![]() |
মারাত্মক নেশা – রকিব হাসান – গোয়েন্দা গল্প – রোমাঞ্চ গল্প – কিশোর থ্রিলার - Marattok Nesha – Rokib Hasan – Detective Story |
ফিনিক্স ফাউন্ডেশনের অফিসে বসে টেরি হ্যাচার
আর জ্যাক ডালটনের সঙ্গে আড্ডা মারছিল গোয়েন্দা ম্যাকগাইভার, এই সময় ঘরে ঢুকল লোকটা
খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে ৷ রোগাটে শরীর। ফ্যাকাসে চেহারা। চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড় এবং উজ্জ্বল।
-এই যে, ম্যাক, বলার সময় ঠোঁট কাঁপল তার।
চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে পড়েছিল ম্যাক, আবার
বসে পড়ল।
-আপনি?
-চিনতে পারছ না? ওই যে সেবার, গোল্ডলেকে মাছ
ধরতে গিয়ে...
-ওহো, নিক!
-চিনেছ তাহলে ।
-সরি, নিক । কিন্তু এ
কি চেহারা হয়েছে তোমার! চিনব কি করে?
ম্যাকের মনে পড়ল হাসিখুশি সেই প্রাণোচ্ছল যুবক,
যার বোটে করে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে গোল্ডলেকে, মাছ ধরেছে। বস বস, তাড়াতাড়ি
বলল সে। তা হঠাৎ কি মনে করে?
একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ডালটন।
-পরিচয় করিয়ে দিই,
ম্যাক বলল। ও আমার বন্ধু, জ্যাক ডালটন। আর ও টেরি হ্যাচার...
-হাল্লো। হাত বাড়িয়ে
দিল নিক, আমি নিকলসন ওয়াগনার।
কি করে ম্যাকগাইভারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে নিজেই
বলল ।
-তা কি মনে করে, নিক?
আবার প্রশ্ন করল ম্যাক ।
-কিছু বুঝতে পারছ না?
-একটা কিছু ধারণা দাও,
তাহলে তো বুঝব ৷
-এসেছি, একটা গহনার দোকানের
জানালায় ইট মারতে । গোল্ডলেকেই মারতে পারতাম, তবে সেখানে আমাকে কিছু করত না দোকানদার।
হেসে ছেড়ে দিত। যত ভাবেই বোঝাতাম, আমার নামে নালিশ করত না, জেলে ঢোকাত না। শেরিফও
আমাকে কিছু বলত না। বেশি খাতির থাকার এইই এক অসুবিধে...
-সে জন্যেই অচেনা জায়গায় চলে এসেছ...
-জায়গাটা অচেনা নয়। মানুষগুলো অচেনা। আরেকটু
হলেই মেরে বসেছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল তোমার কথা। ভাবলাম, গারদে ঢোকার আগে তোমাকে অন্তত
জানাই ব্যাপারটা, এসেই যখন পড়েছি শহরে।
-মাছ ধরাটাই তো নেশা
জানতাম, হেসে বলল ম্যাক, অবসর কাটানোর একমাত্র ব্যবস্থা। টিল মারাটা শুরু করলে কবে
থেকে?
-শুরু করিনি। এই একবারই
মারব ভেবেছি।
-কেন? হঠাৎ এই সুবুদ্ধি?
-জেলে যেতে চাই। ওই অপরাধের জন্যে কতদিন আটকে
রাখবে, বলতে পার?
-আসলে ব্যাপারটা কি,
বল তো? জেল নয়, আমার তো মনে হচ্ছে হাসপাতালে নেয়া দরকার তোমাকে । মাথা চেকাপ করানোর
জন্যে।
-না। রোগটা সারাতে হলে
জেলেই যেতে হবে আমাকে।
-কি রোগ?
-নেশা। নেশার শিকার হয়ে
গেছি।
চুপ হয়ে গেল ম্যাক। টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে
টাট্টু বাজাল কয়েক সেকেন্ড। আবার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কি করে বাধালে এই ভয়ঙ্কর
অসুখ?
-অ্যাক্সিডেন্ট, বুঝলে,
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল নিক । মোটর সাইকেল নিয়ে পাহাড়ে চড়েছিলাম। ওপরে উঠে
গেল স্টার্ট বন্ধ হয়ে । গড়াতে শুরু করলাম। একটা পা গেল ভেঙে। আরও কিছু হাড় ভাঙল,
তবে ওগুলো ভাল হয়ে গেছে। বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। পা-টা
কেটে ফেলে দিতে হল। নকল পা লাগিয়ে দেয়া হল সেখানে । ওরকম অ্যামপিউটেশনের পরে মাঝে
মাঝে যা হয়, আমারও তাই হল। তীব্র ব্যথা। আর সে যে কি ব্যথা, বলে বোঝাতে পারব না। মনে
হয় ব্যথাটা পায়ে নয়, ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়ে, ব্রেনে চাপ দিতে আরম্ভ করে। আত্মহত্যা
করতে ইচ্ছে করে তখন। বহুবার বহু ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। তারা ট্যাবলেট দেয়, বলে ওরকম
হবেই। পরে সারতে পারে। কিন্তু সারার কোন লক্ষণ দেখলাম না। পেইন কিলারে কিছু হয় না।
কিছুক্ষণের জন্যে সারলেও আবার শুরু হয়।
-ওই ট্যাবলেটের কারণে
নিশ্চয় তোমার এই অবস্থা হয়নি?
-না। বলছি। একদিন বেরিয়েছি,
একটা কাজে যাব, রাস্তায় শুরু হল ব্যথা। সঙ্গে ট্যাবলেটও ছিল না। কাছেই একটা কেমিস্টের
দোকান দেখে তাতে ঢুকলাম। জিজ্ঞেস করলাম ব্যথা সারানোর ভাল কিছু আছে কিনা?
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল দোকানি, তারপর
মাথা ঝাঁকাল । বলল, এত ভাল জিনিস আছে, যার তুলনা হয় না ।
-তারপর?
-কিছু সাদা পাউডার দিল
আমাকে সে। গিললাম। জাদুমন্ত্রের মত কাজ হল। কয়েক বছরে এত আরাম আর পাইনি। তোমরা যারা
সব সময়ই সুস্থ থাক, আমার অবস্থাটা বুঝবে না। জিনিসটা দামি । কিন্তু টাকা দিতে এতটুকু
খারাপ লাগল না। যা চাইল তাই দিয়ে দিলাম। বরং মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, একটু ওষুধ
পাওয়া গেল বলে।
-ওষুধটার নাম জিজ্ঞেস
করেছ?
