বড় গল্প,কিছু না, আশাপুর্ণা দেবী,Kichu na,Ashapurna devi,Boro golpo |
বড় গল্প - "কিছু না" - আশাপুর্ণা দেবী - Kichu na - Ashapurna devi - Boro golpo
একেবারে
সকাল বেলা, আজকে আয়েশাই আগে ঘুম থেকে উঠেছিলো। মাত্র দুটো কি তিনটে কাক ডেকেছে
তখন, আর আকাশটা ঠিক সিঁদুরে আমের মতো দেখতে হয়েছে। উঠেই দরজার পিঠের শেষ দাগটা মুছে ফেলবার জন্যে হাত নিসপিস করছিলো তার।
অনেক কষ্টে লোভ সামলে আছে বেচারা। না
সামলে উপায় কি, আজকের দাগটা যে ভাইয়ার ভাগের । ভাইয়া উঠে যদি দেখে আয়েশা তার ভাগের দাগটা মুছে বসে আছে, তাহলে আয়েশার নামটাই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে চাইবে কিনা সাজিদ, কে জানে!
অতএব
লোভ সামলানো ছাড়া আর কি করা যায়? অবশ্যি লোভ সামলে আছে বলেই কি আর চুপ করে বসে রয়েছে আয়েশা?
উহ!
মোটেই তা নয় ।
উঠে
বসা পর্যন্তই ভাইকে ওঠাবার জন্যে উঠে পড়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু সাজিদ বরাবরই
একটু ঘুম কাতুরে, আয়েশার খোচানিতে কেবলই উহ
শব্দ করে পাশ ফিরছিলো।
অবশেষে
আয়েশা তার আসল অস্র নিক্ষেপ করলো, আর যদি দেরি করিস ভাইয়া, ভালো হবে না কিন্তু দাগ
মুছে দেবো। এতোক্ষণে সাজিদ উঠে বসলো।
একেবারে রেগে কাই হয়েই বললো, দাগ মুছে দিবি? আব্দার পেয়েছিস? আজ কার দিন? আয়েশার রাগ হয়েছে, সেও ঝোঁকে উঠে বলে, তা তুই
উঠছিস না কেন?
এই
তো উঠলাম, এই তো মুছলাম, বলে সাজিদ এক সেকেণ্ডের মধ্যে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘরের একটা কপাট বন্ধ করে দরজার কপাটের সেই শেষ
দাগটা মুছে । যেটার জন্যে এতোক্ষণ হাত নিসপিস
করছিলো আয়েশার।
দাগগুলো
হচ্ছে মামার বাড়ি যাওয়ার দাগ। যেদিন প্রথম মামার বাড়ি যাওয়ার কথা উঠেছে, সেদিনকে দরজার
পিঠে খড়ি দিয়ে দাগ কেটে রেখেছে সাজিদ-আয়েশা। মা বলেছিলো, যাবার আর সাতদিন আছে। তাই গুনে গুনে সাতটা দাগ দিয়েছিলো
ওরা। সঙ্গে সঙ্গে আইনও জারি করে ফেলেছিলো। পালা করে দাগ মুছবে দু’জনে, আজ সাজিদ তো–কাল আয়েশা। দাগ মুছে ফের বসে পড়ে
হাই তুললো সাজিদ, অগত্যা আয়েশাও
হাই তুললো। তাই নিয়ম কি না?
তারপর দুখু দুখু গলায় বললো, তোর বেশ মজা ভাইয়া, ফাষ্ট দাগটাও তোর। লাস্ট
দাগটাও তোর।
সাজিদ
আত্মগর্বের হাসি হাসলো, হুম, কেমন চালাকিটি খেলেছি!
তুই
সব সময়েই জিতে যাস। দুখু মুখে বললো আয়েশা। জিতবোই তো, আমি বড়ো না?
বললো সাজিদ। আয়েশা আর তর্কের দিকে গেলোনা, তক্ষুনি হাসি হাসি
চোখে বললো, তোর কি মনে হচ্ছে রে ভাইয়া?
কী
আবার মনে হবে ?
আহা, যাওয়ার কথা বলছি। মনে হচ্ছে না যে এক্ষুনি
বিকেল হয়ে যাক?
