যাপারটা ট্রাই করে দেখতে চাই ধরে নাও এটা আমার গোয়েন্দাকাহিনী প্রীতির ফল  

তুমি কি সিন্দুকের বাকি সব জিনিসই বার করতে চাও?  

না শুধু ইটালিয়ান নস্যির কৌটো আর মোগলাই সূরাপাত্র ডাঃ সরকার খুড়ীমাকে দেখতে গেছেন উনি এলেই তুমি ওপরে গিয়ে জিনিস দুটো বার করে আনবে আমি পকেটে রেখে দেব এই নাও চাবি  

জয়ন্তবাবু, অনিচ্ছার ভাব করে চাবিটা নিলেন 

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ডাঃ সরকার ফিরে এলেন ভদ্রলোক হেসে বললেন, দিব্যি ভালো আছেন আপনার খুড়ীমা বারান্দায় বসে দূধভাত খাচ্ছেন আপনাদের আরো অনেকদিন জ্বালাবেন

জয়ন্তবাবু, চুপচাপ উঠে পড়লেন 

কী বসে আছেন চেয়ারে? ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন ডাঃ সরকার চলুন একটু হাওয়া খাবেন হাওয়া কলকাতায় পাবেন না  

শঙ্করবাবু সমেত আমরা চারজনই সিঁড়ি দিয়ে নামলাম বাঁয়ে চেয়ে দেখি লালমোহনবাবু বাগানের মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছেন পেলেন আপনার প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচারের দেখা? জিগ্যোস করল ফেলুদা 

না, তবে এইমাত্র একটা জাঙ্গল ব্যাবলার দেখলুম মনে হয়

এখন পাখিদের বাসায় ফেরার সময়, বলল ফেলুদা এর পরে প্যাঁচা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না  

বাকি দুজনে গেলেন কোথায়? বাড়ির সামনের দিকে কি, না কাঁচের ঘরের পিছনে ফলবাগানে? 

শঙ্করবাবুর বোধহয় একই প্রশ্ন মনে জেগেছিল, কারণ উনি হাঁক দিয়ে উঠলেন কই হে, নরেশ? কালীনাথ গেলে কোথায়? 

একজনকে দেখলুম এদিকের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে, বললেন লালমোহনবাবু 

কোনজন? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু বোধহয় সেই ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক  

কিন্তু লালমোহনবাবু ভুল দেখেছিলেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন কালীনাথবাবু নয়, নরেশ কাঞ্জিলাল 

সন্ধের দিকে ঝপ করে টেমপারেচারটা পড়ে, বললেন কাঞ্জিলাল, তাই আলোয়ানটা চাপিয়ে এলাম 

আর কালীনাথ? প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু 

সে তো বাগানে নেমেই আলাদা হয়ে গেল বলছিল শুকনো ফুলকে টাটকা করে দেবার একটা ম্যাজিক দেখাবে, তাই মিঃ কাঞ্জিলালের কথা আর শেষ হল না, কারণ সেই সময় বুড়ো চাকর অনন্তর চিৎকার শোনা গেল  

দাদাবাবু!  

অনন্ত গঙ্গার দিকের বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে নেমে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ছুটে এল আমাদের দিকে 

কী হল অনন্ত? শঙ্করবাবু উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করে এগিয়ে গেলেন ছোট দাদাবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন দোতলায়  

 

।। ৩ ।।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ল্যান্ডিং পেরিয়েই খুড়ীমার ঘর, সেটা আগেই বলেছি জয়ন্তবাবু সেই ঘরে চৌকাঠের হাত তিনেক এদিকে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর মাথার পিছনের মেঝেতে খানিকটা রক্ত চুইয়ে পড়েছে ডাক্তার সরকার দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে সবচেয়ে আগে পৌছে জয়ন্তবাবুর নাড়ী টিপে ধরলেন ফেলুদাও প্রায় একই সঙ্গে পৌছে জয়ন্তবাবুর পাশে হাটু গেড়ে বসেছে তার মুখ গভীর কপালে খাজ 

কী মনে হচ্ছে? চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু

পাল্ সামান্য দ্রুত, বললেন ডাঃ সরকার

মাথার জখমটা?’ 

