মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, July 16, 2021

জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা - সত্যজিৎ রায়- গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo


feluda series,feluda samagra,feluda somogro,জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা,সত্যজিৎ রায়,গোয়েন্দা গল্প,Jahangirer Swarnamudra,Satyajit Ray,goyenda golpo

জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা সত্যজিৎ রায় - গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo (Part 1 of 3)

-হ্যালোপ্রদোষ মিত্র আছেন? 

-প্রদোষ মিত্রই বলছি

-ধরুনপানিহাটি থেকে কল আছে আপনার..... হ্যাঁ, কথা বলুন

-হ্যালো

-কে, মিঃ প্রদোষ মিত্র? 

-বলছি

-আমার নাম শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরী আমি পানিহাটি থেকে বলছি আমি অবিশ্যি আপনার অপরিচিত, কিন্তু একটা বিশেষ অনুরোধ জানাতে আপনাকে টেলিফোন করছি 

-বলুন

-আমার ইচ্ছা আপনি একবার আমার এখানে আসেন

-পানিহাটি? 

-আজ্ঞে হ্যা আমি এখানেই থাকি গঙ্গার উপরে আমাদের একটা একশো বছরের পুরোন বাড়ি আছে নাম অমরাবতী এখানে সকলেই জানে আপনার কাজের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে, এবং আপনারা যে তিনজন একসঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তাও আমি জানি আমি আপনাদের তিনজনকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এই শনিবার সকালে এসেএই ধরুন দশটা নাগাদরাত্তিরটা থেকে আবার রবিবার ফিরে যাবেন 

-কোনো অসুবিধায় পড়েছেন কি? মানে আমার পেশাটা জানেন; কোনো রহস্য--?

-তা না হলে আপনাকে ডাকব কেন বলুন? তবে সে বিষয়ে আমি ফোনে বলব না, আপনি এলে বলব আমার বাড়িটা আপনাদের ভালোই লাগবে, ভালো ইলিশ মাছ খাওয়াব, যদি ভিডিও ক্যাসেটে ছবি দেখতে চান তাও দেখাব, আর তার উপরে আপনার মস্তিষ্ক খাটানোর খোরাকও জুটবে বলে মনে হয় 

-আমার অবিশ্যি এখন এমনিতে কোনো এনগেজমেন্ট নেই

-তাহলে চলে আসুন——দ্বিধা করবেন না তবে একটা কথা 

-কী?

-এখানে আমি ছাড়াও কয়েকজন থাকবেন গোড়ায় আমি কাউকে আপনার আসল পরিচয়টা দিতে চাই নাএকটা বিশেষ কারণে 

-ছদ্মবেশ নিয়ে আসতে বলছেন? 

-সেটার হয়ত প্রয়োজন নেই আপনি ফিল্মস্টার নন যারা এখানে শুধু আপনাদের তিনজনের জন্য তিনটি ভূমিকা বেছে নেবেন কী ভূমিকা সেটাও আমি সাজেস্ট করতে পারি

-কিরকম? 

-আমার প্রতিতামহ বনোয়ারিলাল চৌধুরী ছিলেন এক বিচিত্র চরিত্র তার কথা পরে জানবেন, কিন্তু আমি এইটুকু বলতে পারি যে তার একটা জীবনী লেখা এমনিতেও বিশেষ দরকার আপনি যদি ধরুন তাঁর সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে আসেন 

-ভেরি গুড আর আমার বন্ধুমিঃ গাঙ্গুলী আপনার বাইনোকুলার আছে?

-তা আছে 

-তাহলে ওঁকে পক্ষিবিদ করে দিন না আমার বাগানে অনেক পাখি আসে; ওঁর একটা অকুপেশন হয়ে যাবে 

-বেশ আমার খুড়তুতো ভাইটি হবেন পক্ষিবিদের ভাইপো 

-ব্যাস, তাহলে হয়েই গেল

-তাহলে পরশু শনিবার সকাল দশটা? 