তা
তো হচ্ছেই। কিন্তু দেখিস তুই, ঘড়িটা আজ কি রকম শত্তুরতা করবে। ঠিক দু'-তিন ঘন্টা পর পর একবার বাজবে।
ই-স,
কী দুষ্টু রে! কেন অমন করে
বলতো ভাইয়া ?
কেন
আর! সাজিদ দার্শনিক দার্শনিক গলায় বলে, যা দেখছে তাই শিখবে তো? দেখছে
বাড়িসুদ্ধ সক্কলের তাল শুধু
আমাদের জব্দ করা, তাই-ই শিখছে।
মামার
বাড়িতে কিন্তু এ রকম না, না রে ভাইয়া?
বাঃ,
মামার বাড়িতে এ রকম হবে কি করে? সাজিদ বোনকে থামিয়ে দেয়, ঢেঁকির মতো কথা বলিস কেন? অভিধানে কি সব লেখা আছে ?
অভিধানে
কি লেখা আছে অথবা কি লেখা থাকে, তা আয়েশার জানা নেই, তবে চট করে হার মানাও তো চলে না, তাই বলে,
হ্যা, সেই সব তো কতো কি-ই লেখা আছে।
খুব
বিদ্যে প্রকাশ
করেছিস..থাক। লেখা আছে না, মামার বাড়ির আদর, মামার বাড়ির আব্দার।
সে
তো আছেই জানিনা, না কি ?
ছাই
জানিস। সব আমার কাছে শিখে নিয়ে নিয়ে বলিস।
তা
তুই ছোটোকাকার কাছে অঙ্ক শিখে নিস না?
আয়েশা ঝুমরো চুলগুলো এক
ঝটকায় মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে, বড়োদের কাছেই সব শিখতে হয় ।
সাজিদ নিশ্বাস ফেলে বলে, অথচ দেখ, বড়োরা কী বিচ্ছিরি। ইস ভাইয়া, কী বললি
? মাও তো বড়ো, মা বিচ্ছিরি ?
সাজিদ অপ্রতিভ ভাবটা ঢাকতে চোখ দুটো সাংঘাতিক
রকমের গোল করে, মা’র কথা বলেছি আমি? মা তো আমাদের দলে। চাচীমা ? ফুপুআম্মা? ফুপুআম্মাই সবচেয়ে----- কাল আবার বলছিলো কি জানিস, এবার তো দীর্ঘকালের মতন
মামার বাড়ি চললে, যাও থাকোগে, সুখ করোগে। শুনছি নাকি মামার
অনেক পয়সা হয়েছে, সব ভোল পাল্টে গেছে । শুনলে এতে রাগ ধরে। আয়েশা
বোকামি ধরা পড়বার ভয়ে তুচ্ছ করেও বলে ফেলে, দীর্ঘকাল না কি যেন বললি
রে ভাইয়া, ওর মানে কি ?
ওর
মানে? দীর্ঘকাল মানে? হঠাৎ হো হো করে বেদম হাসতে থাকে সাজিদ, হেসে হেসে আয়েশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে
বলে, দীর্ঘকাল মানেও জানিস না? কী বোকারে? মানে হচ্ছে, অনেক
কাল। বেশিদিন থাকবো কি না এবার?
অনেক
বেশিদিন? কতো দিনরে ভাইয়া?
আয়েশার
মুখটা জ্বল জ্বল করে ওঠে ।
অনেকদিন
মানে আর কি, বেশিদিন। নাহ, তুই বড্ড বোকা।
আর
ওই ভোল পাল্টা না কি বললি, তার
মানে ?
তার
মানে? সাজিদ নিতান্ত অবজ্ঞার
সঙ্গে বল, সব কথার মানে জেনে কি মহারানী হবে তুমি ? আর বড়োদের সব কথার
মানে থাকে নাকি ? যতো সব বাজে কথা বলার ওস্তাদ! এই যে
ঠাকুরমা বলে, রাত দিন খেটে খেটে হাড় কালি হলো আমার—এ কথার
মানে আছে কিছু? ছালের তলায় মাংস, মাংসের তলায় হাড়, সে হাড় কালি হবে
কি করে রে? তাহলেই বোঝ, বড়োদের কথার মাথামুন্ডু থাকে কি না। যাকগে বাবা, আসল
কাজের কথা কিছু হচ্ছে না, খালি পচা কথা। তুইও যেমনি----আয়েশা অবাক দৃষ্টিতে বলে, আসল কাজের কথা
কিসের রে ভাইয়া ?