-না। ব্যথা চলে যাওয়ায়
এতই খুশি হলাম, সবই ভুলে গেলাম । ভাবলাম, দরকার হলেই এসে ওর কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারব।
-কিন্তু এখন নামটা নিশ্চয়ই
জান?
-আন্দাজ করতে পারি। যদিও
সে বলেনি। আমার বিশ্বাস, হেরোইন দেয়া হয়েছিল আমাকে ।
মাথা ঝাঁকাল ম্যাক, আগেই বুঝতে পেরেছি। বলে যাও।
-তারপর, পরের বার ব্যথা
শুরু হতেই চলে গেলাম ওর কাছে। খানিকটা ওষুধ চাইলাম। দিল। চলে এলাম। আবার ব্যথা উঠলে
আবার গেলাম। এভাবেই চলতে লাগল। প্রথমবারেই যদি বুঝতে পারতাম, ওটা হেরোইন, কিছুতেই খেতাম
না আমি। যত ব্যথাই হোক, নেশার ফাঁদে পা দিতাম না। বুঝতে যখন পারলাম, অনেক দেরি হয়ে
গেছে তখন। গলায় জড়িয়ে গেছে হেরোইনের ফাঁস। ব্যথা ছাড়াও ওই জিনিস খেতে ইচ্ছে করে
তখন। না খেয়ে থাকতে পারি না। এটা যেই বুঝল শয়তানটা, দাম বাড়িয়ে দিল । যতবার যাই,
ততবারই দাম বাড়ায়।
-এ রকমই করে ওই নেশা
ব্যবসায়ীরা, জ্যাক বলল। নরকের ইবলিস ওগুলো!
-গল্প বাড়িয়ে আর লাভ
নেই, শেষ করে ফেলি। আমাকে ফকির বানিয়ে দিয়েছে সে। একটা আধলাও নেই আর আমার কাছে। টাকা
তো গেছেই, সঙ্গে সঙ্গে শরীর মন সবই শেষ। ওর ধারণা, আমাকে ওর ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
পুলিশকে বললে আমিও বিপদে পড়ব। কে আমাকে হেরোইন সাপ্লাই দেবে?
-কিন্তু এখন তো আর এমনিতেও
পাবে না ।
-নাহ্! টাকা ছাড়া দেবে
না। ও মনে করে, কোথাও না কোথাও থেকে টাকা আমি জোগাড় করবই। ধার করে, চুরিদারি করে,
যে ভাবেই হোক। এই একটা জায়গায় ভুল করেছে সে। মরে গেলেও এক অপরাধকে টিকিয়ে রাখতে
আরেক অপরাধ করব না আমি।
-শয়তানটা কে? থাকে কোথায়?
-জেমস মাঙ্গালো। গোল্ডলেকের পাশের গ্রাম ডিয়ার
হিলে থাকে। নিগ্রো। ছোট একটা কেমিস্টের দোকান আছে। সর্বনাশ করে দিয়েছে আমার, দেখতেই
তো পাচ্ছ। আয়নার দিকে তাকাতে পারি না। সাহস হয় না। আজ সকালে ঠিক করেছি, আর নয়, ওই
নেশার কবল থেকে বাঁচতেই হবে আমাকে। আর সেই জন্যেই জেলে ঢুকে আটকে ফেলতে হবে নিজেকে।
-এই ভাবনাটা নতুন নয়,
শুকনো গলায় বলল ম্যাক। অনেকেই ভেবেছে। তবে বাঁচার আরও সহজ উপায় আছে। সেটা পরে আলোচনা
করছি। আগে সত্যি করে বল তো, আমার কাছে টাকা চাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না তো? দিলেই সোজা
চলে যাবে ডিয়ার হিলে...
-না, ভাঙা গলায় বলল নিক।
টাকা চাইব না। আমি মনে মনে কসম খেয়ে ফেলেছি...
-বেশ। বিশ্বাস করলাম
তোমার কথা। মনে হয়, বাঁচতে পারবে। তোমার মনের জোর আছে। টেবিলে ফেলে রাখা খবরের কাগজটা
টেনে নিল ম্যাক। পাতা উল্টে একটা জায়গায় এসে থামল। সেখানে জাহাজের খবর দেয়া আছে,
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটা কার্গো বোট ছাড়বে নিউ ইয়র্ক থেকে। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে
যাবে অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে। অনেক পথ পেরিযে, অনেক ঘুরে যাবে। তাতে সময় লাগবে। ওই
জাহাজে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে তোমাকে। ছসাত সপ্তাহ লেগে যাবে যেতে । অতদিন একটানা
হেরোইন না পেলে নেশার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে তুমি। তোমার খরচের ব্যবস্থা আমি করে
দেব...না না, আমাকে শেষ করতে দাও। টাকাটা দান হিসেবে দিচ্ছি না আমি। ধার। পরে শোধ করে
দিও।
পুরো একটা মিনিট চুপ করে রইল নিক। তারপর একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই নেশা যে মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়! বন্ধু-বান্ধবের কাছেও
শেষে হাত পাততে হচ্ছে...
-আরে দূর, কি যে বল।
উপকারের সময়ই যদি কাজে না লাগল তাহলে বন্ধু কিসের? উঠে এসে নিকের কাঁধে হাত রাখল ম্যাক।
-টাকাটা নাও তুমি । বেশি
তো না। পরে সহজেই শোধ করে দিতে পারবে।
-বেশ। নেব। তবে শোধ দিতে পারবই, কথা দিতে পারছি
না। কারণ নেশা যখন চাগিয়ে উঠবে, সহ্য করতে পারব না, লাফিয়েও পড়তে পারি সাগরে।
-ওসব আজেবাজে চিন্তা
বাদ দাও। এখন ওই দোকান এবং লোকটা সম্পর্কে যা যা জান, সব বল।
-বেশি কিছু জানি না। নেশার ব্যবসা করে, গোপন
রাখাটাই স্বাভাবিক তবে আমার বিশ্বাস, একটা রোলস রয়েস গাড়িতে করে জিনিসটা আসে তার
কাছে। কেন এ সন্দেহ হল, বলছি। দুবার গাড়িটাকে দোকানের সামনে থামতে দেখেছি। একজন মহিলা
নামে। আমেরিকান নয়। মিশরী- টিশরী হবে। তার শোফারটাও নিগ্রো। মহিলা খুব দাবি পোশাক
পরে। আমি ভেবেছি সে-ও আমারই মত কাস্টোমার। একদিন গিয়ে ওষুধ চাইলে মাঙ্গালো বলল, ফুরিয়ে
গেছে। আধ ঘণ্টা পরে আসুন। এতই অস্থির হয়ে পড়েছিলাম, বাড়ি যেতে পারিনি। দোকানের বাইরে
বেরিয়ে পায়চারি করছি। এই সময় মহিলা এল, কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল। আধ ঘণ্টা পর দোকানে
ঢুকলাম । ওষুধ বের করে দিল মাঙ্গালো।
-গাড়িটার নম্বর নিয়েছ?
