বড় গল্প - আয়ারল্যাণ্ডে সাপ নেই – ফ্রেডারিখ ফরসাইথ – বাংলা অনুবাদ - There are no snakes in Ireland – Frederick Forsyth – Translation in Bengali |
বড় গল্প - আয়ারল্যাণ্ডে সাপ নেই – ফ্রেডারিখ
ফরসাইথ – বাংলা অনুবাদ - There are no
snakes in Ireland – Frederick Forsyth –
Translation in Bengali
ঘড়িতে তখন সকাল ছ'টা বেজে
বিশ মিনিট। আয়ারল্যাণ্ডের ব্যাঙ্গর শহরের স্টেশন চত্বরে দাড়িয়ে আছে হরেকৃষ্ণ রামলাল।
খানিকক্ষণ আগে একটি লক্কর-ঝক্কড় মার্কা ট্রাক এসে থেমেছে। সেখানে,
তার চারদিকে এসে জড়ো হয়েছে ডজন খানেক শ্রমিক। সম্ভবত ওই লোকগুলোই তার
সহকর্মী। রামলাল নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই দলের ফোরম্যানের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
রামলাল ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের অধিবাসী।
এখানকার বেলফাস্ট শহরের রয়েল ভিক্টোরিয়া মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র সে। শুধুমাত্র
স্কলারশিপের টাকায় থাকা-খাওয়া, পড়াশোনা,
জামা-কাপড় এতসব খরচ চালানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল
না। তাই এই গ্রীষ্মের ছুটিতে সে ম্যাক কুইনের কর্মীবাহিনীতে শ্রমিকের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে।
বেলফাস্ট থেকে বেশ দূরে, ব্যাঙ্গর শহরের এক ঘিঞ্জি গলিতে ট্যাক্স
ফাকি দিয়ে অনেকটা লুকিয়েই ডেমোলিশন কন্ট্রাক্ট-এর ব্যবসা চালাচ্ছেন
ম্যাক কুইন। অ্যাসেট বলতে আছে সেই লক্কড়-ঝক্কড় ট্রাক,
মান্ধাতার আমলের ভারি কিছু শাবল আর জে হ্যামার। এসবের সাহায্যে তার কর্মী
বাহিনী পিটিয়ে পিটিয়ে পুরানো বিন্ডিং ভেঙে ফেলার কাজ করে। রামলাল জানে, কাজটি খুব শ্রমসাধ্য, কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল না।
অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছে সে।
কোথাও চাকরি পায়নি। কেউ মুখ ফুটে না
বললেও রামলাল জানে যে তার চামড়ার রঙের কারণেই তাকে চাকরি দেয়া হয়নি। ঠিক একই কারণে
ব্যাঙ্গর শহরে থাকার জায়গা পেতেও তাকে যথেষ্ট ঘুরতে হয়েছে। জুলাইয়ের কড়া রোদে অনেক
খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে রেইল স্টেশনের কাছেই একটি মেসে ঘর পেয়েছে সে। গতকাল সকালের
মধ্যে বেলফাস্ট থেকে সব জিনিসপত্র এনে সব গোছগাছ করা হয়ে গেছে। ডাক্তারী পাস করে ইন্টার্নী
শেষে দেশে ফিরে সাধারণ লোকদের সেবা করবে-এমনটিই রামলালের স্বপ্ন। যত কষ্টই
হোক না কেন এ স্বপ্নকে সে বাস্তবে পরিণত করবেই।
রোজ সকালে দলের ফোরম্যান বিগ বিলি ক্যামেরন
স্টেশন চত্বরের এই স্থানটি থেকে সবাইকে নিয়ে কর্মস্থলে চলে যায়। মিনিট দশেক পর বিগ
বিলি নিজের গাড়ি চালিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। বিগ বিলি লম্বায় প্রায় ছ'ফিট
তিন ইঞ্চি। তার চওড়া কাঁধের দু'পাশে ঝুলে আছে থামের মত বিশাল
বলিষ্ঠ দুটো হাত। রামলাল তার দিকে এগিয়ে গেল।
বিগ বিলি তার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সাথে
