বাংলা ছোট গল্প, ছোটদের গল্প,Bangla short story,valobasar golpo,জীবনের গল্প,Bangla choto golpo,আশাপূর্ণা দেবী,Ashapurna devi |
বাংলা ছোট গল্প - চোরের আবার ভূতের ভয় - আশাপূর্ণা দেবী - Chorer abar vuter voy - Bangla choto golpo - Ashapurna devi
নাঃ, ব্যবসা-ট্যবসা আর চলবে
না— হারু বলল তার বন্ধু
গদাইকে লোকেরা বেজায়
চালাক হয়ে গেছে,
সহজে
আর অসাবধান হয় না তারা।
যা
বলেছিস ভাই— গদাই নিশ্বাস
ফেলে বলে— তুই তো এক
পুরুষে সিদেল চোর, আমরা বাপ-চাচার
আমল থেকে তিন-পুরুষে এই কাজ করে আসছি।
কিন্তু ব্যবসা এমন কানা পড়ে যায়নি কখনো। দেখ না কেন সেকালের
বাড়িগুলোর দেয়াল তৈরি হতো ইট-চুন-সুরকি দিয়ে, তাতে সিঁদ চালানো চলতো। দু’হাত পুরু দেয়াল অক্লেশে এফোঁড়-ওফোঁড় করেছি। আর এখন? এখনকার
দেয়ালগুলো যেন বজ্জর! কাটে কার সাধ্য!
কংক্রিটের
কিনা! বললো হারু।
আরে
বাবা, সে তো আমিও জানি— গদাই রেগে উঠে
বলে, কথা হচ্ছে
পেটেপিঠে যে কংক্রিট হয়ে যাচ্ছে,
তার
কি হয়?
কি
আর-হারু উদাসভাবে বলে— শ্রেফ ছোলামটর! আমি তো আজ ছদিন শুধু
ঝাল-ছোলা খেয়ে আছি।
আর
আমিই যেন কালিয়া পোলাও
খাচ্ছি। গদাই ঝাঁজিয়ে ওঠে।
আহা
রাগারাগির দরকার কি--হারু বলে;-আমি বলি কি—শহর ছাড়িয়ে একটু
এদিক ওদিক দেখলে হয় না।
কেন, শহর ছাড়িয়ে
কেন! এদিক-ওদিকের লোকের খুব পয়সা আছে বুঝি? না কি তারা
আমাদের জন্যে রাতে দরজা খুলে রাখে ?
গদাই
বরাবরই একটু রোখা, আর হারুর অবশ্য একটু ঠাণ্ডা
মেজাজ।
বহুদিন
থেকে দু’জনে একত্রে
যুক্তি-পরামর্শ করে ‘জগতের সেরা ব্যবসাটি
চালিয়ে আসছে। কিন্তু ইদানীং ব্যবসা বড়োই মন্দ। এখন বড়োলোকের বাড়ির দেয়ালা-টেয়ালগুলো
সব কংক্রিটের,
উঠোনের পাঁচিলগুলো দু'মানুষ সমান উচু, তাও একটু কোথাও ফাঁকা থাকলো তো কাঁচের টুকরো পুতেছে, তারের জাল ঘিরছে, আরো কতো কি! কোন্ ফাঁক দিয়ে তবে
চুরির-কাজটা সেরে নেয় এরা?
বেচারাদের
ওইটাই তো জীবিকা?
হাসছো? আহা চোররা কি
মানুষ নয়?
খাবে
না ওরা?
হারু
বললো— তা বলছি না, তবে ওসব দিকে
বাড়ি গুলো পুরোনো টুরোনো, সিঁদকাঠিতে কাজ
হতে পারে। গদাই মুখখানা সিটিয়ে বলে, কাজ আর ছাই হবে।
চল দেখি, আজ পুল পেরিয়ে
চেওলার ওদিকে চলে যাই।
কিছু
সন্ধানে আসে নাকি?
হারু
বলে মহোৎসাহে ।
গদাই
ভারি মুখে বলে,
সন্ধান
টন্ধান কিছু নয়,
তবে
বলছিলো রেমোটা ওখানে
নাকি----
হারু
বলে, বাহ, রেমো সন্ধান
দিচ্ছে ? তা সে নিজে কেন চেষ্টা করছে না ?