-দশটা

-অমরাবতী?

-অমরাবতী আর আমার নাম শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরী 

ফেলুদাকে অবিশ্যি টেলিফোনের পুরো ব্যাপারটা আমার জন্য রিপীট করতে হল বলল, কিছু লোক আছে যাদের কণ্ঠস্বরে এমন একটা ভরসা-জাগানো হৃদ্যতাপূর্ণ ভাব থাকে যে তাদের অনুরোধ এড়ানো খুব মুশকিল হয় 

আমি বললাম, এড়াবে কেন? এঁকে একরকম মক্কেল বলেই মনে হচ্ছে তোমার রোজগারের কথাটাও ভাবতে হবে 

আসলে ফেলুদার একটা ব্যাপার আছে পর পর গোটা দুতিন কেসে ভালো রোজগার হলে কিছুদিনের জন্য গোয়েন্দাগিরিতে ইস্তফা দিয়ে অন্য জিনিস নিয়ে পড়ে সে জিনিসে অবিশ্যি রোজগার নেই, শুধু শখের ব্যাপার এখন ওর সেই অবস্থা চলেছে এখনকার নেশা হল আদিম মানুষ পাঁচবার গেছে মিউজিয়ামে, তিনবার ন্যাশনাল লাইব্রেরী আর একবার চিড়িয়াখানা মাঝে মাঝে ওর কলকাতা ছেড়ে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য বাইরে ঘুরে আসতে ভালোই লাগে এইত সেদিন আমরা লালমোহন-বাবুর গাড়িতে গিয়ে বর্ধমানের রাস্তায় পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত ঐতিহাসিক গম্বুজ আর ষোড়শ শতাব্দীর মুসলমান মসজিদ দেখে এলাম 

লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু দশদিনের ছুটিতে দেশে গেছেন বলে ফেলুদাকেই তাঁর জায়গা নিতে হল পথে যেতে যেতে লালমোহনবাবু বললেন, দিলেন মশাই একটা দায়িত্ব আর একটা বাইনোকুলার আর দুখানা বই ঘাড়ে চাপিয়ে; এদিকে গড়পারে কাক চড়ুই ছাড়া কোনো পাখি কোনে দিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না 

বই দুটো হল সেলিম আলির ইন্ডিয়ান বার্ডস আর অজয় হোমের বাংলার পাখি 

ফেলুদা বলল, কুছ পরোয়া নেহী মনে রাখবেন, কাক হল করভাস সপ্লেনডেন্স, চড়ুই হল পাসের ডোমেস্টিকাস সব সময় ল্যাটিন নাম বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে যাবে, তাই ইংরেজি নামও ব্যবহার করতে পারেনযেমন ফিঙেকে ড্রঙ্গো, টুনটুনিকে টেলর বার্ড, ছাতারেকে জাঙ্গল ব্যাবলার আর পাখি না দেখলেও, মাঝে মাঝে বাইনোকুলার চোখে লাগালেই অনেকটা কাজ দেবে 

আমার নামও একটা চাই,' বললেন লালমোহনবাবু আপনি হলেন ভবতোষ সিংহ, আপনার ভাইপো প্রবীর আর আমি সোমেশ্বর রায় 

পৌনে নটায় রওনা হয়ে আমরা দশটা বেজে পাচে পানিহাটিতে শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরীর বাড়ি অমরাবতীতে পৌছে গেলাম আমাদের গাড়ি দেখেই বন্দুকধারী গুর্খা দারোয়ান এসে বিকট ক্যাঁ-চ শব্দে লোহার গেট খুলে দিল 