-না। তখন তো আর কিছু
ভাবিনি।
-পুলিশকে জানাওনি কেন?
-দুটো কারণে। এক, মাঙ্গালোকে
পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে আমি ওষুধ পাব না। আর দ্বিতীয় কারণ, আমাকে ভয় দেখিয়েছে সে,
পুলিসে খবর দিলে তার দল আমাকে ছাড়বে না। মাদক ব্যবসায়ীরা যে কি নিষ্ঠুর হয় জানি
তো। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
মাথা ঝাঁকাল ম্যাক। তা ঠিক। যা করার আমরাই করব।
তুমি এখন টাকা নিয়ে যাও। জ্যাক যাবে তোমার সঙ্গে। জাহাজে তুলে দিয়ে তারপর আসবে।
একটা চেক লিখে দিল ম্যাক। জ্যাকের হাতে দিয়ে
বলল, যাও নিককে দিয়ে এস। অসুবিধে আছে?
-আরে না না, অসুবিধে
কি? আমি বরং ইন্টারেস্টেড হচ্ছি। আমার নতুন কেনা বিমানটা বোধহয় এবার কাজে লাগবে।
নিককে নিয়ে বেরিয়ে গেল ডালটন।
দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই ম্যাকের দিকে তাকাল টেরি।
-আশ্চর্য! ওর মত একজন
মনের জোরওয়ালা মানুষ রেহাই পেল না! হেরোইন কি জিনিস!
-সমস্ত মাদকের মধ্যে
হেরোইনটাই বোধহয় সবচেয়ে ক্ষতিকর, ম্যাক বলে চলল। শুধু যে শরীরের ক্ষতি করে তাই নয়,
মনকেও ধ্বংস করে দেয়। বেশি দিন ধরে সেবন করার পর হঠাৎ বন্ধ করে দিলে পাগলও হয়ে যায়
অনেকে । হেরোইন তো অনেক শক্তিশালী জিনিস। সিগারেটের কথাই ধর। ওই নেশাই তো ছাড়তে কষ্ট
হয়। সিগারেটে যা নেশা হয়, তার চেয়ে একশো গুণ বেশি হয় হেরোইনে। মানুষ সবই জানে।
জেনেশুনেও এতে আক্রান্ত হয়। মাদকের ব্যবসা বন্ধ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে পৃথিবীর
অনেক দেশ পারছে না। কেন জান? দাম। বিরাট লাভ। কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা ।
-হেরোইন জিনিসটা আসলে
কি?
হাসল ম্যাক, কোন দুনিয়ায় থাক তুমি? আজকাল পত্রপত্রিকায়
এত লেখালেখি হচ্ছে জান না...
-আহ্, বলই না। সবাইকে সব কিছু জানতে হবে এমন
কোন কথা আছে নাকি? হেরোইনের নাম তো হরদম শুনছি। কি দিয়ে তৈরি হয় জানি না। জানলে বল
।
-এটা একধরনের ক্ষার জাতীয় পদার্থ, পপি ফুলের
বীজ থেকে তৈরি হয়। বীজের শুঁটি থেকে বের করা ঘন নির্যাসকে বলা হয় আফিম। রাসায়নিক
প্রক্রিয়ায় এটা থেকে তৈরি হয় মরফিন। অ্যাসিটিক অ্যাসিডের অ্যানহাইড্রাইড দিয়ে এই
মরফিন থেকে তৈরি হয় ডায়াসিটাইল মরফিন। সাদা গুঁড়া। যার আরেক নাম হেরোইন।
-তার মানে, হেরোইন পেতে হলে ওই বিশেষ জাতের পপির
চাষ করতে হয়?
-হ্যাঁ। সবজে ধূসর পাতা হয় গাছগুলোর, এক গাছে
একটিমাত্র বেগুনি রঙের ফুল ধরে। মধ্যপ্রাচ্য আর এশিয়ার কিছু কিছু অঞ্চলে জন্মে এই
গাছ ।
কথা শেষ করে ইন্টারকমের বোতাম টিপে পিটার থরটনকে
বলল ম্যাক, দেখা করতে আসছে।
-তাহলে তো তদন্ত করতে হয়, সব শুনে বললেন পিট।
তবে যা করার করতে হবে তোমাকেই ।
জানি। রাঘব বোয়ালটাকে ধরা দরকার। আমরা মাঙ্গালোকে
ধরলে বোয়ালটার দেখা আর পাব না। গভীর জলে ডুবে যাবে। -তদন্তই করব। কোথা থেকে আসে, কিভাবে
আসে, সব জানব। পুরো দলটাকেই ধরতে চাই । নাহলে কোন লাভ হবে না ।
-আমাকে কি করতে হবে?
-গোল্ডলেকের শেরিফের সঙ্গে কথা বলুন। ব্যাপারটা
যেন গোপন রাখা হয় আপাতত, তাঁকে বলবেন। দোকানটার ওপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করুক। রোলস
রয়েসটা কার, কোথায় যায়, সেটাও জানা দরকার। খুব সাবধানে যাতে কাজ করে। সামান্যতম
সন্দেহ জাগলেই বাতাসে মিলিয়ে যাবে পুরো দলটা। হাজার খুঁজেও আর বের করা যাবে না তখন
ওদেরকে । বুঝিয়ে বলুন শেরিফকে সব।
দুই
ও-কে, মৃদু শিস দিতে লাগলেন পিটার ।
পুরো এক হপ্তা কোন খবরই পাওয়া গেল না। সাতদিন
পর পিটারের অফিসে এসে হাজির হলেন গোল্ডলেকের শেরিফ। ম্যাককেও ডাকা হলো সেখানে। পরিচয়
আছে। হাত মেলানো আর দুচারটা সাধারণ কথাবার্তার পর জিজ্ঞেস করল সে, কিভাবে আসছে, জানতে
পেরেছেন?
