![]() |
জীবনের গল্প, অনুবাদ গল্প, translated story, short story, লিও টলস্টয়, Leo Tolstoy, God Sees the Truth, But Waits |
বাংলা অনুবাদ গল্প - গড সীজ দু ট্রুথ বাট ওয়েট - কাউন্ট লিও টলস্টয় - God Sees the Truth, But Waits - Leo Tolstoy – Bangla
সুখেই দিন কাটছিল আক্সিওনোভের
(Iván Dmítritch Aksyónof)। ভ্লাডিমির শহরে নিজস্ব বাড়ি, দুই রাস্তায় দু'খানা দোকান। রীতিমত সচ্ছল অবস্থা। নিজের এই পরিপূর্ণ যৌবন, অটুট স্বাস্থ্য, লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতই চেহারা।
প্রাচুর্যের পেয়ালা কানায় কানায় ভরাট। সত্যিই আক্সিওনোভ সুখী মানুষ।
বছর বছরই নিজনির (Nízhny) মেলায়
যায় আক্সিওনোভ, এবারেও
যাবে। ওখানে এক মাসে যা কেনাবেচা হয়, ঘরে বসে এক বছরেও তা হয়
না। শুধু আক্সিওনোভ বলে কী কথা, ও-তল্লাটের
সব ব্যবসায়ীর পক্ষেই নিজনি যাওয়া একটা অবশ্য করণীয় ব্যাপার।
যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে, সওদাপত্র বেঁধেছেঁদে গাড়িতে বোঝাই করেছে
ভৃত্যেরা, এমন সময়ে আক্সিওনোভের স্ত্রী ভ্যানিয়া বলে বসল-“আজ তুমি যেও না গো! একটা ভারি বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি আমি--”
আইভান আক্সিওনোভ হেসেই কুটিকুটি-“স্বপ্ন? স্বপ্নের আবার দাম আছে নাকি কিছু?
ও ত বিলকুল বাজে জিনিস! কবে ভাল স্বপ্ন দেখব,
সেইজন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ত আর ব্যবসায়ীকে করে খেতে হয় না!”
“কিন্তু স্বপ্নটা যে বড়ই বিশ্রী দেখলাম”—অবুঝ ভ্যানিয়া চোখের জল রাখতে পারে না।
“বিশ্রী? কী স্বপ্ন দেখলে? বলেই ফেল না দেখি!
হয়ত তার মানেই বুঝতে পার নি তুমি, এমনও ত হতে
পারে,” সাহস দেয় আক্সিওনোভ।
“দেখলাম যে তুমি নিজনি থেকে ফিরে আসছ, একমাথা সাদা চুল নিয়ে এবার ভ্যানিয়া ডুকরে কেঁদে উঠল।
“সাদা চুল? একে তুমি বলছ বিশ্রী স্বপ্ন? সাদা চুলের
মান কত বেশী কাঁচাচ চুলের চেয়ে তা কি আকছার দেখছ না ? ও-স্বপ্নের মানে হল এই যে মেলা থেকে এত বেশী মুনাফা করে ফিরে আসব আমি যে দেশে
আমার মান-ইজ্জত অনেক বেড়ে যাবে। দেখো তুমি! এখন চোখের জল মোছো। যাবার বেলায় হাসিমুখে বিদায় দিতে হয়---”
আক্সিওনোভের দেওয়া ব্যাখ্যা
যে ভ্যানিয়াকে খুব বেশী আশ্বস্ত করেছিল, তা নয়। তবে স্বামী যখন যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন যাওয়ার সময় কান্নাকাটি করে তার মন খারাপ করে দেওয়া ঠিক হবে না,
এটা সে বুঝল। হাসিমুখে নয়, তবে শুকনো চোখেই সে
বিদায় দিল। শিশুপুত্র দুটিকে এনে দাঁড় করাল আক্সিওনোভের সামনে, ওরা অন্ততঃ হাসতে পারবে বাপকে দেখে। ওরা ত ভাবছে বাবা যাচ্ছে দোকানে,
রোজ যেমন যায়। বিকাল বেলায় ফিরে আসবে নতুন কিছু খেলনা হাতে করে।।
অর্ধেক পথ বেশ আনন্দেই অতিবাহিত
করল আইভান আক্সিওনোভ। সন্ধ্যাবেলায় উঠল গিয়ে এক সরাইখানায়, রাত্রিটা সেখানেই কাটাবে। আরও একজন বণিক
