ছোট গল্প – ইপাই্ওরনিস আইল্যান্ড – এইচ জি ওয়েলস – বাংলা অনুবাদ - Short story - Æpyornis Island – H. G. Wells – Bengali Translation |
ছোট গল্প – ইপাইওরনিস আইল্যান্ড – এইচ জি ওয়েলস – বাংলা অনুবাদ - Short story - Æpyornis Island –
H.
G. Wells – Bengali Translation
-অর্কিড নাকি?
পেছন থেকে প্রশ্নটা শুনে ঘুরে তাকালাম। হাসি মুখে এগিয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারে
বসল প্রশ্নকর্তা, ষণ্ডা চেহারার লোকটি।
-হ্যা, মাথা ঝাঁকালাম।
-সাইপ্রিপেডিয়াম নিশ্চয়ই? আবার জিজ্ঞেস করল সে।
তার চোয়াড়ে মুখের ডান পাশে বিশাল কাটা দাগ। ভাল লাগল না আমার।
-বেশিরভাগই ওই প্রজাতির, জবাব দিলাম।।
-নতুন কিছু পাননি?
সাতাশ বছর আগে গিয়েছিলাম ওই দ্বীপে।
-কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-জোয়ান বয়সের
খেয়াল। উড়ু উড়ু মন, তাই উড়েই বেড়িয়েছি। দু'বছর ছিলাম- ইস্ট ইণ্ডিজে। ব্রেজিলে সাত বছর। তারপর
গেলাম মাদাগাসকারে।
-ওই দ্বীপে
গেছে এরকম কিছু লোকের নাম জানি। কার চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন?
-ডসনের। বুচারের
নাম শুনেছেন? আমিই বুচার।
-ও, আপনিই! ডসনের বিরুদ্ধে মামলা তো আপনিই করেছিলেন।
চার বছর আটকে ছিলেন মরুদ্বীপে। সেই চার বছরের টাকা আপনি মামলা করে আদায় করেছিলেন ডসনের
কাছ থেকে, ঠিক না?
বিগলিত হাসিতে গলে পড়ল বুচার। জ্বি, আমিই সেই অধম। মামলাটা খুবই
মজার ছিল, তাই না?
-হ্যা, দারুণ ইন্টারেস্টিং।
-ঈপাইওনিস
নামটা কি শুনেছেন?
-শুনেছি।
অ্যাণ্ড্রুজ বলেছিল। ওটা নিয়ে গবেষণা করছে সে। একখানা মাত্র উরুর হাড় নিয়ে যে কী
মাতামাতি। স্রেফ পাগলামি। ওই জন্যেই তো সমুদ্র পাড়ি দিতে হলো আমাকে।
-উরুর হাড়! অবাক হলো যেন বুচার।
-হ্যা, একগজ মত লম্বা সে হাড়। দৈত্যের মত প্রাণী।
-দৈত্য মানে এক্কেবারে
সিন্দবাদের দৈত্য। কবে, কোথায় পেয়েছে ওটা জানেন আপনি?
-কোথা থেকে পেয়েছে বলতে
পারব না,
তবে হাতে পেয়েছে তিন-চার বছর আগে। কেন,
আপনি কি ওটা সম্পর্কে কিছু জানেন? জিজ্ঞেস
করলাম।
-জানি না মানে? হাড় কেন, ওই হাড়ের মালিকও তো আমারই আবিষ্কার।
ডসন ব্যাটা যদি বেতন নিয়ে খাচড়ামি না করত, তা হলে ওই একখান
হাড়ের বদৌলতেই রাজা বনে যেত।
-আপনিই বা ওটা পেলেন
কোথায়?