- না।
ধীরেসুস্থে পাইপ ধরালেন শেরিফ। গলগল করে ধোঁয়া
ছেড়ে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ছাতের দিকে। মুখ নামিয়ে বললেন, রোলসটার মালিক
একজন মিশরীয়, নাম আবদাল হামাদ। রেড ক্রীকে একটা বাড়ি আছে। সিগারেটের ব্যবসা করে।
তুরস্ক আর মিশরীয় তামাক আমদানী করে।
-জানলেন কি করে?
আরেকবার ছাতের দিকে তাকালেন শেরিফ। ইনটেলিজেন্স
ব্রাঞ্চের একজন ইন্সপেক্টর আমার শালা। রবার্ট মরগান। তাকে সব জানিয়েছি। সে- ই সমস্ত
খবর জোগাড় করেছে...
ও। বলে যান।
-ব্যবসা
যা করে হামাদ, তাতে এতটা লাভ হয় না যে সে রোলস রয়েস কিনতে পারে। অত বড় বাড়ি তৈরি
করতে পারে। যে হারে খরচ করে সে, তামাকের ইনকাম থেকে তার দশ ভাগের এক ভাগও আসে না। তাহলে
টাকা পায় কোথায়? অন্য কোনওখান থেকে। ব্যবসা দেখাশোনায় তাকে সাহায্য করে তার স্ত্রী।
শোফারটাও এসবে জড়িত, বোঝাই যায়। ওর নাম জুলু। নিউ ইয়র্কের নাইক্লাব সুইট ড্রীমের
সঙ্গে যোগাযোগ আছে ওদের, প্রায়ই যায়। চারটে কেমিস্টের দোকানে যেতে দেখা গেছে রোলস
রয়েসটাকে আরও অনেক জায়গায় যায় নিশ্চয়, তবে সেগুলো দেখার আর প্রয়োজন মনে করেনি
মরগান।
-চারটেই যথেষ্ট । হামাদ আর তার স্ত্রী উইক- এন্ডে
রেড ক্রীকে থাকেনা, চলে যায় উইলো লেকে, ওখানে একটা খামার আছে ওদের। চাষবাস হয়। ইনকাম
ট্যাক্সকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেই বোধহয় ওই ব্যবসা ফেঁদেছে। ভাঁওতাবাজি। এছাড়া ওই খামার
করার আর তো কোনও কারণ দেখি না।
-হেরোইন চোরাচালানের ঘাঁটিও হতে পারে ওটা, ম্যাক
বলল। মাল দিয়ে যায় এজেন্টরা। তারপর ওখান থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়
।
-হতে পারে, বিড়বিড় করলেন শেরিফ।
-তাহলে ওই খামার থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের।
কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই ওখানে, আমি শিওর।
-খামার থেকে ফেরার পথে গাড়িটাকে আটক করতে পারি।
-ভেতরে কিছু না থাকলে বোকা বনতে হবে। আটক করার
আগে শিওর হয়ে নিতে হবে, ভেতরে মাল আছে কিনা। আমরা যে জেনে গেছি এটা এখন কিছুতেই বুঝতে
দেয়া চলবে না ওদেরকে।
-আসলে, পাইপ দিতয়ে দাঁতে টোকা দিলেন শেরিফ,
যা-ই করি না কেন, সাবধান ওরা হয়েই যাবে। আর গাড়িতে মাল রাখলেই বা কতটুকু রাখবে...
-সে কথাই তো বলছি আমি। এভাবে হবে না। অন্যভাবে
চেষ্টা করতে হবে। ভাবছি, নিজের চোখেই খামারটা একবার দেখে আসব।
-ঠিক আছে। তোমার ওপর ভরসা আছে আমাদের। যে ভাবে
যা ভাল বোঝ, কর । তাড়াহুড়া করে সব পণ্ড করার কোনও মানে হয় না।
-নিজের অফিসে ফিরে এল ম্যাক। জ্যাক ডালটনকে খবর
পাঠাল।
একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাক্, জানতে চাইল,
কী?
-প্লেন ওড়ানোর বন্দোবস্ত হয়েছে? এয়ার ফোর্সের
বাতিল করে দেয়া একখান নীলামে কিনে নিয়ে এলাম না সেদিন? মেরামত-টেরামত করে সব ঠিকঠাক।
এখন উড়াল দিলেই হল ।
-হ্যাঁ, সুযোগ হয়েছে, জানাল ম্যাক। তবে এক্ষুনি
লাগবে না। পরে।
-কেন, পরে কেন? উত্তেজিত হয়ে উঠল ডালটন।
-কারণ, প্রথমে গাড়িতে করে দেখতে যাব জায়গাটা।
শেরিফ যা যা বলে গেছেন, বলতে লাগল ম্যাক।
মন দিয়ে শুনল জ্যাক। মাথা দুলিয়ে বলল, হুঁ,
বুঝলাম, কেন আজই যেতে চাইছ। আজ শনিবার। উইক-এন্ডে খামারে যাবে হামাদ দম্পতি। শনিবারে
গিয়ে সোমবারে ফিরবে। শয়তানী কিছু করলে এই সময়টাতেই করবে। ভেরি গুড। চল, যাই।
-কোথায় যাওয়া হচ্ছে? দরজার কাছ থেকে বলে উঠল
টেরি।
-এই তো দিল বাধা, গম্ভীর হয়ে গেল জ্যাক। কৃত্রিম
গাম্ভীর্য।
-শুরুতেই এই। নাহ্, এবার কপালে দুঃখ আছে।
-এসো, ডাকল ম্যাক। হেরোইন চোরাচালানিদের ব্যাপারে
তদন্ত করতে যাচ্ছি। টেরিকেও ব্যাপারটা খুলে বলল সে।
-আমিও যাব।
-কোনও দরকার নেই, সঙ্গে সঙ্গে বলল জ্যাক। মেয়েমানুষ
নিয়ে এসব কাজে যাওয়া একদম পছন্দ করি না আমি। কাজের কাজ কিচ্ছু পারে না, খালি ঝামেলা
বাড়ায়।
জ্যাকের মুখ কি করে বন্ধ করতে হয় জানা আছে টেরির।
ভুরু নাচিয়ে বলল, ঝামেলাটা আমি করব, না তোমার ওই প্লেন? নিশ্চয় ওটা নিয়েই যাচ্ছ?
