মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Tuesday, September 8, 2020

ছোট গল্প – স্টেঞ্চ অফ কেরোসিন – অমৃতা প্রিতম – বাংলা অনুবাদ - Short Story - Stench of Kerosene - Amrita Pritam – Bengali Translation

 

ছোট গল্প  স্টেঞ্চ অফ কেরোসিন  অমৃতা প্রিতম  বাংলা অনুবাদ - Short Story - Stench of Kerosene Amrita Pritam – Bengali Translation

ছোট গল্প স্টেঞ্চ অফ কেরোসিন অমৃতা প্রিতম বাংলা অনুবাদ - Short Story - Stench of Kerosene - Amrita Pritam – Bengali Translation

গুলেরির বাবা-মা বাস করে চাষায় স্বামীর বাড়ি থেকে মাইল কয়েক দূরে, রাস্তাটা এঁকেবেঁকে খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে গেছে পাহাড় থেকে পরিষ্কার দেখা যায় চাম্বা গুলেরির বাড়ির জন্য মন কেমন করলেই স্বামী মানাককে নিয়ে সে পাহাড়চুড়োয় গিয়ে দাঁড়ায় চাম্বার বাড়িঘরের ছাদে সূর্যরশ্মি পড়ে ঝকঝক করে জ্বলতে থাকে, মন ভরে দেখে গুলেরি বুক ভরা খুশি আর গর্ব নিয়ে ফিরে আসে স্বামীর ঘরে 

প্রতি বছর ফসল তোলার সময় গুলেরি তার বাপের বাড়ি যায় বাবা মা লাকারমান্ডিতে লোক পাঠিয়ে দেয় মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য গুলেরির আরও দুই বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে চাম্বার বাইরে বছরের এ সময়ে তারাও বেড়াতে আসে বিশেষ এই দিনটির জন্য সারাটা বছর তারা চাতক পাখির তৃষ্ণা নিয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গোণে তিন বান্ধবী মিলে মেতে ওঠে জম্পেশ আড্ডায়, নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্পে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘন্টা দল বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়ে তারপর প্রধান আকর্ষণ শস্য তোলার উৎসব তো আছেই এ অনুষ্ঠানের জন্য মেয়েরা নতুন জামা বানায় দোপাট্টায় রঙ করে, মাড় দেয়, অভ্র লাগায় কেনে কাঁচের চুড়ি আর রূপোর কানের দুল 

উৎসব কবে আসবে সে জন্য সবসময় দিন গুনতে থাকে গুলেরি। যখন শরতের বাতাস আকাশের বুক থেকে সরিয়ে দেয় বর্ষার, কালো মেঘ, চাম্বার কথা মনে পড়তে থাকে ওলেরির। দৈনন্দিন কাজগুলো নিয়মিত করে যায় সে-গরু-বাছুর খাওয়ানো, শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য রান্না, তারপর হিসেব করতে বসে আর কদিন পরে বাপের বাড়ি থেকে লোক আসবে তাকে নিয়ে যেতে।

আবার বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে। ঘোটকীটাকে আদর করে গুলেরি, বাপের বাড়ির চাকর নাটুকে উস্ফুল্ল মুখে স্বাগত জানায়, পরদিন যাত্রা করার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

গুলেরির চেহারা খুশিতে জ্বলজ্বল করছে।

ওর স্বামী, মানাক হুকাটা হাতে নিয়ে চোখ বুজে টানতে লাগল। তার মুখ গম্ভীর। কেন, বোঝা যাচ্ছে না।

চাম্বার মেলায় তুমি যাবে না?' জানতে চাইল গুলেরি। মিনতি ফুটল কণ্ঠে, অন্তত একটা দিনের জন্যে হলেও এসো। মানাক হুঁকার কলকি নামিয়ে রাখল, কিছু বলল না।।

আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? ঝাঝিয়ে উঠল গুলেরি। তোমাকে একটা কথা বলি?