প্রশ্ন করল, তুমিই সেই কালু, যাকে ম্যাক কুইন চাকরি
দিয়েছে? রামলাল মাঝপথে থমকে দাঁড়াল। ভেতরে প্রচণ্ড এক ধাক্কা
খেয়েছে সে। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, হ্যা।
আমার নাম রামলাল।
গালের মাংসের চাপে প্রায় বন্ধ হয়ে আসা
চোখ দুটোতে ঘৃণার ভাব ফুটে উঠল বিগ বিলির। মাটিতে থক করে এক দলা থুথু ফেলে বলল, যাই
হোক, ট্রাকে উঠে পড়ো।
শ্রমিকরা সবাই ট্রাকের পিছনে গিয়ে বসল।
ট্রাক ছেড়ে দিল। পথে টমি বার্নস নামে একজন শ্রমিকের সাথে পরিচয় হলো রামলালের। লোকটি
একদম সহজ-সরল। রামলাল হিন্দু শুনে সে আকাশ থেকে পড়ল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
দেখো, দেখো, এই লোক খিস্টান
নয়।
রামলাল হেসে দিল। এই সময় সামনের সীট
থেকে বিগ বিলি ঘাড় ঘুরিয়ে তিক্ত স্বরে বলে উঠল, হ্যা, হ্যা, বুঝেছি। ব্যাটা মূর্তিপূজারি।
রামলালের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। ট্রাক
ছুটে চলল দক্ষিণ দিকে। একসময় তা পাকা রাস্তা ছেড়ে এবড়োখেবেড়ো মেঠো পথ পেরিয়ে এসে
থামল নদীর তীরে পরিত্যক্ত ভগ্নপ্রায় এক ভবনের সামনে। দুর্ঘটনার ভয়ে কাউন্টি কাউন্সিল
ভবনের মালিককে ভবনটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। ভবনের মালিক কম খরচে কাজ চালানোর
জন্যে ম্যাক কুইনকে এ কাজের কন্ট্রাক্ট দিয়েছে।
বিগ বিলির নির্দেশে সবাই ভারি যন্ত্রগুলো
নিয়ে কাজে লেগে গেল। প্রায় চারতলা উঁচু ভবনটি দেখেই রামলাল ঢোক গিলল। বেশি ওপরে কাজ
করতে সে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু উপায় নেই; তার অর্থের খুবই প্রয়োজন।
পরবর্তী এক সপ্তাহে ভবনের কাঠামো ছাড়া
প্রায় পুরোটাই ভাঙা হয়ে গেল। এই এক সপ্তাহে বিগ বিলি রামলালকে যতভাবে সম্ভব অপমান
করেছে। তাকে দিয়ে সবচেয়ে উঁচু জায়গার কঠিন কাজগুলো করিয়েছে। শুধুমাত্র টাকার কথা
চিন্তা করে রামলাল এতদিন মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করেছে। কিন্তু আর পারা গেল না।
ঘটনার দিন বিগ বিলি রামলালকে ভবনের সবচেয়ে
ওপরের একটি দেয়াল ভাঙার নির্দেশ দিল। কিন্তু সেখানকার মেঝেতে একটি বড় ফাটল লক্ষ্য
করে রামলাল তাকে বলল যে সেখানে একা দাঁড়িয়ে কাজ করা মোটও নিরাপদ হবে না।
শুনেই খ্যাক করে উঠল বিগ বিলি, আমাকে
কাজ বোঝাতে এসো না। তোমাকে যা বলব তাই করবে, ইউ স্টুপিড নিগার!
রামলালের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ঝট করে
উঠে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বলল, একটি কথা তোমায় স্পষ্ট বলে দিচ্ছি,
ক্যামেরন। আমি একজন ক্ষত্রিয়, যোদ্ধা গোত্রের
সদস্য। আমি গরিব হতে পারি, তবে এ কথা জেনে রেখো যে দু’হাজার বছর আগে
যখন তোমরা শরীরে পশুর চামড়া জড়িয়ে হামাগুড়ি দিতে তখন আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন
একেকজন বড় বড় যোদ্ধা, শাসক আর জ্ঞানী ব্যক্তি। দয়া করে আমাকে আর অপমান
করতে এসো না।
বিগ বিলির চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠল।
নীচু স্বরে বলল, তাই নাকি? এখনও আছে নাকি সেইসব দিন?