-কপালগুণে রে ভাই, কপালগুণে। নৌকাটা যে নোঙর ছিড়ে আপন খেয়ালে
ভেসে যাবে তা কি জানতাম। ঘুমের ঘোরে ভাসিয়ে নিয়ে ঠেকাল আন্তানানারিভো থেকে প্রায়
নব্বই মাইল উত্তরের এক বিরাট জলায়।
-ও হ্যা, অ্যাণ্ড্রুজ তো বলেছিল জলাতেই পাওয়া গেছে ওটা।
-পূর্ব উপকূলের জলা। গোল করে চারদিক থেকে জলাভূমি ঘিরে রেখেছে জায়গাটাকে।
পানির কারণেই কিনা কে জানে, কিছুই পচে না। নোনতা বিশ্রী স্বাদের
পানি, তাতে আলকাতরার গন্ধ। ওখানটাতেই পেয়েছিলাম। দেড় ফুটের
মত লম্বা। একটা নয় দুটো নয়, অনেকগুলো ডিম।
-আসলে বেরিয়েছিলামই
ডিম খুঁজতে। সঙ্গে দু’জন কালো আদিবাসী ছিল।
চারখানা ক্যানু, চারদিনের খাবার আর তাবুটাবুসহ যখন নৌকা এনে এখানে ফেলল
বেচারা, কী আর করা। ভাগ্য বলেই মেনে নিলাম। মোটামুটি শক্ত
আর কাদা কম দেখে এক জায়গায় তাঁবু খাটালাম। কী গন্ধ রে ভাই, এখনও যেন নাকে আটকে আছে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ওই আলকাতরার গন্ধ। তবে কাজটা
ছিল মজারই, লোহার শিক দিয়ে কাদা খোঁচানো। আচ্ছা বলেন দেখি
এমন করে খোঁচাখুঁচি করলে আস্ত থাকে ডিম?
-শেষ কবে যে ডিম ফুটে
ঈপাইওনিসের বাচ্চা দ্বীপময় দাপিয়ে বেড়িয়েছিল তা ওই কালো ব্যাটাদের মুখেই শুনেছিলাম।
কিংবদন্তী মিশনারীদের প্রচার। জ্যান্ত ঈপাইওরনিস সাদারা কোনওকালেই দেখেনি। কালোরাও
দেখেছে কিনা সন্দেহ।
-১৭৪৫ সালে ম্যাকার নামে
কে নাকি দেখেছিল। মাদাগাসকারে জ্যান্ত, চলেফিরে বেড়ানো ঈপাইওরনিস।
কী জানি। দেখতেও পারে। আমি পেয়েছিলাম ডিম। যেন সদ্য পাড়া। নৌকা থেকে নামাতে গিয়ে
পাথরের ওপর পড়ে ঠাস্ করে ফেটে চৌচির হয়ে গেল একটা। পচা তো নয়ই। একেবারে টাটকা গন্ধ।
‘আশ্চর্য
দেখেন,
ওটা যার পেট থেকে বেরিয়েছে, সে তো,
সেই চার শ' বছর আগেই অক্কা পেয়েছে। যাহোক,
ডিম ভাঙতে মেজাজ গেল খিচড়ে। যাবে না-ই বা
কেন, সেই সারাদিন কাদা ঘেঁটে ঘেঁটে বের করেছি আর ব্যাটা কালা
হারামজাদা ফেলে ভাঙল। রাগলে আবার আমার মাথার ঠিক থাকে না। দিলাম আচ্ছামত থোলাই। তাই
বলে তোরা ওই ভাবে শোধ নিবি?
