মোরেলা – এডগার অ্যালান পো - MORELLA - Edgar Allan Poe – Bangla translation
মোরেলা – এডগার অ্যালান পো - MORELLA - Edgar Allan Poe – Bangla translation Main Text of this story linkবান্ধবী মোরেলাকে আমি এককভাবে স্নেহ করতাম। গভীরভাবে
ভালোও বাসতাম তাকে। অনেকদিন আগে হঠাৎ দেখা হয়েছিল ওর সাথে। সেই প্রথম দেখার পর থেকে
আমার হৃদয় ওর জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। কিন্তু সেই ব্যাকুলতার আগুন ভালোবাসার আগুন
নয়। অনেকদিন ধরে সেই উত্তাপ অনুভব করেছি আমি। কেন যে এমনটি হয়, এ যে কী তা আমি জানি
না। তাকে আমি ইচ্ছেমতো থামাতেও পারিনি। তবু আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। একসাথে আমাদের ভাগ্য
বাঁধা পড়ে গেছে বিবাহের পবিত্র বন্ধনে। আমি আবেগ প্রকাশ করিনি, ভালোবাসার কথা ভাবিনি।
মোরেলা তার বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আমাকে নিয়ে থাকতে শুরু করল। আমি
এতে খুশি হয়েছিলাম খুব। এ খুশি স্বপ্নের মতো।
মোরেলার যথেষ্ট লেখাপড়া ছিল। আমার বিশ্বাস তার
মেধা অসাধারণ, মনোবল অদ্ভুত। আমি এটা অনুভবও করেছিলাম। অনেক ব্যাপারে তার শিষ্যত্বও
গ্রহণ করেছি। যা হোক শিগগিরই লক্ষ করলাম যে, কিছু অলৌকিক লেখা নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে।
বুঝতে পারি না কেন ওই লেখাগুলোর ওপর ওর এত পক্ষপাতিত্ব। সারাদিন ওই নিয়ে মেতে থাকে
সে। ক্রমে ক্রমে সেগুলো আমারও প্রিয় হয়ে উঠল মোরেলার সাহচর্যে।
যদি ভুল না হয় তাহলে বলতে পারি, কোনো কারণ ছাড়াই
আমার এই প্রীতি গড়ে উঠেছিল। তার প্রিয় বইগুলোর ভেতরে আমি ডুবিয়ে দিয়েছি নিজেকে।
যখন সেই নিষিদ্ধ অনুভূতি আমার ভেতর বিস্তৃত হয়ে পড়ত, তখন মোরেলা এসে তার ঠাণ্ডা হাত
আমার হাতে রেখে আমার ঘোর কাটিয়ে দিত। সেই শুষ্ক, মৃত দর্শনশাস্ত্রের ভেতর থেকে শুনতে
পেতাম তার কণ্ঠস্বর— একটা-দুটো শব্দ। তার অর্থ আমার স্মৃতিতে গভীরভাবে
গেঁথে যেত। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে বসে তার সংগীতময় কণ্ঠস্বরের কথা ভাবতাম।
অবশেষে সেই সংগীত এক ভয়াবহ আতঙ্কের রূপ ধারণ করত। আত্মা আমার অন্ধকার হয়ে যেত। মুখ
ফ্যাকাসে হয়ে আসত। সেই অবাস্তব, অনৈসর্গিক কণ্ঠস্বরের সমুখে ভয়ে আমি কাপতাম। এমনি
করেই সুখ হয়ে যেত ভয়, সুর হয়ে যেত অসুর, এক মুহূর্তেই।
মোরেলা এবং আমাতে ওই বইগুলো নিয়ে যে ধরনের যে
সমস্ত আলাপ-আলোচনা হত তা এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন। তবে একটা কথা এখানে শুধু বলব। আমাদের
সকলেরই একটা নিজস্ব সত্তা আছে। আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন। এই যে ভিন্নতা বা বৈশিষ্ট্য