ইউ ব্ল্যাক বাস্টার্ড! কী করবি তুই, কী করবি?... বলেই সে প্রচণ্ড এক চড় কষিয়ে দিল রামলালের
ডান গালে। ছিটকে গিয়ে কয়েক হাত দূরে মাটিতে পড়ে গেল রামলাল।
টমি বার্নস তার কাছে দৌড়ে এসে বলল, কিছু
করতে যেয়ো না বাছা, তা হলে বিগ বিলি তোমাকে মেরেই ফেলবে। রামলাল
মাটিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখ চেপে অশ্রু সংবরণ করল সে। কল্পনায়
দেখল তার যোদ্ধা পূর্বপুরুষরা তার সামনে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে আর সকলে একটি শব্দই
উচ্চারণ করছে—প্রতিশোধ। দিনের বাকি সময়টুকু নিঃশব্দে
কাজ করল সে। যা হবার হয়েছে, কিন্তু এর প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে।
রাতে বাইরে প্রকৃতি ক্রমে অশান্ত
হয়ে উঠল; ব্যাঙ্গর শহরে ঝড় বয়ে গেল। এক ঘন্টা পর
প্রার্থনা শেষ করে উঠে ঘরের বাতি জ্বেলে দিল সে। রামলাল এ সময় লক্ষ করল যে বৃষ্টির
পানি জানালা দিয়ে ঢুকে মেঝেতে একটি চিকন নালা সৃষ্টি করে এঁকেবেঁকে ঘরের এক কোণে চলে
গেল। সেখানে দেয়ালে ঝোলানো একটি ড্রেসিং গাউনের ফিতা খুলে মেঝেতে সাপের মত পেঁচিয়ে
আছে। রামলাল তার ইঙ্গিত বুঝে নিল।
পরদিন রোববার সকালে বেলফাস্টগামী ট্রেনে
চেপে সে সোজা গিয়ে উঠল তার ক্লাসমেট রঞ্জিত সিং-এর রূমে। রঞ্জিৎ উচ্চবিত্ত
পরিবারের সন্তান। পিতার অসুখের কথা বলে রামলাল তার কাছ থেকে প্লেনের ভাড়ার টাকা ধার
নিল। সন্ধ্যায় একই কারণ দেখিয়ে সে ম্যাক কুইনের কাছ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে
নিল। সেই রাতটা হোস্টেলে নিজের রূমের মেঝেতে পার করে পরদিন সকালে রওনা হয়ে এক দিনের
মধ্যেই ভারত পৌছে গেল সে। বুধবার বিকেলে সরীসৃপ বিষয়ের একজন ইংরেজ প্রকৃতিবিদের লেখা
একটি টেক্সট বই সাথে নিয়ে রামলাল এ্যাণ্ড রোড ব্রিজের পাশের বাজারে গুজরাটি ব্যবসায়ী
মি. চ্যাটার্জির দোকানে উপস্থিত হলো। মি. চ্যাটার্জির ট্রপিক্যাল ফিশ অ্যাণ্ড রেপটাইল এমপোরিয়াম অনেক দিন থেকেই দেশের
বিভিন্ন মেডিক্যাল সেন্টারে গবেষণা আর ডিসেকশনের জন্যে নমুনা সরবরাহ করে আসছে। দেশের
বাইরে থেকেও মাঝে মাঝে বড় বড় অর্ডার আসে এখানে।
রামলাল খুঁজছিল একটি বিশেষ ধরনের সাপ।
বইয়ে দেয়া তথ্য অনুসারে সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম:Echis carinatus. প্রায়
এক ফুট লম্বা এ সাপ যে কোনও আবহাওয়ায় চমৎকার খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ছিপছিপে সরু
এ সাপটি কোবরার চেয়েও বিপজ্জনক। কোনও প্রকার পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই অত্যন্ত ক্ষিপ্র
গতিতে এটি শিকারকে আঘাত করে। এর দাঁত খুব ছোট আর সরু হওয়ায় কামড়ের চিহ্ন খালি চোখে
প্রায় দেখাই যায় না। অধ্যায়ের শেষে লেখা আছে, ছোবল হানার সময়
এটি কোনও ব্যথার সৃষ্টি করে না, কিন্তু চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে
শিকারের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। বিষের প্রতিক্রিয়ায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় এবং সে
কারণেই মৃত্যু ঘটে থাকে। - মি, চ্যাটার্জিকে
সাপের বর্ণনা দিতেই তিনি তাকে একটি কাচের বাক্সের কাছে নিয়ে গেলেন। পুরো দোকানে ওই
প্রজাতির সাপ একটিই ছিল।
রামলাল প্রশ্ন করল, হাউ
মাচ ডু ইউ ওয়ান্ট ফর হিম?