সাজিদ
চোখে-মুখে একটি ঘোরালো রহস্যরোমাঞ্চের আভাস
এনে বলে, তোকে বললেই তো সবাইকে বলে বেড়াবি।
কখখনো না, এই বইয়ে হাত দিয়ে বলছি রে ভাইয়া,
কাউকে বলবে না— ।
এই, আবার কসম করছিস ?
আচ্ছা আচ্ছা
বাবা, করবো না। বল না কাজের কথা!
মামার
বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে আমি এাইসা একটা জিনিস জোগাড় করেছি —
নিয়ে
যাবার জন্যে! ওমা! মা তো বলেছিলো, মাজেদ কাকুর সন্দেশ নিয়ে যাবে। মায়েদের তো শুধু ওই খালি খাওয়াবার চিন্তা। আমি
যা নিয়ে যাবো, হুঃ বাবা !
তুই
খালি খালি সব কথা অমন দেরি করে করে কষ্ট দিয়ে বলিস কেন ভাইয়া? তাড়িতাড়ি বল না।
তাড়াতাড়ি
বললে তুই মানে বুঝতে পারবি? বলেই হঠাৎ খুব দ্রুত তালে বলে, মামার বাড়ির
বাগানে ফুল গাছ পুততে বিচি জোগাড় করেছি। পারলি
বুঝতে ?
আয়েশা
হতাশ হয়ে বলে, অতো তাড়াতাড়ি ?
হু
বাবা! এও পারবো না, সেও পারবো না। শোন তাহলে, জায়েদ আমাকে এক রকম গাছের বিচি দিয়েছে, পুতলে তিন দিনে গাছ,
সাত দিনে ফুল। মামার বাড়ি গিয়েই বাগানে পুতে দেবো।
আয়েশা
ঈষৎ ভয়ে ভয়ে বলে, বাগান কোনটা রে ?
বাগান
কোনটা ? বাঃ চমৎকার! রান্নাঘরের পেছনটা ভুলেই গেলি ?
ওঃ, আয়েশা ঢোক গিলে বলে, তা ওখানে যে ভুষণ্ডী বুড়ি গাদা গাদা উনুনের ছাই ফেলে !
সেই
জন্যেই তো—সাজিদ যুদ্ধ বিজয়ীর গর্ব
নিয়ে বলে, ও খানটাই পছন্দ করেছি। জায়েদ বলেছে, ছাই-গাদায় পুতলে দুদিনেও গাছ বেরোতে পারে। আর ফুল যা হবে
ইয়া—বড়ো—বড়ো-
কী
ফুল রে ভাইয়া ?
ইস,
অমনি জেনে নেওয়া হচ্ছে! বলবো কেন ?
বল
না ভাইয়া, তোর দু’টি পায়ে পড়ি।
কাউকে
বলবি না, বল?
বলছি
তো বলবে না, আর কতো খাটাবি ?
সাজিদ মুখটাকে আয়েশার
ঘাড়ের কাছে এনে প্রায় কান কামড়ানোর ভঙ্গীতে সেই গোপন কথাটি উচ্চারণ
করে। আয়েশা চমকে উঠে বলে সত্যি!
ব্যস, এখনি অবিশ্বাস! সাধে কি আর বলি না ?
না
রে ভাইয়া, অবিশ্বাস করছি না, শুধু
আশ্চর্য হচ্ছি। উফ,
কী মজা হবে ভাইয়া তাহলে? নানুতো তো দেখে আশ্চর্যের আশ্চর্য!
কেন
নয়? মেজোমামি, সেজোমামি, মামারা আর বড়ো খালা ঢাকা থেকে এসে----
মা-ও!
