মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Monday, April 13, 2020

গোয়েন্দা গল্প - ঘড়ি রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ- Detective Story - Ghori Rahasshya - Syed Mustafa Siraj

গোয়েন্দা গল্প - ঘড়ি রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ- Detective Story - Ghori Rahasshya - Syed Mustafa Siraj

গোয়েন্দা গল্প - ঘড়ি রহস্য - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ - Detective Story - Ghori Rahasshya - Syed Mustafa Siraj
কর্নেল মাহমুদুল হাসানের প্রিয় পরিচারক আব্দুল মাজেদের দুদিন থেকে সামান্য সর্দিজ্বর পাড়ার ডাক্তার তারেক হাসান সাহেব তাকে দেখতে এসেছিলেন প্রচুর আশ্বাস দিয়ে এবং লম্বা-চওড়া প্রেসক্রিপশন লিখে তিনি আড্ডার মেজাজে বসলেন দেশের হালচাল নিয়ে কিছুক্ষণ বকবক করে গেলেন তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা কর্নেল সায়েব, আপনি তো বিখ্যাত রহস্যভেদী যাবৎ বিস্তর জটিল রহস্য ফাস করেছেন শুনেছি কিন্তু কখনও কি এমন কোনও কেস আপনার হাতে এসেছে, যার রহস্য ফাস করতে পারেননি?” 
কর্নেল প্রেসক্রিপশনটা দেখছিলেন বললেন, প্রশ্নটা আপনাকেও করা যায়
ডাক্তার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, কেন? কেন?” 
ডাক্তার হিসেবে আপনার সুনাম আছে আপনি কি সব রোগীর সঠিক রোগ ধরতে পেরেছেন?” 
ডাক্তারবাবু মাথা নেড়ে বললেন, কোনও ডাক্তারই এমন দাবি করতে পারেন না।”   
কর্নেল প্রেসক্রিপশনটা ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন তারপর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে সাদা দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, আমার ক্ষেত্রেও তা কিছু-কিছু রহস্য ফাঁস করতে শেষাবধি আমি ব্যর্থ হয়েছি” 
কর্নেল চোখ বুজে চকচকে টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন এবার আমার খুব আগ্রহ হল কারণ দীর্ঘকাল যাবৎ আমি তার প্রায় ছায়াসঙ্গী অসংখ্য জটিল রহস্য তাকে নিপুণ দক্ষতায় ফাস করতে দেখেছি আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, কোনও ক্ষেত্রে উনি ব্যর্থ হয়েছেন তাই না বলে পারলাম না, আশ্চর্য! কখনও তো আপনাকে ব্যর্থ হতে দেখিনি! তা ছাড়া তেমন কোনও কেসের কথা আপনি আমাকে বলেনওনি” 
জয়! তুমি সৈয়দাবাদ রাজবাড়ির জড়োয়া নেকলেস হারানোর ঘটনা ভুলে গেছে
মনে পড়ে গেল বললাম, কিন্তু নেকলেস হারানোটা যত রহস্যময় হোক, কে ওটা চুরি করেছে, আপনি তো জানতে পেরেছিলেন এখন চোর যদি লাপাত্তা হয়ে যায়, আপনার কী করার আছে? খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার কাজটা পুলিশের
ডাক্তার অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন বললেন, একটু ডিটেলস বলুন কর্নেল সায়েব! রাজবাড়ির জড়োয়া নেকলেস যখন, তখন নিশ্চয় প্রচুর দামী কীভাবে ওটা চুরি গিয়েছিল?” 