মি. চ্যাটার্জি পাঁচশো রূপী
চাইলেন। দরদাম করে তিনশো পঞ্চাশে রামলাল সাপটি কিনে নিল।
এরপর রামলাল বাজার থেকে একটি সিগার বক্স
কিনে সেটি খালি করে ঢাকানায় কতগুলো ছিদ্র করে খুব সতর্কতার সাথে সাপটি বাক্সে ঢুকিয়ে
ঢাকনা বন্ধ করে দিল। এবার বাক্সটি একটি তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে সেটি সুটকেসে ভরে হোটেলে
ফিরে সবকিছু গোছগাছ করে আয়ারল্যান্ডের পথে রওনা দিল।
হিথরো বিমান বন্দরে সুটকেস নিয়ে বাথরুমে
ঢুকে বাক্সটি সে হ্যাণ্ডব্যাগে ভরে ফেলল। নাথিং টু ডিক্লিয়ার চ্যানেল দিয়ে পার হবার
সময় তার শুধুমাত্র সুটকেসটি খুলে দেখা হলো। শুক্রবার বিকেলের দিকে সে তার ব্যাঙ্গরের
বাড়ি পৌঁছে সাপটিকে একটি কৌটোয় ঢেলে মুখ বন্ধ করে দিল।
রামলালের পরিকল্পনাটি ছিল একেবারে ছিমছাম, নিরাপদ।
সে লক্ষ করেছে বিগ বিলি প্রতিদিন কাজে এসেই তার জ্যাকেটটি খুলে এক জায়গায় ঝুলিয়ে
রাখে। লাঞ্চ শেষে সে জ্যাকেটের ডান পকেট থেকে পাইপ আর দেশলাই বের করে, আর ধূমপান শেষে পাইপটি আবার সেই ডান পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। রামলালের প্ল্যান
হলো, কাজের ফাঁকে একসময় সবার অলক্ষে সে জ্যাকেটের ডান পকেটে
সাপটি রেখে দেবে। সাপটি যখন বিগ বিলির হাতে দাঁত বসিয়ে নিস্তেজ হয়ে ঝুলতে থাকবে তখন
রামলাল সেটিকে মাটিতে ফেলে পায়ের চাপে পিষ্ট করে পাশের নদীতে ফেলে দেবে। হত্যাকাণ্ডের
কোনও চিহ্নই আর থাকবে না।
পরদিন শনিবার সবকিছুই ঠিকঠাক মত এগোল।
কিন্তু লাঞ্চের পর বিগ বিলি যখন পকেট থেকে একে একে পাইপ, দেশলাই
আর তামাকের কৌটো বের করল তখন কিছুই ঘটল না। বিগ বিলি পাইপ জ্বালিয়ে দেশলাইটি আবার
পকেটে রেখে নিশ্চিন্ত মনে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে দূরে সরে গেল।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না রামলাল।
তার এত পরিশ্রম—সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেল? -জ্যাকেটটির
দিকে ভালমত তাকিয়ে রামলাল দেখল সেটির একদম নীচের অংশে কী যেন সামান্য নড়ে আবার থেমে
গেল। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, সাপটি পকেটের কোনও ছিদ্রপথে
বের হয়ে জ্যাকেটের লাইনিং-এ স্থান করে নিয়েছে।
পুরো ব্যাপারটি তার কাছে দুঃস্বপ্নের
মত মনে হলো।
সেদিন কাজ শেষে বিগ বিলি যথারীতি তার
জ্যাকেটটি সাথে নিয়ে গেল। এদিকে রামলালের মনে নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিল-সাপটি
যদি বিগ বিলির বাড়িতে তার নিরপরাধ স্ত্রী সন্তানদের কোনও ক্ষতি করে, তখন কী হবে?