ফেলুদা বলে, গল্পের শুরুতেই একগাদা বর্ণনা হড় হড় করে ঢেলে দিলে পাঠক হাবুডুবু খায়; ওটা দিবি গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তাই অনেকটা বিলিতি কাসূলের ধাঁচে তৈরি বাড়ির দক্ষিণে ফুলবাগান, তার পরে গাছপালা রাখার কাঁচের ঘর, আর তারও পরে ফলবাগান নুড়ি বিছানো প্যাচালো পথ দিয়ে আমরা সদর দরজায় পৌছলাম।। 

বাড়ির মালিক গাড়ির শব্দ পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আমরা নামলে হেসে বললেন, ওয়েলকাম টু অমরাবর্তী এর (বাড়ির মালিক) বর্ণনা হলমাঝারি হাইট, ফরসা রং, বয়স পঞ্চাশ টঞ্চাশ পরনে পায়জামা আর আদ্দির পাঞ্জাবী, পায়ে শুড় তোলা লাল চটি, ডান হাতে চুরুট 

আমার খুড়তুতো ভাই জয়ন্তও কাল এসেছে, তাকেও দলে টেনে নিয়েছি অর্থাৎ সে আপনাদের আসল পরিচয় জানলেও অন্যদের সামনে প্রকাশ করবে না’ 

অন্যরা কি এসে গেছেন? ফেলুদা জিগ্যেস করল 

না তারা আসবেন বিকেলে চলুন, একটু বসে জিরোবেন আর সেই সুযোগে কিছু কথাও হবে 

আমরা বাড়ির পশ্চিমদিকের বিরাট চওড়া বারান্দায় গিয়ে বসলাম সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায় অমরাবতীর প্রাইভেট ঘাটও দেখতে পাচ্ছি সামনে ডান দিকে একটা তোরণের নিচ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে জল অবধি 

ওই ঘাট কি ব্যবহার হয়? ফেলুদা জিগ্যেস করল 

হয় বৈকি, বললেন শঙ্করবাবু আমার খুড়ীমা থাকেন এখানে উনি রোজ সকালে স্নান করেন 

উনি একা থাকেন বাড়িতে?  

একা কেন? আমিও দুবছর হল এখানেই থাকি টিটাগড় আমার কাজের জায়গা কলকাতায় আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ির চেয়ে বাড়ি অনেক কাছে হয়

আপনার খুড়ীমার বয়স কত? 

সেভেনটি এইট আমাদের পুরোন চাকর অনন্ত ওঁর দেখাশোনা করে এমনিতে মোটামুটি শক্তই আছেন, তবে ছানি কাটাতে হয়েছে কিছুদিন হল, দাঁতও বেশি বাকি নেই, আর মাথায় সামান্য ছিট দেখা দিয়েছে নাম ভুলে যান, খেতে ভুলে যান, মাঝরাত্তিরে পান ছাঁচতে বসেনএই আর কি ঘুম এমনিতে খুবই কম-রাত্তিরে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি নয় আসলে চার বছর আগে কাকা মারা যাবার পর উনি কলকাতায় থাকতে চাননি এখানে থাকাটা ওঁর কাছে একরকম কাশীবাসের মতো 

বেয়ারা ট্রেতে করে চা আর মিষ্টি নিয়ে এল 

দুপুরে খেতে খেতে সেই একটা দেড়টা হবে, বললেন শঙ্করবাবু, কাজেই আপনারা মিষ্টির সদ্ব্যবহার করুন মিষ্টি কলকাতায় পাবেন না 

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, আমাদের আসল আর নকল দুটো পরিচয়ই জানেন, এবার আপনাদের পরিচয়টা পেলে ভালো হত আপনি কী করেন জিগ্যেস করাটা কি অভদ্রতা হবে? 

মোটেই না, বললেন শঙ্করবাবু আপনাকে ডেকেছি সব কথা খুলে বলার জন্যেই; নাহলে আপনি কাজ করবেন কি করে?--সোজা কথায় আমি হলাম ব্যবসাদার বুঝতেই পারছেন এত বড় বাড়ি যখন মেনটেন করছি তখন ব্যবসা আমার মোটামুটি ভালোই চলে 

আপনার কি বংশানুক্রমিক ব্যবসা?