দেখেছি তো, কয়েকদিন ধরে খেটেও কিছু করতে পারছ না । আকাশে ইঞ্জিন বন্ধ না হলেই বাঁচি।
-কি, আমার প্লেনের ইঞ্জিন বন্ধ হবে! রেগে গেল
জ্যাক। চল, এখুনি দেখিয়ে দেব! বাজি হয়ে যাক । যদি বন্ধ না হয়, কি দেবে?
-শী-শেল রেস্টুরেন্টে ডিনার খাইয়ে দেব একপেট।
আর যদি বন্ধ হয়?
-হবে না! ঊরুতে চটাস করে চাপড় মারল জ্যাক।
ম্যাকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল টেরি।
তিন
শেষ বিকেলে শান্ত গ্রামটায় এসে ঢুকল ম্যাকের
গাড়ি। উইলো লেক। হামাদের খামারটা মনে হলো সবাই চেনে। কারণ একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করতেই
বলে দিল কোন রাস্তায় যেতে হবে। এখানকার রাস্তাগুলো বড় অদ্ভুত। সাধারণত রাস্তা হয়
আশপাশের জমি থেকে উঁচু, এখানে হয়েছে নিচু। যেন কেটে বসেছে মাটিতে। দুধারে দশ-বারো
ফুট উঁচু পাড়, তার ওপরে রয়েছে পাতাবাহারের বেড়া। ফলে গাড়িতে বসে কিছুই দেখার উপায়
নেই ।
-নাহ্, হবে না এভাবে, ম্যাক বলল। গাড়ি থামাল।
জ্যাক, যাও তো, উঠে গিয়ে দেখ তো কিছু দেখা যায় কিনা?
-প্রায় খাড়া পাগ বেয়ে উঠতে বেশ অসুবিধেই হল,
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনমতে উঠল জ্যাক। ফিরে এল একটু পরেই।
-সয়াবীনের খেত। আর তো কিছুই দেখলাম না । কাঁটাতারের
বেড়া দিয়ে ঘেরা। ঢুকে দেখার উপায় নেই ৷
দুশো গজ সামনে এগিয়ে আবার চেস্টা করল ওরা। একই
ফল হলো ।
-গরু-টরু কিছুই দেখনি? জিজ্ঞেস করল ম্যাক ।
-না। শুধুই সয়াবীনের খেত।
-তাহলে কাঁটাতারের বেড়া দিল কে?
-তা তো বলতে পারব না।
আবার গাড়ি চালাল ম্যাক। সামনে একটা গেট দেখার
পর থামল। একটা কটেজ রয়েছে ভেতরে। বাগানে কাজ করছে একজন নিগ্রো। ম্যাককে গাড়ি থেকে
নেমে গেটের দিকে এগোতে দেখে হাতের বেলচা ফেলে দিয়ে প্রায় দৌড়ে এল লোকটা।
-কি চান?
-এই রাস্তা দিয়ে কি উলফ ক্রীকে যাওয়া যায়?
তা তো বলতে পারব না। নতুন এসেছি।
লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে আবার গাড়িতে এসে উঠল
ম্যাক। চালাতে চালাতে বলল, ও কাউকে ঢুকতে দেবে না ৷
এগিয়ে চলল ম্যাক। রাস্তা আর ওপরে ওঠে না, অর্থাৎ
মাটির সমতল হয় না। খানিক পর পরই গাড়ি থামিয়ে জ্যাককে দেখে আসতে বলে কি দেখা যায়।
কয়েকবার এসে খেতের কথা বলল জ্যাক, একবার এসে বলল দূরে একটা খামারবাড়ি চোখে পড়েছে।
তবে কাঁটাতারের বেড়ার বিরাম নেই । ফাঁক নেই কোথাও ৷
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই এসে
পৌঁছেছি, ম্যাক বলল। পুরো জায়গাটাই তো চক্কর
দিয়ে ফেললাম। দারোয়ান আর সয়াবীনের খেত ছাড়া তো আর কিছুই দেখলাম না। লোকটার সামনেও
আর যাওয়া যাবে না। সন্দেহ করে বসবে।
-কি করব তাহলে?
-আপাতত বাড়ি ফিরে যাব।
-বাড়ি? অবাক হয়ে বলল টেরি। তাহলে এলাম কেন?”
-এভাবে হবে না। মাটি থেকে তো কিছু দেখাই যায়
না, বুঝব কি? কাল আবার আসব, প্লেন নিয়ে। সাথে ক্যামেরাও নিয়ে আসব্ ওপর তেকে যতক্ষণ
খুশি দেখব জায়গাটা, কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। দরকার হলে ছবি তুলে নিয়ে যাব।
মিনিটখানেক পরে সামনে থেকে রোলস রয়েসটাকে আসতে
দেখা গেল। রাস্তা এত সরু, পাশ কাটানোর সময় গায়ে গায়ে প্রায় ঘষা লেগে যাওয়ার অবস্থা।
-এসে গেছে তাহলে, ম্যাক বলল। একটা কাজ করা যায়।
খামারে ঢোকার একটাই গেট। হেরোইনের প্যাকেট নিয়ে কেউ এলে, আর খামারে ঢুকতে চাইলে ওই
পথ দিয়েই ঢুকতে হবে। জ্যাক, তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও। আমি আর টেরি থাকি গেটে চোখ
রাখব। সারাক্ষণ টেলিফোনের পাশে থাকবে। সাহায্যের দরকার দলে ফোন করব।
-আমিও থাকি?
-না। সবাই একসঙ্গে থাকা ঠিক হবে না। বিপদে পড়তে
পারি একজনের আলাদা থাকা উচিত।
-কতক্ষণ থাকবে?
-আজ আর ফিরব না। দরকার হলে সারারাত পাহারা দেব।
কিছুই যদি না ঘটে, কাল ফিরে গিয়ে প্লেন নিয়ে ফিরে আসব।
চার
পরদিন সকাল ছটায় ফিরে এল ম্যাক আর টেরি ।
-কি ব্যাপার? জানতে চাইল জ্যাক ।
-নাহ্, কোনই লাভ হল না, ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা
নাড়ল ম্যাক। সারাটা রাত অযথাই কষ্ট করলাম। ড্রাইভার ব্যাটা ঢুকল খামারে। বেরোল না।
সন্দেহ করার মত কিছু দেখলাম না। সব সপ্তাহে মনে হয় জিনিস আসে না । এটা না আসার সপ্তাহ।
-তাহলে? কি করবে এখন?