-কেটলিতে চায়ের পানি
ফুটছে। আমি পাইপ ধরিয়ে আয়েশ করে টানছি আর দু'চোখ ভরে দেখছি জলাভূমির সূর্যাস্ত।
অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য। সামনে সিদুর রঙা আকাশের গায়ে ধূসর পাহাড়। জলাভূমিতে পড়েছে
তার ছায়া। থিরথির করে কাঁপছে লালচে পানি। অপূর্ব। দেখছি আর মনে মনে হিসেব করছি কয়দিন
এখানে থাকতে পারব। স্টকে আছে তিনজনের তিন দিনের মত খাবার আর এক পিপে পানি। ভয়ের কিছু
নেই। ভাল মতই ফিরতে পারব। হঠাৎ ঝপাৎ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, দুই, হারামজাদা নামিয়ে নিয়েছে নৌকো। মুহূর্তে
বুঝে গেলাম শয়তানদের মতলব। সর্বনাশ! ছররাওলা বন্দুক যাও আছে
তা তাবুতে। ওটা আনতে আনতেই ব্যাটারা চলে যাবে নাগালের বাইরে। ঝট করে মনে পড়ল ছোট্ট
রিভলভারটা তো আছে পকেটে। ছুটলাম সমুদ্রের দিকে। ততক্ষণে চলে গেছে বিশগজ মত। পিস্তল
তাক করে ধরে বললাম, ফিরে আয় শয়তানের বাচ্চারা, নইলে কুত্তার মত গুলি করে মারব। কেয়ারই করল না। উল্টে আমাকে কী টিটকারি
দেয়া! পিত্তি জ্বলে গেল। দিলাম দমাদম গুলি চালিয়ে। পড়ে
গেল একজন পানিতে। আরেকজন মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল নৌকার খোলে। দাঁড়টা পড়ে গেল পানিতে।
বুঝলাম এভাবে কাজ হবে না। জামা কাপড় খুলে ছুরিটা দাঁতে কামড়ে দিলাম ঝাপ পানিতে। অনেক
দূরে চলে গেছে নৌকো। হাঙরের ভয়ও আটকাতে পারল না। ভয় পেলে এই দ্বীপে পচে মরতে হবে,
জানি। অন্ধকার নেমে গেছে। স্রোতের টানে দাঁড় ছাড়া নৌকা কোনদিকে
ভেসে যাবে আঁচ করে সেই দিকেই সাঁতরে চললাম। কালো কালির মত অন্ধকারে ঢেউয়ের মাথায়
ঝিকিয়ে উঠতে লাগল ফসফরাসের আলো। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। খানিক দূরে ছায়ামত চোখে পড়ল।
বুঝলাম নৌকোটা। ঢেউ, * আছড়ে পড়ছে ওটার তলায়। সাবধানে এগিয়ে
গেলাম। ব্যাটা টের পেলে, রক্ষে নেই। নিঃশব্দে মাথা তুললাম,
পুরো নৌকা খালি। তারমানে খোলের ভেতর শুয়ে পড়া লোকটা গুলি খেয়েই
শুয়েছে, জন্মের মত। নৌকোয় উঠেই ওকে ফেলে দিলাম পানিতে।
দুঃশ্চিন্তা আর পরিশ্রমে ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। দু’খানা বিস্কুট
আর দু’ঢোক পানি
খেয়ে পাটাতনের ওপরে শুয়ে পড়লাম। উঠে দেখি সকাল। ডাঙার চিহ্নও নেই। সীমাহীন পানি।
বহু দূরে একটা পালতোলা জাহাজের মাস্তুলের আগাটুকু একপলকের জন্য দেখতে পেলাম। সূর্য
মাথার ওপর উঠতেই চড়চড়ে রোদে জ্যান্ত ভাজা হয়ে যাবার জোগাড় হলাম। বিস্কুট মোড়ানো
একটুকরো খবরের কাগজ ছিল ওটাই মাথার ওপর দিলাম। ওটুকুতে কী আর হয়। ফোসকা পড়ে গেল সারা
গায়ে।
‘পুরো দশ
দিন এভাবে নরক যন্ত্রণা ভোগ করলাম। রোদের তোড়ে চোখ মেলে তাকাতেও পারতাম না। শুধু সকাল
আর বিকেলের দিকে লক্ষ্য রাখতাম জাহাজ-টাহাজ যায় কিনা। দু’বার দেখেছিলামও।
চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়েছি। শুনতে পায়নি। কপালে আছে দুর্ভোগ-না
হলে... যা হোক, খাওয়ার টান পড়তেই
একটা ডিম ভাঙলাম। একটু গন্ধ গন্ধ। তবে স্বাদ খারাপ না। হাঁসের ডিমের মত। কুসুমের পাশে
বিটকেলে এক দাগ। সরু সরু সুতা আর মইয়ের মত জাল জাল কী যেন। খিদের সময় অত কে দেখে।
তিনদিন ধরে খেলাম ওই একখান ডিম। তিনদিন পর আরেকটা ভাঙতেই খাড়া হয়ে গেল গায়ের লোম!
অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য! বাচ্চা ফুটছে একটু
একটু করে। প্রায় চারশো বছর আগের আলকাতরা-কালো কাদায় পোতা
ডিম। তাই থেকে বেরুচ্ছে ছানা। রোদের তাতে তৈরি হচ্ছে বাচ্চা! আজব কেরামতি রে ভাই।. জ্বণের মধ্যে বিরাট মাথা
আর বাঁকা পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকী ওর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিও দেখতে পাচ্ছি। পাতলা
এক পর্দা ক্রমশ শুকিয়ে আসা কুসুমটাকে ঢেকে ফেলেছে। এসব দেখে অদ্ভুত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন
হয়ে গেল আমার মন। ভারত সহাসাগরের বুকের ওপর বসে ডিম ফুটাচ্ছি। কোন কালে লুপ্ত হয়ে
যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক পাখির ডিম! ডসন যদি জানত,
চার বছরের মাইনে আমার এক কথাতে দিয়ে দিত, তাই না?
এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে শুনছিলাম আমি। তার প্রশ্নে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে আগ্রহ
ভরে জানতে চাইলাম, তারপর?
খিদের জ্বালয় সেই আধফোটা বাচ্চাকেই খেয়ে ফেললাম একটু একটু করে। জঘন্য স্বাদ।
ভাবলেও গুলিয়ে ওঠে গা। তৃতীয়টা আর ভাঙলাম না, খাওয়া যাবে না বুঝতে পেরেই।
এভাবে মাঝ সমুদ্রে না খেয়ে মরার ভয়ে বাঁচার চেষ্টা চালালাম। একটা দিক নির্দিষ্ট করে
নৌকো নিয়ে এগুতে লাগলাম। বিশাল ডিমের খোলাটাকে দাড় হিসেবে ব্যবহার করলাম। এভাবেই
পৌছুলাম অ্যাটলে। চাকার মত প্রবাল দ্বীপ। মাঝখানে উপহ্রদ। চারমাইলের ছোট্ট দীপটাতে
গোটা কয় গাছ, একটা ঝরনা আর হ্রদ বোঝাই কাকাতুয়া মাছ। ‘টেনে ডাঙায়
তুললাম নৌকো। তারপর সাবধানে নামালাম ডিমটা। সৈকত থেকে দূরে শুকনো বালুতে গর্ত করে তাতে
রাখলাম ওটা। ভালমত রোদ লাগার জন্য খুলে রাখলাম গর্তের মুখ। এরপর শুরু হলো রবিনসন ক্রুশোর
জীবন। ছোটবেলায় বই পড়ে ভেবেছিলাম চমক্কার জীবন। অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। বাস্তবে দেখলাম
এক্কেবারে জঘন্য। অসহ্য একঘেয়েমিতে ভরা। প্রথম দিনটা খাবারের সন্ধান করতেই কেটে গেল।
সারাদিনের শ্রমে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছিল শরীর। নৌকোর মধ্যে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ
প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। যেন এক সঙ্গে হাজার হাজার নুড়ি পাথর আছড়ে পড়ল নৌকোর
গায়ে। স্বপ্ন দেখছিলাম। আচমকা ঘুম ভাঙতে ভুলে গিয়েছিলাম পরিবেশ পরিস্থিতি। নিজের
বাড়িতে আছি ভেবে অন্ধকারেই হাতড়ালাম দেশলাইয়ের জন্যে। মুহুর্তে খেয়াল হলো আছি কোথায়।
সে সে বাতাসের শব্দের সঙ্গে গর্জন করে নৌকোর গায়ে আছড়ে পড়ল ঢেউ। ভাগ্যিস পানির কাছ
থেকে অনেক দূরে রেখেছিলাম ডিমটা। ঘন কালো আকাশ। আলোর চিহ্ন নেই কোথাও। প্রচণ্ড শব্দে
একের পর এক বাজ পড়তে লাগল। তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। যেন ফুটো হয়ে গেছে আকাশ। মাথায়