কর্নেল বললেন, সেটাই একটা জটিল রহস্য সেই রহস্য আমি ফাঁস করতে পারিনি নেকলেসটা নাকি রাজপরিবারের সৌভাগ্যের প্রতীক পরিবারে নতুন বউমা এলে ওলিমাতে (বৌভাতে) জমকালো পার্টি দেওয়া হত পার্টিতে নতুন বউমা নেকলেস পরে সিংহাসনে বসে থাকতেন পার্টি শেষ হলে ওটা খুলে নিয়ে গিয়ে পাতালঘরে রাখা হত এটাই ছিল বংশানুক্রমে রীতি সে রাত্রে পার্টি শো হতে তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে হঠাৎ দেখা গেল বউমার গলায় নেকলেস নেই” 
ডাক্তার বললেন, জয় বলল আপনি নেকলেস চোরকে চিনতে পেরেছিলেন!” 
হ্যা কিছু সূত্র থেকে অনুমান করেছিলাম রাজবাড়ির গোবিন্দ নামে এক কর্মচারী যেভাবেই হোক, নেকলেস চুরি করেছে সে একা থাকত রাজবাড়ির একটা ঘরে কিন্তু তার ঘরে শেষ রাত্রে হানা দিয়ে দেখা গেল তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে উধাও হয়ে গেছে তবে রহস্যটা থেকে গেল গোবিন্দ কখন কীভাবে নেকলেস চুরি করল? হলঘরের পার্টিতে প্রচুর লোক ছিল চোখ ধাঁধানো আলো ছিল সব চেয়ে আশ্চর্য, নতুন বউমাও টের পাননি কখন তার গলা থেকে নেকলেস উধাও হয়েছে” 
ডাক্তার ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন উঠি কর্নেল সায়েব! এতক্ষণ রোগীরা আমার মুণ্ডুপাত করছে” 
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর কর্নেল একটু হেসে বললেন, তারেক হাসান সাহেব ডাক্তার হিসেবে জনপ্রিয় কিন্তু মশা মারতে কামান দেগেছেন একে তো মাজেদ ঔষধ খেতেই ভয় পায়, তাতে এত সব ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, সিরাপ! তুমি একটু বস, জয়! দেখি, কাউকে দিয়ে ওষুধগুলো আনানো যায় নাকি” 
বললাম, আমিই এনে দিচ্ছি” 
এই সময় ডোরবেল বাজল এবং ড্রয়িং রুমের দরজায় পরদায় ফাকে অবাক হয়ে দেখলাম, মাজেদ গিয়ে দিব্যি দরজা খুলে দিল তারপর প্রায় তাকে ঠেলে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক সটান -ঘরে এসে ঢুকলেন  কাচুমাচু মুখে তিনি বললেন, কর্নেলসায়েবের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত দাদা বলে গেছেন, টাইম ইজ মানি তো কাগজে আপনার কীর্তিকলাপ পড়েছি ছবি দেখেছি অনেক চেষ্টায় ঠিকানা জোগাড় করে ছুটে এসেছি টাইম ইজ মানি”   
ওঁর কথার ওপর কর্নেল বললেন, আপনি বসুন বলুন কী ব্যাপার” 
ভদ্রলোক সোফায় বসে রুমালে মুখ মুছে বললেন সব কথা গুছিয়ে বলতে সময় লাগবে কিন্তু ওই যে বললাম! দাদা বলে গেছেন টাইম ইজ মানি ইংরেজি  প্রবাদবাক্য হলেও কথাটা সত্যি
ভদ্রলেক পাগল নন তো? একটু বিরক্ত হয়ে বলরাম বারবার টাইম ইজ মানি বলছেন অথচ নিজেই টাইম নষ্ট করছেন” 
ভদ্রলোক চটে গিয়ে বললেন, আমার কথা হচ্ছে কর্নেলসায়েবের সঙ্গে
কর্নেল হেসে ফেললেন ঠিক তবে উনি একজন সাংবাদিক দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয় চৌধুরী আপনি নিশ্চয় জানেন, রিপোর্টাররা সবকিছুতে খবর খোজেন?
