Bangla translation, অনুবাদ গল্প, অতিপ্রাকৃত গল্প, দ্যা সিলভার মিরর, বাংলা অনুবাদ গল্প, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, The Silver Mirror, Arthur Conan Doyle |
বাংলা অনুবাদ গল্প – দ্যা সিলভার মিরর – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল - The Silver Mirror - Arthur Conan Doyle – Bangla
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
“কাজটা ভাই খেটে-খুটে তোমায় তুলে দিতেই হবে”--বললেন বড় শরিক জনসন।
“২০শে তারিখের মধ্যে? ঐ মোটা মোটা কুড়িখানা
লেজার?”—ছোট শরিক বার্টনের কণ্ঠে হতাশার সুর- “সময়টা বড়ই অল্প যে স্যার?”
“উপায় কী, বল! কোর্ট তো সময় দিলো না আর! খাটো একটু। এই তো খাটবার বয়স
হে তোমার। ভবিষ্যৎ গড়ে তোলবার সময়ই তো এই!”—জনসনের
কথার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই যে উক্ত কুড়িখানা মোটা মোটা লেজারের ভিতর থেকে উদারস্পুন
বুড়োর জালিয়াতির অকাট্য প্রমাণ যদি বার্টন খুঁজে বার করতে না পারে, এ-কোম্পানিতে তার আর বিশেষ কিছু উন্নতির
আশা থাকবে না।
হোয়াইট অ্যাণ্ড উদারস্পুন! খুব জোর ব্যবসা চলছিল ওদের। হঠাৎ, এই
কয়েক বছরের মধ্যেই সব আলো নিবে গেল একে একে। ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবার তোড়জোড় চলছে,
এমন সময় এক নগণ্য অংশীদার কোর্টে দিলো নালিশ ঠুকে। তার বলার কথা এই
যে ম্যানেজিং ডিরেক্টর উদারস্পুন দেদার টাকা আত্মসাৎ করেছে কোম্পানির, সেই কারণেই বর্তমানের এই ভগ্নদশা!
কোর্ট থেকে তল্লাস চালিয়ে সব হিসাবের খাতাই আটকে ফেলা
হল। এখন সেই সব ঘাঁটাঘাঁটি করে উদারস্পুন এর অপরাধের প্রমান যদি পাওয়া যায়, সাজা হবে বুড়োটার। আর তা যদি না পাওয়া যায়, তার খালাস কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
জনসন অ্যাণ্ড জনসন—এরা হল বনেদী
চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এদের উপরেই রিপোর্ট দেবার ভার চাপিয়েছে কোর্ট। দুই বড়
কর্তা, জনসনেরা দুই ভাই, দুইজনই আয়েসী লোক। বেশী খাটতে নারাজ বলেই হালে এই ছোকরা বার্টনকে টেনে নিয়েছেন
দুই-আনার অংশীদার করে। স্বভাবতঃই এই হিমালয় প্রমাণ বোঝা তারা
ওর ঘাড়েই চাপালেন।
কাজটা যে কী প্রকাণ্ড, তা অনুধাবন করার সঙ্গে সঙ্গেই হৃৎকম্প শুরু হল বাটনের। কুড়িখানা
ইয়া-মোটা খাতা, সময় মাত্র পনেরো দিন।
প্রত্যেকখানা খাতার প্রতি পৃষ্ঠার প্রতিটি অঙ্ক তাকে দেখতে হবে, মেলাতে হবে, সংগতি-অসংগতি বিচার
করতে হবে, তারপর যোগ দিতে হবে। উঃ! এমন
জানলে সে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হত কিনা, সন্দেহ আছে। যা হোক,
হয়ে যখন বসেছে, তখন কার্যকালে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা
তো আর চলে না! আখের (শেষ পাওনা) নষ্ট হবে, সে তো এক কথা আছেই। কিন্তু বার্টনের কাছে তার চেয়েও বড় কথা এই যে নিজের উপর
