choto golpo,ছোট গল্প,বাঙ্গালীর হাসির গল্প,জসীম উদ্দীন,Jasimuddin, Bangalir hasir golpo |
শেয়ালসা পীরের দরগা – বাঙ্গালীর
হাসির গল্প – জসীম উদ্দীন –Sheyalsa peerer dorga – Jasimuddin - Bangalir
hasir golpo
রহিম এক ঝাঁকা সুপারি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল। মাঠের মধ্যে যেখানে তিন পথ একত্র হয়েছে সেখানে শেয়ালে পায়খানা করে রেখেছে। এইখানে এসে সে হঠাৎ আছাড় খেয়ে পড়ল। তার ঝাঁকার সুপারিগুলি কতক এধারে ওধারে পড়ে গেল। আর কতক সেই শেয়ালের বিষ্টার উপর পড়ল। রহিম তখন এধার ওধার হতে সুপারিগুলি তুলে নিল। শেয়ালের বিষ্টার উপর যেগুলি পড়েছিল সেগুলি আর তুলল না; তারপর তাড়াতাড়ি হাটে চলে গেল।
ইহার পরে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক পানের ব্যাপারী। সে পথের মধ্যে কতকগুলি সুপারি পড়ে থাকতে দেখে ভাবল, নিশ্চয় জায়গাটিতে কোনো পীর আওলিয়া আছেন। কেহ হয়তো জানতে পেরে এই সুপারিগুলি সেই পীরকে দিয়ে গিয়েছে। তখন সে মাথার ঝকা হতে কতকগুলি পান সেই সুপারির পাশে রেখে অতি ভক্তিভরে সালাম করে চলে গেল। ইহার পরে পেঁয়াজের ব্যাপারী, রসুনের ব্যাপারী, মরিচের ব্যাপারী যে-ই এই পথ দিয়ে যায় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সেই সুপারি-পানের উপর রেখে যায়।
হাট হতে ফিরিবার পথে রহিম দেখে কি, পানে, পেঁয়াজে, রসুনে, মরিচে, তরি-তরকারিতে সেই স্থানটি এক হাত উঁচু হয়ে উঠেছে! সে তাড়াতাড়ি পানি, মরিচ, পেঁয়াজ, তরি-তরকারি যাহা পারল ঝাঁকায় ভরে নিয়ে বাড়ি চলল।
বাড়িতে গেলে রহিমের বউ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “গেলে তো কয়েক পন সুপারি নিয়ে। তার দাম দিয়ে এত জিনিস আনলে কেমন করে?”
রহিম বলল, “ও সব কথা পরে হবে! তাড়াতাড়ি তোমার শাড়ী খানা দাও। আমাদের কপাল ফিরেছে।”
সে তাড়াতাড়ি বউ-এর শাড়ী আর নৌকার পাল নিয়ে সেই তিন পথের কাছে এসে উপস্থিত হল। দেখে আশ্চর্য হল, ব্যাপারীরা যে যে আজকের হাটে লাভ করেছে, প্রত্যেকে দু’আনা এক আনা করে এই পথের উপরে রেখে গিয়েছে! রহিম তাড়াতাড়ি পয়সাগুলি গাঁটে বেঁধে সেই জায়গাটির চারপাশ বউ এর শাড়ী দিয়ে ঘিরে ফেলল। উপরের চাঁদোয়ার মতো করে নৌকার পালটি টানিয়ে দিল।
পরদিন গ্রামের লোকে অবাক হয়ে দেখল, মাঠের মধ্যে পীরের আস্তানা। মাথায় কিস্তি টুপী পরে, গলায় ফটিকের তসবী দুলিয়ে রহিম শেখ সেই আস্তানার সামনে চক্ষু মুদে বসে আছে। যখন সেখানে বহু লোক জড়ো হয়, রহিম চক্ষু মেলে বলে, “আহা! শেয়ালসা পীরের কি কুদরৎ। যে এখানে এক আনা মানত করবে, একশ আনার বরকত পাবে। আজ রাতে শেয়ালসা পীর আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছে, এখানকার ধূলি নিয়ে গায়ে মাখলে সকল অসুখ দূর হবে। যার ছেলেপেলে হয় না তার কোলে সোনার যাদু হাসবে।”
গ্রামের লোকেরা কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না। কিন্তু কেহই ইহার আসল ইতিহাস খুঁজে দেখল না। বিশ্বাস করে যাহারা এখানে রোগ-আপদের জন্য মানত করল, কাহারও ফল হল, কাহারও হল না। যাহাদের ফল হল তারা শেয়ালসা পীরের তেলেসমাতির কথা লোকের কাছে আরো বাড়িয়ে বলল। রোগ হলে আপনা হতে তো কত লোক সেরে উঠে। আপদে বিপদেও তো আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু না করেও কত লোক উদ্ধার পায়। তারা ভাবে শেয়ালসা পীরের দোয়ায়-ই তাদের রোগ সারিতেছে-তাদের আপদ-বিপদ চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন পীরের নাম যেমন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল, মানত ও হাজতের টাকা পেয়ে রহিম শেখের অবস্থা ততই বাড়তে থাকে। একবার একজন বড়লোক এখানে মানত করে মামলায় জিতিল। সে বহু টাকা খরচ করে শেয়ালসা পীরের দরগা পাকা করে দিয়ে গেল। রহিম শেখ এই দরগার খাদেম। সে চক্ষু বন্ধ করে মনে মনে ভাবে, “দেশের লোকগুলি কি বোকা! শেয়ালের বিষ্টার উপরে এই দরগা। এখানে এসে কত মানুষ, কত আলেম-মৌলবী, মাথা কুটে সেজদা করে।”
No comments:
Post a Comment