তুমি কী বলবে তা জানাই আছে। বাপের বাড়ি যাবে। সে প্রতিবছরই তো যাচ্ছ।'

তা হলে এবার যেতে মানা করছ কেন? ক্রুদ্ধ কণ্ঠ গুলেরির।

শুধু এবারে যেয়ো না।'

তোমার মা তো কিছু বললেন না। তুমি বাধা দিচ্ছ কেন? ভুরু কোঁচকাল গুলেরি।।

আমার মা...' কথাটা শেষ করল না মানাক, চুপ করে রইল।

পরদিন সকালের আলো ফোটার আগেই সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেল গুলেরি। তার সন্তান নেই। ফলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে বাচ্চাকাচ্চা রেখে যাওয়ার ঝামেলা থেকে সে মুক্ত। নাটু ঘোটকীর পিঠে জিন চাপাল। গুলেরি মানকের বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিল। তারা পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

তোমাকে কিছুটা রাস্তা এগিয়ে দিতে যাব আমি,' বলল মানাক। উৎফুল্ল মনে বেরিয়ে পড়ল গুলেরি। দোপাট্টার আড়ালে মানকের বাশি নিতে ভোলেনি। খাজ্জার গ্রামের পর, রাস্তা ঢাল বেয়ে নেমে গেছে চাম্বার দিকে। এখানে এসে দোপাট্টার নীচে থেকে বাঁশি বের করে মানাককে দিল গুলেরি। মানকের হাত ধরে বলল, এবার তোমার বাঁশি বাজাও!'

কিন্তু মানাক গভীর চিন্তায় মগ্ন, গুলেরির কথা কানে যায়নি।

তুমি বাঁশি বাজাচ্ছ না কেন?' বিরক্ত হলো গুলেরি। মানাক ম্লান চোখে একবার তাকাল স্ত্রীর দিকে, তারপর ঠোটে তুলল বাঁশি। করুণ একটা সুর তুলল।

গুলেরি, যেয়ো না,' অনুনয় করল মানাক। আবারও বলছি এবার যেয়ো না।' বাঁশিটি স্ত্রীকে ফেরত দিল সে, বাজাতে পারছে না

কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করল গুলেরি। তুমি তো মেলার দিন আসছই। তখন এক সঙ্গে বাড়ি ফিরব আমরা। কসম, আরেকটা দিন থাকার জন্য বায়না ধরব না।'

মানাক আর অনুরোধ করল না।

রাস্তার পাশে থামল ওরা। নাটু ঘোটকীটিকে নিয়ে কয়েক কদম সামনে বাড়ল দম্পতিটিকে একা কথা বলার সুযোগ দিয়ে। মানকের মনে পড়ে গেল সাত বছর আগে, এই রাস্তা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চাম্বায় যাচ্ছিল সে উৎসব দেখতে। মেলায় সাক্ষাৎ হয় গুলেরির সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই প্রেমের মত ব্যাপারটি ঘটে যায় তাদের মধ্যে। তাকে বলেছিল, তুমি যেন অপক্ব শস্য-দুধে ভর্তি।

মোষের দল অপক্ক শস্য খেতেই ভালবাসে, বলেছিল গুলেরি। বড়লোকেরা খায় সিদ্ধ করে। আমাকে পেতে চাইলে আমার বাবার কাছে যাও। গিয়ে বলল আমার হাত ধরতে চাও।'