মনে হচ্চে পড়ে গিয়ে হয়েছে এই সময় খালি মাথায় রোদে ঘোরা ডেনজারাস সেটা অনেকবার বলেছি ওঁকে  

কনকাশন?

সেটা পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব না আজ আবার আমি যন্ত্রপাতি কিছুই আনিনি সঙ্গে একবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হত  

তাই করুন না গাড়ি রয়েছে  

ভদ্রলোক বেশ ভালো ভাবেই অজ্ঞান হয়েছেন, কারণ ফেলুদা সমেত চারজন ধরাধরি করে গাড়িতে তোলার সময়ও তার জ্ঞান হল না সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অবিশ্যি কালীনাথবাবুর সঙ্গেও দেখা হল বললেন, আমি জাস্ট ওষুধটা খাবার জন্য ঘরে গেছিআর তার মধ্যে এই কান্ড!  

আমি সঙ্গে আসব কি? শঙ্করবাবু ডাক্তারকে জিগ্যেস করলেন 

কোনো দরকার নেই, বললেন ডাঃ সরকার, আমি হাসপাতাল থেকে আপনাকে ফোন করব  

গাড়ি চলে গেল এই দুর্ঘটনার জন্য শঙ্করবাবুর প্ল্যান যে ভেস্তে গেল সেটা বুঝতে পারছি বেচারী ভদ্রলোকের জন্মতিথিতে এমন একটা ঘটনা ঘটার জন্য আমারও খারাপ লাগছিল 

আমরা সবাই এসে বসবার ঘরে বসেছিলাম, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফেলুদা কেন যে, আমি, আসছি বলে উঠে গেল তা জানি না অবিশ্যি মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আবার ফিরে এল 

শঙ্করবাবু অতিথিদের সামনে যথাসম্ভব স্বাভাবিক হাসিখুশি ব্যবহার করছিলেন এমনকি তাঁর আশ্চর্য প্রপিতামহ সম্বন্ধে অদ্ভুত সব ঘটনাও বলছিলেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে সেটা করতে তাঁর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে 

প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পর হাসপাতাল থেকে ডাঃ সরকারের ফোন এল জয়ন্তবাবুর জ্ঞান হয়েছে তিনি অনেকটা ভালো মনে হচ্ছে কাল সকালেই আসতে পারবেন  

এই সুখবরের পর অবিশ্যি ঘরের আবহাওয়া খানিকটা হালকা হল, কিন্তু আমি জানি যে শঙ্করবাবুর মোটেই ভালো লাগছে না, কারণ চোরের রহস্য রহস্যই থেকে যাবে খাওয়া দাওয়ার পর ভিত্তিও ক্যাসেটে ছবি দেখতে চাই কিনা জিগ্যেস করাতে আমরা সকলেই না বললাম অবস্থায় ফুর্তি চলে না তাই ম্যাজিকও বাদ পড়ল 

সকলকে গুড নাইট জানিয়ে নিজেদের ঘরে আসতেই আমি যে প্রশ্নটা ফেলুদাকে করব ভাবছিলাম, সেটা লালমোহনবাবু করে ফেললেন 

আপনি তখন ফস করে বেরিয়ে কোথায় গেলেন মশাই?

খুড়ীমার ঘরে

খুড়ীমাকে দেখতে গিয়েছিলেন? অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু

সেই সঙ্গে অবিশ্যি সিন্দুকের হাতল ধরে একটা টানও দিয়ে এলাম

খোলা নাকি? 