-বেরোব। প্লেন নিয়ে।
দুই ঘণ্টা পরে জ্যাকের বিমানে করে আবার উইলো
লেকে উড়ে চলল তিনজনে। রাস্তা থেকে আগের দিন কিছুই দেখা যায়নি, আজ আকাশ থেকে সব পরিষ্কার।
ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টেরি। মূল বাড়িটা অনেক বড়। আরও কতগুলো ছোটবড় বাড়ি
রয়েছে আশপাশে। ঘিরে রেখেছে সয়াবীনের খেতে। গরু-ঘোড়া একটাও চোখে পড়ল না।
-শুধুই সয়াবীন, আনমনে বিড়বিড় করল ম্যাক। বিশ
একরের কম না। কিন্তু এর আয়েও রোলস রয়েস চালানো সম্ভব না। হঠাৎ গলা বাড়িয়ে নিচে
তাকাল।
-আরে!
-কী? জানতে চাইল টেরি।
-ভাল করে দেখ। দুটো লম্বা রেখা পাশাপাশি চলে
গেছে। দুপাশের গাছের তুলনায় রঙটা ফ্যাকাসে। ওই যে, কয়েকজন লোকও কাজ করছে সারিগুলোর
কাছে।
-তাতে কি?
-ওই সারি দুটো কিসের বলে মনে হয় তোমার?
-এখান থেকে বলা মুশকিল।
-এ রকম জিনিস আগে আর কখনও দেখেছ?
-না। কোনও ধরনের ফুলগাছ হবে। মনে হয় ফুলের চাষ
করে ওরা, ব্যবসার জন্যে।
-কিন্তু এখন কি ফুল জন্মাবে? বছরের এই সময়ে?
আর সয়াবীনের খেতেই বা জন্মাবে কেন, এভাবে?
-তুমি বল। আমি তো বুঝতে পারছি না।
-হয়তো পাগল ভাববে আমাকে। কিন্তু ওই গাছ একমাত্র
মধ্যপ্রাচ্যে জন্মাতে দেখেছি আমি। এভাবে কিছু কিছু চাষী অন্য ফসরের খেতে লুকিয়ে এই
গাছের চাষ করে।
-মানে..., হঠাৎ বুঝে ফেলল টেরি। পপি না তো!
-আমার কাছে তো সে রকমই লাগছে। তবে শিওর হওয়া
দরকার। পুলিশকে জানানোর আগে ।
-দেখতে হলে তো নিচে নামতে হবে। নামবে?
-পাগল হয়েছ! কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে না?
এখন বাড়ি চলে যাব। ফিরে আসব আবার রাতে।
ডালটনকে নির্দেশ দিল ম্যাক । বড় একটা চক্কর
দিয়ে পুবে মুখ ঘোরাল বৈমানিক ।
শেষ বিকেলে গাড়িতে করে উইলো লেকে হাজির হলো
দলটা। রাত নামার অপেক্ষা করতে লাগল। সাথে করে তুলার কিছু মোটা কম্বল নিয়ে এসেছে। কাঁটাতারের
ওপর ছুঁড়ে দেবে। তারপর ডিঙাতে আর তেমন অসুবিধে হবে না, অন্তত হাতে-পায়ে আর তারের
কাঁটা ফুটবে না ।
চমৎকার একটা লেকের কারণেই জায়গাটার নাম হয়েছে
উইলো লেক । সেটার পাড়ে এসে বসল তিনজনে। সূর্য ডোবার অপেক্ষায় রইল ।
লেকের অন্য পাড়ে পাহাড়। তার ওপাশে ডুবতে শুরু
করল সূর্যটা। লাল আলোয় রাঙিয়ে দিল আকাশ। সেই রঙ লেকের শান্ত পানিতেও পড়ল। এত পরিষ্কার,
পানিতে তাকিয়ে থাকলেই হয়, আকাশের দিকে তাকানোর আর প্রয়োজন হয় না । একই রকম দেখা
যায় ।
সূর্য ডুবল। গোধূলির সবুজ আলো ছড়িয়ে পড়ল।
তারপরেও আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ওরা। তারপরেও আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ওরা। অন্ধকার
হলে এসে উঠল গাড়িতে। চলল খামারটার দিকে ।
সেই খাদের মত রাস্তা ধরে এগোল গাড়ি। একটা জায়গায়
এসে থামল। টেরিকে গাড়িতে থাকতে বলে জ্যাককে নিয়ে বেরোল ম্যাক। হাতে কম্বল। প্রায়
খাড়া পাড়ে বেয়ে উঠে এল দুজনে। তারের ওপর ছুঁড়ে দিল কম্বল। বেড়া পেরোতে খুব একটা
অসুবিধে হলো না ম্যাকের। তবে জ্যাকের হল কিছুটা, তার মোটা পেট আর শরীরের জন্যে। যাই
হোক, পেরোল দুজনেই ।
-সাবধান, ফিসফিসিয়ে বলল ম্যাক। শব্দ যাতে না
হয়। সয়াবীনের পাতায় কাপড় লাগলেই খসখস করবে। যতটা সম্ভব কম লাগানোর চেষ্টা করবে।
কিন্তু সতর্ক থাকা সত্ত্বেও অঘটন ঘটিয়েই ফেলল
জ্যাক। কয়েক পা এগোতে না এগোতেই কিসে যেন পা বেধে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে।
-অ্যাই, কি হলো!
-বোধহয় পাথর-টাথর...
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দূরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল
কুকুর।
পিছিয়ে এল ম্যাক। যেখানে হোঁচট খেয়েছে ডালটন,
সে জায়গাটা হাতড়াতে লাগল । পাথর আছে। তবে তাতে হোঁচট খায়নি ডালটন, কিংবা খেলেও অন্য
কিছুতেও পা লেগেছে। বিড়বিড় করল, দিয়েছ অ্যালার্ম বেলের তারে পা! জলদি এস! কাজ শেষ
করে পালাতে হবে!
