![]() |
Struggles of an university students |
সম্প্রতি পুলিশের এসআই নিয়োগ
পরীক্ষা চলছে। ছেলেটি কাগজপত্র সত্যায়িত করতে আসে। নিজের রুমে বসে আছি, হাত মুখ ধুয়ে মাত্র দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় সে এসে
হাজির। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করছিল, ভেতরে
প্রবেশের অনুমতি দিলাম।
প্রথম ধাক্কায় মনে হল, ছেলে নেশাআসক্ত নয়ত শারীরিকভাবে অসুস্থ। কাগজপত্র এগিয়ে দিল, আমি একে একে সাক্ষর করছি আর অল্পস্বল্প তার বিবিধ জিজ্ঞেস করছি। এই
আলাপপর্ব আমি প্রায়শ করে থাকি।
-বাবা,
তুমি কি নেশাটেশা কর?
-না,
স্যার।
-রাত জাগো?
-জ্বী না
স্যার।
ছেলেটির লিকলিকে শরীর আর
কাগজপত্র, ছবি স্বাক্ষরের সময় যখন একটা একটা কাগজ টেনে
নিচ্ছিল তখন খেয়াল করছিলাম ছেলেটির হাত ঈষৎ কাঁপছে। তাই ভণিতা না করে সরাসরি
প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিলাম।
-তাহলে
তোমার এই অবস্থা কেন? দেখে তো সুস্থ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে
না।
-(সলজ্জভঙ্গিতে উত্তর দিল) মেসে থাকি তো, খাওয়া-ঘুমের ঠিক নেই স্যার।
-(সলজ্জভঙ্গিতে উত্তর দিল) মেসে থাকি তো, খাওয়া-ঘুমের ঠিক নেই স্যার।
জিজ্ঞেস করলাম, টিউশনি কর কয়টা?
-তিনটা। এই
মাসে আর একটা নিয়েছি।
-কত পাও সব
মিলিয়ে?
- ছয়-সাত
হাজার!
-টাকাগুলো
দিয়ে কী কর?
-বাড়িতে
পাঠাই কিছু, গ্রামে বাবা-মা আর ছোট একটা ভাই থাকে। বাকিটা
মেস ভাড়া, মিল খরচ আর পড়াশোনার ব্যয় স্যার।
-বুঝলাম,
তুমি তোমার খরচ চালিয়েও বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছো। কিন্তু তোমার
স্বাস্থ্যের এই ভগ্নদশা কেন? খাওয়া-দাওয়া নিয়মিত কর না?
-করি স্যার।
(ছেলেটি এবার কুঁকড়ে যায়) তবে সব-সময় খাওয়া হয় না। সকালে ভার্সিটিতে আসি, ক্লাস শেষ করে টিউশনিতে চলে যাই। মেসে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারটা।
টিউশনির বাসায় যে নাস্তা দেয় তাই দিয়ে দুপুরেরটা চালিয়ে নিই; অবশ্য কখনও-সখনও দেয়ও না। এভাবেই দিন চলে।
আমি গভীর এক দীর্ঘশ্বাস
ফেললাম। দুই সেট অনেকগুলো কাগজ স্বাক্ষর করতে করতে এক সময় মনে হল, কলম আর চলে না। আমি আর ওর দিকে তাকাতে পারছি না।
মাথাটা নিচু করে বললাম-
-মাঝে সাঝে খেতে না পারলে অন্তত মুড়ি খাবে। তবুও খালি পেটে থেকো না। মুড়ি খেয়ে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নেবে। দেখবে শরীরে অনেক বল পাবে।
-মাঝে সাঝে খেতে না পারলে অন্তত মুড়ি খাবে। তবুও খালি পেটে থেকো না। মুড়ি খেয়ে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নেবে। দেখবে শরীরে অনেক বল পাবে।
ছেলে এবার যা বলল, এর জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। খুব ক্ষীণকণ্ঠে হা করা মুখের
দিকে হাতটা নিয়ে তর্জুনি দিয়ে মাড়ির দিকে নির্দেশ করে বলল-
-স্যার,