এসে আশ্রয় নিয়েছে ওখানে, সেও নিজনিতেই যাবে। তার বাড়ি রিয়াজান
শহরে, ভ্লাডিমির থেকে কাছেই জায়গাটা।
মিশুকে লোক আক্সিওনোভ। রিয়াজানের
দোকানীর সাথে যথেষ্ট ভাব জমিয়ে ফেলল দেখতে দেখতে। খাওয়ার সময় দু’জন একসাথেই খেতে বসল। খাওয়া-দাওয়া গালগল্পে কেটে গেল প্রায় দেড়
প্রহর রাত। তারপর পরস্পরে বিদায় নিয়ে পাশাপাশি দু'খানা কামরায়
তারা শুতে গেল দু’জনে।
আক্সিওনোভের চিরদিনের অভ্যাস-খুব ভোরেই তার ঘুম ভেঙে যায়। আজও তাই
গেল। সে আর কালবিলম্ব করার দরকার বুঝল না, ভৃত্যকে ডেকে তুলল,
গাড়ি জুড়তে বলল, এক্ষুণি রওনা হবে। মেলা বলে
কথা, যে দোকানী আগে পৌঁছোবে, সে জায়গা
পাবে ভাল।
সরাইওয়ালা সরাইয়েরই পিছনদিকে
থাকে, তার ঘরে গিয়ে
ডেকে তুলে আক্সিওনোভ পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দিল তার, তারপর রওনা
হয়ে পড়ল নিজের পথে। ভোর-ভোর সময় পথ চলা খুব আরামের। মনটা ভারি
ভাল লাগছে ওর।।
মাইল পঁচিশের মাথায় একটা ছোট্ট
সরাই। কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ঘোড়া দুটোকেও খাওয়ানো চাই। সরাইতে নেমে বাইরের বারান্দাতেই
একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল আক্সিওনোভ, ভৃত্য ঘোড়া দুটোকে নিয়ে চলে গেল আস্তাবলে।
খাবার এল বারান্দায়। খেয়েদেয়ে
বসে আছে আক্সিওনোভ কফির প্রতীক্ষায়, একখানা তিন ঘোড়ার গাড়ি দ্রুতবেগে এসে সরাইয়ের দরজায় থামল।
গাড়ি থেকে নামলেন এক পুলিস কর্মচারী, দু’জন সিপাহী বসেই রইল গাড়িতে।
অফিসারটি সরাইওয়ালার সঙ্গে নীচুগলায়
দুই-একটা কথা বলেই
উঠে চলে এলেন বারান্দায়, যেখানে আক্সিওনোভ কফির পেয়ালার অপেক্ষায়
আরামে বসে আছে। ভদ্রলোক কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন দেখে ভদ্রতা হিসাবেই আক্সিওনোভ তাঁকে
কফি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করল, উনি কিন্তু সে কথা কানে না তুলে প্রশ্নের
পর প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন আক্সিওনোভকে---“কী নাম? কোথায়
ধাম? কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কেন?” ইত্যাদি। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর যথাযথই দিয়ে
গেল আক্সিওনোভ, কিন্তু তার ধৈর্যচ্যুতি হল অফিসারের দ্বিতীয়
কিস্তি প্রশ্নাবলীতে—“আপনি কাল রাত্রে কোথায় ছিলেন? কখন বেরিয়েছেন সেখান থেকে? কেন অত ভোরে
বেরিয়েছেন? অত ভোরে আর কোন শান্তিপ্রিয় নাগরিককে শয্যাত্যাগ
করতে দেখেছেন কখনো?” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আক্সিওনোভ রীতিমত রেগে উঠল—“আপনি কেন এত জেরা করছেন মশাই? আমি ভ্লাডিমির শহরের একজন গণ্যমান্য ব্যবসায়ী।
অথচ আপনার জেরার টং দেখলে যে-কেউ মনে করবে যে আপনি আমাকে চোর
বা ডাকাত বা ঐরকম অন্য কিছু বলে ধারণা করে নিয়েছেন। মানে কী এরকম ব্যবহারের?”