ফসফরাসের আগুন নিয়ে কিলবিলিয়ে এগিয়ে এল বিশাল এক ঢেউ। ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে
দিলাম ছুট। বৃষ্টি ধরতেই ফিরে এলাম নৌকোর কাছে। কিন্তু কোথায় নৌকো। বুঝলাম ভেসে গেছে।
ডিম পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি ঢেউ। ওটার পাশে বসেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটুকু। কী ভয়ানক
রাত। এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
ভোর হলো। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। বালুর ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নৌকোর টুকরো-টাকরা।
কুড়িয়ে আনলাম ওগুলো। পাশাপাশি দুটো গাছে ওগুলো বেঁধে ছাউনি মত বানিয়ে নিলাম। ওই
দিনই ডিম ফুটে বেরুল ঈপাইওরনিসের বাচ্চা।
-ডিমটা জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছিলাম।
ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেলাম ফটাশ শব্দে ভাঙল কী যেন। ভাঙুকগে, আমার কী, ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম আবার। কিন্তু আচমকা
ঝাকুনি লাগতেই ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। ডিমটার দিকে তাকিয়ে দেখি ফুটো হয়ে গেছে খোলা।
ফুটো থেকে কদাকার এক বাদামি মুণ্ডু জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওকে দেখে অভিভূত
হয়ে গেলাম আমি। “সোনা মানিক, লক্ষ্মী বাপধন আবার!” বলে
ডাকতেই খুটুর খাটুর করে বেরিয়ে এল। দেখতে পাখির ছানার মতই। তবে আয়তনে বড়।
ওর গায়ের বাদামি রঙের নোংরা মামড়ি দুদিনেই ঝড়ে গেল। গজালো চুলের মত নরম
মিহি পালক। নাম রাখলাম ফ্রাইডে। রবিনসন ক্রশোর ফ্রাইডে ছিল মানুষ। আমার ফ্রাইডে হলো
তিন চারশো বছর আগের এক দানব পাখির ছানা।
ডিম থেকে বেরুনোর পর ওর কুৎসিত চেহারা দেখে ঘিন ঘিন করে উঠেছিল আমার গা। কিন্তু
মুরগির মত ঘাড় ঘুরিয়ে কেক কেক করে ডেকে খাবার চাইতেই হু-হু
করে উঠল মন। আহা রে, মা-বাপ নেই।
আমি ছাড়া কে দেবে ওর খাবার। তখুনি ছুটলাম মাছ ধরে আনতে। খাওয়াতে গিয়ে দেখি,
ওরে বাবা, এ যে রাক্ষস। দিতে না দিতেই শেষ।
আর শেষ হতেই ঠোট ফাক করে কেক কেক শব্দ করে কী লাফালাফি। দারুণ মজা পেলাম। বললাম,
খেয়ে দেয়ে বড় হ। অনেক দিন মাংসের স্বাদ পাই না, তোকে দিয়ে সে সাধ পূর্ণ হবে।
দিন দিন বেড়ে চলল ঈপাইওনিসের ছানা। সেই সঙ্গে খুলতে লাগল ওর রূপ। বাড়তে লাগল
চেকনাই। মাথায় গজাল নীল ঝুঁটি। লেজের লম্বা পালকের রং হলে ঝিকমিকে সবুজ। ওকে নিয়ে
বেশ সুখে শান্তিতে কেটে গেল দুটো বছর। কাজকর্ম নেই। মাথায় নেই দায়িত্বের বোঝা। মাইনে
জমা হচ্ছে ডসনের অফিসে। সময় কাটানোর জন্যে সাজাতে শুরু করলাম দ্বীপটাকে।
নুড়ি, শামুক, ঝিনুক দিয়ে দ্বীপের চারপাশ
ঘিরে লিখলাম ঈপাইওনিস আইল্যাণ্ড। প্রতিদিন সকাল বিকাল সমুদ্রের তীরে বসে থাকতাম জাহাজের
আশায়। এসব সময় ফ্রাইডে সারাক্ষণই থাকত আমার পাশেপাশে। আমাকে খুশি করার জন্যে কিংবা
দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে মাঝেমাঝে নাচত। অপূর্ব সে নাচের ভঙ্গি! নীল ঝুঁটি ঘুরিয়ে, লেজে ঢেউ তুলে পা তুলে তুলে
সে কী নাচ! ঝড় বৃষ্টির সময় গুটিগুটি এসে আমার গা ঘেঁষে বসত।
বড় ভাল লাগত। ওসব মুহূর্তে ওর ওপর কেমন যেন স্নেহপূর্ণ অনুভূতি হত আমার। এই মানে,
বলতে পারেন ফাদারলি ফিলিংস। কিন্তু এ-সুখ
আর বেশিদিন সইল না আমার কপালে। ফ্রাইডের বয়স দুই বছর পেরিয়ে গেছে। লম্বা হয়েছে চোদ্দ
ফুট। গাইতির ফলার মত বিশাল মাথা। কতবেলের মত বড় বাদামি দুই চোখের চারপাশ ঘিরে হলুদ
রিং। অস্ট্রিচের পালকের মত কর্কশ নয় বরং বেশ মসৃণ ওর পালক। রং আর পালক দুই-ই অনেকটা ক্যাসওয়ারি পাখির মত। কিন্তু রক্তে যার রয়েছে বেঈমানী তাকে বাইরের
রূপে কি চেনা যায়? আমার খেয়ে যার হয়েছে এত চেকনাই,
সে কিনা চালায় আমার ওপর স্বৈরাচার! নিমকহারাম,
বুঝলেন! একেবারে নিমকহারাম।
দুঃখে সত্যি সত্যি ভারি হয়ে উঠল বুচারের কণ্ঠ।
-একদিন মাছ ধরতে গিয়ে
হিমশিম খেয়ে গেলাম। রোজ ধরা পড়ে পড়ে ব্যাটা মাছেরাও হয়ে গেছে ভীষণ চালাক। সব পালিয়েছে
লেকের মধ্যিখানে। একটাও আর পাই না। এদিকে শয়তানের বাচ্চা ঘাড় উচিয়ে টহল দিচেছ। বুঝতে
পারছি ওর পেটে ভীষণ খিদে। পেটে যখন রাক্ষুসে খিদে তা হলে সামুদ্রিক শশা খেয়েও তো পেট
ভরাতে পারে। তা না, নবাবের বাচ্চার চাই মাছ। খিদে পেট জ্বলছে আমারও।
তাই অনেক কষ্টের পর একটা মাছ পেয়ে ওকে ভাগ দিতে চাইলাম না। মোটে একখান মাছ। ওটাতে
ওর পেটের কোনাও রবে না জেনেই একাই খেতে গেলাম। ওরে বাবা, হোয়াক
করে তেড়ে এসে ছিনিয়ে নিল। খিচড়ে গেল মেজাজ। মাথায় দিলাম কষে এক ঘা। ব্যস,
সাথে সাথে ঝাপিয়ে পড়ল আমার ওপর।
-এই দেখুন, বলে বুচার তার মুখের কাটা দাগটা দেখাল। এক
ঠোকুরেই এই দশা হয়েছিল। এত বছরেও দাগটা মুছল না। জানি জীবনেও মিলাবে না। ঠোকর মেরেও
রেহাই দিল না। শুরু হলো ঝড়ের বেগে লাথি। ঘোড়ার লাথি তার কাছে কিছুই না। মুহূর্তে
বুঝে গেলাম শয়তানটার মতলব। খুন করবে আমাকে। তারপর আমার মাংসেই উদোর পূর্তি করবে। টের
পেতেই ছুটতে শুরু করলাম। সে-ও তাড়া করল আমাকে। পঙ্খীরাজের
গতি ওর। ধরা পড়ে গেলাম। ওর পাঁচ ফুট উঁচু গোদা পায়ের লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম।
এরপর শুরু হলো ঠোক্কর আর লাথি বৃষ্টি। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গিয়ে
পড়লাম লেগুনের পানিতে। জানতাম পানিতে নামবে না ইবলিশটা। সারাদিন গলা পানিতে দাঁড়িয়ে
কাটালাম। এক মুহূর্তের জন্যেও সে নড়ল না ওই জায়গা থেকে। গলা লম্বা করে ফুটি উচিয়ে
পায়চারি করতে থাকল। সেই সাথে চিৎকার। সহ্য করা যায় না। মিথ্যে বলব না, নবাবের বাচ্চার খানদানী টহল দেখে নিজেকে খুবই হোট লাগছিল। অমন লর্ড স্টাইলে
হাঁটা আমার দ্বারা জীবনেও সম্ভব হবে না। ওকে দেখছি আর যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছি। সারা শরীর
