|
Bangla short story, short story, ছোট গল্প,বাংলা ছোট গল্প,আশাপূর্ণা দেবী,Ashapurna Debi |
বাংলা ছোট গল্প- একটি নোট বই - আশাপূর্ণা দেবী - A Note book - Bangla short story - Ashapurna Debi
শিশি-বোতলও’লা ডাকা হয়েছে। চাকরটা বাড়ির ভেতর থেকে রাজ্যের পুরোনো খবরের কাগজ, ছেঁড়া সাপ্তাহিক, মাসিক ইত্যাদি এনে জড়ো করে এখন দর নিয়ে রীতিমতো মারামারি শুরু করেছে। হঠাৎ বৃষ্টি এলো চেপে। অগত্যা রাশীকৃত জঞ্জাল সমেত শিশি-বোতল-ও’লাকে ঘরের ভেতর আশ্রয় দিতে হলো। থাক দিয়ে দিয়ে সাজানো কাগজের মধ্যে একখানা বেগুনি মলাটের খাতা দেখে হা হা করে উঠলাম, সর্বনাশ করেছে এই গৌরে হতভাগা, বড়ভাইর খাতা এনেছিস কেন? নাঃ, তুই দেখছি ডোবাবি।
গৌর দাড়ি-পাল্লায় চোখ রেখে নিশ্চিন্ত চিত্তে বললো, বড়ভাই এর দরকার নেই। হাড় জ্বলে গেলো, নিজেই যত্ন করে খাতাটা তুলে নিয়ে বললাম, দরকার নেই! বেটা সবজান্তা। দেখি, আর কি কি এনেছিস আমার মাথা খেতে। তোকে বাবু, কে সর্দারি করতে বলে? বাড়ির ভেতর থেকে দেখিয়ে আনতে পারিস না ?
আমার অফিসের খাতা পত্র, খুকির পড়ার বইপত্র, মায়ের মলাট খোলা কুরআন খানা আর এ বছরের নতুন পাঁজি যে এই পাহাড়ের ভেতরে আত্ম গোপন করে নেই, কে বলতে পারে!
ধমক দিতেই জনাব গৌরাঙ্গ রাগভরে গোছানো থাকগুলো ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে বললো, দেখেন ভাই, কোথায় কি আছে! ছয় মাস নাগাদ সিড়ির নিচে পড়ে আছে, কেউ উল্টে দেখে না।
সত্যই কিন্তু দেখলাম না কিছু, ভালো করে ধমকে দেওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করায় হতভাগার উপর চটেই গেলাম। খাতাখানা নিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম। দেখি বারো আনা অংশই খালি, প্রথম দিকের খানিকটা আার শেষ ছ'পাতায় কতকগুলো অঙ্ক কষা। পরিষ্কার নীল লাইন টানা ধবধবে পাতাগুলো দেখে গা-টা করকর করে উঠলো।
এই খাতা কখনো ফেলে দিতে পারে ফারুক! উজবুক গৌরেটা টেবিল থেকে টেনে এনেছে। বললাম, যা, বড়ভাইর ঘরে রেখে আয়। এক মিনিটও হয়নি, পাজিট৷ দু’পাটি দাতের একটাও ঢাকবার চেষ্টা না করে এসে বললো, বড়ভাই বললেন, ওটা ও কেলাসের খাতা, আর দরকার হবে না। বাড়িতে অনেক জিনিসই নষ্ট হয়, সর্বদাই হয়। লক্ষ্য করি না, লক্ষ্য করলে জিনিসের বদলে বাড়ির শান্তি নষ্ট হবে। তা ছাড়া সময়ই বা কোথায়? কিন্তু তুচ্ছ ক'খানি সাদা কাগজের ওপর এতো মায়া কেন? একটি একটি করে পরিষ্কার পাতা ক’খানি খাতা থেকে ছিড়ে নিয়ে সযত্নে ড্রয়ারের ভেতর তুলে রাখলাম।