মানাকদের গোত্রে বিয়ের আগে কন্যাপক্ষকে যৌতুক দিতে হয়। মানাক চিন্তিত ছিল গুলেরির বাবা তার মেয়ের জন্য কত টাকা দাবি করে বসেন ভেবে। গুলেরির বাবা সম্পন্ন গৃহস্থ, শহরে থেকেছেন অনেকদিন, যৌতুক প্রথায় বিশ্বাসী নন। মেয়েকে একটি ভাল পরিবারের সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই তার চাইবার কিছু ছিল না। আর মানকের মাঝে সে সব গুণ ছিল। ফলে গুলেরির গলায় মালা পরাতে বেশি সময় লাগেনি। সেই সব দিনের কথা ভাবছিল মানাক, কাধে গুলেরির হাতের স্পর্শ পেয়ে চমক ভাঙল। এতক্ষণ কোন্ স্বপ্নের মধ্যে ডুবে ছিলে? ঠাট্টা করল গুলেরি। জবাব দিল না মানাক! ঘোটকী চিহিহি করে উঠল অধৈর্য ভঙ্গিতে। গুলেরি বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। নীলঘণ্টার মঙ্গলের কথা শুনেছ, না?' জিজ্ঞেস করল সে। এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে। ওখানে যে যায় সে নাকি আর কানে শুনতে পায় না

শুনেছি।

তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সেই জঙ্গল থেকে ঘুরে এসেছ; আমি যা বলছি কোনকিছুই তোমার কানে যাচ্ছে না।'

ঠিকই বলেছ, গুলেরি। তুমি কী বলছ কিছুই শুনতে পাইনি আমি, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মানাক।  

ওরা একে অন্যের দিকে তাকাল। কেউ জানে না অপরজন কী ভাবছে। আমি এখন যাব। তুমি বাড়ি যাও। অনেকখানি রাস্তা এসেছ। মৃদু গলায় বলল গুলেরি। এতটা রাস্তা পায়ে হেঁটে এলে। বাকিটুকু ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাও।' বলল মানাক।

এই নাও তোমার বাঁশি।  

তুমি এটা নিয়ে যাও।

মেলার দিন এসে বাজাবে তো? হাসিমুখে জানতে চাইল গুলেরি। সূর্যরশ্মি ঝিকমিক করছে ওর কালো চোখের তারায়। মানাক অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অবাক হলো গুলেরি, কাঁধ ঝাকাল। তারপর চাম্বার খাস্তা ধরল। মানাক ফিরে এল নিজের বাড়ি। ঘরে ঢুকে ধপ করে বসে পড়ল চারপাইতে। এতক্ষণ পরে এলি, খেঁকিয়ে উঠলেন মা, চাম্বা পর্যন্ত গিয়েছিলি নাকি?

না। শুধু পাহাড় পর্যন্ত। ভারী গলা মানকের।

বুড়িদের মত অমন গোমড়ামুখো হয়ে আছিস কেন? ধমক দিলেন মহিলা। হাসিখুশি থাকতে পারিস না?

মানাক বলতে চাইল হাসিখুশি থাকার মত অবস্থা তো তুমি তৈরি করোনি, তা হলে থাকতাম। কিন্তু কিছু বলল না সে। নিচুপ হয়ে রইল।

মানাক আর গুলেরির বিয়ে হয়েছে সাত বছর। এখনও মা হতে পারেনি গুলেরি। মানকের মা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এরকম অবস্থা তিনি চলতে দেবেন না। ঘরে নাতি দেখতে চান তিনি। দেখবেনই।

কিছু দিনের মধ্যে আট বছরে পড়বে মানকের দাম্পত্য জীবন। মানকের মা ছেলেকে পাঁচশো রূপী দিয়েছেন আরেকটি বিয়ে করার জন্য। তিনি আর অপেক্ষা করতে রাজি নন। অপেক্ষা করছিলেন কখন গুলেরি তার বাপের বাড়ি যাবে আর তিনিও নতুন পুত্র বধূ ঘরে নিয়ে আসবেন। মা ও সামাজিক প্রথার একান্ত অনুগত মানকের শরীর সাড়া দিল নতুন নারীটির জন্য, তবে মন নয়।

এক সকালে মানাক দাওয়ায় বসেছিল, দেখল তার পুরানো এক বন্ধু যাচ্ছে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে।

ওহে, ভবানী,' হাঁক ছাড়ল সে। এত সকাল সকাল চললে কোথায়?