শ্রদ্ধাটাই তার নষ্ট হয়ে যাবে এতে। তার চেয়ে বড় সর্বনাশ তো একটা উদ্যমশীল যুবার
পক্ষে কিছুই হতে পারে না। অতএব কুড়িখানা লেজার গাড়িতে চাপিয়ে সে নিজের ফ্ল্যাটে
নিয়ে গেল। টেবিলের নীচে সারিবন্দী করে তাদের সাজিয়ে রেখে এক নম্বর খাতাকে তুলে নিল
টেবিলে। আরম্ভ হয়ে গেল মৃত্যুপণ সংগ্রাম।
“পেরে উঠলাম না” বলে লোক হাসাবে না বার্টন। প্রাণ
যায় যাক, ফার্মের মান সে রাখবে।
এ যেন একরকম মৃগয়া। বিশখানা লেজারের নিবিড় জঙ্গলে
কোন্খানে সে ধূর্ত শিকার ঘাপটি মেরে লুকিয়ে
আছে, বার করতে হবে খুঁজে খুঁজে। কাজে যতই ডুবে যায় বার্টন,
ততই বেড়ে ওঠে তার উত্তেজনা। আফ্রিকার অরণ্যে সিংহ বা সুন্দরবনে বেঙ্গল
টাইগার মারতে যায় যারা, তারাই সাধারণতঃ পেয়ে থাকে এ-ধরনের উত্তেজনার আস্বাদ।
শুধু আফিসের কয় ঘণ্টার খাটুনিতে এ কাজের অর্ধেকও নির্দিষ্ট
সময়ের মধ্যে ভোলা যাবে না। বিকাল পাঁচটায় আফিস থেকে এসে আটটা পর্যন্ত মাথাটাকে বিশ্রাম
দেয় বার্টন। এরই মধ্যে খাওয়াদাওয়া, অবশ্যকরণীয় সব কিছু কাজকর্ম সেরে নিতে হয় তাকে। তারপর শুরু হয় নৈশ আফিস।
টানা পাঁচ ঘণ্টা খাটুনি আবার। রাত একটায় খাতা রেখে সে ওঠে, টলতে
টলতে গিয়ে বিছানায় পড়ে, সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুম। তারপর কোনরকমে
প্রাতরাশটি সেরে নিয়ে আবার অফিসে ছুট, গাড়িতে লেজারের গাদা।
এই হাড়ভাঙা খাটুনি দিন তিনেক খাটবার পরেই সে আবিষ্কার
করে ফেলল উদারস্পুনের প্রথম গলদ। উৎসাহে সব ক্লান্তির কথা ভুলে গেল সে। ধূর্ত উদারস্পুন
পাপের প্রমাণগুলো সযত্নে লুকোবারই চেষ্টা করেছে; কিন্তু হিসাব যারা বোঝে, অমন কারচুপিতে তাদের ভোলানো
যায় না। বার্টন হন্যে হয়ে উঠেছে, রক্তের গন্ধে হাঙ্গরের মত।
কিন্তু মাথাটা বড় বেয়াড়া গাইছে। ব্যথা-বেদনা কিছু নয়, একটা ভার-বোধ শুধু। আর মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখা। বাটন ভাবে—একটা ডাক্তার দেখালে কেমন হয়! কোন ট্যাবলেট যদি সে ব্যবস্থা করে, বা কোন টনিকের কথা
বলে দেয়! এই উপসর্গগুলো চলে গেলেই বার্টন খুশী।।
ব্যারাম তো তার কিছু নয়, পরিশ্রমটাই শুধু অতিরিক্ত হচ্ছে। দৈহিক হলে তবু বাঁচোয়া ছিল,
এ-পরিশ্রম হল মস্তিষ্কের। ঐ মস্তিষ্কটাকে সতেজ
রাখার একটা ওষুধ যদি কেউ দেয়।
ডাক্তার সিনক্লেয়ারের সঙ্গে একটু পরিচয় আছে বার্টনের, তার কাছেই সে গেল। সব শুনে তিনি বললেন—“ওষুধে কিছুই হবে না, তোমায় বিশ্রাম
নিতে হবে। দৈনিক বারো ঘণ্টা হিসাব করবে, অথচ মাথা বিগড়াবে না,
এমনটা কোনমতেই হতে পারে না। বাঁচতে চাও তো কাজকর্ম বন্ধ করে গলফ খেল
গিয়ে।”
বার্টন ফিরে এল বিরক্ত হয়ে। এসব ডাক্তারের কি জ্ঞান
গরিমা কিছু নেই? বিশখানা লেজার তন্নতন্ন করে
পরীক্ষা করার ভার নিয়ে যে বসে আছে, তাকে দেয় বিশ্রাম করার ব্যবস্থা?