তখন স্বমূর্তি ধরলেন অফিসার—“আমি এ-জেলার পুলিসকর্তা। আপনি কাল রাত্রে যে সরাইতে ছিলেন, সেখানে খুন হয়েছে একটা। রিয়াজানের এক বণিককে কেউ গলা কেটে মেরে ফেলেছে। ঐ
বণিকের সঙ্গে আপনি রাত্রে একসাথে খাওয়া-দাওয়া গল্পগুজব করেছেন,
তারপর আপনি শুয়েছেনও তার পাশের ঘরেই।
“তারপর আজ অতি ভোরে, একরকম রাত থাকতেই আপনি তিন-তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছেন সরাই থেকে। তার বহুক্ষণ পরে সরাইয়ের
অন্য লোকেরা উঠেছে, আবিষ্কার করেছে যে আপনার পাশের ঘরের বাসিন্দাটি
খুন হয়েছেন রাত্রে। এ খবর শুনে স্বভাবতঃই আপনার উপর সন্দেহ হয়েছে আমার। আমি আপনার
মালপত্র সব তল্লাস করব—”
আক্সিওনোভের মাথায় সেই মুহুর্তে
আকাশ ভেঙে পড়লেও সে এতখানি স্তম্ভিত হত না। কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বেরুলো না, যদিও কথা বলবার, নিজের সাফাই গাইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা সে করছিল। সেই সময় রাশিয়াতে এরকম একটা
মারাত্মক অভিযোগের পরিণাম যে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন, তা তার ভালরকমই
জানা ছিল। অভিযোগ একটা হলে নিরপরাধ বলে নিজেকে প্রমাণ করা একরকম সাধ্যাতীতই ছিল লোকের,
এমনি ছিল সেদিনের আইন-কানুন, বিচারপদ্ধতি।
এদিকে অফিসারের আহ্বানে পুলিস-গাড়ি থেকে সিপাহীরা নেমে এসেছে,
আক্সিওনোভের গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে তন্নতন্ন করে সন্ধান চালাচ্ছে-দেখছে যে লোকটাকে দোষী সাব্যস্ত করবার মত কোন সূত্র আবিষ্কার করা যায় কি না।
খানিকটা ওলটপালট করবার পরেই পাওয়া
গেল সূত্র, নিদারুণ
মোক্ষম সূত্র একটা। আর কিছু না, ছোরা একখানা। তাও আবার সে ছোরা রক্তমাখা।
অফিসার বজ্রগর্জনে প্রশ্ন করছেন- “এ ছোরা
আপনার?”
বিবর্ণ, শুষ্ক ঠোট দিয়ে কথা বেরোয় আক্সিওনোভের—“না, না, না”-জোর গলাতেই সে বলতে চাইছে বার বার, একবারও এতটুকু শব্দ
সে উচ্চারণ করতে পারছে না। নিজের অজান্তেই সে এমন আচরণ করে যাচ্ছে, দেখলে নিরপেক্ষ দর্শকও তাকে দোষী বলে স্বভাবতঃই ধারণা করবে “না, আমার নয়’--অতিকষ্টে সে
বলল শেষ পর্যন্ত।
“না? তবে আপনার ব্যাগের ভিতর এল কোথা থেকে?”
