শিক্ষামূলক মজার গল্প - লাভের অঙ্ক - আশাপূর্ণা দেবী - Laver Onko - Ashapurna Devi - Bangla mojar golpo
অবাক!
অবাক!
এমন
অসম্ভব ঘটনা যে জগতে সত্যিই ঘটতে পারে
একথা মাজেদ ফকির কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। অথচ ঘটলোও। প্রকাশ্য দিনের বেলায় ময়লার ভাগাড়ের পাশেই ঘটে গেলো। অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গেই মাজেদ পাশের গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো, আর খানিকক্ষণ হাপিয়ে তবে ধাতস্থ
হয়েছিলো ।
ধাতস্থ
হবার পর চোখদুটো ভালো করে রগড়ে মুঠোয়
চেপে ধরে জিনিসটাকে ফের চুপি চুপি দেখে নিয়ে
নিঃসন্দেহ হলে মাজেদ। এইমাত্র ময়লার ভাগাড় এর পাশ থেকে ছোট্ট করে ভাজ করা যে কাগজটুকু সে কুড়িয়ে পেয়েছে, সেটা একটা এক হাজার টাকার নোট।
জলজ্যান্ত
সত্যিকার একখানা নোট!
জীবনে
এর চাইতে বিস্ময়কর ঘটনা আর কি হতে পারে ? অন্ততঃ মাজেদের মতো হতভাগ্যের জীবনে ?
মাজেদ ফকির !
নামটার
মধ্যেই যেন তার মুল্য ধার্য হয়ে গেছে। যেন মাজেদর জীবনের প্রাক্কালেই তার বাবা-মা সচেতন করে দিয়েছে তাকে বাপুহে, জেনে রেখো জগতে তোমার কোন দাম নেই, অতএব জগতের কাছে বেশি কিছু আশা করো না।
তা
তেমন আশা কোনোদিন করেওনি বেচারা। বাল্যকাল থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেই নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এই উদাসীন পৃথিবীর এক কোণে। মাজেদের পরিবেশে যতো রকম কাজ করা সম্ভব, সবই করে দেখেছে মাজেদ, কিন্তু রুগ্নদেহের জন্যে
কোথাও লেগে থাকতে পারেনি, স্রোতের
কুটোর মতো ঘাটে ঘাটে ধাক্কা খেয়ে ভেসে গেছে ।
কিছুদিন
থেকে ধরেছে এই রাস্তার কাগজ কুড়োনোর কাজ !
পরণে ছেড়া খোড়া একটা প্যান্ট, গায়ে ফুটো ফাটা
একটা গেঞ্জি, পিঠে ঝুলি, হাতে এক টুকরো কঞ্চি। জড়ো করা জঞ্জাল উটকে দেখবার জন্যে রাখা এই কঞ্চিটা দিয়ে মাঝে মাঝে নিজের পিঠও চুলকোয়।
কিন্তু
সে যাক, কথা হচ্ছে—ট্যাক নেই, পকেট নেই, নোটখানা তবে রাখে কোথায়? আস্ত একটা হাজার টাকার নোট, এ যেন মাজেদের কাছে রাজার ঐশ্বর্য!
আস্তে
আস্তে পিঠ থেকে ঝুলিটা নামিয়ে গলির মোড়ে
একটা বাড়ির রোয়াকে বসলো মাজেদ ।
এখন
কিং কর্তব্য ?
বস্তিতে
ওর নিজের আস্তানায় সেইখানেই গুজে রাখলে নোটটাকে, নির্ঘাৎ চুরি যাবে। যতোসব হতচ্ছাড়া লোকের বাস তো সেখানে!
নাহ! নিজের সঙ্গে সঙ্গেই রাখা ভালো। তবে কি
এটা ভাঙিয়ে, একটা পকেটওয়ালা জামা কিনে নেবে? আর বাকি টাকাটা পরম যত্নে রেখে দেবে সেই পকেটে ?
ভাঙানো
?
ওরে
বাবা, এখনি প্রাণধরে তা পারবে না মাজেদ। তা ছাড়া আস্ত নোটখানাই যদি রাখতে
না পারলো তো পকেটের কি কাজ ?
বসে
বসে ভাবতে থাকে মাজেদ, টাকাটা দিয়ে কোনো অদ্ভুত আর সুন্দর কাজটা করে নেবে! না, ভাঙ্গিয়ে চুরিয়ে একটি একটি পয়সা করে নয়,
একসঙ্গে বড়ো একটা কিছু।
চিরটাকাল তো পয়সা নিয়েই দোকানে গিয়েছে মাজেদ, টাকা নিয়ে দোকানে গিয়ে
দেখবে একবার !