থেঁতলে দিয়েছে হারামজাদা। দরদর করে রক্ত পড়ছে মুখের ক্ষত থেকে।
শরীরের কষ্টকে ছাপিয়ে উঠল মনের কষ্ট। ডিম ফুটিয়ে যাকে জন্ম দিলাম, নিজ হাতে খাইয়ে এতটা বড় করলাম, তারই হাতে আজ
এতটা অপদস্থ। কতবড় নিমকহারাম ভাবুন একবার।
ঈপাইওরনিসের বাচ্চার নিমকহারামির কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে এল বুচারের। মনে হলো
দুঃখে কেঁদেই ফেলবে সে। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য মুখের চেহারা স্নান করলাম আমি।
-ভেবেছিলাম রাগ পড়ে
গেলে নিজের ভুল বুঝতে পারবে সে। কিন্তু আমার ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত করে সে আমার উঠে
আসার অপেক্ষায় দাড়িয়েই রইল। সারাদিন এভাবে কাটার পরও যখন সে নড়ল না, তখন ডুব সাঁতার দিয়ে চুপি চুপি গিয়ে উঠলাম একটা তাল গাছের তলায়। জিন্দিগীতে
তালগাছে উঠিনি। প্রাণের ভয়ে ওই ক্ষতশরীর নিয়ে উঠলাম তালগাছের মাথায়। নিজের হাতের
ওপর জন্মানো এক বেঈমানের ভয়ে নেংটি ইদুরের মত বসে আছি তালগাছে। মানুষের বাচ্চা হয়ে
আমি চারশো বছর আগের বিলুপ্ত এক পাখির ভয়ে কাঁপছি ঠকঠক করে।
গাছের মাথায় আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এল। গলা লম্বা করে ধরতে চেষ্টা করল।
শয়তানটাকে বশে আনার জন্যে কত যে ফন্দি ফিকির করলাম, তা মুখে বলতে পারব
না। এখন ভাবতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছি। ফন্দি ফিকিরে কাজ হলো না দেখে মারধর শুরু করলাম।
বড় বড় প্রবালের টুকরো ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। ওমা, অবাক হয়ে
দেখি গিলে ফেলছে কোৎ কোৎ করে। তাই দেখে ভোলা ছুরি ছুঁড়ে দিলাম। বললাম, “এইবার গেল
হারামজাদা”। যেন সে বুঝতে
পারল আমার মতলব। ছুরি নিজের দিকে ছুটে আসতে দেখেই গলা সরিয়ে নিল সে। ব্যর্থ হলো আমার
এই পরিকল্পনা। শেষ পর্যন্ত ফন্দি করলাম না খাইয়ে মারব। এও ব্যর্থ হলো। হারামজাদা অল্প
পানিতে নেমে পোকা মাকড় খুঁটে খেয়েই পেট ভরাতে লাগল। না খেয়ে মরতে বসলাম আমি নিজেই।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেক সময় থাকতে লাগলাম গলা পানিতে ডুবে। বাকি অর্ধেক সময় তাল
গাছের ডগায় বসে।
একদিন পা ঝুলিয়ে ঘুমাচ্ছি তালগাছে। আচমকা পায়ে তীব্র ব্যথায় চিঙ্কার দিয়ে
ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। বাম পা উঠিয়ে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে আশপাশে খুঁজলাম।
পেয়েও গেলাম। তালগাছের পাশেই ঝাপির মত বড়সড় এক গাছ ছিল। ওটাতে উঠেই শয়তানের বাচ্চা
আমার গোড়ালি থেকে ঠুকরে তুলে নিয়েছে মাংস। অসহ্য যন্ত্রণায় সারারাত কাতরালাম। নীচে
নেমে গাছপাতার রস লাগিয়ে যে রক্ত বন্ধ করব, সে উপায়ও নেই। পরিত্রাণের
কোনও পথ না দেখে অসহায়ের মত কাঁদতে শুরু করলাম। উঃ, কত বড়
ইবলিশ তা আর কী বলব। পাখি না জ্যান্ত শয়তান। দেখতে যেমন জঘন্য, স্বভাবটাও তাই।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমি বাঁচব না, বুঝতে পারলাম। খুন চেপে গেল