“জা--জানি না ত?”-আক্সিওনোভ কেঁপে
কেঁপে উঠছে জবাব দিতে গিয়ে।
আর বেশী বাক্যব্যয় করা দরকার
মনে করলেন না অফিসার, আক্সিওনোভকে বেঁধে নিয়ে পুলিস-গাড়িতে তুললেন। মালপত্র
সমেত আক্সিওনোভের গাড়িও পুলিস পাহারায় শহরে চলল।
খবর ভ্লাডিমিরে পৌছাতে দেরি হল
না। ভ্যানিয়া যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল চোখের পলকে। না বলে কথা, না ফেলে চোখের জল-মাথায় ঘোরে শুধু সেই স্বপ্নের কথা--- আক্সিওনোভ ফিরে
এসেছে শুক্লকেশ বৃদ্ধের বেশে।
আত্মীয়-বন্ধুরা এসে প্রবোধ দিয়ে, সাহস দিয়ে তাকে কতকটা চাঙ্গা করে তুলল শেষ পর্যন্ত। এ সময়ে ভেঙে পড়লে তো
চলবে না। সঙ্গিন মামলা, তার তদ্বির করতে হবে তো! স্বামীর জীবনটাই যে নির্ভর করছে ভ্যানিয়ার চেষ্টার উপরে।
অবশেষে কোহেভস্টক শহরের দিকে
একদিন রওনা হয়ে গেল ভ্যানিয়া, শিশুপুত্র দুটিকে সঙ্গে নিয়ে। ঐ শহরের জেলখানাতেই আক্সিওনোভ আছে।
ভ্যানিয়া ঢুকল জেলখানাতে। কয়েদীর
পোশাকে তার স্বামী বসে আছে। অন্য শত শত কয়েদীদের মধ্যে। নোংরা, বিবর্ণ, উষ্কখুষ্ক
চেহারাতে আগের সে উজ্জ্বলতার তিলমাত্র নেই। সবচেয়ে মারাত্মক কথা— স্বপ্ন যেমন দেখছিল—আক্সিওনোভের মাথার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে। এই কয়েকদিনের
মানসিক যন্ত্রণাতেই।
প্রথমটা ভ্যানিয়া মূর্ছিত হয়েই
পড়েছিল। জ্ঞান হয়ে তারপর স্বামীর কাছে গিয়ে ঘেঁষে বসল। ছেলে দুটোকে তুলে দিল তার
কোলে। কিন্তু কী আশ্চর্য! অবোধ শিশুরা ভয় পেয়ে সরে এল বাপের কাছ থেকে। এ-বেশে,
এ-পরিবেশে বাপকেও তারা চিনতে পারছে না যেন।
ক্ষীণস্বরে আক্সিওনোভ বলল--“জারের
কাছে একটা দরখাস্ত পাঠাতে হবে--” ভ্যানিয়া অধোবদন। সেই ভাবেই বলল-“পাঠিয়েছিলাম, ফিরে এসেছে---”
“তবু আবার” বলতে বলতেই আক্সিওনোভ থেমে গেল। ভ্যানিয়া মুখ তুলেছে, কী যেন বলবে বলবে করছে। অবশেষে ভ্যানিয়া বলেই ফেলল কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস
করে বলল-“আইভ্যান, আর যাকে যা-ই বল,
আমার কাছে ত আর মিথ্যে বলবে না তুমি! সত্যি করে
বল ত—এ-কাজ কি করেছ তুমি? বিশ হাজার রুবল নাকি রিয়াজানের ঐ
লোকটার কাছে ছিল, তা পাওয়া যাচ্ছে না”।
আক্সিওনোভ যেন মুখের উপর চাবুক
খেয়ে পিছিয়ে বসল ভ্যানিয়ার কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব, ততটাই দূরে গিয়ে বসল- “আমার স্ত্রীও সন্দেহ করছে আমায় ?” বিড়বিড় করে বলল আপনমনেই।
আর সে ভাল করে কথাই কইল না স্ত্রীর
সঙ্গে। সে বেচারী বেফাঁস কথাটা বলে ফেলে এখন অনুতপ্ত, কিন্তু আক্সিওনোভ কোন কথাই আর শুনছে না
তার, গুম হয়ে বসে আছে। এদিকে প্রহরী এসে তাগাদা দিল—“সময় হয়ে গিয়েছে, বাইরের লোক সব বাইরে চলে যাও-”
চোখের জল ফেলতে ফেলতে, শিশু দুটির হাত ধরে জেলখানা থেকে বেরিয়ে