সে? তাকে জেল থেকে
এসে অবধি এখন রোজ রাত্তিরে থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
হারু
একটা বিরাট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
তা
হবে বৈ কি! আমরা বেচারারা গরিব চোর কি না? আর এই রাজ্য
জুড়ে যে কতো চুরির কারবার
চলছে—তার লেখাজোখা আছে? কি করে বুদ্ধি খাটিয়ে চুরিটি
করবে এই চিন্তায় যতো বুদ্ধিমান মাথা খাটাচ্ছে, তাতে কোনো দোষ নেই, কেমন? তারা যে বড়োলোক
চোর!
গদাই
ফের রেগে ওঠে--আরে বাবা রাখ,
তোর
বড়ো বড়ো কথা! কতো রাত্তিরে
বেরোবি, তাই বল।
হারু
বলে, যেমন বেরোই, রাত একটা-দেড়টা
।
আচ্ছা।
রাত
দেড়টা নাগাদ চেংলার পুলের ওদিকে দুই বন্ধু মিলিত হলো। যথারীতি পরনে
একটা ছোটো হাফ প্যান্ট,
সর্বাঙ্গে
আষ্টেপৃষ্ঠে তেল মাখা, মুখে ভূষোর কালি
ঘষা।
ঈশ্বরের
নাম স্মরণ করে দু’জনে বেরিয়ে
পড়লো গভীর অন্ধকারে। আজকে ওদের ভাগ্য
সুপ্রসন্ন! হঠাৎ দেখলো — একটা পুরোনো কিন্তু বেশ বড়ো
বাড়ির খিড়কির দরজাটা খোলা পড়ে রয়েছে।
পরমেশ্বরের
জয় হোক বললো হারু
ফিসফিস করে—মনে হচ্ছে, তিনি আজ মুখ তুলে
চাইবেন।
গদাই
বলে, চুপ! টু শব্দটি
নয়।
মস্ত
বড়ো বাড়িটা-— কতো ঘর দরজা দালান, সব ঘুট ঘুট করছে অন্ধকারে। আস্তে আস্তে, দু’জনে সুড়ুত করে খোলা দরজা
দিয়ে দালানে ঢুকে পড়ে!
দালান থেকে ঘরে! আশ্চর্য! আশ্চর্য! পর পর। সমস্ত দরজাগুলোই খোলা। এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড জীবনে কখনো
দেখেনি ওরা ! স্বয়ং ঈশ্বর কি হারু
গদাইয়ের দুঃখে বিগলিত
হয়ে একে একে সব কপাট
খুলে রেখেছেন ?
তাহলে
ভাগ্যের কপাটও খুলে যাবে নাকি
এবার ?
হারু
বাতাসে পাতা নড়ার মতো ফিসফিসিয়ে বলে, কী রে গদা, হানা-বাড়ি-টাড়ি
নয় তো ? আমার কিন্তু
কেমন ভয় করছে।
থাম
হেরো, গদাই বলে, চোরের আবার
ভূতের ভয়! আমার বিশ্বাস, যে বেটা দোর
বন্ধ করে, সে দৈবাৎ ভুলে
গেছে—
গদাই
কথাটা শেষ না করতেই হারু চমকে উঠে বলে, এই! কিসের শব্দ রে?
শুনে
গদাইও চমকায়। সত্যিই কিসের শব্দ— হু, হু, চি, চি।
মানুষের না জীন-ভূত-প্রেত-পেত্নী-শাকচুন্নীর?
কান
খাড়া করে শুনতে লাগলো ওরা!
নাঃ, মানুষের
ব্যাপারই বটে!
অন্ধকার ঘুটঘুটে এই বাড়িখানার
কোন এক কোণের দিকের
একটা ঘর থেকে খুব রুগ্ন-মানুষের চি চি গলার আওয়াজ ভেসে আসছে, কার পায়ের শব্দ রে? কেষ্ট এলি নাকি? কেষ্ট! কোথায়
থাকিস? কখন থেকে একটু পানি চাইছি।
অন্ধকারে
দু’জনে চুপচাপ! খানিক পরে হারু
বলে, ব্যাপার বুঝতে
পারছিস? বাড়ির কোথাও কোনো খানে একটা রুগী
আছে। সেটাই ‘পানি পানি’ করে চিল্লা চিল্লি করছে।
হারুর
কথাই সত্যি।
সেই
চি চি শব্দের মধ্যে থেকে শোনা যায়— কেষ্ট—অ-কেষ্ট, গলাটা যে
শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো,
জল
দে একটু।
আশ্চর্য্য, কেষ্ট নামক কাউকেই তো কোথাও দেখতে
পাওয়া গেলো না। না সাড়া, না শব্দ!
