আমার শৈশব – ফ্লোরিন মিলি |
আমার
শৈশব – ফ্লোরিন মিলি
দুপুর, মা
ঘুমাচ্ছে। আর আমি পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়তাম। কোন দিন শলার ঝাটা নিয়ে বেরোতাম ফড়িং ধরার জন্য। লাল লাল বড় রাজা ফড়িং
ধরার চেষ্টা করতাম ঝাটা দিয়ে বাড়ি মেরে। ওগুলো ছিল ভীষণ চালাক। হাত দিয়ে ধরতে
গেলেই পালিয়ে যেত। কত রঙের ফড়িং যে ছিল। কোনটি ছিল হলুদ-কালো ফুটকি দেওয়া। কোনটি হলুদ, কোনটি ছিল বাদামি। ছোট চিকন ফড়িংকে বলতাম বাঁশ ফড়িং। ওগুলো ধরা ছিল খুব সোজা। ঘাস ফড়িং বা গয়া ফড়িং ধরতে ভয় পেতাম, কারণ লাফ দিত। কসমস ও রঙ্গন ফুলের ঝাড় থেকে ধরতাম বড় বড় হলুদ, কমলা,
কালো প্রজাপতি। ওদেরকে কৌটার
মধ্যে বন্দি করে রাখতাম। বেচারারা পরে
অবশ্য মারা যেত।
উঁচু
উচু খই বাবলার ডালে ঝুলে থাকত লাল রঙের পাকা খই। খইগুলো গাছের মগ ডালে থাকায় ছিড়তে
পারতাম না। অপেক্ষা করতাম কখন কাক ঠোকর দিয়ে একটা খই নীচে ফেলবে। মনে মনে ভাবতাম যদি কাক হতে পারতাম তা হলে সব পাকা খই খেয়ে নিতাম।
মাঝে
মাঝে আসত আইসক্রিমওয়ালা। হাতে দশ পয়সা
থাকলে দৌড় দিতাম একটা লাল, সবৃজ আইসক্রিম নেওয়ার জন্য।
আর
চার আনা থাকলে তো কথাই নেই, একটা দুধ-মালাই পেয়ে যেতাম। ঘণ্টা বাজিয়ে কখনও কখনও হাওয়াই-মিঠাইওয়ালা চলে আসত। ছোট ছোট গ্লাস ভর্তি ঝুরঝুরে আইসক্রিম পাওয়া যেত। ভাঙাচোরা জিনিস কিনতে
আসা লোক আনত গুড়ের তৈরি দেল-বাহার নামে খুব শক্ত একটা জিনিস। ভাঙা জিনিসের বদলে ওটা ছেনী দিয়ে কেটে কেটে দিত।
সিমেন্টে
ঝিনুক ঘষে ফুটো করা হত। তারপর সেই ধারাল অংশ দিয়ে আম ছিলতাম। পরে লবণ, মরিচ
দিয়ে মেখে কলাপাতার খিলি বানিয়ে তাতে আম ভর্তা রেখে খেতাম।
বিকেল
গড়াতেই খেলতে শুরু করতাম। এ পেন্টি বায়োস্কোপ, হরিণরে খাব, আংটি লুকানো, গোল্লাছুট,
বউ-চি, দাড়িয়াবান্ধা। সন্ধ্যাবেলা যখন এক গাঁ ধূলো নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, মাঝে মাঝে দু-চার
ঘা ধোলাই জুটত। কখনও কখনও মায়ের ভয়ে ঘরে ঢোকার সাহস পেতাম না। লেবু গাছের কাছে রাস্তায়
দাড়িয়ে থাকতাম। অন্ধকারে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলত। সন্ধ্যায় বাবা যখন ঘরে ফিরত, বাবার
সাথে সাথে ঘরে ঢুকতাম। হাত-মুখ
ধুয়ে যথারীতি পড়তে বসতাম। হ্যারিকেনের আলোতে পড়তে বসতাম। বাতির যে পাশে হ্যান্ডেল সেটা আমার দাদা আমার পাশে ঘুরিয়ে দিত। আমি নিতে চাইতাম না। বাতি ঘোরানোর এক পর্যায়ে ও আমাকে দিত কিল। আমি
কান্না জুড়ে দিলে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যেত। সেদিনের মত আমার
পড়া
শেষ হত।
খুব
ভোর বেলা আম কুড়াতে বেরোতাম। আমাদের
সামনের বাড়িতে ছিল প্রচুর আম গাছ। তাদের পুকুর পাড়ে ছিল একটি ফজলি আমের গাছ। তার
একটা আম পেলে হতাম মহা খুশি। শরৎ কালে
কুড়াতাম শিউলি ফুল আর কাঠ বাদাম। রাতের
বেলা বাদুড়গুলো ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলত। খুব ভয় পেতাম। সন্ধ্যাবেলা কদম গাছের মগ
ডালে ছোট সাদা কুপ পাখি ডাকত। আর মাঝে
মাঝে রাতে একটা পাখি ডাকত। মা বলত
নিম পাখি। ওর ডাক নাকি ভাল না। মা বলত ওটা ডাকলে নাকি মানুষ মারা যায়।
মায়ের
রান্না করা কলার মোচার ঘণ্ট, ছোট মাছের চচ্চড়ি, মাংসের স্বাদ ছিল খুবই মজার। এখন মনে হয়
ও খাবার ছিল জান্নাতী খাবার।
মায়ের
গায়ের গন্ধ ছিল অদ্ভুত। মায়ের মাথার তেল, পান
খাওয়া ও শাড়িতে ন্যাপথালিনের গন্ধ খুব ভাল লাগত। জ্বর হলে, মা কাজ থামিয়ে মাঝে মাঝে এসে তার গাল আমার
গালে লাগিয়ে জুর দেখত। এ জীবনের কষ্ট
যন্ত্রণা এখন কেউ নেই যে শুষে নেবে॥
কারন
আমার স্নেহময়ী মা এখন বাস করছেন না ফেরার দেশে।
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
আর
তাদের (মুমিনদের) চারপাশে বিচরণ করবে চিরজীবী বালকেরা। যখনি তাদের (বালকদের) তুমি দেখবে
মনে করবে যেন তারা ছড়ানো ছিটানো মুক্তা। তুমি সেখানে (জান্নাতে) যেদিকেই তাকাবে শুধু
নিয়ামতে পরিপূর্ণ দেখতে পাবে। আর (দেখবে) অতি বৃহৎ সাম্রাজ্য। (সুরা আল ইনসান ১৯-২০)
No comments:
Post a Comment