![]() |
জীবনের গল্প,অনুবাদ গল্প,দ্য স্নাইপার লিয়াম ও ফ্লাহার্টি,The Sniper By Liam O’Flaherty Bangla translation |
অনুবাদ
গল্প - দ্য স্নাইপার – লিয়াম ও ফ্লাহার্টি - The Sniper By
Liam O’ Flaherty – Bangla translation
জুনের দীর্ঘ
গোধূলিবেলা বিবর্ণ হয়ে রাত নেমে এল। গাঢ় আঁধারে ডুবে আছে ডাবলিন। কিন্তু ভেড়ার লোমের
মত নরম মেঘদল চুইয়ে আসা চাদের ফ্যাকাসে আলোয় মনে হচ্ছে রাস্তা এবং লিফি’র কালো জলের ওপর যেন
বা ভোরের আলো ফুটে উঠছে। অবরুদ্ধ ‘ফোর কোর্টস’
(beleaguered)-এর চারদিকে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল। শহরের এখানে-সেখানে
মেশিন গান এবং রাইফেল নিঃসঙ্গ খামারে কুকুরের ঘেউ ঘেউ-এর মত থেকে থেকে গর্জে উঠে রাতের
নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। রিপাবলিকান এবং ফ্রি স্টেটার্সরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে
পড়েছে।
ও’কনেল ব্রিজ (O’Connell
Bridge)-এর কাছে
এক বাড়ির ছাদের ওপর শুয়ে লক্ষ্য রাখছে এক রিপাবলিকান স্নাইপার। রাইফেলটা পাশে শুইয়ে
রেখেছে সে, তার কাঁধের ওপর ঝুলে আছে একজোড়া ফিল্ড গ্লাস। তার চেহারাটা একজন ছাত্রের
মত, পাতলা এবং তপস্যাপরায়ণ, কিন্তু চোখ জোড়ায় রয়েছে অন্ধবিশ্বাসীদের মত ঠাণ্ডা
আভা। চোখ দুটো গভীর এবং চিন্তাযুক্ত, মৃত্যু খুঁজে বেড়ানো একজন মানুষের চোখ।
ক্ষুধার্তভাবে
একটা স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে সে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। গোগ্রাসে খাচ্ছে সে। স্যাণ্ডউইচ
খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে হুইস্কির একটা ফ্লাস্ক বের করে ছোট্ট একটা চুমুক দিল। এক
মুহূর্ত থমকে চিন্তা করল সিগারেট খাওয়ার ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে কি না। অন্ধকারে আলো
দেখা যেতে পারে। লক্ষ রাখছে শত্রুরা। ঝুঁকি নেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।
দু’ঠোটের মাঝে একটা সিগারেট
গুজল সে, দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে দ্রুত ধোয়া গিলেই আগুন নিভিয়ে ফেলল। প্রায়
সঙ্গে সঙ্গে ছাদের প্যারাপিটে এসে লাগল একটা গুলি। দ্রুত আরেক টান দিয়ে সিগারেটটা
নিভিয়ে ফেলল স্নাইপার। তারপর মৃদুস্বরে ঈশ্বরের নামে শপথ করে বুকে হেঁটে বাঁ দিকে
সরে গেল।
সাবধানে
উঠে দাঁড়িয়ে প্যারাপিটের উপর দিয়ে উকি দিল সে। আগুনের ঝলক দেখা গেল, শোঁ শোঁ শব্দ
তুলে তার মাথার উপর দিয়ে গুলি চলে গেল একটা। ঝট করে শুয়ে পড়ল সে। আলোর ঝলকানিটা
দেখেছে। রাস্তার উল্টো দিক থেকে এসেছে ওটা।
ছাদের ওপর
দিয়ে গড়িয়ে পেছন দিকের একটা চিমনির কাছে চলে গেল সে। ওটার আড়ালে ধীরে-ধীরে সোজা
যেতে শুরু করল যতক্ষণ না তার চোখ প্যারাপিটের উপরিভাগের সমান্তরালে আসে। নীল আকাশের
পটভূমিতে উল্টোদিকের বাড়িটার উপর দিকের অস্পষ্ট কাঠামো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না।