না বাড়ি তৈরি করেন আমার প্রপিতামহ-বনোয়ারিলাল চৌধুরী

অর্থাৎ যার জীবনী লিখতে যাচ্ছি আমি?’ 

এগজ্যাক্টলি তিনি ছিলেন রামপুরের ব্যারিস্টার অগাধ পয়সা করে শেষ বয়সে কলকাতায় চলে আসেন; এসে এই বাড়িটা তৈরি করেন উনি এখানেই থাকতেন, এখানেই মৃত্যু হয় ঠাকুরদাদাও ব্যারিস্টার ছিলেন, তবে তাঁর পসার আমার প্রপিতামহের মতো ছিল না তার দুটো কারণ-জুয়া আর মদ তার ফলে চৌধুরী পরিবারের অবস্থা কিছুটা পড়ে যায় বাড়িতে বনোয়ারিলালের কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিলসেগুলোর কথায় পরে আসছিতার কিছু আমার ঠাকুরদাদা বিক্রী করে দেন ব্যবসা শুরু করেন আমার বাবা, আর তার ফলে বংশের ভিত খানিকটা মজবুত হয় তারপর আমি 

আর আপনার খুড়তুতো ভাই?’ 

জয়ন্ত ব্যবসায় যায়নি সে আছে এক এনজিনিয়ারিং ফার্মে ভালোই রোজগার করে, তবে ইদানীং শুনছি ক্লাবে গিয়ে পোকার খেলছে ঠাকুরদাদার একটা গুণ পেয়েছে আর কি? জয়ন্ত আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট 

এই ফাঁকে ফেলুদা পকেট থেকে তার মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারটা বার করে চালু করে দিয়েছে এটা হংকং থেকে আনা আজকাল মক্কেলের কথা খাতায় না লিখে রেকর্ডারে তুলে নেয়, তাতে অনেক বেশি সুবিধা হয় 

শঙ্করবাবু বললেন, আত্মীয়ের কথা হল, এবার অনাত্মীয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক 

তার আগে একটা প্রশ্ন করে নিই, বলল ফেলুদা যদিও প্রায় ঘষে উঠে গেছে, তবুও মনে হচ্ছে আপনার কপালে একটা চন্দনের ফোটা দেখতে পাচ্ছি তার মানে--- 

তার মানে আর কিছুই না, আজ হল আমার জন্মতিথি ফোঁটাটা দিয়েছেন খুড়ীমা

জন্মতিথি বলেই কি আজ এখানে অতিথি সমাগম হবে?’ 

অতিথি বলতে মাত্র তিনজন গত বছর ছিল ফিফটিয়েথ বার্থডে, সেবারও ডেকেছিলাম এই তিনজনকেই ভেবেছিলাম ওই একটি বারই অতিথি পালন করব কিন্তু একটা বিশেষ কারণে এবারও করছি বুঝতেই পারছেন, এ বাড়িতে যারা একবার এসেছেন, তাঁদের দ্বিতীয়বার আসতে কোনো আপত্তি হবে না 

এই দ্বিতীয়বারের কারণটা কী? 

শঙ্করবাবু একটু ভেবে বললেন, খুব ভালো হয় আপনারা যদি চা খেয়ে একবারটি দোতলায় আসেন আমার সঙ্গে আমার খুড়ীমার ঘরে তাহলে বাকি ঘটনাটা বুঝতে সহজ হবে আর আমিও ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে পারব 

আমরা মিনিটখানেকের মধ্যেই উঠে পড়লাম 

সিঁড়িতে পৌছাতে হলে বৈঠকখানা দিয়ে যেতে হয় এখানে বলে রাখিবাহারের আসবাব, কার্পেট, মখমলের পর্দা, ঝাড়লণ্ঠন, শ্বেতপাথরেরর মুর্তি ইত্যাদি মিলিয়ে এমন জমজমাট বৈঠকখানা আমি বেশি দেখিনি 

সিঁড়ি উঠতে উঠতে ফেলুদা বলল, আপনার খুড়ীমা ছাড়া দোতলায় আর কে থাকেন? 