কতো তুচ্ছ কারণে কতো পুরোনো কথা, পুরোনো স্মৃতি হঠাৎ জেগে ওঠে...বাধানো এক্সারসাইজ বুক আজ নতুন দেখলাম এমন নয়, খুকির স্কুলে বাধানো খাতা ব্যবহার না করলে ডিসিপ্লিনই থাকে না।
ফারুক তো কবে থেকেই খাতা কেনে দেখতে পাই। এই তো ক্লাসে উঠে খাতাই কিনলো তিন টাকা চার আনার। নিজের হাতে বাধিয়ে নেওয়ার ঝামেলা পোয়াতে রাজি নয় ওরা। কিন্তু আজ হঠাৎ চকচকে বেগুনি মলাটের খাতাখানা দেখে মনে পড়ে গেলো.. এমনই একটি জিনিস কী দূর্লভই না ছিলো এক সময়ে।
ছেলেবেলায় যখন শ্লেটে একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফোটার শোচনীয় কাহিনী লিখি মামার বাড়ি গিয়ে প্রথম এই রকম একখানি খাতা নজরে পড়ে মামাতো বোন মীরা আপুর বাক্সে। বোধহয় গানের খাতাই হবে, দেখলাম, একদিন একটা ভিখারিকে দাড় করিয়ে ‘আল্লাহ মেহেরবান’ না ওই গোছের কি একটা গান লিখে নিচ্ছেন। রুল ধরে ধরে লাইন টেনে নিতে হয় না। এমন একটা অপূর্ব বস্তু সেদিন ঈশ্বরপ্রাপ্তির চাইতে কম দূষ্প্রাপ্য মনে হয় নি!
নিজেকে মীরা আপুর জায়গায় দাড় করিয়ে, কল্পনায় সেই নীলাভ রেখা টানা বকের পালকের মতো শুভ্র পাতাগুলোর ওপর কতো কি লিখলাম, তার ঠিক নেই। খাতাখানি আবার কবে বাক্স থেকে বেরোবে ভেবে উৎসুক হয়ে থাকতাম, দেখেই চক্ষু সার্থক। কিছুদিন পরে কাগজে লিখতে শুরু করলাম। মেজোকাকা রেল অফিসে চাকরি করতেন, কি সুবাদে জানিনা অফিস থেকে লম্বা লম্বা কাগজ আনতেন। হলদেটে কাগজ, একপিঠে অফিসিয়াল লেখা; অপর পিঠে লিখতাম আমরা। সেই সময় আবার একখানা বাধানো খাতা দৃষ্টি গোচর হলো ছোটোকাকার বিছানার তলায়।
কি লেখা ছিলো দেখবার সুযোগ হয়নি; কিন্তু সেদিন ছোটো কাকাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখীব্যক্তিদের সঙ্গে একাসনে বসাতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করিনি। কিছু আগে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প শুনেছি; আমি উক্ত সৌভাগ্যবান বালক হতে পারলে যা আগে চাইতাম তা বোধহয় আর বলে দিতে হবে না।
ক্রমে রেল কোম্পানির কাগজ থেকে বালি কাগজ, আরো পরে ছ’পয়সা দিস্তা দরের সাদা কাগজে প্রমোশন পেলাম! কিন্তু আমার সেই স্বপ্নের জিনিস স্বপ্নেই রয়ে গেলো। দীর্ঘকাল পরে যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন আমার এই চিরদূর্লভ বস্তু একদিন দৈবক্রমে করায়ত্ত হয়ে গেলো।
অনেকদিনের প্রাণপণ চেষ্টায় চৌদ্দটা পয়সা জমেছিলো, আলুভাজা, ঘুগনিদানার দুর্নিবার প্রলোভন জয় করে করে। দামটা ঠিক জানা না থাকলেও কাছাকাছি পৌছেছি, এ ধারণা জন্মেছিলো। কিন্তু সুযোগ কোথায় কেনার?