ভদ্রলোক ঝটপট আমাকে সালাম দিয়ে বললেন, আপনিই সেই বিখ্যাত সাংবাদিক জয় চৌধুরী? কী সৌভাগ্য! আপনি আমার এই খবরটা দয়া করে লিখুন! বজ্জাতের মুখোশ খুলে দিন হ্যাঁ, এবার খবরটা সংক্ষেপে বলি কারণ টাইম ইজ মানি
বলে উনি কর্নেলের দিকে ঘুরে বসলেন আগে আমার নাম ঠিকানা বলি আমার নাম প্রাণনাথ রায় সাতাশ বাই তিন, কামাল পাশা লেনে একটা মেসবাড়িতে একখানা আলাদা ছোট্ট ঘরে থাকি চাকরি করি একটা ট্রেডিং কোম্পানিতে তো কিছুদিন থেকে একটা ভুতুড়ে ঘটনা লক্ষ করছি ধরুন, টেবিলে যে পাঁঞ্জাবিখানা যেখানে রেখে বেরিয়েছিলাম, বাসায় ফিরে দেখি, সেটা ঠিক সেই খানে নেই কিংবা ধরুন, যে শার্টটা হ্যাঙ্গারে যেভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, ফিরে এসে দেখি, সেটা সেইভাবে ঝোলানো নেই একটা কাঠের ছোট্ট আলমারি আছে তার তালা তেমনই আটকানো অথচ ভেতরকার জিনিসপত্র এদিক-ওদিক হয়ে আছে রোজ বিকেলে ছড়ি হাতে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাস কাল ছড়িটা দেখি, ব্রাকেটের যেখানে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, সেখানে নেই এই রকম অসংখ্য ব্যাপার প্রতিদিন ঘটছে আমি এর মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না চোর ঢুকলে তো সে কিছু চুরি করত কিন্তু -পর্যন্ত কিছুই চুরি যায়নি আমার সন্দেহ হয়েছিল, কেউ বজ্জাতি করে আমাকে তাড়াতে চাইছে কিন্তু গত রাত্রে হঠাৎ একটি শব্দে ঘুম ভেঙে যেতেই টেবিলবাতি জ্বেলে দেখি কাঠের আলমারিটা নড়ছিল সদ্য থেমে গেল আতঙ্কে সারা রাত্রি আর ঘুম হয়নি তো টাইম ইজ মানি আর দেরি করা চলে না আপনার শরণাপন্ন না হয়ে উপায় ছিল না” 
কর্নেল চুপচাপ শুনছিলেন এতক্ষণে বললেন, আপনার ঘরে কোনও দামি জিনিস আছে?” 
নাহ যৎসামান্য টাকাকড়ি ব্যাঙ্কে রাখি এই রিস্টওয়াচটা যদি দামি বলেন, এটা প্রায় সারাক্ষণ আমার হাতেই বাঁধা থাকে শুধু স্নানের সময় টেবিলে খুলে রেখে যাই কিন্তু এটা চুরি হয়নি” 
আপনার বড় ভাইয়ের নাম কী?” 
হরনাথ রায়” 
তিনি বেঁচে নেই?” 
না এখন আমি মেসবাড়ির যে-ঘরে থাকি, দাদাভাই সেখানেই থাকতেন বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বিয়ে করেননি আমার সঙ্গে বহু বছর দাদার কোনও যোগাযোগ ছিল না হঠাৎ দুমাস আগে টেলিগ্রাম পেলাম, হার্ট অ্যাটাক হয়ে দাদা হাসপাতালে আছে সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে এলাম কলকাতা” 
আপনি কোথায় ছিলেন তখন?” 
সাহেবগঞ্জে আমার কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ আছে সেখানে আমাদের পৈতৃক বাড়িও সেখানে আমার ফ্যামিলি এখনও সাহেব গঞ্জে আছে” 
তারপর কী হল বলুন” 
হাসপাতালে দাদা তখন মরণাপন্ন আমাকে চিনতে পেরে শুধু বললেন, পানু! টাইম ইজ মানি কথাটা মনে রাখিস! ব্যস! ওই শেষ কথা” 
কথাটা একটা ইংরেজী প্রবচন যাই হোক, তারপর?” 