আড়ালে লুকিয়ে আছে তার শত্রু।
ঠিক এর
পরপরই সেতুর ওপর একটা আর্মার্ড কার দেখা গেল, রাস্তার দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল ওটা।
পঞ্চাশ গজ এগিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে গিয়ে থামল। মোটরের ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্নাইপার।
হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে তার। গাড়িটা শত্রুপক্ষের। গুলি করতে চাইল সে, কিন্তু জানে তা
হবে অহেতুক। ধূসর দানবটাকে ঘিরে থাকা স্টিল কখনওই ভেদ করতে পারবে না তার গুলি।
তারপর একটা
সাইড স্ট্রিটের কোনার দিকে এগিয়ে এল এক বৃদ্ধা। ছেঁড়া একটা শাল দিয়ে মাথা ঢাকা।
গাড়ির টারেটে বসা লোকটার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল সে। ছাদের যেদিকটায় স্নাইপার শুয়ে
আছে সেদিকটায় আঙুল তুলে দেখাচ্ছে সে। একজন চর।
টারেট খুলে
গেল। একজন মানুষের মাথা আর কাঁধ দেখা গেল, তাকিয়ে আছে স্নাইপারের দিকে। রাইফেল তুলে
গুলি করল স্নাইপার। টারেটের দেয়ালে খুব জোরে আছড়ে পড়ল মাথাটা। সাইড স্ট্রিটের দিকে
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল মহিলা। আবারও গুলি করল স্নাইপার। চরকির মত পাক খেল মহিলা, তীক্ষ্ণ
এক চিৎকার দিয়ে রাস্তার পাশে নর্দমায় পড়ে গেল।
হঠাৎ উল্টো
দিকের ছাদ থেকে শব্দ তুলে একটা গুলি ছুটে এল, অভিসম্পাত দিয়ে হাত থেকে রাইফেল ফেলে
দিল স্নাইপার। ছাদের ওপর সশব্দে পড়ল রাইফেল। স্নাইপার ভাবল, শব্দটা মড়াকে জাগিয়ে
তুলবে। রাইফেল তুলতে ঝুঁকুল সে। তুলতে পারল না। অবশ হয়ে আছে তার বাহুমূল ‘লেগেছে আমার,’ বিড়বিড় করে বলল সে।
ছাদের ওপর
টান টান হয়ে শুয়ে থেকে বুকে হেঁটে ছাদের রেলিং-এর কাছে ফিরে গেল সে। বাঁ হাত দিয়ে
ডান বাহুমূলের ক্ষতস্থান স্পর্শ করল। কোটের হাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। কোনও ব্যথা
নেই-কেমন একটা বিবশ অনুভূতি, যেন বাহুটা কেটে ফেলা হয়েছে।
দ্রুত পকেট
থেকে ছুরিটা বের করল সে। ছাদের রেলিং-এর উপর দিকে চাপ দিয়ে ওটা খুলল। চিরে ফেলল হাতাটা।
গুলিটা যেখান দিয়ে ঢুকেছে সেখানে ছোট্ট একটা গর্ত। উল্টো দিকে কোনও গর্ত নেই। হাড়ে
আটকে গেছে গুলি। ফ্র্যাকচার সৃষ্টি করবে এটা নিঃসন্দেহে। ক্ষতের নীচ দিকে বাহু বাকা
করল সে। সহজে পেছন দিকে বেঁকে গেল বাহু। ব্যথা সহ্য করতে দাঁতে দাঁত চাপল।
এরপর ফিল্ড
ড্রেসিং বের করে ছুরি দিয়ে প্যাকেটটা কেটে ফাক করল। আয়োডিন বোতলের ঘাড় ভেঙে বোতলের
ঝাঁঝাল তরল পদার্থটুকু ক্ষতের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় ফেলতে শুরু করল। ব্যথার তীব্র এক
প্রবাহ বয়ে গেল তার মধ্য দিয়ে। তুলার পুটলিটা ক্ষতস্থানের ওপর বসিয়ে এর ওপর ড্রেসিং
করল। ড্রেসিং-এর দুই প্রান্ত দাঁত দিয়ে শক্ত করল।
এবার সে
প্যারাপিট ঘেঁষে স্থির হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে ব্যথাটা সইয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