বন্ধ সেটাই স্বাভাবিক যে ভাবে ঘরের দরজার দিকে পা করে পড়ে ছিলেন ভদ্রলোক, তাতে মনে হয় ঘরে ঢোকার আগেই পড়েছেন

কিন্তু চাবিটা কোথায়, ফেলুদা? আমি জিগ্যেস করলাম প্রশ্নটা কিছুক্ষণ থেকেই আমার মাথায় ঘুরছিল  

ফেলুদা বলল, শঙ্করবাবু হয়ত দুর্ঘটনায় ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন

কথাটা বলতে বলতেই শঙ্করবাবু এসে ঢুকলেন আমাদের ঘরে দেখুন কী বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল! বললেন ভদ্রলোক জয়ন্তর আরেকবার এরকম হয়েছিল ওর ব্লাড প্রেশারটা একটু বেশি নেমে যায় মাঝে মাঝে

ফোনে আর কী বললেন ডাঃ সরকার? 

সেটাই বলতে এলাম তখন লোকজনের সামনে বলিনি চাবির কথাটা গোলমালে ভুলেই গিয়েছিলাম; এখন কী হয়েছে জানেন ? ডাক্তারকে জিগ্যেস করতে বললেন জয়ন্তর কাছে চাবি ছিল না হয়ত অজ্ঞান হবার সময় হাত থেকে পড়ে গেছে  

আপনি খুঁজেছেন চাবি?’ 

তন্ন তন্ন করে সিঁড়ি, ল্যান্ডিং, সদর দরজার বাইরে কোথাও বাদ দিইনি সে চাবি হাওয়া 

যাকগে, ডুপলিকেট আছে , বলল ফেলুদা নিয়ে ভাববেন না  

তা না হয় ভাবব না, গম্ভীরভাবে বললেন শঙ্করবাবু, কিন্তু রহস্য দুর হল না! চোর অজ্ঞাতই রয়ে গেল আর আপনাকে একটা মাথা খেলানোর সুযোগ দেব ভেবেছিলাম, সেটাও হল না  

তাতে কী হল? ফেলুদা বলল এখানে এসে লাভ হয়েছে বিস্তর একে এরকম বাড়ি, তার উপর আপনার আতিথেয়তা  

শঙ্করবাবু যাবার আগে বলে গেলেন যে সকালে সাড়ে ছটায় চা দেবে, আর আটটায় ব্রেকফাস্ট 

এটা অ্যাটেমটেড মার্ডার নয়ত মশাই? লালমোহনবাবু ফিস্ ফিস্ করে প্রশ্ন করলেন মিঃ কাঞ্জিলাল আর মিঃ ম্যাজিশিয়ান দুজনেই কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলেন  

মার্ডারের দরকার কী? কার্যসিদ্ধির জন্য শুধু অজ্ঞান করলেই চলে

কার্যসিদ্ধি?  

জয়ন্তবাবুকে অজ্ঞান করে তাঁর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে সিন্দুক খুলে যা বার করার বার করে আবার হাতে চাবি গুজে দিয়ে চলে আসা  

সর্বনাশ! এটা খেয়াল হয়নি আমার আমি বললাম তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এখন তিনজনের জায়গায় সাসপেক্ট মাত্র দুজন কাঞ্জিলাল আর কালীনাথ  

নারে তোপসে, বলল ফেলুদা, ব্যাপারটা অত সহজ নয় জয়ন্তবাবুর মাথায় কেউ বাড়ি মারলে সেটা তিনি জ্ঞান হলে বলতেন; তা তো বলেননি আর অজ্ঞান করে যে সিন্দুক খুলবে সেটাই বা কি করে সম্ভবখুড়ীমা ঘরে থাকতে পারেন একজন বাইরের লোক সিন্দুক খুলছে দেখলে কি তিনি চুপ করে থাকতেন? 