আয়েশা
জোরে জোরে হাততালি দিয়ে ওঠে। ঠিক তো, মা’ও তো। ভাইয়া, আমার ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি বিকেল হয়ে যাক।
দীর্ঘনিশ্বাস! একটুক্ষণ
নীরবতা। আবার আয়েশাই নীরবতা ভঙ্গ করে। মামার বাড়িটা কি সুন্দর পুরোনো
পুরোনো ভাইয়া ?
ওই
জত্যেই তো, সাজিদ বলে, অতো চমৎকার!
দেয়ালগুলো
কেমন একটু একটু ইট—একটু একটু সাদা ?
সেই
তো! ঠিক C. L. T-র বাড়িটার মতন। আবার ইটগুলোর ফাক থেকে কেমন লাল লাল গুড়ো পড়ে।
ওমা,
তুইও দেখেছিস ভাইয়া? একদিন মায়ের চুলের
কাটা নিয়ে খুড়ে খুড়ে বার করে আমি না—হি-হি-হি–একটুখানি খেয়ে না---
খেয়েছিলি
তুই? ই-স!
না ভাইয়া, সত্যি বলছি বেশ মজার--নোনতা নোনতা খেতে।
সাজিদ উৎসাহ গোপন রেখে
উদাস উদাস গলায় বলে, আচ্ছা বেশ! এবার না হয় খেয়ে দেখা যাবে। কিন্তু
ওসব ছাইপাশ খেয়ে পেট ভরালে পেয়ারা গাছের পেয়ারা গুলো কে খাবে শুনি?
আহা! আমি কি পেট ভরাতে বলেছি? পেয়ারার সঙ্গে
নুনের বদলে তো খাওয়া যায় ?
তা
অবশ্যি--
কিন্তু ভাইয়া! আয়েশা মুখখানাকে দাদীর প্যাটার্ণে বুলিয়ে গম্ভীর করে
বলে, পেয়ারা পাড়বি কি করে? ছাতের আলসে ভেঙে গেছে বলে ছোটোখালা যে খালি খালি ছাদে যেতে বারণ করে। আর
ঠিক্ ভাঙা দিকেই তো গাছটা
।
পেয়ারা
পেড়ে পেড়েই তো ভেঙেছে ছোটো মামারা।
সাজিদ
হেসে হেসে ফিস ফিস করে বলে, ছোটো খালা বারণ করে বলে আমরা যেন যাই না। বারণ করে বলেই তো
আরো মজা। ইস্ ভাইয়া, ঠিক বলেছিস। এই জন্যেই তো তোকে এতো ভালোবাসি।
আমারও তাঁই। সেই যখন দুপুর বেলা দিদা ঘুমিয়ে পড়েন, মেজোমামি, সেজোমামি
গল্পর বই নিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে শোয়, মা আর ছোটো খালা রাজ্যের গল্প শুরু করে, তখন চুপি চুপি ছাদে উঠতে কী ওরকম ভয় ভয় করা
ভালো লাগে ?
মামার
বাড়ির সিড়িটা কী মজার সরু আর কী চমৎকার অন্ধকার !
আর
ঠিক সুড়ঙ্গের মতন, দু'দিকে কেমন উঁচু উচু কালো দেওয়াল ৷
আর
কী অদ্ভুত মিষ্টি মতন চামচিকে চামচিকে গন্ধ!
আর
ধাপগুলোর মাঝখানটা কেমন নৌকোর মতন
উঁচু-নিচু !
মামার
বাড়ির সি'ড়িটাই সবচেয়ে ভালো। দু'জনে একসঙ্গে সায় দেয়।
কিন্তু
কোনটাই বা ভালো নয় ? মেঝেগুলো খাবলে খাবলে উঠে গিয়ে আপনি আপনি যে গাব্বুগুলো তৈরি হয়েছে? জানলার শিক ভেঙে
যাওয়ার জন্যে যেখানে তাঁর জড়িয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে ?
কোনটা ফেলে কোনটা বলবে ?
মামাবাড়ি
সম্পর্কে আলোচনাটা আরো কতোক্ষণ চলতো বলা শক্ত, কিন্তু ব্যাঘাত হানলেন
এসে ফুপু
আম্মা,
কীরে, তোরা এখনো দুটোতে বসে বসে হাই তুলছিস, দুধ-টুধ খেতে হবে না?