তাহলে তো, বাঘের তাড়া খেয়ে যে লোক প্রাণপণে ছুটছে,
তাকেও ওরা বলতে পারে—“বাপু হে! তোমার এখন যা দরকার, তা হল পরিপূর্ণ বিশ্রাম,
আর ছুটলে তোমার হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে!”
ওষুধের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে সে অতঃপর বীরবিক্রমে কাজে
ঝাপিয়ে পড়ল আবার। দুখানা লেজার সে দেখে ফেলেছে, উদারস্পনের কারচুপি একটা একটা করে ধরা পড়ছে তার চোখে, সযত্নে সে নোট নিচ্ছে সেসবের। এসবের উপরে ভিত্তি করেই তো রিপোর্ট লিখতে হবে
ওকে!
তিনখানা লেজার শেষ হল যেদিন, আবার ডাক্তার সিনক্লেয়ারের কাছে যেতে হল বার্টনকে। ঘোর অনিচ্ছাতেও
যেতে হল। মাথা খাড়া করে বসতে পারছে না আর। চোখ মুছতে হচ্ছে মুহুর্মুহুঃ। “একটা কিছু ব্যবস্থা কর হে ডাক্তার, দোহাই তোমার”।
কিছু ওষুধ ডাক্তার দিলেন বটে, কিন্তু আগের চাইতেও কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বিদায় দিলেন
ওকে—“এভাবে চালালে তুমি পাগল হয়ে যাবে, বলে দিচ্ছি”।
বার্টন জবাব দিয়ে এল—-“হই পাগল হব, কাজটা আমায় তুলতেই
হবে ২০শে তারিখের আগে। সে-তারিখের আগে যদি পাগল না হই,
তাহলেই আমি খুশী।”
যথারীতি আটটার সময় এসে টেবিলে বসেছে বার্টন-ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে চলেছে। রাত বারোটা নাগাদ মাথার ভিতরে
যেন দাপাদাপি শুরু হয়ে গেল। কিছুতেই সোজা হয়ে বসে থাকতে না পেরে সে চেয়ারের ডান
দিকে কাত হয়ে সেই দিকেই মুখ ফেরাল।
* ডানদিকে দেয়ালের গায়ে আর একখানা
টেবিল। নানা টুকিটাকি জিনিসই আছে তাতে, কিন্তু দেখবার মত বস্তু
একটাই, সেটি হচ্ছে মস্ত একখানা আয়না। উঁচুতে দুই ফুটের বেশী
নয়, কিন্তু চওড়াতে পুরো তিন ফুট; ফ্রেমটা
রূপোর, সেটাও অন্ততঃ তিন ইঞ্চির মত চওড়া হবে।
কিন্তু আয়নাখানার বৈশিষ্ট্য হল ওর কাচ। দেখলেই মনে
হবে কাচখানা বুঝি বাইরের দিকে ঠেলে বেরুতে চাইছে। তারই জন্যই বোধ হয় এ-কাচের প্রতিফলনক্ষমতা খুব বেশী, কোন আধুনিক
আয়নার কাছে অমন পরিষ্কারভাবে কোন ছবি ফুটে উঠতে বার্টন তো দেখে নি।
এ-আয়না যে প্রাচীন কালের, এটা নিলামওয়ালাও বলে দিয়েছিল।
অবশ্য নিলাম ডাকতে বার্টন যায় নি, গিয়েছিল ওর এক বন্ধু। কিনে
এনে বার্টনকে ওটা দেয়। আয়নার প্রয়োজনে নয়, বন্ধুর উপহার হিসাবেই
বার্টন ওটাকে নিজের বসবার ঘরে ঠাই দিয়েছে।
রাত্রে আলো জ্বাললে যে-জিনিসটার ছায়া স্বভাবতঃই এসে পড়ে এই আয়নায়, তা হল জানালার পদা। কিন্তু আজ-
ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত মস্তিষ্ককে দুই মিনিট একটু জিরিয়ে নেবার সুযোগ দেবে বলে ডানদিকে
কাত হয়ে যখন বার্টন ঘুরে বসেছে, তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে
সে লক্ষ্য করল যে পর্দার ছায়া আজ পড়ে নি ওর উপর।।
পড়ে নি বলে যে কাচ একেবারে পরিষ্কার, তাও তো নয়! কী যেন ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী
পাকিয়ে পাকিয়ে ঘুরছে আয়নার ভিতরে। বার্টনের হঠাৎ মনে হল জানালার পর্দাতেই আগুন লেগেছে
বুঝি। চট করে মুখটা ঘোরাল সেইদিকে। কিন্তু না তো! পর্দায় আগুন
লাগে নি তো! তবে ও ধোঁয়া কিসের? ঐ যা ঘুরছে আয়নার ভিতরে?