যা তার জন্মের পর জীবনে কখনো করতে পারেনি তেমনি একটা কিছু করে নেবে। একবারের
জন্যে ইশ্বরের দেওয়া এই অগাধ ঐশ্বর্যের বিনিময়ে।
কোনটা
জন্মে কখনো করেনি ? করবার সুযোগ পেলো কখন ?
জন্মে
তো কিছুই কখনো করেনি মাজেদ । করতে পারেনি। পৃথিবীর সব কিছু থেকেই তো বঞ্চিত সে !
আচ্ছা--
বড়ো
রাস্তার ওপরকার ওই চমৎকার খাবারের দোকানটায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়
? কাচের দরজা বসানো, আর নীল আলো
জ্বলা ঘরটাকে সন্ধ্যাবেলা ঠিক বেহেস্তের মতো দেখতে লাগে, আর টেবিলের ধারে
ধারে বসে থাকা লোকগুলোকে লাগে এক-একটা রাক্ষস !
হ্যা,
ওদের খাওয়া দেখে তাই মনে হয় মাজেদের। মাজেদও তো ইচ্ছে করলে—আজই সন্ধ্যায় ওদের মতো
ওই চেয়ারে বসে রাক্ষসের মতো গোগ্রাসে গিলতে পারে জগতের সেরা সেরা সুখাদ্য !
কল্পনা
করতেই লোভে আর আবেশে হাত-পা যেন ঝিম ঝিম করে এলো মাজেদের! মনে হলো, খাবারগুলো বুঝি ওর মুখের সামনেই ঝুলে রয়েছে । কিন্তু পরক্ষণেই মনটা বদলে
গেলো। ভাবলো—দূর ! চেহারার যা হালচাল, হয়তো ওখানে
ঢুকতেই দেবে না, হয়তো বা হাতের মুঠো থেকে নোটখানা বার করতে দেখলে বলে বসবে,
অ্যাই দেখো—বেটা নিশ্চয় কারো পকেট মেরে এনেছে।
তবে
কি পোষাকের দরকারই আগে? ফর্সা কাপড়-জামা ! সত্যি, জীবনে কখনো একখানা
ফর্সা জামা পরেনি মাজেদ! আর এই হত-শ্রী ছেড়া
প্যান্ট পরেই চিরটাকাল গেলো!
তাও
কি কিনে ?
বাবুদের
বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে। কি অভাগা জীবন তার! বেশ, তাই ভালো, একটা নতুন প্যান্ট আর একটা জামা-
নাহ, ভাবতে গিয়ে তেমন রোমাঞ্চ এলো না। জীবনের পরম পাওয়ার
বিনিময়ে কিনা মাত্র একজোড়া ফর্সা কাপড় জামা ?
আর
সে-সব পরবেই বা কখন? কাজ তো এই ! রাস্তার জঞ্জাল কুড়ানো ।
সামনে
দিয়ে একটা মোটরগাড়ি চলে গেলো। মাজেদ নড়েচড়ে বসলো ।
এইতো!
এইতো পেয়ে গেছে!
ধরো একটা হাওয়াগাড়ি চেপে অনে—ক দূর
বেড়িয়ে এলে কেমন হয়? এই টাকাটা খরচ করে যতো দূর বেড়ানো যায়? ভাবতেই
বুকটা আহলাদে ধড়ফড় করে উঠলো মাজেদের! সত্যি তো, জীবনে কখনো তো হাওয়াগাড়ি চাপেনি
মাজেদ!
কাগজ
কুড়িয়ে বেড়াবার সময় গাড়িগুলো যখন গায়ের কাছ দিয়ে ছুটোছুটি করে, আর
মাজেদকে যেন নেহাৎ দয়া করেই চাপ না দিয়ে সাঁ করে এগিয়ে যায়, তখন রাগে মাথার মধ্যে আগুন জ্বলতে থাকে।
আজ
মাজেদই কেন তেমনি করে বেরিয়ে যাক না পথের লোকের নাকের সামনে দিয়ে ?
মহোৎসাহে
কথাটাকে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে লাগলো মাজেদ, আর আশ্চর্য এই, ভাবতে
ভাবতেই উৎসাহটা কেমন শিথিল হয়ে এলো!
ধুর ছাই!
মাজেদ
কি পাগল ?
হাওয়াগাড়ি
চেপে এতোগুলো টাকা হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে ? লাভ কি তাতে ?
না;
না, ওসব কিছু নয় ।
খুব
জোরালো একটা কিছু করা চাই। কিন্তু কি সেটা?
ভাবতে
ভাবতে সহসা নতুন একটা সংকল্প স্থির করে ফেলে মাজেদ।
আরে
ছি ছি, এতোক্ষণ এটা মনে পড়েনি!
এইতো
এইবার মনে পড়েছে জীবনের পরম বাসনার কথা !