হাই
তোলা আবার কী? আয়েশা বলে উঠলো, আমরা তো সেই কখন থেকে উঠে মামার বাড়ির গল্প
করছি। কথাটা বলবার সময়ে ভাইয়া যে তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানলো, সেটা আর
বেচারা বুঝতে পারলো না। আয়েশা বেচারা ভাইয়ার থেকে মাত্র আড়াই বছরের ছোটো
হয়েও অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু সাজিদ পারে। যেন এইমাত্র পারলো,
আয়েশার ওই বোকার মতো কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফুপু আম্মা নাক বাঁকালেন। হলোও তাই। ফুপু
আম্মা বলে উঠলেন, সালাম বাবা তোমাদের, আজই যাচ্ছো মামারবাড়ি, তবু তার গল্প চলছে। এসে না জানি আরো কতো হবে।
এবার
তো আরোই হবে। কি করে আদর-যত্ব করে মামিরা, তা তো জানিনা। বাড়িতে এতো ঐশ্বর্য, এতো আদর, তবু মন ওঠে না গো!
বাড়িতে
আদর ? সাজিদ আর থাকতে পারে না, ফেটে পড়ে, বাড়িতে তো খালি বকুনি! যাও, আজও দুধ খাবো না।
বেশ, না খাবি। মামাদের কালো গরুর দুধ খা গিয়ে যা পাঁচ সের করে।
পাঁচ
সের করে! হি-হি করে হেসে ফেলে
আয়েশা, তোমার মতন মুস্কো রঘু নাকি আমরা ?
কী
বললি! আমি মুস্কো রঘু? তা বলবি বৈকি!
বলে ফুপু আম্মা দুম দাম পা ফেলে চলে যান।
ওরা
এবার মুখ ধোবার জন্যে প্রস্তুত হয়, তবু
কি গল্পের বিরাম আছে? মামার বাড়িতে কেমন মসজিদের ওপর তুলসী গাছ আছেরে, আর মামার বাড়ির
গোয়ালের পিছনের পাতকুয়োটা কী সুন্দর ?
কিন্তু
বেশিক্ষণ দেরি হয় না, কাকা এসে দু'জনের দু'টি কান ধরেছেন, এই বাদররা, কী বলেছিস তোদের ফুপু আম্মাকে ?
কি
বলেছে, কিংবা কিছুই বলেছে কিনা,
অথবা আজ ওরা আদৌ ফুপু আম্মাকে চোখেই দেখেছে কিনা, একেবারে মনে পড়ে না, তাই
মুখ লাল করে ছাড়াবার চেষ্টা করে।
কিন্তু
কাকা নাছোড়, বল, কি বলেছিস ! বল্ শীগগির !
শেষ
পর্যন্ত তাদের
দাদীমা তাদের
ছাড়িয়ে দেন কাকার হাত থেকে, আহা, আজ ওরা বাড়ি থেকে যাত্র৷ করছে, কেন
মারধোর করছিস ?
ওঃ,
মামাবাড়ি যাবেন তো রাজ্যপদ পেয়েছেন! বলে কাকা রাগ করে চলে যান।
এরপর
মা এসেও খানিকটা বকাবকি করেন, কী
অসভ্য ছেলে মেয়ে হচ্ছো তোমরা। ফুপু আম্মা তোমাদের গুরুজন, ওসব কী কথা বলেছো! যাচ্ছি তো নিয়ে, কী যে তোমরা করবে
গিয়ে!
আহা!
যেন মামাবাঁড়ি গিয়েও ওরা গুরুজনকে কিছু বলবে।
যেন
"এর আগে কখনো সেখানে যায়নি ওরা!
যেন সেখানের সব্বাই বলে কী সভ্য লক্ষী ছেলে-মেয়ে! সারাদিন আস্তে আস্তে দু'ভাই-বোনে ওই কথা ।
বিকেলের
দিকে আরো উদ্দাম হয়ে ওঠে আলোচনা! যদিও দেখে কিছু বোঝা যায় না যে ওর মধ্যে সেই
অতি আশ্চর্য আকাশ কুসুমের গাছ লুকোনে৷ আছে কিন! দেখতে ঠিক আশ ফলের বিচির
মতো গোল গোল কালো লাগছে, কিন্তু জায়েদ তো জানে, ওটা আকাশ কুসুমের বীজ। জায়েদের যে
নিজের প্রত্যক্ষ দেখা! আর তিনটে দিন পরে সাজিদরাও নিজের চোখে প্রত্যক্ষ
দেখবে। তারপর, সাতদিনের মধ্যে ?