খুড়ীমা থাকেন উত্তর প্রান্তে, বললেন শঙ্করবাবু, আর দক্ষিণে থাকি আমি জয়ন্ত এলেও দক্ষিণেরই একটা ঘরে থাকে 

দোতলার ল্যান্ডিং পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম খুড়ীমার ঘরে বেশ বড় ঘর, কিন্তু এতে কোনো জাকজমক নেই পশ্চিমে দরজার বাইরে আলো আর বাতাসের বহর দেখে বোঝা যায় ওদিকেই গঙ্গা দরজার পাশেই বুড়ি মাদুরে বসে মালা জপছেন তাঁর পাশে একটা হামানদিস্তা, একটা পানের বাট্টা আর একটা মোটা বই আসবাব বলতে একটা খাট আর একটা ছোট আলমারি 

আমরা ঘরে ঢুকতেই খুড়ীমা মাথা তুলে পুরু চশমার ভিতর দিয়ে আমাদের দিকে চাইলেন 

কজন অতিথি এসেছেন কলকাতা থেকে, বললেন শঙ্করবাবু 

তাই এই ঘাটের মড়াকে দেখাতে আনলি? 

আমরা তিনজনে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতে বৃদ্ধা বললেন, তা বাপু তোমাদের পরিচয় জেনে আর কী হবে, নাম মনে থাকবে না নিজের নামটাই ভুলে যাই মাঝে মাঝে এখন বসে বসে দিন গোনা 

আসুন শঙ্করবাবুর ডাকে আমরা ঘুরলাম বৃদ্ধা আবার বিড়বিড় করে মালা জপতে শুরু করলেন 

এবার দেখলাম ঘরের উল্টোদিকে খাটের পাশে একটা প্রকান্ড সিন্দুক রয়েছে শঙ্করবাবু পকেট থেকে চাবি বার করে সিন্দুকটা খুলতে খুলতে বললেন, এবারে আপনাদের যে জিনিস দেখাব সে হল আমার প্রপিতামহের সম্পত্তি রামপুরে থাকতে বহু নবাব-তালুকদার তার মক্কেল ছিলেন এগুলো তাদের উপঢৌকন এরই বেশ কিছু আমার ঠাকুরদাদা বিপাকে পড়ে বেচে দিয়েছিলেন তবে তার পরেও কিছু আছে যেমন এই যে দেখুন 

শঙ্করবাবু একটা থলি বার করে তার মুখটা ফাঁক করে হাতের তেলোয় উপুড় করলেন ঝন ঝন করে কিছু গোল চাকতি তেলোয় পড়ল 

জাহাঙ্গীরের আমলের স্বর্ণমুদ্রা, বললেন শঙ্করবাবু দেখুন, প্রত্যেকটিতে একটি করে রাশির ছবি খোদাই করা জিনিস একেবারেই দুষ্প্রাপ্য 

রাশিচক্র হলে এগারোটা কেন? ফেলুদা জিগ্যেস করল বারোটা হওয়া উচিত নয় কি?

একটি মিসিং আমরা পরস্পরের দিকে চাইলাম 

আরো জিনিস আছে, বললেন শঙ্করবাবু, সেগুলো এই আইভরির বাক্সটার মধ্যে সোনার উপর চুনি বসানো ইটালিয়ান নস্যির কৌটো, জেড পাথরে চুনি আর পান্না বসানো মোগল সূরাপাত্র, আংটি লকেট,,, কিন্তু সে সব আপনারা দেখবেন আজ সন্ধ্যাবেলা সর্বসমক্ষে এখন নয় 

এর চাবি আপনার কাছেই থাকে? ফেলুদা জিগ্যেস করল 

হ্যা, আমার কাছেই একটা ডুপলিকেট আছে থাকে খুড়ীমার আলমারিতে

কিন্তু সিন্দুক আপনার ঘরে নয় কেন? 