খুবই আশ্চর্য ব্যাপার তো! বার্টনের একবার সন্দেহ
হল যে সব জিনিসটাই তার দৃষ্টিবিভ্রম। ধোঁয়া আয়নায় নয়, ধোঁয়া
তার মাথায় ভিতরে।।
কিন্তু সে অনুমানও তো সত্য বলে ধারণা করা যাচ্ছে না।
ধোয়াগুলো সারা আয়নায় ছড়িয়ে ছিল, ক্রমে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতে লাগল। না, একটা নয়,
দুটো জায়গায়। খুব কাছাকাছি দুটো জায়গায়। ক্রমে আকার নিতে লাগল সেই
দুই জায়গার জমাটবাঁধা ধোঁয়া।
কী জিনিস ও দুটো? চোখ?
হ্যা, চোখই বটে। দুটো চোখ। ডাগর ডাগর কালো কালো দুটো
চোখ। সে চোখের পাতা কী ভারী! কী সূক্ষ্ম
সুবঙ্কিম দুটি ভূ তাদের উপরে! আর কপাল? কপালটা এত উঁচু যে বেমানান বলেই মনে হতে পারত—যদি মুখখানা নারীমুখ বলে নিঃসন্দেহ হওয়া যেত।
কিন্তু ছবিটা আবার ঝাপসা হয়ে আসে যে!
ক্ষণিক বিশ্রামের ফলেই বার্টনের মস্তিষ্ক আবার সজীব
সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার ফলেই অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বার গিয়েছে রুদ্ধ হয়ে। অন্ততঃ
তা ছাড়া এর আর কোন ব্যাখ্যা এই মুহূর্তে মনে এল না বার্টনের।
না, আয়নাতে ক্ষণপূর্বের সেই রহস্যময় আবির্ভাবের কোন কিছু চিহ্ন নেই আর। মসৃণ
চকচকে কাচে ওদিককার জানালার পর্দাটাই প্রতিফলিত হচ্ছে আবার।
পরের দিন ডাক্তার সিনক্লেয়ারকে এই ব্যাপারটা জানানো
দরকার মনে করল বার্টন। তার অতিরিক্ত মানসিক শ্রমের সঙ্গে এই ম্যাজিক দেখার কোন সম্পর্ক
আবিষ্কার করেন কি না ডাক্তার এইটাই তার দেখবার জিনিস।
ব্যাপারখানা শুনে ডাক্তার তো রীতিমত চমৎকৃত। তিনি বার্টনের
ফ্ল্যাটে চলেই এলেন রহস্যময় আয়নাটা দেখবার জন্য!
সযত্ন পর্যবেক্ষণের ফলে আয়নার পিছনদিকে রূপোর ফ্রেমের
উপরে তিনি দুটি দাগ দেখতে পেলেন। একটি হল লাটিন ভাষায় তিনটি শব্দ ‘স্যাংক x প্যাল’, অন্যটি বল্লমের ডগার মত তিনটি চিহ্ন। প্রথমটিতে বোঝায় পবিত্র
প্রাসাদ অর্থাৎ পোপের প্রাসাদ—‘হলিরুড’, দ্বিতীয়টা ফ্রান্সের রাজপ্রতীক তিন লিলি।
ডাক্তারকে এর পর দেখা গেল দোয়ামনা। মাথার অসুখ সারাবার
জন্য বার্টনের শ্রমবিরতি যে একান্ত আবশ্যক, তা তিনি এখনও জোর দিয়েই বলছেন। কিন্তু তাঁর ভাব দেখে বার্টনের সন্দেহ হল-এ-পরামর্শ সে অগ্রাহ্য করলেই ডাক্তার খুশী হবেন। অবসন্ন
মস্তিষ্কই অবাস্তব চিত্র দর্শনের অনুকূল। যে-চিত্রের প্রথম রেখাপাত
আজ বার্টন দেখেছে, তার পরিণতি কী হয়, জানবার
জন্য ডাক্তারের অসীম আগ্রহ।
ডাক্তারের কৌতূহল যাতে চরিতার্থ হবে, সেই কাজই বার্টন করে যাচ্ছে, অর্থাৎ মস্তিষ্ককে
খাটিয়ে যাচ্ছে অতিরিক্তের চেয়েও বেশী পরিমাণে। ডাক্তারের গরজে নয়, গরজটা তার নিজেরই। ২০শে তারিখ ঘনিয়ে এসেছে, লেজার এখনও
দশখানাই বাকী। উদারস্পুন বুড়োর কুকীর্তির প্রমাণ ইতিমধ্যেই সে ভূরিভূরি পেয়েছে অবশ্য,
কিন্তু তা বলে বাকী দশখানা বই তো না দেখে সে পারবে না! তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করতে হবে ওগুলিও। তাতে আসবে ক্লান্তি, ক্লান্তি সৃষ্টি করবে আয়নার বুকে অলীক ছবি।
যেদিনই অবসাদটা বেশী আসে, সেদিনই আয়নার ছবি ফুটে ওঠে তার চোখের সামনে। ক্রমেই সে-ছবি বড় হচ্ছে। বিশদ, বিচিত্র হচ্ছে নব নব অংশের যোজনায়।
আগে ছিল একখানি মাত্র মুখ, এখন দেখা দিয়েছে অনেকগুলি। শুধু মুখ
নয়, পরিপূর্ণ অবয়ব। বিচিত্র ভঙ্গীতে দাঁড়ানো। চমকলাগানো অভিনয়ে
ব্যাপৃত।
আগের মুখখানি নারীমুখ কি না, প্রথম রাতে সন্দেহ ছিল বার্টনের। সে-সন্দেহ
ঘুচে গিয়েছে। নারীরই মুখ নিশ্চয়, মহীয়সী কোন নারীর। উঁচু কপাল
তার মুখশ্রীকে শক্তি আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় মণ্ডিত করেছে। মাথায় সোনালী চুলের উপর রেশমী
টুপি, তাতে মুক্তোর ঝালর লাগানো। কালো ভেলভেটের পোশাকের উপর ঠিক
বুকের গোড়ায় একটা জ্বলজ্বলে হীরে, আর বসনাভ্যন্তরে সোনার একটা
ক্রুশ।
এই মূর্তির বাঁয়ে এক দীর্ঘদেহ সুবেশ পুরুষ দাঁড়িয়ে, উপবিষ্টা মহিলা কাতর অনুনয়ের দৃষ্টিতে ঐ পুরুষের দিকেই তাকিয়ে
আছেন। আর মহিলার পায়ের তলায় উপুড় হয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছে বেঁটেখাটো দাড়িওয়ালা
একটি লোক। তার বাঁহাতে ছোট্ট ছুরি একখানা, আর ডানহাত দিয়ে সে
শক্ত করে চেপে ধরেছে মহিলাটির পোশাকের প্রান্ত। আশ্রয়! নিশ্চয়ই
সে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি চায় মহিলার কাছে। শক্ত করে ঐ যে পোশাক চেপে ধরা,
ওর মানেই হল প্রাণভয়ে শরণ নেওয়া।
প্রাণের ভয় তার সত্যিই আছে। ছবি দেখে তাই মনে হয়
বার্টনের। পশ্চাৎপটে অনেকগুলি আবছা মুখ, অনেকগুলি অস্পষ্ট দেহের জটপাকানো আনাগোনা। তাদের হাত যখন নড়ছে, তখন বড় বড় ছোরা আর তরোয়াল দেখা যাচ্ছে তাতে।।
ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল ২০শে তারিখের আগের
রাত্রে। প্রাণপণ করে শেষ করেছে বার্টন। কিন্তু প্রাণ বুঝি সত্যিই যায়। মাথা তার ফেটে
যেতে চাইছে। চোখ ফেটে রক্তই বা বুঝি বেরোয়। সে যে কেন অজ্ঞান হয়ে পড়ছে না এখনো, এ ভেবে নিজেই সে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে।
টেবিলের উপর রিপোর্ট লেখা রয়েছে। অফিসে খবর দেওয়া
আছে, বার্টন যে অবস্থায়ই থাকুক,
যে-কেউ একজন এলেই রিপোর্ট নিয়ে যেতে পারবে। নিশ্চিন্ত
এখন বার্টন। মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। পরে উন্মাদ হতে হয় যদি তো হবে।
সে-আশঙ্কা মাথায় নিয়েই সে মাথা খাটিয়েছে এত। যা হয় হবে, আজ নিশ্চিন্ত।
নিশ্চিন্ত হয়ে সে এইবার আয়নার দিকে তাকাল। জ্বলজ্বল
করছে আয়নাখানা আলোর মালায় ঝলমলে রঙ্গমঞ্চের মত। রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের মত জীবন্ত অভিনয়
হচ্ছে সেখানে। এক ভয়াবহ বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয়। বার্টনের চোখের সামনেই একটা হত্যাকাণ্ড
চলছে।
Bangla translation, অনুবাদ গল্প, অতিপ্রাকৃত গল্প, দ্যা সিলভার মিরর, বাংলা অনুবাদ গল্প, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, The Silver Mirror, Arthur Conan Doyle |
মহিলাটিকে টেনে তুলে জোর করে ধরে রেখেছেন তার পাশের
লম্বা পুরুষটি। মহিলাটির পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল যে লোকটি, তাকেও টেনে তুলেছে অনেকগুলি লোক। এইসব লোকেরই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি
এতদিন আয়নার ভিতর পশ্চাৎপটে মাঝে মাঝে দেখেছে বার্টন। আজ এরা সম্মুখে এগিয়ে এসেছে।
জ্যান্ত মানুষ এরা আজ, আবছা ছবি নয়। ভূশায়ী লোকটাকে টেনে তুলে
তাকে ছোরার ঘা মারছে এরা সবাই। ক্রমাগত মেরেই চলেছে। রক্ত ছুটছে লোকটার সারা দেহ থেকে।
ধারায় নয়, ছুটছে ফোয়ারায়। লোকটা পড়ে গেল। তবু তাকে টানতে
টানতে নিয়ে যাচ্ছে ঘাতকেরা। মহিলাটি করছেন আর্তনাদ। দীর্ঘদেহ পুরুষ তাকে তখনও ধরে
রেখেছেন।
আর কিছু দেখতে পেল না বার্টন। অজ্ঞান হয়ে সে চেয়ার
থেকে পড়ে গেল। জ্ঞান হল কয়েকদিন পরে, ডাক্তার সিনক্লেয়ারের নার্সিং হোমে। তারও কয়েকদিন পরে সে ডাক্তারকে বলল তার
শেষ রজনীর অভিজ্ঞতার কথা।
আরও কয়েকদিন যায়। ডাক্তার এসে একদিন বললেন-“ও সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করেছি আমি। রূপোর আয়নাখানি স্কট রানী মেরীর ছিল একদিন।
থাকত তারই ঘরে। সেই ঘরেই তাঁর প্রিয় পারিষদ রিজিয়োকে হত্যা করে স্কটল্যাণ্ডের ব্যারনেরা।
আয়নায় সেই সব ছবি ধরা পড়ে।
সে-ছবি ভৌতিক আয়না এখনও বুকে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে কাউকে হয়ত দেখায়।
ছবির মহিলাটিই রানী মেরী, আর তার পাশের দীর্ঘদেহ পুরুষটি লর্ড ডার্নলি, রানীর স্বামী।”
No comments:
Post a Comment