প্রায় দৌড়ে এগোল দুজনে। পাতায় কাপড় ঘষা লাগার
পরোয়া আর করল না। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। তারাগুলোকে ইয়া বড় বড় লাগছে। ওগুলোর ম্লান
আলো ছড়িয়ে পড়েছে খেতের ওপর। সেই আলোয় সয়াবীনের মাঝে আলাদা দাগ দুটোও দেখা যাচ্ছে
অস্পষ্ট।
কাছে এগিয়ে আসছে কুকুরের ডাক। আর ডাকের ধরনই
বলে দিচ্ছে সাধারণ কুকুর নয়।
কথা বলল না ম্যাক। চলে এল একটা দাগের কাছে। ছুরি
বের করে দুই পোঁচে কেটে ফেলল একটা গাছ। গোড়া থেকে। সয়াবীন নয়, অন্য রকমের গাছ। তারপর
দিল বেড়ার দিকে দৌড়।
টর্চ জ্বালতে পারলে সুবিধে হত। সঙ্গেই আছে। কিন্তু
সাহসে কুলোচ্ছে না। কুকুরগুলো তাহলে দেখে ফেলবে। ছুটে আসবে।
অন্ধকারে তাড়াহুড়ো করে ভুল করে ফেলল । বেড়ার
কাছে এসে দেখল কম্বল নেই। কোন দিকে সরে এসেছে? ডানে, না বাঁয়ে? যে কোনও একদিকে যাওয়ার
সময় আছে এখন। আরেকবার ভুল করলে আর রক্ষা নেই। ধরে ফেলবে ওদেরকে কুকুরগুলো ।
যা থাকে কপালে ভেবে বাঁয়েই ছুটল ম্যাক । পেছনে
ডালটন ।
তবে এবার আর ভুল হয়নি। কম্বলগুলো পেয়ে গেল।
ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কুকুরগুলো। ফিরেও তাকাল না ম্যাক। বেয়ে উঠতে শুরু করল। নেমে এল
অন্যপাশে । কিন্তু বিশাল শরীর নিয়ে ফসকে গেল জ্যাক। একটা কম্বল কি করে জানি ছুটে গেল।
সেটা নিয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ল সে। পাতাবাহারের ঝাড় ভেঙে গড়াতে গড়াতে পড়ল রাস্তায়।
অন্য সময় হলে হো হো করে হেসে ফেলত ম্যাক। কিন্তু এটা সময় নয়। তারের গায়ে ঝাঁপিয়ে
পড়েছে দুটো ডোবারম্যান কুকুর। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। পারলে তার কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে।
পেছনে চেঁচামেচি করছে দুজন মানুষ। নিশ্চয় পিস্তল-টিস্তল আছে তাদের কাছে ।
ডালটনকে টেনেটুনে তুলল ম্যাক। দুজনে এসে গাড়িতে
উঠল। জলদি ছাড়! টেরিকে নির্দেশ দিল ম্যাক ।
-কিছু ঘটিয়ে এসেছ মনে হয়? টেরি জিজ্ঞেস করল।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
-জ্যাকের কাজ, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ম্যাক। অ্যালার্ম
বেলের তার ছড়িয়ে রেখেছে খেতের ভেতর। তাতে পা দিয়ে ফেলে ছিল। কাঁটাতারের বেড়া, অ্যালার্ম,
কুকুর...একেবারে দুর্ভেদ্য বানিয়ে ফেলেছে জায়গাটাকে!
-তা তো ফেলবেই। আসল কাজ হয়েছে তো?
-হয়েছে । গাছ নিয়ে এসেছি। পপিই, টর্চ জ্বেলে
দেখতে দেখতে বলল ম্যাক। কোনও সন্দেহ নেই।
-হুঁশিয়ার হয়ে যাবে হামাদ, ডালটন বলল । জেনে
গেছে কেউ ঢুকেছিল খেতে।
-তাতে হুঁশিয়ার হওয়ার কিছু নেই। সে জানছে কি
করে যে পপির জন্যেই ঢুকেছিল কেউ? অনেক শেয়াল আর খরগোশ আছে ভেতরে। ভাবছে চুরি করে ওগুলো
শিকার করতেই ঢুকেছিল কোনও শিকারি।
-কিন্তু যদি পপির কথাই সন্দেহ করে? পালাবে ।
-পালিয়ে যাবে কোথায়? বড় জোর তার রেড ক্রীকের
বাড়িতে।
-এখনি রওনা হলে আমাদের আগেই চলে যেতে পারে। কারণ
তার গাড়ি আমাদের চেয়ে ভাল। রোলস রয়েসের সঙ্গে পারবনা আমরা । বাড়িতে না-ও যেতে পারে।
আর গেলেও টাকা পয়সা যা আছে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে।
-তা ঠিক। শেরিফকে ফোন করার দরকার। টেরি, সামনেই
গাঁয়ের পোস্ট অফিস। রেখো তো ওখানে ।
পোস্ট অফিসের কাছে এসে গাড়ি রাখল টেরি। বেরোতে
বেরোতে ম্যাক বলল, তোমরা থাক । আমি ফোন করে আসছি।
দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল সে। ফিরে এল মিনিট দশেক
পরেই। জানাল, পেয়েছি। প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি শেরিফ। উইলো লেকে পপির চাষ! বিশেষ
আবহাওয়া আর উত্তাপ ছাড়া জন্মায় না পপি । কিন্তু জন্মেছে যখন, নিশ্চয় ওখানটা পপি
চাষের উপযোগী। যখন বললাম, কেটে সাথে করে গাছ নিয়ে এসেছি, তখন বিশ্বাস করল।
পাঁচ
ম্যাকেরা যতটা ভেবেছে, ততটা হুঁশিয়ার হয়নি
হামাদ। হয়তো খরগোশ শিকারিই ঢুকেছে ভেবেছে। কারণ রেড ক্রীকে গিয়ে পুলিশ ওত পেতে রইল
ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবু তার দেখা নেই। শেষে সন্দেহ করতে আরম্ভ করল সকলে, অন্য কোনও পথে
পালাল না তো?