টমি বার্নসকে প্রশ্ন করে রামলাল বিগ বিলির
ঠিকানা জেনে নিল। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার দিকে এবার সে অস্থির পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিগ
বিলির এলাকায় উপস্থিত হলো। কী করবে সে? কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারল না
রামলাল, বাড়ি ফিরে আবার পায়চারি শুরু করল। পরদিন রোববার,
ছুটির দিন; অর্থাৎ সমস্ত দিন সাপটি বিগ বিলির বাড়িতেই
থাকবে। রামলাল তো প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল বিগ বিলির ওপর, তার
নির্দোষ স্ত্রী সন্তানের ওপর নয়। রাতে রামলালের ঘুম হলো না।
পরদিন সকালে আবার চলে গেল সে বিগ বিলির
এলাকায়। একবার ভাবল সবকিছু খুলে বলবে বিগ বিলিকে। কিন্তু তারপর ওই দানবটি তার কী অবস্থা
করবে তা চিন্তা করে সাহস হারিয়ে ফেলল। প্রচণ্ড দ্বিধা-দ্বন্দ্বের
মধ্যে সব কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল রামলাল। পার হয়ে গেল আরও একটি
নিদ্রাহীন রাত। সোমবার, সকাল ছ’টা বেজে বিশ
মিনিট। বিগ বিলি ক্যামেরনের বাড়ির ডাইনিং স্পেস। পোশাক পরে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করছে
বিগ বিলি। তার জ্যাকেটটি শনিবার থেকে ক্লজেটেই পড়ে আছে। সে তার ছোট মেয়ে জেনিকে বলল
জ্যাকেটি সেখান থেকে বের করে দরজার হুকে ঝুলিয়ে রাখতে।
জেনি জ্যাকেটটি বের করতেই চিকন কালো কী
যেন একটা মাটিতে পড়ে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে ঘরের কোণায় গিয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে মাথা
উঁচু করে রইল।
মিসেস ক্যামেরন চিক্কার করে উঠলেন, সাপ!
বিগ বিলি সাথে সাথে তাকে এক ধমকে থামিয়ে
দিল, বোকার মত কথা বোলো না! আয়ারল্যান্ডে যে কোনও সাপ নেই,
সেটাও জানো না?
সে তার চোদ্দ বছরের ছেলে ববিকে প্রশ্ন
করল, এটি কী, ববি?
তার এই ছেলেটি স্কুলে গিয়ে কী সব যেন
লেখাপড়া করে। তাই তার জবানের প্রতি বিগ বিলির অগাধ আস্থা।
-বাবা, এটি কেঁচো জাতীয় কিছু
হতে পারে। আমরা বায়োলজি ক্লাসে এ ধরনের স্নো-ওয়ার্ম ডিসেকট করেছি।
-দেখে তো মনে হচ্ছে না
কেঁচো,
বিগ বিলি সন্দেহ প্রকাশ করল।
-না, এটি
ঠিক কেঁচো নয়। এটি আসলে পা-ছাড়া গিরগিটি।
-তা হলে এর নামের মধ্যে কেঁচো (ওয়ার্ম)
আছে কেন?
-জানি না, বাবা।
-তা হলে স্কুলে কী সব লেখাপড়া হয়, হ্যাঁ!