বাড়িতে
ওই রুগীটা ছাড়া আর কেউ নেই, হারু বলে!
গদাই, ওই কেষ্টাটাই
তাহলে কোথাও গেছে।
ছেলে
বোধহয়, বুড়োর!
হতে
পরে। কিন্তু মনে হচ্ছে,
মিথ্যে
এলাম। এ বাড়িতে কি কিছু মিলবে?
আরে
বাবা, এতো বড়ো
বাড়িতে বাসনপত্তরও কি কিছু নেই?
চল
না, ওই পাশের ঘরটায়
।
যে
ঘর থেকে আওয়াজ আসছিলো তার পাশের ঘরে ঢুকে। খুব সন্তর্পণে একটা
দেশলাই কাঠি জ্বাললো গদাই। না,
ঘরে
কেউ নেই। কিন্তু
জিনিসপত্রই বা কই ?
প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দুটো সেলফ, একটা মস্ত বড়ো
টেবিল, একটা মুখ-খোলা
খালি কাঠের সিন্দুক সব খোলা হা-হা করছে। কোনোখানে
কিছু নেই।
বাবা
রে, যেন রুপকথার গল্পের
মতন নিঝুমপুরী-পড়ো বাড়ি।
চল, পালাই! আর দরকার
নেই বাব!
পালাবি? হেস্তনেস্ত একটা
না দেখেই?
ততোক্ষণে
সেই চি চি কণ্ঠ যতোটা সম্ভব তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, কে, কে, পাশের ঘরে কে
কথা কইছে? কেষ্টা এলি?
নাঃ, বুড়োটা জালালো!
বলে গদাই, চেঁচামেচি শুনে কে কেমনে থেকে এসে পড়বে।
ওর গলাটা টিপে শেষ করে ফেললেই আপদ চোকে ।
কী
আপদ! হারু বলে— কোথাও কিছু
জুটবে কি না,
তাই বুঝতে পারছি না, আর এ ছোড় কিনা
খুনের দায়ে ফাসি যেতে চায়। চল না, দেখিগে ও ঘরে ।
রুগ্ন বুড়োটা একা আমাদের দু’জনের আর কি করবে ?
তা
সত্যি, তেমন কিছু করে, গলা টিপে দেওয়া
তো আছেই হাতে।
অতএব
সাহসে ভর করে দুই স্যাঙাৎ এ ঘরে
ঢুকে এসে দাড়ায়।
মিটমিট
করে প্রদীপ জ্বলছে,
চৌকির
ওপর একজন জীর্ণ-শীর্ণ বৃদ্ধ। বৃদ্ধ কি
অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছে ?
নইলে
এর দোরের পাশে দাড়াতে ও বলে
উঠলো কেন- কে ? কে ? ওখানে কে ?
বলা
বাহুল্য-–এরা চুপ!
এবার
বুদ্ধ হঠাৎ কেঁদে ওঠে— কেন এমন করছিস, কেষ্ট ? কাকে এনেছিস? কার সঙ্গে কথা
কইছিস? কানা অন্ধ
মানুষের সঙ্গে কি তোর তামাসার
সম্পর্ক? তেষ্টায় ছাতি
ফেটে যাচ্ছে,
এক গ্লাস পানি দে বাবা, কেষ্ট !
কানা
অন্ধ ! চমকে ওঠে হারু-গদাই ।
একটা
বিরাট দৈত্যের মতো বাড়িতে শুধু একটা অন্ধ বুড়ো? এমনতো কখনো দেখা
যায় না !
কিন্তু!