একটা আশার আলো জ্বলতে না জ্বলতে নিভে গেল আমি শুয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু অত তাড়াতাড়ি আর ঘুমোন হল না ফেলুদা এমনিতেও পায়চারি করছিল, বারোটা নাগাদ লালমোহনবাবু হঠাৎ আমাদের ঘার এসে নিচু গলায় বললেন, বারান্দায় গেসলুম চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, মশাইউপচে পড়ে আলো! 

উপচে নয়, উছলে, বলল ফেলুদা

সরি, উছুলে কিন্তু একবার বাইরে এসে দেখুন দৃশ্য দেখবেন না কখেনো  

আপনি একা কাব্যি করবেন, এটা হতে দেওয়া যায় না, বলল ফেলুদা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম 

বাইরে গিয়ে মনে হল যেন দিনের বেলার দৃশ্যর চেয়েও আরো বেশি সুন্দর একটা পাতলা কুয়াশা নদীর ওপারটাকে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলেছে গঙ্গার আবছা গাঢ় জলের উপর ছড়ানো চাঁদির টুকরোগুলো ধীরে ধীরে দুলছে তারই মধ্যে ঝিঁঝিঁর ডাক, হাস্নাহেনার গন্ধ, ফুরফুরে বাতাস, সব মিলিয়ে সত্যিই অমরাবতী।। 

ফেলুদা ত্রয়োদশীর চাঁদটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, চাঁদের মাটিতে মানুষের পা পড়লেও, এর মজা কোনোদিন নষ্ট করতে পারবে না  

একটা মারাত্মক পোয়েম আছে চাদ নিয়ে, বললেন লালমোহনবাবু আপনার এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনের সেই বাংলার শিক্ষকের লেখা?  

ইয়েস বৈকুণ্ঠ মল্লিক এই পোড়া দেশে লোকটা রেকগনিশন পেলে না, কিন্তু আপনি শুনুন কবিতাটা শোনো, তপেশ  

এতক্ষণ আমরা নিচু গলায় কথা বলছিলাম কিন্তু আবৃত্তির সময় লালমোহন-বাবুর গলা আপনা থেকেই চড়ে গেল 

আহা, দেখ চাদের মহিমা 

কভু বা সুগোল রৌপ্যথালি

কভু আধা কভু সিকি কভু একফালি 

যেন সদ্য কাটা নখ পড়ে আছে নভে

সেটুকুও নাহি থাকে, যবে 

আসে অমাবস্যা

সেই রাত্রে তুমি তাই 

অচন্দ্রপশ্যা!

বুঝতেই পারছ, তপেশ, পদ্যটা একজন লেডিকে অ্যাড্রেস করে লেখা

একজন লেডিকে আপনি আবৃত্তির ঠেলায় ঘর থেকে টেনে বার করেছেন দেখছি  

ফেলুদার দৃষ্টি দোতলার বারান্দার দিকে ওই যে খুড়ীমার ঘর বৃদ্ধা বারান্দার দরজার মুখটাতে এসে দাঁড়িয়েছেন মিনিটখানেক এদিক ওদিক দেখে আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন 

এর পরে আমরা ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসেছিলাম আধ ঘণ্টা! মনমেজাজ তাজা, রাতের খাওয়া হজম তারপর এক সময় ফেলুদা তার হাতঘড়ির রেডিয়াম ডায়াল চোখের সামনে ধরে বলল, পৌনে এক 

আমরা তিনজনেই উঠে পড়লাম, আর তিনজনেই একসঙ্গে শুনলাম শব্দটা সেটা যেন আসছে বাড়ির দোতলা থেকেই খট খট ঠং ঠং খট্ খট্ খট্‌... আমরা ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম

৩য় পর্ব লিঙ্ক ঃ জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা - সত্যজিৎ রায় - গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo (Part 3 of 3)

Tags: feluda series,feluda samagra,feluda somogro,জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা,সত্যজিৎ রায়,গোয়েন্দা গল্প,Jahangirer Swarnamudra,Satyajit Ray,goyenda golpo

No comments:

Post a Comment

Popular Posts