-কামড়াবে না তো? জানতে
চাইলেন মিসেস ক্যামেরন।
-না, না, একেবারে নিরীহ, ববি উত্তর দিল। বিগ বিলি বলল,
তা হলে মেরে ডাস্টবিনে ফেলে দাও।
ববি এক পায়ের স্যাণ্ডেল খুলে হাতে নিয়ে
এগিয়ে গেল সাপটির দিকে।
এ সময় হঠাৎ কী মনে করে বিগ বিলি তাকে
মাঝ পথে থামিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে ঢাকনা সহ একটি খালি জ্যামের কৌটো চেয়ে নিল।
ববি জানতে চাইল, কী
করবে, বাবা?
বিগ বিলি বলল, আমাদের
সাথে এক কাল্লু কাজ করে, সাপ খোপ ভরা এক দেশ থেকে এসেছে। ওর সাথে
একটু মজা করা যাবে।
বাঁ হাতে কৌটো ধরে বিগ বিলি তার ডান হাতটি
নামিয়ে আনল সাপটির দিকে। বিগ বিলির হাতের মুঠোয় আসার আগেই সাপটি তড়িৎ গতিতে ছোবল
হানল হাতের তালুতে। নিজের হাতের আড়ালের কারণে ব্যাপারটি কিছু জানতে পারল না বিগ বিলি।
সাপটিকে সে কৌটোয় বন্ধ করে সেটি ব্যাগে
ভরে কাজে রওনা দিল। স্টেশন চত্বরে পৌছে রামলালকে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করল বিগ বিলি। ওভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কী? সবকিছু
বুঝে ফেলেছে নাকি ছেলেটা?
যাইহোক, কাজে
যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিগ বিলি দলের কয়েকজনের কাছে কাল্পটাকে জব্দ করার ফন্দিটি
খুলে বলল, আর বারবার নিশ্চয়তা দিল যে কেঁচোটি কোনও ক্ষতি করবে
না। একজন দু’জন করে রামলাল বাদে অন্য সকলকেই ফন্দিটি
জানিয়ে দেয়া হলো। সকলেই ব্যাপারটিকে একটি মজা হিসেবে ধরে নিল।
লাঞ্চের সময় সবাই একসাথে বসল। রামলালের
মাথায় তখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা, সঙ্গীদের চাপা হাসি আর গুঞ্জন খেয়াল করার
মত মনের অবস্থা তার নেই। আনমনে সে তার লাঞ্চ বক্সটি হাতে নিয়ে ঢাকনা সরিয়ে খাবারের
দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, স্যাণ্ডউইচ আর আপেলের মাঝখানে
ওটা কী কিলবিল করছে? ব্যাপারটি মাথায় ঢুকতেই আকাশ কাঁপানো এক
চিৎকার দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তিতে বাক্সটি উপরে ছুঁড়ে মারল রামলাল। বাক্সের একেকটি
জিনিস একেকদিকে ছিটকে পড়ে বড়বড় ঘাসের মাঝে হারিয়ে গেল। কর্মীদের মধ্যে ততক্ষণে
হাসির ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে রামলাল তখন ভূতে পাওয়া মানুষের
মত চিৎকার করে বলছে, সরে যাও, সরে যাও সবাই!
সাপ! বিষাক্ত সাপ! এতে হাসির
মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে গেল। হাসতে হাসতে বিগ বিলির চোখে পানি এসে গেছে। গত কয়েক বছরের
মধ্যে সে এত হাসি হাসেনি। চোখের পানি মুছে সে রামলালের কাছে গিয়ে বলল, আরে হাঁদারাম, আয়ারল্যাণ্ডে কোনও সাপ নেই, বুঝতে পেরেছ?