আসতে হল ভ্যানিয়াকে।। আক্সিওনোভ নিজেকে বাঁচাবার জন্য কোন চেষ্টাই করল না আর। তার
স্ত্রীই যখন তার নির্দোষিতায় বিশ্বাস করে না, তখন অন্য আর কে
করবে? সে না দিলে উকিল, না করল দয়া প্রার্থনা—বিচারশালায় গিয়ে একদম চুপ করে রইল।
বিচারক দণ্ডাজ্ঞা দিলেন—বিশ ঘা চাবুক। চাবুকের পরে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন চির-জীবনের মত। চাবুকের ঘায়ে ফিনকি দিয়ে
রক্ত ছুটল আক্সিওনোভের গা থেকে, সে তবু নীরব। ঘা যখন শুকোল,
তখন অন্য নির্বাসিতদের সঙ্গে এক শিকলে গেঁথে তাকে নামিয়ে দেওয়া হল
সাইবেরিয়ার পথে। হোঁচট খেলে লাথি, কথা কইলে ঘুষি! ক্রমাগত লাথি আর ঘুষি খেয়ে খেয়েও তবু আক্সিওনোভ নীরব।
সাইবেরিয়ায় পৌঁছে তামার খনিতে
কাজ করতে লেগে গেল আক্সিওনোভ। কথা কয় না, মুখ বুজে কাজ করে যায়, দু’দিনেই কারাকর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়ে গেল সে। আদর্শ কয়েদী
বলে নাম পড়ে গেল আক্সিওনোভের। নেশাভাঙ্গ নেই, কলহ করে না, কোন নালিশ নেই মুখে—
অন্য কয়েদীদেরও শ্রদ্ধা আকর্ষণ
করল আক্সিওনোভ। বৎসরের পরে বৎসর গড়িয়ে যায়। দেশের খবর কিছু পায় না সে। স্ত্রী-পুত্রের কথা ভাবেও সে কদাচিৎ। কেউ কারও
নয়, এই একটা ধারণাই শিকড় গেড়ে বসেছে তার মনে। সব দিক থেকে
মুখ ফিরিয়ে সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের স্মরণ নিয়েছে শুধু।।
খনির কাজ দারুণ শ্রমসাধ্য কাজ।
চিরদিন সে-কাজ কোন
কয়েদীকে দিয়েই করানো হয়। আক্সিওনোভ এখন রেহাই পেয়েছে ও-থেকে, ওকে দেওয়া
হয়েছে জুতা তৈরির খাটুনি। মেহনত ত এতে কমই, তা ছাড়া কারা-কর্তৃপক্ষ কারিগরকে কিছু কিছু পারিশ্রমিকও দেন ফি জোড়া জুতোর জন্য। আক্সিওনোভের
হাতে পয়সা আসছে কিছু।।
সে-পয়সা দিয়ে ধর্মগ্রন্থ কেনে সে আর
কেনে সাধু-সন্তদের জীবনী। কে ধর্মের বিজয়ের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন,
কে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন রোমের মল্লক্ষেত্রে সিংহের মুখে—এই সব গল্প বড় ভাল লাগে তার। এঁদের তুলনায় তার নিজের
কষ্ট আর কতটুকু?
কয়েদী মহলে তার নাম রটে গিয়েছে
‘সন্ত দাদু’– বয়সের আন্দাজে খুবই বুড়ো দেখায় ওকে, তাই সবাই দাদু
বলে ওকে।
একদিন এল একদল নতুন কয়েদী। তখন
ছাব্বিশ বছর নির্বাসন যাপন করা হয়ে গিয়েছে আক্সিওনাভের।
পুরোনো কয়েদীরা নতুনদের পরিচয়
নেয়, পরামর্শ দেয়,
হালহদিস বাৎলায়, এ কারামহলের পুরাতন প্রথা। একটা
লোক দৃষ্টি আকর্ষণ করল সবার। বয়স প্রায় ষাট হবে, কিন্তু কী
লম্বা চওড়া পালোয়ানী চেহারা এখনও ! সে অন্য একজনের পরিচয় দিচ্ছে
নিজের নাম তার ম্যাকর সেমিওনিক, বাড়ি ভ্লাডিমির।
“ভ্লাডিমির’--আক্সিওনোভ এগিয়ে গেল—“ওখানকার আক্সিওনোভদের চেনো কাউকে?”