নীচের রাস্তায়
নিথর হয়ে আছে সবকিছু। ব্রিজের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গেছে আর্মার্ডকার, সঙ্গে
নিয়ে গেছে টারেট থেকে ঝুলে থাকা মেশিন গান চালকের প্রাণহীন মাথাটা। এখনও রাস্তার পাশের
নর্দমায় পড়ে আছে মহিলার মৃতদেহ।
অনেকক্ষণ
ধরে স্থির হয়ে শুয়ে আছে স্নাইপার, আহত বাহুর পরিচর্যা করতে করতে পালানোর পরিকল্পনা
করছে। সকালে যেন কিছুতেই তাকে আহত অবস্থায় ছাদের ওপর না পায়। তার পালানোর পথ রুদ্ধ
করে রেখেছে উল্টোদিকের ছাদে অবস্থানকারী শত্রু। ওই শত্রুকে তার মেরে ফেলা উচিত। কিন্তু
এক্ষেত্রে সে নিজের রাইফেল ব্যবহার করতে পারবে না কাজটা সারার জন্য শুধু একটা রিভলভার
সম্বল তার। একটা পরিকল্পনার কথা ভাবল সে।
ক্যাপ খুলে
রাইফেলের নলের ওপর বসিয়ে দিল সে ওটা। এবার রাইফেলটা ধীরে-ধীরে প্যারাপিটের উপর দিকে
ঠেলতে শুরু করল-যতক্ষণ না ক্যাপটা রাস্তার উল্টো দিক থেকে দেখা যায়। প্রায় সঙ্গে
সঙ্গে গুলির শব্দ শোনা গেল, ক্যাপের কেন্দ্র ভেদ করে চলে গেল গুলিটা। রাইফেল সামনের
দিকে ঝোকাল স্নাইপার। রাস্তায় খসে পড়ল ক্যাপটা। এবার রাইফেলের মাঝখানটা ধরে বাঁ হাত
ছাদের বাইরে বের করে নির্জীবভাবে ঝুলিয়ে রাখল। কয়েক মুহূর্ত পর রাইফেলটা রাস্তায়
পড়ে যেতে দিল। এরপর সে ধপ করে ছাদের ওপর পড়ল, নিজের সঙ্গে হাতটাকে টেনে নিতে শুরু
করল।
দ্রুত পায়ের
পাতার ওপর ভর দিয়ে উঁচু হলো সে, ছাদের কোনা দিয়ে উঁকি দিল। তার কৌশল সার্থক। ক্যাপ
আর রাইফেল পড়ে যেতে দেখে অন্য স্নাইপার ভেবেছে, সে তার শত্রুকে মেরে ফেলেছে। এ মুহূর্তে
একসারি চিমনি পটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। তাকিয়ে আছে আড়াআড়িভাবে। পশ্চিম আকাশের
পটভূমিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার ছায়া-মাথা।
হাসল রিপাবলিকান
স্নাইপার। প্যারাপিটের উপরে তুলল তার রিভলভার। প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরত্ব-মৃদু আলোয়
তীব্র একটা গুলি। তার ডান বাহু এমন ব্যথা করছে, যেন হাজারো শয়তান কষ্ট দিচ্ছে তাকে।
ধীরে-সুস্থে লক্ষ্যস্থির করল সে। থরথর করে হাত কাঁপছে তার। ঠোটে ঠোট চেপে নাক দিয়ে
লম্বা একটা শ্বাস টেনে গুলি করল। গুলির প্রচণ্ড শব্দে প্রায় কালা হয়ে গেল সে, তীব্র
ঝাকি খেল বাহু।
এরপর ধোঁয়া
সরে গেলে সামনে উঁকি দিয়ে আনন্দে চিৎকার দিল সে। গুলি খেয়েছে তার শত্রু। মৃত্যুযন্ত্রণায়
কাতরাতে কাতরাতে প্যারাপিটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পাদুটো ছাদের ওপর রাখতে প্রাণপণ
চেষ্টা করছে সে, কিন্তু ধীরে-ধীরে সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছে, যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে
ব্যাপারটা। তার মুঠো থেকে খসে গেল রাইফেলটা, প্যারাপিটে বাড়ি খেয়ে পড়ে নীচের নাপিতের
দোকানের খুঁটিতে লেগে ঠাস করে রাস্তায় পড়ল!
এবার ছাদের
মৃত্যুপথযাত্রী লোকটা সামনের দিকে ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল। দেহটা শূন্যে পাক খেতে খেতে
থপ করে আছড়ে পড়ল রাস্তায়। তারপর স্থির হয়ে গেল দেহটা।
শত্রুকে
পড়ে যেতে দেখল স্নাইপার, ভয়ে শিউরে উঠল সে। মরে গেছে তার ভেতরের যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা।
দুঃখে যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে পড়েছে সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ক্ষতস্থানের
কারণে, গ্রীষ্মের লম্বা একটি দিনে কিছুই পেটে না পড়ায় এবং ছাদে উঠে লক্ষ্য রাখতে
রাখতে দুর্বল হয়ে পড়ায় শত্রুর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ থেকে জোর করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
কাঁপুনির চোটে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে, বিড়বিড় করতে শুরু করল সে নিজের সঙ্গে, যুদ্ধকে
অভিশাপ দিচ্ছে, অভিশাপ দিচ্ছে নিজেকে, প্রত্যেককে।
হাতের ধোঁয়া
ওঠা রিভলভারের দিকে তাকাল সে। শপথ নিয়ে পায়ের কাছে ছাদের ওপর সজোরে ছুঁড়ে মারল ওটা।
ছাদের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে গুলি বেরিয়ে গেল ওটা থেকে; শোঁ শোঁ শব্দ তুলে স্নাইপারের
মাথা ঘেঁষে চলে গেল। শকের ফলে ভয়ে দিশেহারা অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল
সে। স্থির হয়ে এল তার স্নায়ু। ভয়ের মেঘ দূরীভূত হয়ে গেল তার মন থেকে, হেসে উঠল
সে।
পকেট থেকে
হুইস্কির ফ্লাস্ক বের করে পুরোটাই খালি করে ফেলল সে। স্পিরিটের প্রভাবে বিচার-বুদ্ধি
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার। এখনই ছাদ থেকে নেমে গিয়ে কোম্পানি কমাণ্ডারকে রিপোর্ট করার
সিদ্ধান্ত নিল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। রাস্তা দিয়ে গেলে তেমন কোনও বিপদের আশঙ্কা
নেই। রিভলভারটা তুলে পকেটে ভরল। এরপর স্কাইলাইট দিয়ে বুকে হেঁটে নীচের বাড়িটায় নামতে
শুরু করল।
স্নাইপার
যখন রাস্তায় ওঠার গলিপথে পৌছুল, যে শত্রু স্নাইপারকে সে খুন করেছে তার পরিচয় জানার
জন্য হঠাৎ করেই কৌতূহল অনুভব করল সে। লোকটা যে-ই হোক না কেন, কেউকেটা গোছের কেউ হবে-সিদ্ধান্তে
পৌছুল সে। লোকটা পরিচিত কেউ কি না জানতে উৎসুক হয়ে উঠল। এমনও হতে পারে সেনাবাহিনী
দুই দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগে তার কোম্পানিতেই ছিল লোকটা। ঝুঁকি নিয়ে তাকে দেখে
আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ও’কনেল স্ট্রিট-এর চারপাশে তীক্ষ নজর বোলাল
সে কোণে দাঁড়িয়ে। রাস্তার ভাটিতে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে, কিন্তু এখানে সব শান্ত।
রাস্তার
ওপর দিয়ে তীরবেগে ছুটল স্নাইপার। একটি মেশিনগান থেকে শিলার মত গুলি ছুটে এসে তার চারপাশের
মাটি ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। তবে একটা গুলিও তার গায়ে লাগল না। মুখ নিচু করে মৃতদেহটার
পাশে ঝাপিয়ে পড়ল সে। থেমে গেল মেশিনগান।
এবার স্নাইপার
মৃতদেহটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে, তাকাল তার ভাইয়ের মুখের দিকে।
মূল: লিয়াম
ও ফ্লাহার্টি
রূপান্তর:
হাসান মোস্তাফিজুর রহমান
No comments:
Post a Comment