ঘরটা অতীতে ছিল আমার প্রতিতামহের ঘর সিন্দুক তারই আমলের ওটা আর সরাইনি আর কড়া পাহারা আছে গেটে, ঘরে খুড়ীমা প্রায় সর্বক্ষণ থাকেন, তাই এক হিসেবে ওটা এখানে যথেষ্ট সেফ 

আমরা আবার নিচের বারান্দায় ফিরে এলাম চেয়ারে বসার পর ফেলুদা টেপরেকর্ডার চালু করে দিয়ে বলল, একটি মুদ্রা মিসিং হল কি করে? 

সে কথাই বলছি, বললেন শঙ্করবাবু তিনজনকে উইক এন্ডে নেমন্তন্ন করেছিলাম গত জন্মতিথিতে একজন হলেন আমার বিজনেস পাটনার নরেশ কাঞ্জিলাল আরেকজন এখানকারই ডাক্তার অর্ধেন্দু সরকার আর তৃতীয় ব্যক্তি হলেন কালীনাথ রায় ইনি ইস্কুলে আমার সহপাঠী ছিলেন; পঁয়ত্রিশ বছর পরে আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন আমার প্রপিতামহের মহামূল্য সম্পত্তির কথা এরা সকলেই শুনেছিলেন, কিন্তু চোখে দেখেননি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত্তিরে ডিনারের পর জয়ন্ত সিন্ধুক থেকে স্বর্ণমুদ্রার থলিটা বার করে নিচে বৈঠকখানায় আনে কয়েনগুলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে রেখেছি, সকলে ঘিরে দেখছে, এমন সময় হল লোডশেডিং ঘর অন্ধকার এটা অবিশ্যি অস্বাভাবিক ঘটনা নয় চাকর দুমিনিটের মধ্যে মোমবাতি নিয়ে আসল, আমি কয়েনগুলো তুলে নিয়ে আবার সিন্দুকে রেখে এলাম একটা যে কমে ঘেছে সেটা তখন খেয়াল করিনি এমন যে হতে পারে কল্পনাও করিনি পরদিন সকলে চলে যাবার পর মনে একটা খটকা লাগাতে সিন্দুক খুলে দেখি কর্কট রাশির মুদ্রাটি নেই 

কয়েনগুলো আপনিই তুলে রেখেছিলেন? 

হ্যা, আমি ব্যাপারটা বুঝুন মিঃ মিত্তির তিনজন নিমন্ত্রিত একজনকে পঁচিশ বছর চিনিআমার বিজনেস পার্টনার অর্ধেন্দু সরকার হলেন ডাক্তার এবং ভালোই ডাক্তার খড়দা টিটাগড় থেকে কল আসে ওঁর আর কালীনাথ আমার বাল্যবন্ধু

কিন্তু এদের সকলকেই কি অনেস্ট লোক বলে জানেন আপনি? 

সেখানেই অবিশ্যি গন্ডগোল কাঞ্জিলালের কথা ধরুন ব্যবসায় অনেকেই জেনে শুনে, অসৎ পন্থা নেয়, কিন্তু কাঞ্জিলালের মতো এমন অম্লান বদনে নিতে আমি আর কাউকে দেখিনি আমাকে ঠাট্টা করে বলে- তুমি ধর্মযাজক হয়ে যাও, তোমার দ্বারা ব্যবসা হবে না 

আর অন্য দুজন?