-একটিও সাপ নেই।
অন্যরাও মাথা নেড়ে বিগ বিলিকে সমর্থন
করল। রামলাল বাধ্য হয়েই ঘাসগুলো থেকে একটু দূরে সরে বসল আর ভয়ে ভয়ে আশপাশে তাকাতে
থাকল।
লাঞ্চ শেষে সকলে আবার কাজ শুরু করল। দুপুরের
দিকে এক সময় বিগ বিলি কাজ থামিয়ে নীচে নেমে গাছের ছায়ায় বসে তীব্র যন্ত্রণায় দু’হাতে মাথা চেপে
ধরল। মিনিট কয়েক পরেই একটি খিচুনি দিয়ে নিথর হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল তার দেহ। বিগ
বিলির মৃত্যুর পর যথারীতি অটোপসি করা হলো প্যাথোলজিস্ট-এর রিপোর্ট
অনুসারে, মধ্য দুপুরের প্রচণ্ড তাপে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ
করার কারণেই মৃতের সেরেব্রাল হেমারেজ হয়েছিল এবং সেটাই তার মৃত্যুর একমাত্র কারণ।
এই রিপোর্টের পর সাধারণত তদন্তের কোনও
প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু রামলালের
জানা ছিল না যে বিগ বিলি ক্যামেরন ছিল ব্যাঙ্গর কাউন্সিল অভ আলস্টার ভল্যান্টিয়ার
ফোর্স-একটি চরমপন্থী প্যারামিলিটারি অর্গানাইজেশন-এর প্রথম
সারির একজন সদস্য। এই সংস্থার প্রচেষ্টায় একটি ফর্মার তদন্তের ব্যবস্থা করা হলো।
ব্যাঙ্গর টাউন হলে কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে
তদন্তের আয়োজন করা হলো। দলের কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে নতুন কিছুই জানা গেল না।
বরং বিগ বিলির ছেলেমানুষীর কথাই সকলে জেনে ফেলল। এই তদন্তে অবশ্য ম্যাক কুইনের ক্ষতি
হয়ে গেল-এর পর থেকে তিনি আর ট্যাক্স ডিডাকশন এড়াতে পারবেন না।
পরবর্তী শুক্রবার ব্যাঙ্গর সেমিট্যারিতে
বিগ বিলির শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। দলের সকলেই সেখানে উপস্থিত, রামলাল
বাদে। রামলাল তখন ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে আসল ভেঙে ফেলা ভবনটির নীচের বড় বড়
ঘাসে ছাওয়া জনহীন সেই স্থানটিতে। এখানেই কোনও এক স্থানে আশ্রয় নিয়েছে সেই বিষধর
সাপটি।
একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একসময় রামলাল
বলল, হে বিষসর্প, তোমাকে যে কাজের জন্যে এনেছিলাম তুমি তা
করেছ। সবকিছু ঠিকমত এগোলে এতক্ষণে তোমার মরে যাবার কথা ছিল, আমি
নিজেই তোমাকে মেরে ফেলতাম। বিষধর সাপ, তুমি কী শুনতে পাচ্ছ আমার
কথা? যদি পাও তবে শুনে রাখো যে তুমি হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচবে,
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই একদিন তোমাকে মরতে হবে; এবং মরতে হবে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কারণ সর্পহীন এই আয়ারল্যাণ্ডে মিলনের
জন্যে কোন স্ত্রী সাপ তুমি খুঁজে পাবে না যার মাধ্যমে তুমি বংশধর রেখে যাবে।
এদিকে সাপটি কিন্তু রামলালের কোনও কথাই
শুনছিল না, অথবা শুনে থাকলেও তা বোঝার কোনও রক্ষণ প্রকাশ করল না। কারণ
সে তখন খানিকটা দূরে তার গর্তের উষ্ণতায় প্রকৃতির এক বিশেষ আজ্ঞা পালনে ব্যস্ত।
সাপটির লেজের নীচের অংশে রয়েছে দুটো
পর্দা যা ঢেকে রেখেছে অবসারণীর ছিদ্র পথটিকে। ধীরে ধীরে সরে গেল পর্দা দুটো, আদিম
ছন্দে নেচে উঠল সর্পটির সমস্ত দেহ। সর্পমাতা তার অবসারণীর ছিদ্রপথে সর্পহীন আয়ারল্যাণ্ডের
সেই ছোট্ট গর্তে একে একে মুক্ত করে দিল স্বচ্ছ থলিতে মোড়া এক ইঞ্চি লম্বা প্রায় ডজন
খানেক বিষাক্ত সন্তান।
মূল: ফ্রেডারিক ফোরসাইথ
রূপান্তরঃ সামিউল আমীন
No comments:
Post a Comment