একটা
ডাক্তারখানায় গিয়ে নিজেকে একবার ডাক্তার দেখাবে মাজেদ। আর ভালো ওষুধ কিনে
ফেলবে।
সত্যিকার
ওষুধ !
দামী ওষুধ! যা মাজেদ জীবনে কখনো খেয়ে
দেখেনি! যা খেয়ে এই চির রুগ্ন দেহটাকে চিরকালের
মতো চাঙ্গা করে নেওয়া যাবে। সেই স্বাস্থ্যভরা দেহ নিয়ে ভালো একটা কাজ করবে
মাজেদ। মাসের মধ্যে পাঁচ দিন জ্বরে ধূ’কে লোকসান খেতে হবে না আর। বেড়াতে হবে না জঞ্জাল কুড়িয়ে!
আহলাদে
বুকটা ডগমগ করে ওঠে মাজেদের। ভাগ্যিস
হাওয়া গাড়ি চোপে কি জামাকাপড় কিনে, কিম্বা খাবারদাবার খেয়ে টাকাটা খরচা
করে ফেলেনি সে!
তাহলে
জীবনের চরম সাধটা আর কখনো পূর্ণ হতো না! ওষুধ !
ওষুধ!
শিশি-বোতলে ভরা সত্যিকার ওযুধ। কোন ডাক্তারখানাটায় যাবে ভাবতে
ভাবতে, হঠাৎ রাস্তায় একটা সোরগোলে কল্পনার সুতোটা ছিড়ে গেলে৷৷
একদল বাচ্চা ছেলে আসছে গান গাইতে গাইতে। সামনের ছেলেটার হাতে পতাকা, গলায় ফিতে দিয়ে ঝোলানো
কাটা বাক্স।
মাজেদ
ওদের গানটা শুনতে লাগলো হা করে।
রাস্তায়
এরকম কতো দেখেছে মাজেদ,
শুনেছে কতো গান আর শ্লোগান, এমন মন দিয়ে কোনোদিন শোনেনি। শোনেনি
সময় পায়নি বলেই। ওর মন থেকেছে তখন—ওরা কোনো ছাপানো কাগজ বিলোচ্ছে কি না
দেখতে। বিলোবার সঙ্গে সঙ্গেই তো লোকে মুচড়ে ফেলে দিয়ে চলে
যায়। কিন্তু আজ একটু আগেই অর্ধেক রাজত্ব কুড়িয়ে পেয়েছে মাজেদ, তাই
সেই দীনহীন মনোভাব এখন নেই,
তাই গানের কথাগুলো কানে ঢোকে ।
ওরা গেয়ে চলেছে--
অন্ন
দাও গো-অন্ন দাও গো ভাই।
তোমাদেরই
মুখ চেয়ে আছি মোরা
আমাদের
কিছু নাই।
আমরা
অভাগা দুঃখী
এতিম অনাথ ছেলে,
বাচবো আমরা খোদার
দয়া
পেলে।
................................................
মুখস্থ
গানের বুলি, তারস্বরে আওড়াতে আওড়াতে চলে যাচ্ছে, তবু পথচারীদের হাত থেকে দু’-চারটে
পয়সা পড়ছে ওদের কাটা বাক্সয়। মাজেদ বিফলের মতো তাকিয়ে থাকে।
সত্যি, এও তো জীবনে কখনো করতে পারেনি মাজেদ, হাত
তুলে কাউকে কিছু দেওয়া। কখনো ভালো না খাক, তবু খেয়েছে, ভালো না পরুক,
কিন্তু ও পরেছে, হাওয়াগাড়ি না হোক ট্রামগাড়ি ও চেপেছে, দামি ওষুধ না কিনতে
পারুক, কমদামী
ওষুধ সে কিনেছে। কিন্তু
না, হাত তুলে তো কখনো কাউকে কিছু দিতে পারেনি এতো বড়ো জীবনটায়। আর দিতেই যদি
হয়, এদের থেকে উপযুক্ত পাত্র আর কোথায় পাবে?
লেখাপড়া
শেখেনি মাজেদ ; কিন্তু ‘অভাগা’ ‘অনাথ’ ‘দুঃখী’‘গরিব’এ কথাগুলোর মানে বুঝতে
পারছে বৈকি।
ঘাম ঘাম
মুঠোটা খুলে নোটটাকে দু’আঙুলে ধরে কাটা
বাক্সধারী ছেলেটার দিকে এগিয়ে যায় মাজেদ। কাটার খাজে গলিয়ে দিতে অসুবিধে হবে না, ছোট্ট করে ভাজ করাই আছে।
মূলঃ
ছোটদের ভালো ভালো গল্প - আশাপূর্ণা দেবী
এডিটঃ মারুফ মাহমুদ
No comments:
Post a Comment