মাথায়। খুন করব হারামজাদাকে, যেভাবেই হোক। দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে
ধরার প্ল্যান করলাম। লেগুন থেকে আঁশের মত একরকম গাছ আর লম্বা ঘাস তুলে কখনও পানিতে
দাঁড়িয়ে কখনও গাছের ডগায় বসে বানিয়ে ফেললাম বিরাট এক দড়ি। একদিনে হয়নি। দিনের
পর দিন লেগেছে। এরপর বড় এক প্রবালের টুকরা দড়ির আগায় বেঁধে পানিতে দাঁড়িয়ে বন
বন করে দড়িটা ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিলাম ওর দুইপা সই করে। আটকে গেল পা। ছুটার জন্যে অস্থিরভাবে
লাফাতে লাগল। যত লাফায় ততই জড়ায়। শেষে যখন ঝপাৎ করে পড়ে গেল, তখন উঠে এলাম পানি থেকে। একটুও ইতস্তত না করে ছুরি দিয়ে পচ পচ করে কেটে
ফেললাম ওর গলা।
এখন ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। অনুশোচনা হয়। মনে হয় মানুষ খুন করেছি। আসলে
তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। বালুর ওপর রক্তের নদী বইছে। সেই রক্তে ওর সুন্দর দুই পা
আর বাহারি গলা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। ওই মুহূর্তে ওই দৃশ্যেও আমার মনে বিন্দুমাত্র কষ্ট
লাগেনি। খানিকক্ষণ বাদেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল মাথা। বুঝলাম কতবড় ভুল করেছি। বুক ফেটে কান্না
এল। ডিম থেকে যাকে বার করে বড় করলাম, দিনের পর দিন যে সঙ্গ দিয়ে
আমার নিঃসঙ্গতাকে ভরিয়ে রেখেছিল, তাকে নিজ হাতে খুন করলাম।
প্রবাল পাহাড় খোড়ার সরঞ্জাম থাকলে মানুষের মতই কবর দিতাম তাকে। সে বেঈমানী করলেও
আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। পুত্রস্নেহে পালন করেছিলাম। ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠল নিঃসঙ্গতা।
খেয়ে না খেয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম দ্বীপময়। এভাবেই কেটে গেল বহুদিন। তারপর একদিন
এক পালতোলা জাহাজ এল অ্যাটলে। স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এলাম ওর হাড়গোড়।
এই কাহিনি শুনে উইন্সলো নামে এক লোক জোর করেই কিনে নিল সেই হাড়। বেশি দামে
সে বেচে দিল হ্যাভার্সকে। হ্যাভার্স মারা যাবার পর ঈপাইওরনিস নিয়ে নতুন করে হৈ চৈ
শুরু হলো। হ্যাভার্সের বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল শুধু উরুর হাড়টা।
-এই পাখির পুরো নাম কি আপনি জানেন? জিজ্ঞেস করল বুচার।
-ঈপাইওরনিস ভ্যাসটাস,বললাম আমি। আপনার ওই পাখির হাড়টা ছিল
এ পর্যন্ত পাওয়া হাড়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাই ওটার নাম দেয়া হয়েছিল ঈপাইওরনিস
টাইটান। আপনারটার পরেও আরও হাড় পাওয়া গেছে ঈপাইওরনিস ভ্যাসটিসিমাসের।
মুখের কাটা দাগটায় হাত বুলিয়ে করুণ সুরে বুচার বলল, এখন বলুন মিস্টার, আমার সঙ্গে অমন জঘন্য ব্যবহার
করা কি উচিত হয়েছিল ঈপাইওনিস ভ্যাসটাসের?
মূলঃ এইচ.জি. ওয়েলস
অনুবাদঃ নাখশাব আফরিন
No comments:
Post a Comment