ফুল
আর ফুল !
আর
মামার বাড়ির পুরোনো-ঝি ওই ভুষুণ্ডি বুড়িটাকে ওরা দুচোখে দেখতে পারে না, কিন্তু আজ তাকে ভক্তি করতে ইচ্ছে
হচ্ছে। ভাগ্যিস ওই রান্না ঘরের পিছনের মাটি জায়গায় রোজ ছাই ফেলে!
তাই
না এইটি সম্ভব হচ্ছে?
আবার
এক সময় ধমক বাবার কাছে, সারাদিন দু'ভাই-বোনে কিসের এতো ষড়যন্ত্র হচ্ছে ?
পড়ার বই-টই কিছু সঙ্গে নিচ্ছে৷? নাকি সে সব ভুল?
বাঃ, ভুল কেন হবে? একটা ট্রাঙ্ক ভতি করে
শুধু বই খাতাই তো নিয়েছি। তিনদিন আগে থেকেই তো পড়ালেখা বন্ধ করে তুলে ফেলেছি। যাতে না
ভুল হয়ে যায়। দেখাতে হবে না সবাইকে ?
কিন্তু এতো কথা কি বাবাকে বলা যায়? তাই
তখনকার মতন চুপ ।
আবার
গাড়িতে।
ফিস
ফিস শব্দে গাড়ি মুখর ।
মামাবাড়ির
নামটাও কি সুন্দর রে ভাইয়া, আলমবাজার! একমিনিটে বলা হয়ে যায়, আর আমাদের? রাজা বসম্ত রায় রোড !
বাব্বাঃ।
বলতে মুখ ব্যথা হয়ে যায়।
এবার
ধমক দেন মা, থাম তো তোরা । দুরন্ত ট্যাক্সিতে চড়েছে তাও চুপ নেই, খালি বক্
বক্!
মেজোমামা,
যিনি নিতে এসেছিলেন, তিনি হেসে বলেন, আহা করুক না, তাতে আমাদের বকবকানির কিছু
ব্যাঘাত হয়েছে?
মা
হেসে ওঠেন ।
এতোক্ষণে
হু'শ হয় সাজিদ-আয়েশার, তারাও তবে বক্ বক্ করছিলেন?
কি আশ্চর্য! কিছুই শুনতে পায়নি তো! এবার পায় অবশ্য ।
মা
বলছেন, সাজিদ-আয়েশা একেবারে হা হয়ে যাবে, কি বলো ভাইজান।
মেজোমামা
বলছেন, সেই জন্যেই তো! আগে থেকে কিছু বলিনি ।
কিন্তু
যাই বলো ভাইজান, ওই কয়লার ব্যবসাতেই
তোমার লাভ।
হেসে
ওঠে আয়েশা খুক্ খুক্ করে, মার যেমন কথা! কয়লা আবার লাভ! তারপর সেই কয়লা নিয়ে কি যে সব কথা ওরা বলে, কিছু
যদি বোঝা যায়। ভাইয়া ঠিকই বলে, বড়োদের
সব কথার মানে থাকে না। তার চাইতে অনেক ভালো রাস্তা দেখা। এই তো কখন
ছেড়ে গেছে মৌলালি-এই তো এসে গেলে শ্যামবাজার---তারপর ওই তো সেই বড়ো
গম্বুজওলা মসজিদটা, ওই তো লম্বা মতন
বিচ্ছিরি আর একটা বাড়ি!'--আরে আরে এই তো, এই তো
এসে গেলো তো! এইবার সেই শিউলিগাছটা, ব্যস তারপরেই-কিন্তু
একি, এখানে কী! শিউলিগাছটা না আসতেই গাড়িটা ঘটাং করে থেমে গেলো কেন? আর
মেজোমামা ট্যাক্সির মিটার দেখতে দেখতে হাসি হাসি মুখে বললেন, কেন, এই এসে
গেলো তোমার মামার বাড়ি। নেমে পড়ো এবার। কি, পছন্দ হয়েছে তো ?