অষ্টম শ্রেণীতে পড়লেও একলা রাস্তায় যাওয়ার স্বাধীনতা তখনো হয়নি। বাড়ির চাকর বাজারে যাবার সময় স্কুলে পৌছে দিয়ে আসতো, বিকেলে এক সময় নিয়ে আসতো। চাকরের মর্জিমতো কতোদিন স্কুলের ছুটির পর অধীরভাবে কতোক্ষণ স্কুলে বসে থাকতেহয়েছে; কিন্তু একলা পথে বেরোনোর কল্পনাও মনের কোণে আনতে পারিনি।
হঠাৎ একদিন মা বললেন, বড় খোকা, পশম কিনে আনতে পারিস? লাল পশম? বুঝলাম, কার্পেটের গোলাপ ফুলটা শেষ হওয়ার মুখে পশমের গুলিটা বিশ্বাসঘাতকতা করায় মা প্রায় অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। সাহসে ভর করে বললাম, খুব পারবো!
মা দুইটা সিকি হাতে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ছ’পয়সা করে একটা গোছা, আটটা আনবি। গুনে আনিস বুঝালি ? গাড়ি ঘোড়া, সাবধান বাবা, তোর দাদি যেন টের না পান, চুপিচুপি যাস।
দাদি জানতে পারলে মার বকুনি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। চুপি চুপি বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু বেরোবার আগে গুপ্ত-ভাণ্ডার থেকে আমার সবেধন নীলমণি চৌদ্দটা পয়সা বের করে পকেটস্থ করলাম।
তোমরা এখনকার থার্ডক্লাসের অর্থাৎ ক্লাস এইটের ছাত্রেরা এ সব কথা শুনলে হাসতে হাসতে দমবন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু সত্যিই আমাদের আমলে বারে তেরো বছরের ছেলেকে এইভাবেই মানুষ করা হতো।
দোকানে গিয়ে আগেই একখানা খাতা চাইলাম ততো মোটা নয়, তবে তেমন চকচকে বেগুনি রঙের শক্ত মলাট। বকের পালকের মতো সাদা ধবধবে নীল রুলটানা পাতা। পাতাগুলোর ওপর সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে দাম জানতে চাইলাম। দোকানি বললো, চার আনা।
চার আনা, আমার রেস্ত থেকে খুব বেশি তফাৎ না হলেও কেনার পয়সা তে হয় না।
মনঃক্ষুন্ন ভাবে আটগোছা পশম গুনে নিয়ে সিকি দু’টা ফেলে দিয়ে ফিরে এলাম; কিন্তু দুর্দমনীয় লোভ পেছন থেকে টানতে লাগলো। আর কিছুদিন অপেক্ষা করলেই দুটো পয়সা জমানো অসম্ভব নয়, কিন্তু আমার পক্ষে সে ধৈর্যটুকু ধরাও কঠিন হলো। দুটো পয়সা জমাতেই বা কদিন লাগবে, কে জানে। তার মধ্যে আগের জমানোগুলো অনিবার্য নয়। দোকানে আসবার সৌভাগ্য আবার কবে ঘটবে, বলা যায় না। এমনকি বাজারে খাতার বিক্রি উঠে যাওয়ার সন্দেহও মনের মধ্যে মাঝে মাঝে উকি দিতে লাগলো। মরিয়া অবস্থা আর কি।
যন্ত্রচালিতের মত দোকানে ফিরে গেলাম, এক গোছা পশম আর সেই চৌদ্দপয়সাম দোকানির সামনে রেখে খাতাটাই দিতে বললাম কিন্তু কি যে বললাম নিজেই শুনতে পেলাম না, গলা দিয়ে স্বরই ফুটলে না যেন। শুধু বোধহয় হাতের ভঙ্গীতেই আন্দাজ করে নিয়ে দোকানি পশমটা তাকের ওপর বড়ো কাচের বোতলে ভরলো। পয়সাকটা তুললো, ধীরে-সুস্থে খাতাখানি আমার হাতে দিলো। কী রকম উর্ধ্ব শ্বাসে যে ছুটে এসেছিলাম, সেটা বরং পুলিশ তাড়া খাওয়া চোর কতকটা অনুমান করতে পারে। ঠিক যেন কে দেখে ফেললেই দারুণ সর্বনাশ ঘটে যাবে!