ডাক্তারেরর কথা আমি জানি না খুড়ীমা মাঝে মাঝে বাতে ভোগেন, ডাক্তার তাকে এসে দেখে যান এর বেশি জানি না তবে কালীনাথ বোধহয় গভীর জলের মাছ এক যুগ দেখা নেই, হঠাৎ একদিন টেলিফোন করে আমার কাছে এল বলল--বয়স যত বাড়ছে ততই পুরোন দিনের কথা মনে পড়ে তাই একবার ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করি 

আপনি তাকে দেখেই চিনেছিলেন? 

তা চিনেছিলাম তাছাড়া স্কুলের বহু পুরোন গল্প করল সে যে আমার সহপাঠী তাতে সন্দেহ নেই গোলমালটা হচ্ছে, সে যে এখন কী করে তা কিছুতেই ভেঙে বলে না জিগ্যেস করলেই বলে, ধরে নাও তোমারই মতো ব্যবসা করে এদিকে গুণ যে নেই তা নয় খুব আমুদে রসিক লোক স্কুলে থাকতে ম্যাজিক দেখাত, এখনো সে অভ্যাসটা রেখেছে হাত সাফাই রীতিমতো ভালো 

আপনার ভাইও অন্ধকারের মধ্যে ঘরে ছিলেন 

সে ছিল তবে সে জিনিস আগে দেখেছে, তাই সে টেবিলের কাছে ছিল না নিয়ে থাকলে ওই তিনজনের একজনই নিয়েছে 

তারপর আপনি কী করলেন? 

কী আর করতে পারি বলুন এমন লোক আছে যারা এই অবস্থায় সোজাসুজি পুলিশ ডেকে তিনজনের বাড়ি সার্চ করাতো কিন্তু আমি পারিনি ওই তিনজনের সঙ্গে বসে কত ব্রিজ খেলেছি, আর তাদের একজনকে বলব চোর?

তার মানে স্রেফ হজম করে গেলেন ব্যাপারটা? 

স্রেফ হজম করে গেলাম ফলে এখানো কেউ জানেই না যে আমি ব্যাপারটা টের পেয়েছি সেই ঘটনার পরেও এদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কতবার, কিন্তু কেউ কোনোরকম অসোয়াস্তি বা অপরাধ বোধ করছে বলে মনে হয়নি অথচ আমি জানি যে এই তিনজনের মধ্যেই একজন দোষীএকজন চোর 

আমরা তিনজনেই চুপ ঘটনাটা অদ্ভুত তাতে সন্দেহ নেই  কিন্তু অবস্থায় কী করা যায়? 

আমার মনের প্রশ্নটা ফেলুদাই করল শঙ্করবাবু বললেন, এরা জানে যে আমি এদের সন্দেহ করি না তাই এদের আবার ডেকেছি এবং আজ রাত্রে আমি আবার এদের সামনে বনোয়ারিলালের কিছু মূল্যবান জিনিস বার করব মাসখানেক থেকে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটায় লোড শেডিং হচ্ছে এখানে তার ঠিক আগে আমি জিনিসগুলো টেবিলে সাজাব ঘর আবার অন্ধকার হবে আশা করছি সেই অন্ধকারে চোরের প্রবৃত্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে সব মিলিয়ে এই সম্পত্তির মূল্য চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখের কম নয় হয়ত আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস চোর লোভ সামলাতে পারবে না চুরির পর আপনি আপনার আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন তখন প্রদোষ মিত্তিরের কাজ হবে চোর ধরা এবং চোরাই মাল বার করা 

ফেলুদা বলল, আপনার ভাই সম্বন্ধে কী বললেন?

২য় পর্ব লিঙ্ক ঃ জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা - সত্যজিৎ রায় - গোয়েন্দা গল্প - Jahangirer Swarnamudra - Satyajit Ray - goyenda golpo (Part 2 of 3)

Tags: feluda series,feluda samagra,feluda somogro,জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা,সত্যজিৎ রায়,গোয়েন্দা গল্প,Jahangirer Swarnamudra,Satyajit Ray,goyenda golpo

No comments:

Post a Comment

Popular Posts