মেজোমামা
কি নিজের বাড়িই গুলিয়ে ফেললেন ? কাদের বাড়িতে এনে ফেললেন ?
কিন্তু
মা? মা এই ভুল বাড়িটাতে এসে আহলাদে একেবারেই আটখানা হচ্ছেন কেন?
সেই
দরজায় শিউলিগাছ দেওয়া! বালির মতন ঝুরি ঝুরি কাঠের গুঁড়ো-ঝরা কালো চক্চকে
ঝক্ঝকে নতুন বাড়ির সামনে এনে ফেলেছে ট্যাক্সি ড্রাইভার, আর মেজোমামা ভুলো-মন
হয়ে বলছেন, এসে পড়েছি, এটা কি মাও খেয়াল করছেন না ? মানে কি এর। মানে বুঝতে পারছে না এরা। সাজিদ আর আয়েশা। কিছু বুঝতে
পারছে না ।
লাল
টুকটুকে পালিস মতন মেঝেওয়ালা এই বাড়িটার মধ্যেই তো মেজোমামি, সেজোমামি, সেজোমামা সব্বাই !
ওদের
দেখে তারা বেরিয়ে এলো হৈ হৈ করে। সাজিদ, তুই যে এই ক'মাসেই বেড়ে লম্বা হয়ে গেছিস । আয়েশা, তুই লম্বা হসনি যে ?
সাজিদ-আয়েশা দু, ভাই-বোন কি সিনেমার ছবির মানুষ হয়ে
গেছে? হাঁটছে, নড়ছে, অথচ নিজেরা কিছু বুঝতে পারছে না !
কিন্তু
শেষ পর্যন্ত তো বুঝতেই হলো !
ঠিক
তাদের রাজা বসম্ত রায় রোডের
বাড়ির মতন রেলিং দেওয়া বিচ্ছিরি আলো-আলো সিড়ি দিয়ে নানী নেমে এলেন থপ থপ করে।
আর
এসেই ফোক্লা মুখে একগাল হেসে বলে উঠলেন, কি ভাইয়ামণি, মামাবাড়ি পসন্দ হয়েছে ? মামারা সেই আদীকালের পাকাবাড়ি ভেঙে কেমন নয়া এমারত বানিয়েছে! ভোল একেবারে পাল্টে ফেলেছে।
ভোল
পাল্টানো। এর নাম ভোল পাল্টানো?
এতোক্ষণে
কথাটার রহস্য পানির মতন পরিষ্কার হয়ে যায় সাজিদ আর আয়েশার কাছে। একটা সুন্দর জিনিসকে বিচ্ছিরি করার
নামই তবে ভোল পাল্টানো।
চোখ
দিয়ে কেমন যেন গরম গরম জল উপছে উঠছে, মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থেকে
কোনোরকমে লজ্জা নিবারণ করে।
নানী ততোক্ষণে মেয়ের সঙ্গে কথা জুড়েছেন, সব
ঘুরেফিরে দেখবি চল না উষা, কোথাও আর সেই ভাঙাপচার চিহ্ন পর্যন্ত নেই৷
ঘর
তুলছে কোথায় ? মেজভাইয়া বলছিলো ছু'খানা
নাকি ঘর ? ওই রান্নাঘরের পেছনের পড়ো জমিটুকুতে। পাঁশগাদা হয়ে পড়েছিলো, তার নিচে দিব্যি দু'খানা ঘর হয়েছে। তোরা ছেলেপুলে
নিয়ে
আসিস, শোবার জন্যে, নিচেরটা--ওমা, একি উষা, তোর ছেলে পকেট থেকে কি একমুঠো বের করে আকাশে ছুঁড়ে মারছে !
মা
চোখ পাকিয়ে বললেন, কি অসভ্যতা হচ্ছে সাজিদ, কি ও? কি ফেলছিলে ?
সাজিদ
আরো চোখ পাকিয়ে বলে, কিচ্ছু না।
No comments:
Post a Comment