নিচের পড়ার ঘরে বড়ো আলমারির পিছনে ‘বামাল গায়েব’ করে যখন মায়ের কাছে এলাম, তখন বুকের মধ্যে টেকির পাড় পাড়ছে যেন। হাত-পা ঠাণ্ডা, নাক-কান দিয়ে আগুন ছুটছে। না দেখতে পেলেও বুঝলাম চোখ-মুখ লাল।
আমায় পাঠিয়ে পর্যন্ত মাও সুস্থির ছিলেন না। ছুটে এসে বললেন, কিরে, খোকা, কী হয়েছে? রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলি নাকি? মুখচোখ এমন কেন? গাড়ির ধাক্কা লেগেছে? পয়সা হারিয়ে ফেলিসনি তো?
মিথ্যে কথা বললাম। বললাম, একটু পড়ে গেছি। বলতে খুবই কষ্ট হলো; কারন মিথ্যা বলা মহাপাপ। কিন্তু তবু বলতে হলো;
মা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আহা বাছারে বলে বারবার করে গায়ের কাল্পনিক ধুলোবালি ঝোড়ে দিলেন! জোর করে এক গ্লাস পানি খাওয়ালেন এবং দাদি যেন জানতে না পারেন সে বিষয়ে বিশেষভাবে সাবধান করে দিয়ে পান চাইলেন।
পশমের গোছা হলো সাতটা। মা সহজভাবেই বললেন, ওমা। সাতটা দেখছি, গুনে নাওনি নাকি?
কোন দিকে ঘাড় কাৎ করে ছিলাম, মনে নেই।
তা হবে হয়তো। হয়তো পড়ে গিয়ে পকেট থেকে ছিটকে গেছে, যাই হোক আল্লাহ রক্ষা করেছেন।
আল্লাহ যথাযথভাবেই রক্ষা করলেন।
একটি গোছা পশমের জন্য যে পরিমান জেরার আশঙ্কা করছিলাম, তার কিছুই হলো না দেখে, মনে মনে আশ্বস্ত হলাম, কিন্তু মিথ্যা কথাটা বলার জন্যে ক্রমাগত মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো। আর কখনো মিথ্যা বলবো না বলে তওবা করলাম।
খাতা তো কিনলাম, কিন্তু কিনেই বা কি স্বস্তি আছে? কখন বের করি আর কখন লিখি? লিখিই বা কি ?
স্কুলের ট্রানস্লেশন করে নষ্ট করার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না। দরজা বন্ধ করে মাঝে মাঝে আবার নেড়ে চেড়ে দেখে নিতাম।
শুধু অনেক যত্নে, অনেক ধরে ধরে নিজের নামটি লিখেছিলাম। এমনি ‘গজ-কচ্ছপ’ অবস্থায় খাতা বেচারা বহুদিন আলমারির পেছনে থেকে গেলো!
রমজানের ছুটিতে ছোট ফুপুর বাড়ি যাই। সেখানে নিয়ে গেলাম তাকে। ফুপার বইয়ের শখ ছিলো। নজরুল ও জসিমউদ্দিনের দু’খানা ‘কাব্য গ্রন্থাবলী’ সংগ্রহ করে, কবিতা নকল করে করে খাতা ভরিয়ে ফেললাম। মানে বুঝি আর না বুবি, তবু একটা ভালো জিনিস লিখেছি বলে মনে তৃপ্তি পেলাম।
কালের স্রোত কোথায় কাকে ছিটকে ফেলে, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কে বলতে পারে? বহুদিনের যন্ত্ররক্ষিত কবিতার খাতাখানা কবে কোথায় হারিয়ে গেছে, আজ আর মনেও নেই! হয়তো আর কেউ তার অভাব পূর্ণ করে থাকবে কিন্তু এতোদিন পরে হঠাৎ একখানা সাধারণ একসারসাইজ বুক মনটা এমনি বিকল করে তুললে যে---
অফিসের বেলা হয়ে গেলো। শিশিবোতলও’লা কখন চলে গেছে। গৌরও নিজের কাজে গেছে। ঘড়িতে দেখি, নটা কুড়ি। গোসল পর্যন্ত হয়নি। মুস্কিল আর কি। তারাতারি তৈরী হয়ে নিই।
No comments:
Post a Comment