“কেন চিনব না? ওরা তো বড়োলোক। জোয়ান দুই ছোকরা কাজকারবার ভালই চালাচ্ছে। বাপটা
অবিশ্যি সাইবেরিয়ায়, তা সেকথা সবাই ভুলে গিয়েছে—তা তোমার নাম কী? বাড়ি ওদিকেই নাকি?”
একথার উত্তর আক্সিওনোভ নিজে আর
দিল না, ম্যাকারই এর-ওর-তার কাছে জেনে নিল তার পরিচয়। জানবার পরে সে বার
বারই নিজের মনে বলতে থাকল—“আশ্চর্য ত! এই বয়সেই
এমন বুড়ো হয়ে গিয়েছে। আশ্চর্য ত!”
এর কয়েকদিন পরেই একটা শোরগোল।
কে যেন কয়েদী সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে পালাবার জন্য। শেষ হয়নি এখনও। ইতিমধ্যেই প্রহরীরা
ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা।
কয়েদীরা অনেকইে জানে কার এ কীর্তি।
জানে আক্সিওনোভও।।
কারা শিবিরের গভর্নর কাউকে কিছু
জিজ্ঞাসা না করে ফাইল থেকে একমাত্র আক্সিওনোভকেই কাছে ডাকলেন-“আমি
জানি তুমি মিছে কথা বল না। কে করেছে এ কাজ?”
আক্সিওনোভ বলল—“মিছে কথা আমি বলি না, তা ঠিক। কিন্তু সত্যি কথাও আমি এক্ষেত্রে বলব
না। বললে অন্ততঃ বিশ ঘা চাবুক খাবে দোষী লোকটা। চাবুকের জ্বালা যে কী, তা ত আমি জানি! আমি বলব না। আমার কোন কথায় বা কাজে যেন
কাউকে এতটুকু কষ্ট পেতে না হয়---আমায় যে-সাজা দিতে চান, দিন।”
ম্যাকার সেমিওনিক রাত্রে আক্সিওনোভের
কাছে এসে কেঁদে আকুল----“কিন্তু আমার কাজের দরুন তোমায় আজ ছাব্বিশ বছর সাইবেরিয়ায়
বাস করতে হয়েছে। আমায় তুমি ক্ষমা কর। রিয়াজানের বণিককে আমিই খুন করেছিলাম। তোমাকেও
করতাম, কিন্তু হঠাৎ
কেমন ভয় করতে লাগল। গাড়িতে তোমার মালপত্র ছিল, ব্যাগের ভিতর
ছোৱাখানা লুকিয়ে ফেলে আমি পালিয়ে গেলাম।” আক্সিওনোভের হাতে ধরে কাঁদতে লাগল ম্যাকার-‘ক্ষমা কর! ক্ষমা কর?”
আক্সিওনোভ শুধু বলল-“আমার
ভাগ্যে যা ছিল, তা হয়েছে।
তোমার উপর কোন রাগ নেই আমার। তোমার শান্তি হোক।”
কিন্তু বিবেক যার জাগ্রত হয়েছে, প্রায়শ্চিত্ত না করলে সে শান্তি পাবে
কেমন করে? ম্যাকার গিয়ে গবর্নরের কাছে ছাব্বিশ বছর আগেকার সেই
খুনের অপরাধ স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে এল।
কয়েক মাস বাদে জারের কাছ থেকে আক্সিওনোভের মুক্তির আদেশ এল। কিন্তু তার কয়েকদিন আগে মারা গিয়েছে আক্সিওনোভ।
No comments:
Post a Comment