অন্ধ যখন, তখন আর ভয় কি? ঘরে ঢোকে ওরা ।
পায়ের
শব্দে বুড়ো হঠাৎ আর
একবার চেঁচিয়ে কেঁদে
ওঠে-- ওরে হতভাগা কেষ্টা, তুই কি আমায়
মেরে ফেলতে চাস?
তবে
দে, গলাটা টিপে
একেবারে শেষ করে দে। হা ঈশ্বর! অন্ধ হয়েও যে কেন মানুষে
বেঁচে থাকে!
হারু
এবার এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে বলে, কেষ্ট?
হ্যা, কেষ্ট। কেষ্টই আমার সব। আমার অন্ধের নড়ি। বুড়ো
ভদ্রলোক হতাশভাবে বলে,
সে
আমার পুরোনো চাকর। কিন্তু তোমরা কে ? তোমরা কি কেষ্টর—কিন্তু যেই হও, আগে আমায় এক গেলাস পানি দাও, বাবা ।
হারু
ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে,
জলের কুঁজো রয়েছে একটা। জল ঢেলে
বুড়োর কাছে এসে হাতে ধরিয়ে দেয় ।
জল
খেয়ে বুড়ো একটা ‘আঃ' শব্দ করে বলে
ওঠে-তোমরা কে বলো না গো? চোখে দেখতে
পাইনে, কেষ্টা কোথায় চলে গেলো, বলে গেলো না, আমি কি করবো। সে
যে আমার ছেলে বলতে ছেলে, নাতি বলতে নাতি
। না বলে কয়ে কোথায় গেলো!
কেষ্টা যে কোথায় চলে
গেছে এতোক্ষণে বুঝতে বাকি নেই এদের।
কারণ
মিটমিটে আলো চোখে সইতে সইতে
ঘরের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘরে একটা
দেরাজ, একটা আলমারি ও
কয়েকটা বাক্স।
সব
খোলা হাঁ হাঁ করছে , ভেতরে এক টুকরো মাত্রও জিনিস
নেই।
গদাই
চাপ গলায় বলে,
দেখছিস? দেখছিস কাণ্ড? শুনলি তো, কেষ্ট না কি
এনার পুরোনো চাকর! হা ঈশ্বর! আমরা তিনপুরুষে চোর, তাও বোধহয়
এমনটা পারতাম না!
বৃদ্ধ
উত্তেজিতভাবে বলে,
কি
বলছো তোমরা, চুপি চুপি ?
গদাই
শাস্তভাবে বলে,
কিছু
না বাবু, বলছি, কেষ্টা হঠাৎ দেশ থেকে চিঠি পেয়ে
তাড়াতাড়ি চলে গেছে,
আমাকে
বদলি রেখে!
আর
ও কে? আর একজন? যার সঙ্গে কথা
কইছো তুমি?
গদাই
তেমনি শাস্তভাবে বলে,
ও আমার বন্ধু।
বুড়ো
ভদ্রলোক আন্দাজে হাতটা বাড়িয়ে গদাইয়ের গায়ে ঠেকিয়ে
ভাঙা
ভাঙা গলায় বলে,
তুমি
আবার কেষ্টার মতন চলে যাবে না তো ?
না
বাবু! মরবার আগে নয়।
হতভম্ব
হারু হঠাৎ গদাইয়ের হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে ঘরের বাইরে এনে
চাপা উত্তেজিতভাবে বলে,
এটা
কি হলো রে,
গদাই?
চিরকেলে
রোগা গদাই শাস্তভাবে বলে,
কিছু
না! চুরি আর করবো না, ঠিক করলাম। কারণ
কি জানিস হারু, চিরদিন চুরির
আগের অবস্থাটা দেখেছি,
চুরির
পরের অবস্থা কখনো দেখিনি।
দেখে বুঝছি, কী কুৎসিৎ
কাণ্ডই না করে আসি আমরা ।
তাহলে
এবার থেকে সৎপথে ?
দেখি
! রাগ করিসনে ভাই ।
রাগ
আবার কি? হারু স্থিরভাবে
বলে, আমিই কি আর
চুরির দিকে যাচ্ছি
নাকি ? অন্ধ বুড়োটাকে
খাওয়াতে পরাতে হবে তো?
দু’জনে মিলে মোট-টোট বয়ে যাহোক করে----
No comments:
Post a Comment