সকালের দিকে আর অপেক্ষা করতে পারলেন না শেরিফ।
বললেন, উইলো ক্রীকের খামারে দেখতে যাবেন তিনি, হামাদ আছে কিনা। সবে তিনি রওনা হতে যাবেন,
এই সময় আসতে দেখা গেল রোলস রয়েসটাকে । তার মানে সতর্ক হয়নি হামাদ।
গাড়ি বারান্দায় গিয়ে থামল হামাদের রোলস রয়েস।
কিছু দূরে পথের ধারে একটা ভ্যানে বসে নজর রাখছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে ম্যাকও রয়েছে।
দরজা খুলে নেমে এল হামাদের নিগ্রো শেফার জুলু। পেছনের দরজা খুলে নামাল দুটো স্যুটকেস।
দুই হাতে নিয়ে এগোল বাড়ির সদর দরজার দিকে। পিছনে চলল হামাদ। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলল। কিন্তু ঢোকার আগেই দুপাশ থেকে বেরিয়ে এল লুকিয়ে
থাকা পুলিশের দল। তাদের দলপতি ইনটেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর রবার্ট মরগান।
-এক মিনিট, স্যার, শান্ত কণ্ঠে বললেন মরগান ।
ততক্ষণে ভ্যান থেকে নেমে দৌড়ে চলে এসেছে ম্যাকও।
একবার ম্যাক, একবার মরগানের ওপর ঘুরতে থাকল হামাদের
কালো চোখের তারা। সাপের চোখের মত শীতল । ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা।
নিজের পরিচয় দিয়ে আইডেনটিটি কার্ড দেখালেন
মরগান। বললেন, আপনার স্যুটকেস দুটো দেখতে চাই ।
গাড়িতে বসে ছিল হামাদের স্ত্রী। পালানোর চেষ্টা
করল। পেছন থেকে ভ্যান নিয়ে এসে গাড়িটার পথরোধ করলেন শেরিফ ।
হামাদের দিকে তাকিয়ে মরগান বললেন, এরকম খোলা
জায়গায় থাকলে রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে যাবে তার চেয়ে ভেতরে চলুন।
যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে, এমন ভঙ্গিতে ঠেলা দিয়ে
পাল্লা খুলল হামাদ । একটা হলঘরে ঢুকল । পেছনে ঢুকলেন মরগান আর ম্যাক্।
-দেখি, হাত বাড়ালেন মরগান, স্যুটকেসে কি আছে?
নীরবে বাড়িয়ে দিল জুলু । তালা দেয়া। আবার
হাত বাড়ালেন মরগান, চাবি?
চাবি বের করে দিল হামাদ। এই প্রথম কথা বলল। কম্পিত
কণ্ঠ, ওগুলো আমার নয়!
-কার? চাবিটা ম্যাকের হাতে দিলেন মরগান ।
-আমার এক বন্ধুর।
-ভেতরে কি আছে জানেন?
-ইয়ে...না!
-তাহলে ভয় পাচ্ছেন কেন?
টেবিলের ওপর স্যুটকেসগুলো রেখে একটার তালা খুলে
ফেলেছে ততক্ষণে ম্যাক। ডালা তুলল। যা আশা করেছিল ঠিক তা পেল না। বাদামী কাগজে মোড়া
ছোট ছোট অনেকগুলো বান্ডিল। গায়ে নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। যেন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে
চালান দেয়ার জন্যে। সাদা পাউডারের প্যাকেট নয়, সাধারণত যেভাবে চালান দেয় হেরোইন
চোরাচালানিরা।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল মরগানের মুখে। একটা প্যাকেট
তুলে নিয়ে বললেন, চমৎকার! অনেক দিন এখানে এ রকম ঘটনা ঘটেনি। এই সাধারণ চুরি-ডাকাতি,
ব্যস। ম্যাকের দিকে তাকালেন। এদিকটায় মাদকের ব্যবসা জোরেশোরে চলছে, আগেই খবর পেয়েছিলাম
। তক্কে তক্কে ছিলামও, কিন্তু সুবিধে করতে পারছিলাম না। আপনার বন্ধু নিক সেই সুবিধেটা
করে দিল।
-প্যাকেটে কি আছে দেখা দরকার, ম্যাক বলল ।
-দেখুন।
একটা প্যাকেট তুলে নিল ম্যাক ।
হামাদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন মরগান, কি আছে
জানেন? এমন ভঙ্গি করছে মিশরীয় লোকটা, যেন এখুনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। খসখসে গলায়
কোনমতে বলল, জানে না ।
-বেশ, তাহলে আমরাই জেনে নিচ্ছি। অ্যারেস্ট হওয়ার
জন্যে তৈরি থাকুন।
প্যাকেট খুলল ম্যাক। বেরিয়ে পড়ল সাদা পাউডার
।
-কি বলবেন? হামাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায়
জিজ্ঞেস করলেন মরগান ।
কিছুই বলার নেই হামাদের। তার স্ত্রীরও না। ধপ
করে এলিয়ে পড়ল একটা সোফায়।
শোফারের মুখের রঙও ছাই হয়ে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে
মরগান বললেন, যদি শাস্তি কম পেতে চাও, যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও। কতগুলোতে ঠিকানা দেখছি
না। ওগুলো কিভাবে চালান হয়?
-এখানে এসে নিয়ে যায় কাস্টোমাররা।
-কেমিস্টের দোকান আছে ওদের, না?
-আছে।
-বেশ। কোন কোন দোকান, দেখিয়ে দিতে হবে। লোক
দিচ্ছি।
চারজন সাদা পোশাক পরা পুলিশের সঙ্গে বেরিয়ে
গেল জুলু ।
-ম্যাকের দিকে তাকালেন মরগান, শয়তানগুলোকে ধরে
আনুক আমরা ততক্ষণ বসি ।
-বেশ।
ঘরে এসে ঢুকলেন শেরিফ, পিট থরটন টেরি আর জ্যাক।
পাউডারের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল বৈমানিক, বা-বা-বা! চমৎকার! ম্যাক, চেখে
দেখি একবার, বলতে বলতে হাত বাড়াল সে। বড় এক চিমটি তুলে নিয়ে মুখে পুরতে গেল ।
এক থাবায় ফেলে দিল ম্যাক। খবরদার! ওই এক চিমটিই
কাল হতে পারে তোমার! তুমি নেশা করলে তোমার বিমানটাও নেশা করতে শুরু করবে।
হাসল মরগান। সংক্রমিত হলো টেরি আর শেরিফের মাঝেও ।
Tags: মারাত্মক নেশা, রকিব হাসান, গোয়েন্দা উপন্যাস, গোয়েন্দা গল্প, রোমাঞ্চ গল্প, কিশোর থ্রিলার, Marattok Nesha, Rokib Hasan, Detective Story
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - #### - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
‘হে ঈমানদাররা! মদ, জুয়া, মূর্তি ও (ভাগ্য নির্ধারক) তীর নিক্ষেপ
এসব নিকৃষ্ট বস্তু ও শয়তানের কাজ। কাজেই তোমরা এগুলোকে বর্জন করো। যাতে তোমরা সফল হতে
পারো। শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক
শত্রুতা ও তিক্ততা ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়।
তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না!’ (সুরা মায়েদা : ৯০-৯১)।
No comments:
Post a Comment