তা মৃত্যুর পরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে বা না-ও পারে। এই ব্যাপারটা ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয়।
মোরেলা যখন এ নিয়ে আলোচনা করত তখন সে উত্তেজিত হয়ে উঠত অস্বাভাবিকরকমে।
এমনি করে একদিন এমন মুহূর্ত এল যখন আমার স্ত্রীর
এই রহস্যময় ব্যবহার আমাকে অভিভূত করে ফেলল। তার কৃশ শরীর, সংগীতময় ক্ষীণ কণ্ঠস্বর,
তার বিষণ্ণ চোখের আভা, কিছুই আর সহ্য করতে পারলাম না। সে আমার এই ব্যাপারটা জানত, কিন্তু
কোনো কথা বলত না। আমার দুর্বলতা বা বোকামি যাই হোক না কেন, দেখে সে হাসত। বলত, এ সবই
ভাগ্য। দিনে দিনে মোরেলা ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে রক্তিম গাল একদিন বিবর্ণ হয়ে
এল। নীল শিরাগুলো ফুলে উঠল সেখানে। আমার মন দুঃখে ভরে যেত সেদিকে তাকিয়ে। কিন্তু পরমুহূর্তেই
তার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি পড়ত আমার চোখে। আত্মা আমার সহসা যেন ভরে উঠত শূন্যতায়।
তাহলে কি বলতে হবে আমি তার এই ক্রমাগত বিলীন
হয়ে যাওয়া মনে মনে প্রার্থনা করেছিলাম? হ্যাঁ করেছিলাম বৈ কি। কিন্তু এত দেরিতে তা
হচ্ছিল যে, একদিন আমার জেদ বেড়ে গেল। উম্মত্ত হয়ে গেলাম অযথা বিলম্ব দেখে। তার জীবন
বিলীন হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, এমনকি দীর্ঘতম হয়ে এসেছিল। আমি অভিশাপ
দিতে লাগলাম অলস মন্থর সময়কে।
কিন্তু একদিন এক শরৎ-সন্ধ্যায় মোরেলা তার বিছানার
পাশে আমাকে ডাকল। বাতাস তখন স্থির। পৃথিবীতে একটা পাতলা কুয়াশার চাদর ঝুলছে। জলাভূমির
উপর উঠেছে উষ্ণ একটা দীপ্তি। আর বনভূমির অন্ধকারে এসে ঠেকেছে একটা রামধনু। আমি কাছে
গেলে ও বলল, ‘আজকের দিনটা সবচেয়ে সেরা দিন। বাঁচবার নয়তো মরবার মতো একটা
দিন আজ। পৃথিবীর পুত্র এবং জীবনের দিন আজকে। হয়তো স্বর্গের কন্যা এবং মৃত্যুর দিনও
আজকে।'
মোরেলার মাথায় চুমু খেলাম। সে বলে চলল, 'আমি
মরে যাচ্ছি, তবু আমি বাঁচব।'
‘মোরেলা !”
‘আজও হয়তো আমাকে ভালোবাসনি
তুমি, কিন্তু জীবনে যাকে ঘৃণা করেছ, মরণে তাকে প্রার্থনা করবে।'
‘মোরেলা।”
‘হ্যা আমি মরে যাচ্ছি।
আমার ভেতরে রয়েছে সেই স্নেহবীজ— সেই ছোট্ট মোরেলাকে রেখে যাচ্ছি, তুমি তাকে
ভালোবেসো। যখন আমার প্রাণ চলে যাবে তখন যে শিশু বাঁচবে— সে হবে তোমার এবং মোরেলার
সন্তান। কিন্তু সেই দিন হবে দুঃখের দিন, যেমন সাইপ্রাস দীর্ঘদিন ধরে বাঁচে, তেমনি এ
দুঃখ হবে দীর্ঘস্থায়ী। কেননা তোমার সুখের দিন বিগত প্রায়। গোলাপ হয়তো বছরে দু'বার
ফোটে কিন্তু জীবনে সুখের দিন দু'বার আসে না।’
চিৎকার করে উঠলাম, ‘মোরেলা, মোরেলা, তুমি
কী করে তা জানলে?'
কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিল বালিশের ওপাশে। একটা
মৃদু কম্পন জাগল তার শরীরে। সে মারা গেল।
তার উক্তি অনুযায়ী সেই শিশু, যে কিনা তার মরবার
মুহূর্তে জন্মেছিল এবং তার মরবার পর নিশ্বাস নিয়েছে, সে বেঁচে গেল। দিনে দিনে সে শারীরিক
মানসিক দু'দিক দিয়েই বেড়ে উঠতে লাগল। দেখতে হল ঠিক অবিকল মোরেলারই মতো। আমি মেয়েটাকে
এত ভালোবাসতে লাগলাম যে, পৃথিবীর আর কোনোকিছুকে অতটা ভালোবাসা সম্ভব নয়।
কিন্তু অল্পদিনের ভেতরেই সেই ভালোবাসার ওপর ব্যথা,
ভয়, বিষণ্ণতা এসে ছায়া ফেলল। আগেই বলেছি শারীরিক মানসিক সব দিক দিয়েই ও বেড়ে উঠছিল।
শরীর তার বাড়ছিল দ্রুত। কিন্তু সবচেয়ে বিহ্বল করে দিল তার মানসিক সত্তার দ্রুত পরিবর্তন
এবং গঠন। তার কিশোরী শরীরে বয়স্কা মহিলার ক্ষমতা আর চিহ্ন দেখতে লাগলাম। তার কিশোরী
ঠোটে অভিজ্ঞা নারীর অভিজ্ঞতা উচ্চারিত হতে লাগল। এর কি আর কোনো মানে হতে পারে? যখন
এই ব্যাপারগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার চোখে, যখন আমি আর তা সহ্য করতে পারলাম না,
অথচ কাউকে বলতেও পারলাম না; তখন ধীরে ধীরে মনে পড়ল কবরে শায়িতা মোরেলার অদ্ভুত কাহিনী
আর রোমাঞ্চকর দর্শনের কথা।
বছরের পর বছর গড়িয়ে যেতে লাগল। তার ক্রমবর্ধমান
শরীরের দিকে তাকিয়ে উদ্ঘাটন করতে লাগলাম মাতা ও কন্যার গভীর সাদৃশ্য। সেই একই বিষণ্ণতা
ও মৃত্যুর ছায়া। এই সাদৃশ্য গভীর হয়ে এল ক্রমে ক্রমে। সেই পরিপূর্ণ, নিশ্চিত, বিহ্বলকারী,
বীভৎস সাদৃশ্য। তার চোখ, তার হাসি, সবই মোরেলারই মতো। তেমনি বিবর্ণ-ফ্যাঁকাসে দেহ মূর্তি,
নিচু সংগীতময় স্বর। তেমনি প্রশস্ত কপাল আর রেশমি চুলগুচ্ছ। সবচেয়ে ভয়াবহ, মোরেলার
মতো আগ্রহ এবং দৃষ্টি দিয়ে সে-ও তাকাত আমার দিকে। এমনকি তার কথাবার্তা হুবহু মোরেলার
মতো, যেন মোরেলার কথাই শোনা যাচ্ছে ওর মুখ থেকে।
এমনি করে তার জীবনের দুটি অধ্যায় চলে গেল। আমার
কন্যার এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি। বাইরের কারুর সাথে কখনো সে মিশত না। আমি তাকে ‘বাছা” ‘সোনামণি এমনি সব আদরের
সম্বোধন করে ডাকতাম। মোরেলার নাম তার মরবার সাথে সাথেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মায়ের
সম্বন্ধে মেয়েকে কোনোদিন কোনো কথা বলিনি। বলা অসম্ভব। একদিন আমার মনে হল তাকে এবার
ব্যাপটাইজ (ধর্মে দীক্ষিত) করানো দরকার। একটা উপযুক্ত নামের জন্যে এবার ইতস্তত করতে
লাগলাম। পুরনো, নতুন, প্রচলিত, দেশি, বিদেশি, বহু নাম আমার মনে পড়তে লাগল। সহসা মৃতের
কথা মনে পড়ল। ব্যাপটাইজ করানোর সময় ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম পুরোহিতের কানের কাছে
: ‘মোরেলা। সাথে সাথে আমার
কন্যার মুখে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পেলাম। তার স্বচ্ছ চোখ মাটি থেকে আকাশের দিকে নিবদ্ধ
হল। তারপর পুরনো হলটার কালো পাথরের উপর ও ঢলে পড়ে গেল। প্রতিধ্বনিত হল : ‘এই তো আমি এখানে।'
অত্যন্ত স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম শব্দক’টি। সে শব্দ আমার কানের
ভেতর ঢুকে গরম সিসার মতো মগজে গড়িয়ে পড়ল যেন। বছর গড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু স্মৃতি
হারিয়ে যায় না কোনোদিন। চারদিকে আমি শুধু দেখতে লাগলাম মোরেলাকে। বাতাসে, আকাশে,
সমুদ্রের ঢেউয়ে উচ্চারিত হতে লাগল মোরেলার নাম। কিন্তু সে তো বেঁচে নেই! আমি তাকে
নিজের হাতে কবর দিয়েছি। হো হো করে হেসে উঠলাম। তিক্ত সে হাসি, কেননা তার মুখে প্রথমার
আর কোনো মিল নেই। দ্বিতীয় মোরেলাকে যেখানে কবর দেয়া হল সেই কবরের প্রকোষ্ঠে হাসি
প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল।
অনুবাদ : মহীউদ্দীন আহমেদ
এডিটঃ মারুফ মাহমুদ
No comments:
Post a Comment