গত কয়েকদিন ধরে মুড়িই খেয়ে আছি। এই মাসের মেস ভাড়া, মিল খরচের টাকা দিতে পারিনি। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার টাকা আর গত
মাসে বাড়িতে গিয়েছিলাম মাকে দেখতে; মা অনেকদিন ধরে
পীড়াপীড়ি কান্নাকাটি করছিলো, অনেকদিন বাড়ি যাই না-বাড়ি
যেতে অনেক ভাড়া আর খরচের ব্যাপার; ছোট ভাইটা অনেক আবদার
করে রাখে; আব্বা অন্যের আম বাগানে কাজ করতে গিয়ে গাছ থেকে
পড়ে কোমর ভেঙে বেশকিছু দিন শয্যাশায়ী। মা শুধু কাঁদে আমাকে এক নজর দেখবে, তাই গেলাম। অনেক খরচ হয়ে গেল গত মাসে।
আমি বাকরুদ্ধ, নিশ্চুপ হয়ে শুধু শুনছিলাম। গলাটা আমার ধরে আসছিল। এতক্ষণ ওকে আমার
বানভণিতাহীন জিজ্ঞাসাকে বড় বাতুলতা মনে হল। স্বাক্ষর সমাপ্তে শুধু একটাই প্রশ্ন
করলাম।
-এই যে এসআই
পরীক্ষা দিতে খুলনা যাচ্ছো, ভাড়া আছে যাওয়ার?
জীবনের রূঢ়তায় কতটা অনিশ্চিত
এই যাপন। ছেলেটা উত্তর দিল-
- না,
নেই স্যার। যাব কি না মনস্থির করি নাই। দেখি, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ধার চাইব। যাওয়া-আসা এক হাজার টাকা হলেই হয়ে
যাবে। কিন্তু জানি না ব্যবস্থা হবে কিনা! তবুও কাগজপত্র ঠিক করে রাখলাম।
এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম
ওকে। বুঝতে পারছিলাম এই অর্ধবেলা পর্যন্ত ছেলেটির পেটে কোন দানাপানি পড়েনি। আমার
লাঞ্চবক্সে দুইটা রুটি ছিল। দুজনে ভাগ করে খেলাম। ও খেতে চায়ইনি। এক প্রকার জোর
করে বসালাম।
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্ষুদ্র শিক্ষক আমি, মানিব্যাগ সার্চ করে দেখি
বেশি টাকা নাই। এক কলিগকে ফোন করে বললাম, এক হাজার টাকা
ধার দিতে পারবে কিনা। বলল, পারবে। ছেলেটিকে নিয়ে আসতে
পাঠালাম। নিয়ে আসলো। টাকা ওর হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকা
তোমাকে ধার হিসেবে দিলাম। চাকরি পেয়ে ফেরত দেবে।
প্রথমে নিতে খুবই আপত্তি করল।
যখন দেখল, আমি সত্যি সত্যি ধার হিসেবে দিচ্ছি তখন আর
দ্বিধা করল না।
আজ ফোন দিয়ে জানালো, সে প্রাথমিকভাবে এসআই বাছাই পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়েছে। আমি আনন্দিত। ওর
জন্য সবার দোয়া চাই। মহান সৃষ্টিকর্তা যেন ওর মনে আশা পূরণ করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রদের জীবন সংগ্রাম কাছে থেকে না দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই। কত টাকা আমরা
রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে ওয়েটারকে বখশিস দিয়ে আসি। অনেক অহেতুক খরচ করি।
প্লিজ, একটিবার আপনার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রতিবেশী ছাত্রটির খবর নিন। তাকে
সাহায্য নয়, ধার দিন। প্রয়োজনে লিখে রাখুন টাকার অংকটা,
একদিন সে বহুগুণ ফেরত দেবে আপনাকে, জাতিকে।’
ড. শাহ মো. আরিফুল আবেদ
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment