মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Friday, September 17, 2021

অনুবাদ গল্প – বাজি (ম্যান ফ্রম দ্যা সাউথ) – রোয়াল্ড ডাল - Man From the South by Roald Dahl – Bangla Translation

অনুবাদ গল্প, রোয়াল্ড ডাল, Man From the South by Roald Dahl, Bangla Translation,রোমাঞ্চ উপন্যাস, রোমহর্ষক গল্প, রোমাঞ্চ গল্প,
অনুবাদ গল্প বাজি (ম্যান ফ্রম দ্যা সাউথ) রোয়াল্ড ডাল  - Man From the South by Roald Dahl – Bangla Translation

প্রায় ছটা বাজে। একটা বিয়ার কিনে সুইমিংপুলের ধারে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করলে মন্দ হয় না।

বার-এ গিয়ে একটা বিয়ার কিনলাম আমি। বাগান পার হয়ে পা বাড়ালাম সুইমিংপুলের দিকে।

বাগানটি খুব সুন্দর। লম্বা লন, অ্যাজালিয়াসের ঝাড় আর নারকেল বীথির সমন্বয়ে চমৎকার লাগছে দেখতে। জোরাল হাওয়ায় দুলছে নারকেল গাছের পাতা, আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে সবুজ ডাব।

সুইমিংপুলের চারপাশে কয়েকখানা ডেক-চেয়ব, বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ানো। সাদা টেবিল, ওপরে ঝলমলে ছাতা। তার নীচে বেদিং সুট পরে বসে আছে নারী-পুরুষের দল। পুলে একটা রাবার বল নিয়ে খেলা করছে তিন-চারটে মেয়ে আর জনা বারো ছেলের একটা দল। খেলা মানে বল নিয়ে লোফালুফি।

পুলের ধারে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিলাম। মেয়েগুলো ইংরেজ। এ হোটেলেই থাকে। ছেলেগুলোকে চিনতে পারলাম না। তবে উচ্চারণ শুনে মনে হলো আমেরিকান। নেভাল ক্যাডেট হতে পারে। আজ সকালেই আমেরিকান একটা ট্রেনিং শিপ নোঙর ফেলেছে বন্দরে।

একটা হলুদ ছাতার নীচে গিয়ে বসলাম। চারটে খালি চেয়ার। অন্য কেউ নেই। বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিতে দিতে একটা সিগারেট ধরালাম।

বিয়ার খেতে খেতে, সিগারেট হাতে সুইমিংপুলের ধারে বসার মজাই আলাদা। আমেরিকান ক্যাডেটগুলো ইংরেজ মেয়েগুলোর সঙ্গে জমিয়েছে ভালই। ডাইভ দিয়ে পড়ছে পানিতে, একজন আরেকজনের পা ধরে ডিগবাজি খাওয়াচ্ছে। সেই সাথে চলছে হাহা হিহি।।

হঠাৎ লোকটাকে চোখে পড়ল আমার। ছোটখাট, বুড়ো মানুষ। বেশ দ্রুত হেঁটে আসছে পুলের পাশ দিয়ে। সাদা, নিভাঁজ সুট পরনে তার, হাঁটছে না যেন ছোট ছোট লাফ দিচ্ছে। মাথায় ক্রীম কালারের বড় পানামা হ্যাট। পুলের লোকজন দেখতে দেখতে আসছে সে। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। হাসলে বেরিয়ে পড়ল অমসৃণ, ইদুরে দাঁত। প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম।

মাফ করবেন, বসিটে পারি?

অবশ্যই, বললাম আমি। বসুন না।

চেয়ারের পেছনটা দেখল সে সতর্ক দৃষ্টিতে, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বসল পা জোড়া আড়াআড়ি ভাবে রেখে। তার সাদা হরিণের চামড়ার জুতোর সব জায়গায় ছোট ছোট ছিদ্র। বাতাস ঢোকার জন্যে।

ভারি সুন্দর সন্ধ্যা, বলল সে। জ্যামাইকাতে অবশ্য সব সন্ধ্যাই সুন্দর। লোকটার উচ্চারণ শুনে ঠিক বুঝতে পারলাম না সে কোন দেশের। স্প্যানিশ বা ইটালিয়ান হতে পারে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার যে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। লোকটার বয়স সত্তুরের কাছাকাছি হবে।।

হ্যা, সায় দিলাম আমি। এখানকার সবগুলো সন্ধ্যাই সুন্দর।

কিন্টু এরা কারা? পুলের সাঁতারুদের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ডেখে টো মনে হচ্ছে না হোটেলের বাসিণ্ডা। ওরা আমেরিকান সেইলর, জানালাম আমি। মানে নাবিক হবার ট্রেনিং নিচ্ছে।

আমেরিকানডের ডেখেই বোঝা যায়। ওরা ছাড়া এটো হল্লা আর কে করবে? আপনি নিশ্চই আমেরিকান নন, টাই না?

না, বললাম আমি। আমি আমেরিকান নই।

হঠাৎ আমেরিকান ক্যাডেটদের একজন পুল ছেড়ে চলে এল আমাদের টেবিলের সামনে। গা বেয়ে পানি ঝরছে। তার সঙ্গে একটি ইংরেজ মেয়েও এসেছে।

এ চেয়ারগুলো কি দখল হয়ে গেছে? জানতে চাইল আমেরিকান তরুণ।

না, জবাব দিলাম আমি। বসা যাবে?

যাবে।

ধন্যবাদ, বলল সে। ছেলেটির হাতে একটি তোয়ালে। চেয়ারে বসে তোয়ালের ভাঁজ খুলে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার বের করল। মেয়েটিকে সিগারেট ছিল। নিল না মেয়েটি। খাবে না। আমাকে অফার করল একটা। নিলাম। বুড়োকেও দিতে যাচ্ছিল। সে বলল, ঢন্যবাদ। আমার কাছে সিগার আছে।

কুমিরের চামড়ার একটা কেস খুলে সে একটা সিগার বের করল, তারপর কাঁচির মত একটা ছুরি দিয়ে সিগারের গোড়াটা কেটে ফেলল।

আসুন, ধরিয়ে দিই, লাইটার এগিয়ে দিল তরুণ।

এমন বাটাসে আগুন ধরাটে পারবে না, বলল বুড়ো।

অবশ্যই পারব। জোর বাতাসেও আমার লাইটার ধরানো যায়। সবসময় যায়।

মুখ থেকে সিগার সরাল লোকটা, মাথাটা একদিকে কাত করে তাকাল আমেরিকানের দিকে।

সবসময় যায়? ধীর গলায় প্রশ্নটা করল সে।

অবশ্যই। কখনওই ব্যর্থ হইনি আমি।

এখনও একপাশে মাথা কাত করে ছেলেটিকে দেখছে বুড়ো।

বেশ। বেশ। টুমি বলছ এই বিখ্যাত লাইটার কখনও আগুন ঢরাতে ব্যর্ট হয় না। টাই টো বলটে চাইছ টুমি?

অবশ্যই, বলল আমেরিকান। তাই বলতে চাইছি আমি। ছেলেটির বয়স বড়জোর কুড়ি হবে। সারা মুখে ফুটকি, নাকটা পাখির ঠোটের মত। ধারাল। বুকেও ফুটকির চিহ্ন, সামান্য লালচে পশমও রয়েছে। ডান মুঠিতে ধরে আছে লাইটার, হুইল বা চাকা ঘোরানোর জন্যে প্রস্তুত। আমার লাইটার কখনও ব্যর্থ হয় না। হাসছে সে, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।

এক মিনিট, পিলিজ, সিগার ধরা হাতটা ট্রাফিক সিগনাল দেয়ার ভঙ্গিতে ওপরে উঠে গেল। এক মিনিট, নরম, ভাবলেশশূন্য গলায় বলল বুড়ো, একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে ছেলেটিকে। এ ব্যাপারে একটা বাজি ধরলে কেমন হয়? হাসল সে। তোমার লাইটার সট্যি জ্বলে কি না টা নিয়ে একটা বাজি ঢরতে পারি না?

অবশ্যই পারি, বলল ছেলেটি। কেন নয়?

বাজি ঢরবে?

অবশ্যই। অবশ্যই ধরব।

বুড়ো সিগারের দিকে চোখ নামাল। ভাবছে কী যেন। সত্যি বলতে কী, লোকটার হাবভাব ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল এসব করে ছেলেটিকে সে বিব্রতকর কোনও পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে চাইছে। একই সাথে মনে হচ্ছিল লোকটার মধ্যে রহস্যময় কিছু একটা আছে, কোনও কিছু গোপন করছে সে।

বুড়ো আবার তাকাল ছেলেটির দিকে। ধীর গলায় বলল, বাজি ঢরতে আমিও পছন্দ করি। এ নিয়ে এক ডান (দান) ভাল বাজি হয়ে যাক না। মোটা অঙ্কের বাজি?

দাঁড়ান, দাঁড়ান, বলে উঠল ছেলেটি। মোটা অঙ্কের বাজি ধরতে পারব না আমি। বড়জোর এক ডলার বাজি ধরতে পারি।

লোকটা ট্রাফিক পুলিশের মত আবার হাত নাড়াল। শোনো। আমরা একটা মজা করব। আর এই মজায় একটা বাজি ঢরব। টারপর আমার রূমে যাব। ওখানে কোনও বাটাস নাই। আমি বাজি ঢরে বলটে পারি ওখানে টুমি টোমার বিখ্যাত লাইটার পরপর ডশবার জ্বালাটে পারবে না।

অবশ্যই পারব, বলল ছেলেটি।

বেশ। টা হলে বাজি ঢরা যাক।

যাক। আমি এক ডলার বাজি ধরছি।

না। না। আমি খুব ভাল বাজি ধরব। আমি খুব ঢনী মানুষ। আর খেলুড়ে মানুষ টো বটেই। শোনো। হোটেলের বাইরে আমার গাড়ি আছে। খুব সুন্দর, ডামী গাড়ি। আমেধিকান গাড়ি। টোমাদের ডেশের ক্যাডিল্যাক।

আরে, দাঁড়ান। দাঁড়ান। ছেলেটা হেসে উঠে হেলান দিল ডেক চেয়ারে। অত বড় বাজি ধরার ক্ষমতা আমার নেই। এ তো স্রেফ পাগলামি।

এটা কোনও পাগলামি নয়। টুমি পরপর ডশবার টোমার লাইটার জ্বালাটে পারলেই গাড়িটি টোমার হয়ে যাবে। টোমার ক্যাডিল্যাকের মালিক হটে ইচ্ছা করে না?

অবশ্যই করে, ছেলেটা হাসছে এখনও।

বেশ। বেশ। টা হলে বাজি ঢরা যাক। আমি আমার ক্যাডিল্যাক বাজি ঢরছি।

আর আমি কী বাজি ধরব? লোকটা গভীর মনোযোগে ছেলেটার লাইটারের লাল রঙের ব্যাণ্ডটাকে দেখছিল। বলল, বোনঢু (বন্ধু), টোমাকে এমন কোনও বাজি আমি ঢরটে বলব না যা টোমার পক্ষে ডেয়া সম্ভব নয়। বুঝটে পেরেছ?

তা হলে আপনিই বলে দিন কী বাজি ধরতে পারি?

ছোটটো একটি জিনিস টোমাকে বাজি ঢরতে হবে। বাজি হারলে ওটা ডিটে আপট্টি করবে না টো?

জিনিসটা কী?

ঢরো, টোমার বাম হাটের কড়ে আঙুল।

আমার কী? হাসি মুছে গেল ছেলেটির মুখ থেকে।

সহজ কটা। বাজি জিটলে টুমি গাড়ি নিবে। হারলে আমি টোমার আঙুল নিব।

বুঝলাম না। আঙুল নেবেন মানে?

আমি ওটা কেটে নিব।

বলে কী এই লোক। এ তো পাগলামি। না। না। এসব বাজির মধ্যে আমি নেই। আমি বড়জোর এক ডলার বাজি ধরতে পারি।

বুড়ো শরীর এলিয়ে দিল চেয়ারে, শ্রাগ করল বেশ। বেশ। বেশ। টুমি টা হলে বাজি ঢরটে চাও না। টা হলে ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া যাক। কেমন?

আমেরিকান ক্যাডেট কোনও জবাব দিল না। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুলের দিকে। হঠাৎ মনে পড়ল এখনও সিগারেট জ্বালানো হয়নি। দুই ঠোটের ফাঁকে সিগারেট গুজল সে, দুহাতের চেটো দিয়ে লাইটারটাকে আড়াল করে চাকা ঘোরাল। জ্বলে উঠল পলতে, স্থির হয়ে জ্বলতে লাগল হলদে, ছোট্ট শিখা। এমনভাবে লাইটারটাকে ধরে রেখেছে সে, বাতাস লাগলই না ওটার গায়ে।

আমার সিগারেটটা জ্বালাতে পারি? বললাম আমি।

সরি। ভুলেই গেছিলাম। লাইটারের জন্যে হাত বাড়ালাম, কিন্তু উঠে দাঁড়াল ছেলেটি। এগিয়ে এল আমার কাছে। ধরিয়ে দিল সিগারেট।

ধন্যবাদ, বললাম আমি। ফিরে গেল সে নিজের জায়গায়। কেমন কাটছে সময়? জিজ্ঞেস করলাম।

ভালই, জবাব দিল সে। খুব সুন্দর জায়গা।

কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নেমে এল। তবে বুঝতে পারছিলাম বুড়োর প্রস্তাব ভাবিয়ে তুলেছে ছেলেটিকে। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে সে চেয়ারে, বোঝাই যাচ্ছে টেনশন করছে। একটু পরে গা মোচড়ামুচড়ি শুরু করল। বুক চুলকাচ্ছে, ঘাড়ের কাছটা ঘষছে, শেষে আঙুল দিয়ে হাঁটুতে তবলা বাজাতে শুরু করল।।

আপনার বাজি নিয়ে আরেকটু কথা বলতে চাই, অবশেষে বলল সে। আপনি বলেছেন আপনার ঘরে গিয়ে যদি এই লাইটার পরপর দশবার জ্বালাতে পারি তা হলে আপনার ক্যাডিল্যাকটা আমাকে দিয়ে দেবেন। আর বাজি হারলে আমার বাঁ হাতের আঙুলটা আপনাকে কেটে দিতে হবে। এই তো?

ঠিক টাই। ওটাই বাজির শর্ট (শর্ত্)। টবে আমার মনে হচ্ছে টুমি ভয় পেয়েছ।

আমি হেরে গেলে কী করতে হবে? যাতে আঙুল কেটে নিতে পারেন সেজন্যে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে?

না। না। টাটে কোনও লাভ হবে না। আঙুল কাটার সময় টুমি হাট সরিয়ে নিটে পারো। খেলা শুরু হবার আগে টোমার একটা হাট আমি টেবিলের সঙ্গে বেঁঢে রাখব। বাজিটে হারলেই টোমার একটা আঙুল কেটে নেব।

আপনার ক্যাডিল্যাকটা কোন্ সালের?

বুঝটে পারলাম না!

কোন সালের-মানে কত হয়েছে ক্যাডিল্যাকের বয়স?

বয়স? আরে। ওটা আমি নটুন কিনেছি। গট বছরে। একডম নিউ কার। টবে টুমি বাজি ঢরবে বলে ভরসা পাচ্ছি না। আমেরিকানরা খুব ভীটু হয়!

এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল ছেলেটা, ইংরেজ মেয়েটার দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে। রাজি, তীক্ষ্ণ গলায় বলল সে। আপনার সঙ্গে আমি বাজি ধরতে রাজি।

গুড! হাততালি দিয়ে উঠল বুড়ো। এখনই বাজিটা ঢরব আমরা। আর আপনি, স্যর, আমার দিকে ফিরল সে, আপনি আমাদের ইয়ে হবেন, কী বলে-রেফারী।

কিন্তু এরকম উদ্ভট বাজিতে রেফারী হবার কোনও ইচ্ছে আমার নেই, বললাম আমি। খেলাটা পছন্দ হচ্ছেনা আমার।

আমারও, এই প্রথম কথা বলল ইংরেজ মেয়েটি। এটা হাস্যকর, বোকার মত একটা বাজি ধরা হয়েছে।

এ ছেলে হেরে গেলে আপনি সত্যি ওর আঙুল কেটে নেবেন? জানতে চাইলাম আমি।

অবশ্যই। আর জিটলে সে ক্যাডিল্যাক পাবে। চলো। আমার ঘরে যাই।

উঠে দাঁড়াল ছেলেটি।

এ বেশেই যাবে? জিজ্ঞেস করল বুড়ো। কাপড় পরে নিলে হটো না?

না, বলল ছেলেটি। এভাবেই যাব আমি। আমার দিকে ঘুরল সে। স্যর, আপনি যদি দয়া করে রেফারীর দায়িত্বটা নিতেন---

ঠিক আছে, বললাম আমি। এত করে বলছ যখন সবাই, নেব আমি রেফারীর দায়িত্ব। তবে আবারও বলছি তোমাদের বাজির ধরন পছন্দ হয়নি আমার।

তুমিও চলো না, ছেলেটি বলল মেয়েটিকে। তুমি দর্শকের ভূমিকায় থাকবে।

কী ভেবে রাজি হয়ে গেল মেয়েটি। লোকটা আমাদের ছোট দলটাকে নিয়ে বাগানের মাঝ দিয়ে হোটেলের উদ্দেশে পা বাড়াল। বুড়োকে এখন বেশ উত্তেজিত লাগছে, হাটার গতি বেড়ে গেছে, রীতিমত ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে।

আমি ওই দিকে থাকি, হাত তুলে দেখাল বুড়ো। আগে আমার গাড়িটা ডেখবেন? আছে এখানেই।

হোটেলের সামনের ড্রাইভওয়েতে নিয়ে গেল সে আমাদেরকে। দাঁড়িয়ে পড়ল। পার্ক করা চকচকে, স্নান-সবুজ রঙের একটি ক্যাডিল্যাকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।

ওই যে আমার গাড়ি। সবুজ রঙের। পছণ্ড হয়?

সুন্দর গাড়ি, মন্তব্য করল ছেলেটি।

তা হলে এবার আমার রূমে চলো। ডেখা যাক গাড়িটাকে জিটটে পারো কি না।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ওপরে। দরজা খুলল বুড়ো। ডাবল একটা বেডরূমে ঢুকে পড়লাম সবাই। বিছানার এক কোণে মহিলাদের একটা ড্রেসিং গাউন ঝুলতে দেখলাম।

প্রঠমে, বলল সে। আমরা সবাই মার্টিনি পান করব।

ঘরের দূর প্রান্তে ছোট একটা টেবিল, তাতে ড্রিংকস সাজানো। শেকার, বরফ, গ্লাস সবই আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। মার্টিনি বানাতে শুরু করল বুড়ো, একটু পরে বেল টিপে দিল। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল এক কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা। জিনের বোতল নামিয়ে রেখে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল লোকটা, এক পাউণ্ডের একটা নোট বাড়িয়ে দিল মহিলার দিকে। এটা টুমি রাখো। আমরা এখানে একটা খেলা খেলব। সেজন্যে কিছু জিনিস ডরকার। টিনটা জিনিস-কয়েকটা পেরেক, একটা হাটুড়ি, আর মাংস কাটার একটা ছুরি, কসাইরা যা ডিয়ে মাংস কাটে সেরকম একটা চাপাটি। আনটে পারবে?

চাপাতি! ঢোক গিলল মহিলা। মাংস কাটার চাপাতি?

হ্যা। হ্যাঁ। ওটাই আমার ডরকার। আনটে পারবে কি না। বলো।

পারব, স্যর। বলে চলে গেল বিস্মিত মহিলা। সবার হাতে একটা করে মার্টিনির গ্লাস ধরিয়ে দিল বুড়ো।

আমরা দাঁড়িয়েই মার্টিনির গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম। লক্ষ করলাম সুন্দরী ইংরেজ মেয়েটা গ্লাসের ওপর থেকে বার বার তাকাচ্ছে ছেলেটির দিকে। আর বুড়ো নীল বেদিং সুট পরা মেয়েটিকে দেখছে। বুড়োর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বাজির ব্যাপারে সে খুবই সিরিয়াস। ছেলেটি যদি বাজিতে হেরে যায় তা হলে কী ঘটবে ভেবে শিউরে উঠলাম আমি। লোকটা সত্যি ওর আঙুল কেটে ফেলবে? তা হলে বুড়োর ক্যাডিল্যাকে করেই ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

বাজির ব্যাপারটা তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে না? ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।।

না। বরং মজার বাজি মনে হচ্ছে, জবাব দিল সে। ইতিমধ্যে বড়সড় একটা মার্টিনি গিলেছে।

আমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে, বলল মেয়েটি। হেরে গেলে কী হবে?

কিছুই হবে না। বাম হাতের কড়ে আঙুল মানুষের কোনও কাজে লাগে নাকি? হাত বাড়িয়ে দেখল ছেলেটি। এই যে আমার কড়ে আঙুল। আজ পর্যন্ত এটা কোনও কাজে লেগেছে? লাগেনি। কাজেই এটাকে নিয়ে বাজি ধরতে ক্ষতি কী? বরং মজাই লাগছে।

হাসল বুড়ো। শেকার এনে আবার ভরে দিল সবার গ্লাস। খেলা শুরুর আগে, বলল সে, আমি রেফারীকে গাড়ির চাবি ডিয়ে ডিচ্ছি। সে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে আমাকে দিল। আর কাগজপট্র, মানে গাড়ির কাগজপট্র এবং ইনসিওরেন্স পেপার্স গাড়ির পকেটে আছে।

সেই কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা আবার ঢুকল ঘরে। তার এক হাতে ছোট এক চাপাতি, কসাইরা মাংস কাটতে এ ধরনের চাপাতি ব্যবহার করে, অন্য হাতে একটা হাতুড়ি এবং কয়েকটা পেরেক। গুড! সব জোগাড় করেছ ডেখছি। ঢন্যবাড। ঢন্যবাড। এখন টুমি যেটে পারো।

মহিলা দরজা বন্ধ করে যাওয়া পর্যন্ত সে সবুর করল, তারপর জিনিসপত্রগুলো রাখল বিছানার এক কোণে। বলল, এবার প্রস্টুট হওয়া যাক, কী বলেন? ফিরল ছেলেটির দিকে। একটু সাহায্য করো, পিলিজ। এই টেবিলটাকে একটু সরাটে হবে।

টেবিল মানে হোটেলের রাইটিং ডেস্ক, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে চার ফুট বাই তিন ফুট। তাতে ব্লটিং প্যাড, কালি, কলম, কাগজ ইত্যাদি রয়েছে। দেয়ালের কাছ থেকে টেবিলটা সরিয়ে নিল ওরা, লেখার সরঞ্জাম রাখল আরেক জায়গায়।

এবার, বলল বুড়ো। একটা চেয়ার।

একটা চেয়ার রাখল টেবিলের পাশে। চটপটে আছে বুড়ো। বাচ্চাদের মত মহা উৎসাহে কাজ করছে। এখন পেরেকগুলো নিয়ে এসো। টেবিলে পেরেক মারতে হবে।

ছেলেটি পেরেক নিয়ে এল। টেবিলে ঠকাঠক হাতুড়ি মেরে পেরেক বসিয়ে ফেলল বুড়ো -

মার্টিনির গ্লাস হাতে বুড়োর কাণ্ড দেখছি আমরা। ছয় ইঞ্চি ব্যবধানে পাশাপাশি দুটো পেরেক ঠুকেছে সে টেবিলে। পরীক্ষা করে দেখল শক্ত ভাবে পেরেক বসানো হয়েছে কি না।

বুড়োর গতি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে এ কাজ সে আগেও বহুবার করেছে। তার কাজেঁ কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই।

এখন ডরকার কিছু রশি, বলল সে। রশি খুঁজেও আনল। বেশ। এটক্ষণে প্রস্টুটি (প্রস্তুতি) সম্পন্ন হলো। ডয়া করে টেবিলের এঢারে (এ ধারে এই দিকে) বসবে? বলল সে ছেলেটিকে।

গ্লাস রেখে টেবিলের পাশের চেয়ারে বসল আমেরিকান ক্যাডেট।

এখন দুই পেরেকের মাঝখানে টোমার বাম হাতখানা রাখো। পেরেক পুঁটেছি (পুঁতেছি) ওগুলোর সাটে (সাথে) টোমার হাত রশি ডিয়ে বাঁঢব বলে। যাটে তুমি হাত নড়াচড়া করটে না পারো।

ছেলেটির কব্জিতে রশি পেঁচাল বুড়ো, তারপর শক্ত করে পেরেকের সঙ্গে বাঁধল রশি। এতই শক্ত করে বাঁধল যে ছেলেটি কোনও ভাবেই তার হাত নাড়াতে পারবে না। তবে আঙুল নাড়াতে পারছিল।

বেশ। এবার হাত মুঠো করো, কড়ে আঙুলটি বাডে। কড়ে আঙুলটি খোলা ঠাকবে, পড়ে ঠাকবে টেবিলের ওপর। বেশ! বেশ! এবার আমরা রেডি। টোমার ডান হাটে ডিয়ে এবার লাইটার জ্বালাবে। টবে এক মিনিট, পিলিজ।

লাফ মেরে বিছানায় উঠল বুড়ো, নিয়ে এল চাপাতি। চাপাতি হাতে দাঁড়াল টেবিলের পাশে।

আমরা সবাই রেডি? বলল সে। মি. রেফারী, আপনি বললেই খেলা শুরু হয়ে যাবে।

ইংরেজ মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটির চেয়ারে পেছনে। মুখে কোনও কথা নেই। ছেলেটি ডান হাতে লাইটার নিয়ে বসে আছে নিশ্চুপ, দৃষ্টি চাপাতির দিকে। আর বুড়ো তাকাচ্ছে আমার দিকে।

তুমি রেডি? জিজ্ঞেস করলাম ছেলেটিকে।

রেডি।

আর আপনি? বুড়োকে প্রশ্ন করল।

পুরো রেডি, বলে চাপাতি শূন্যে তুলল সে, নামিয়ে আনল ছেলেটির হাতের ঠিক দুফুট ওপরে, কোপ মারার জন্যে প্রস্তুত। ছেলেটি তাকাল ওদিকে। তবে চেহারায় কোনও ভাব ফুটল না। শুধু ভুরু কুঁচকে রাখল।

বেশ, বললাম আমি। শুরু করা যাক।

ছেলেটি বলল, আমি লাইটার জ্বালানোর সময় আপনি জোরে জোরে গুনবেন।

আচ্ছা, বললাম আমি। গুনব।

বুড়ো আঙুল দিয়ে লাইটারের ঢাকনি খুলল সে, চাকায় জোরে মোচড় দিল। ঝিক করে উঠল চকমকি পাথর, আগুন ধরে গেল সলতেতে, জ্বলে উঠল ছোট্ট হলুদ শিখা।

এক! ঘোষণা করলাম আমি।

আগুন নেভাল না ছেলেটি, ঢাকনি নামিয়ে রাখল। পাঁচ সেকেণ্ড পরে আবার জ্বালল লাইটার।

দুই!

কেউ কিছু বলছে না। লাইটারের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ছেলেটি। হাতে চাপাতি নিয়ে বুড়োও তাকিয়ে রয়েছে ওদিকে।

তিন!

চার!

পাচ!

ছয়!

সাত!

বোঝাই যাচ্ছে এটি খুব ভাল লাইটার। ঝিক করে ওঠে চকমকি পাথর, সলতে ছোট শিখা নিয়ে স্থির ভাবে জ্বলতে থাকে। আমি শুধু দেখছি ছেলেটির বুড়ো আঙ্গুলের কারসাজি। বুড়ো আঙুল দিয়ে সে লাইটার জ্বালাচ্ছে নেভাচ্ছে। দম নিলাম আমি, আট বলার জন্যে প্রস্তুত বুড়ো আঙুলে ঘুরল চাকা। ঝিকিয়ে উঠল চকমকি পাথর। জ্বলে উঠল ছোট্ট শিখা।

আট! মাত্র বলেছি আমি, তক্ষুনি ঝড়াং করে খুলে গেল দরজা। সবাই ঘুরে তাকালাম। দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে এক মহিলা। মাথা ভর্তি কালো চুল। দুসেকেণ্ড ওখানে দাঁড়িয়ে রইল সে, তারপর কার্লোস! কার্লোস! বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ভেতরে ঢুকল। কব্জি চেপে ধরল সে বুড়োর, ছিনিয়ে নিল চাপাতি, ছুঁড়ে ফেলল বিছানার ওপর, তারপর লোকটার কোটের ল্যাপেল ধরে ভয়ানক ঝাকাতে শুরু করল। সেই সাথে ঝড়ের বেগে তুবড়ি ছুটল মুখে। বকছে সে বুড়োকে। ভাষাটা সম্ভবত স্প্যানিশ। এত জোরে বুড়োকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে যে চেহারাটাই চেনা যাচ্ছিল না।

আস্তে আস্তে কমে এল ঝুঁকির বেগ, বুড়োকে এক ধাক্কা মেরে বিছানার ওপর পাঠিয়ে দিল মহিলা। বিছানার কোণে বসে চোখ মিটমিট করতে লাগল বুড়ো, মাথা হাতড়ে দেখছে ঘাড়ের ওপর ওটা ঠিকঠাক মত আছে কি না।

দুঃখিত, বলল মহিলা, এরকম একটা ঘটনার জন্যে আমি সত্যি দুঃখিত। প্রায় নিখুঁত ইংরেজিতে কথাগুলো বলল সে। দোষ আমারই। চুল ধুতে দশ মিনিটের জন্যে বাইরে গেছি, অমনি সেই কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে কার্লোস।

মহিলার চেহারা করুণ আর বিমর্ষ দেখাল।

ছেলেটি দড়ির বাধন খুলছে। আমি আর ইংরেজ মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

কার্লোসের আসলে মাথার ঠিক নেই, বলে চলল মহিলা। আমরা আগে যেখানে থাকতাম সেখানে সে বাজি ধরে বিভিন্ন লোকের হাত কেটে সাতচল্লিশটা আঙুল জোগাড় করেছে। আর বাজিতে হেরে হারিয়েছে এগারোটা গাড়ি। শেষে সবাই হুমকি দিল ওকে নিয়ে পাড়া ছাড়তে হবে। এরপর ওকে নিয়ে এখানে চলে আসি আমি।

আমরা টো ছোট্ট একটা বাজি ধরেছিলাম মাত্র, বিছানার ওপর বসা বুড়ো মিনমিন করে বলল।

তোমার সঙ্গেও নিশ্চয়ই বাজি ধরেছিল? জিজ্ঞেস করল মহিলা।

হ্যা, জবাব দিল ছেলেটি। একটা ক্যাডিল্যাক।

ওর কোনও গাড়ি নেই। ওটা আমার। জানাল মহিলা। ওর বাজি ধরার মত কিছু নেই তবু বাজি ধরে। যা ঘটেছে তার জন্যে আমি সত্যি দুঃখিত, মহিলাকে খুবই লজ্জিত দেখাচ্ছে।

এই নিন আপনার গাড়ির চাবি, টেবিলের ওপর চাবিটা রাখলাম আমি।

আমরা টো ছোট্ট একটা বাজি ধরেছিলাম মাত্র, আবার বিড়বিড় করল লোকটা।

কার্লোসের বাজি ধরার মত কিছু নেই, বলল মহিলা। এ পৃথিবীতে ওর কিছু নেই। কিছু নেই। ওর যা ছিল অনেক আগেই আমি তার মালিক হয়েছি। তবে এতে প্রচুর সময় লেগেছে আমার, অনেক কষ্টও করতে হয়েছে। শেষে পেয়েছি সব কিছুই।

ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসল সে। করুণ, ম্লান হাসি। এগিয়ে এল টেবিলের সামনে, হাত বাড়াল গাড়ির চাবিটি নেয়ার জন্যে।

তখন আমি দেখতে পেলাম মহিলার হাতে বুড়ো আঙুল ছাড়া আর কোনও আঙুলই নেই। সবগুলো আঙুল কাটা।

মূল: রোল্ড ডাল

রূপান্তরঃ অনীশ দাস অপু

No comments:

Post a Comment

Popular Posts