দাঁড়াল ভবানী। কাঁধে ছোট একটি পুঁটুলি।

তেমন কোথাও না নিরুত্তাপ কণ্ঠ তার।

তা হলে আর তাড়া কীসের? এক ছিলিম তামাক খেয়ে যাও, আমন্ত্রণ জানাল মানাক। ভবানী দাওয়ায় এসে হাঁটু গেড়ে বসল, হুঁকাটা নিল মানকের হাত থেকে। কিছুক্ষণ হুঁকা ঠুকে শেষে বলল, আমি চাম্বার মেলায় যাচ্ছি।'

ছোরার খোচা খেল যেন মানাক হৃৎপিণ্ডে।

আজ মেলা নাকি?  

প্রতি বছর এ সময়ই মেলা হয়, শুকনো গলায় জবাব দিল ভবানী। মনে নেই সাত বছর আগে আমরা একসঙ্গে মেলায় গিয়েছিলাম?' ভবানী আর কিছু বলল না তবে মানাক ওর নিরুত্তাপ আচরণের কারণ ঠিকই বুঝতে পারছে। অস্বস্তি লাগছে। ভবানী পুঁটুলি কাঁধে তুলে নিল। পুঁটুলির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে একটি বাঁশি মানাককে বিদায় জানিয়ে সে নিজের রাস্তা ধরল। ওকে যতক্ষণ দেখা গেল, বাঁশির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল মানাক।

পরদিন বিকেলে মাঠে কাজ করছে মানাক, ভবানীকে দেখতে পেল। আসছে এদিকেই। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল মানাক। ভবানীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। তবে ভবানী সোজা ওর সামনে চলে এল, বসল। চেহারা ম্লান।

গুলেরি মারা গেছে, বিষন্ন গলায় বলল ভবানী।

কী?

তোমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে মেয়েটা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করেছে।  

মানকের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল, বিস্ফারিত চোখে শুধু তাকিয়ে রইল ভবানীর দিকে। মুখে রা ফুটল না। বুকের ভিতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

দিন যায়। মানাক মাঠে কাজ করে ফিরে আসে বাড়িতে। চুপচাপ খেয়ে উঠে যায়। একটি কথাও বলে না। মরা মানুষের মত হয়ে গেছে সে। চেহারা অভিব্যক্তিশূন্য, চোখে ফাকা দৃষ্টি।  

আমি যেন ওর বউ নই, অনুযোগ করে মানকের দ্বিতীয় স্ত্রী। যেন জোর করে ওর কাছে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে। তবে কিছুদিনের মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়ল সে, মানকের মার খুশি আর ধরে না। নতুন পুত্রবধূর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট তিনি। ছেলেকে জানালেন ঘরে নতুন অতিথি আসছে, কিন্তু মানকের চেহারা ভাবলেশহীন হয়ে রইল, চোখের ফাকা চাউনিরও কোনও পরিবর্তন ঘটল না। শাশুড়ি পুত্রবধূকে সাহস যোগালেন। বললেন সন্তান জন্ম নেওয়ার পরে বাচ্চাকে বাপের কোলে বসিয়ে দিলেই মানকের মন-মেজাজের পরিবর্তন হবে।

যথাসময়ে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিল মানকের স্ত্রী। মানকের মা অত্যন্ত খুশি মনে নাতিকে স্নান করালেন, সুন্দর জামা কাপড় পরিয়ে বসিয়ে দিলেন ছেলের কোলে। স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকল মানাক পাথর মুখ নিয়ে। হঠাৎ তার শূন্য চোখে ফুটল আতঙ্ক, চিৎকার করতে লাগল সে মৃগী রোগীর মত, ওকে নিয়ে যাও! ওর গা থেকে কেরোসিনের গন্ধ আসছে!

মূল: অমৃতা প্রীতম

অনুবাদঃ অনীশ দাস অপু

 

No comments:

Post a Comment

Popular Posts