দাদার শেষকৃত্য করে কোম্পানির হেড অফিসে গেলাম আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল রাজধানীতে বদলি হওয়ার হেড অফিসে থাকলে অনেক সুযোগসুবিধে, বুঝলেন তো?” 
বুঝলাম কোম্পানি তা হলে আপনাকে বদলি করল?” 
হ্যা দাদার সঙ্গে মেসের ম্যানেজারের বন্ধুত্ব ছিল তাই দাদার ঘরটা আমাকে একই ভাড়ায় ছেড়ে দিলেন” 
ওই ঘরে তো আপনার দাদার জিনিসপত্র ছিল?
ছিল একটা তক্তাপোশ, বিছানাপত্র, আলমারি এইসব
আর কিছু?  
প্রাণনাথবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আর তেমন কিছু- হ্যা! একটা প্রকাণ্ড দেওয়ালঘড়ি ঘড়িটা অচল দাদা কেন ওটা কিনেছিলেন, কেনই বা আর সারাননি, কে জানে! আমি ওটা বেচে দেব ভেবেছিলাম কিন্তু দাদার স্মৃতি” 
কর্নেল হাসলেন হ্যা টাইম ইজ মানি
প্রাণনাথবাবু সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কথাটা দাদা বলেছিলেন সেই থেকে কেন কে জানে কথাটা আমাকে ভূতের মতো পেয়ে বসেছে
আমাকেও বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, আপনার ঘরের ভুতুড়ে ঘটনার কথা কি ম্যানেজার কিংবা আর কাউকে বলেছেন?” 
ম্যানেজারকে বলেছিলাম” 
উনি হেসে উড়িয়ে দিলেন বললেন, আপনার দাদাও ঠিক একই কথা বলতেন” 
প্রাণনাথবাবু এবার চাপা গলায় বললেন, ওই মেসবাড়িতে যাওয়ার পর দিন মেসের একজন বোর্ডার আব্দুস সামাদ সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ওই ঘরে নাকি ভুত আছে বহুবছর আগে কে নাকি আত্মহত্যা করেছিল” 
ঠিক আছে টাইম ইজ মানি আমরা আজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ আপনার বাসায় যাব তবে আপনি যেন কথাটা গোপন রাখবেন আমরা আপনার কোম্পানির অফিসার হিসেবে যাব” 
প্রাণনাথবাবু আশ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল অভ্যাসমত টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, কী বুঝলে জয়?” 
ম্যানেজার ওঁকে তাড়াতে চাইছেন কারণ নতুন বোর্ডার ঢোকাতে পারলে বেশি ভাড়া এবং সেলামিও পাবেন” 
- তাড়াতে চাইলে তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ওঁকে এই ভাড়ায় থাকতে দিলেন কেন?” 
তা হলে কোনও বোর্ডার- ধরুন, সেই আব্দুস সামাদ সাহেব ঘরটা পাওয়ার জন্য ওঁর পেছনে লেগেছেন” 
কর্নেল হাসলেন টাইম ইজ মনি কথাটা গুরুত্বপূর্ণ ডার্লিং!” 
বিরক্ত হয়ে বললাম, কথাটা দেখছি সত্যিই ভুতের মতো আপনাকেও পেয়ে বসেছে” 
হ্যা ওটাই আসলে ভুত সেই ভুতের উপদ্রব ঘটেছে প্রাণনাথবাবুর ডেরায় বলে কর্নেল উঠে দাড়ালেন নিচের ফ্ল্যাটের নীলার ভাইকে দিয়ে মাজেদের ওষুধগুলো আনিয়ে নিই তুমি বোসো দুজনে আজ রান্না বান্না করব তারপর বিকেলে কামাল পাশা লেনে যাব
দোতলা মেসবাড়িটা খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয়নি ঘিঞ্জি গলির বাকের মুখে একটা ছোট্ট পার্ক দেখা যাচ্ছিল প্রাণনাথবাবু নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাড়ির একতলায় দোকানপাট দোতলায় মেস শেষ প্রান্তে প্রাণনাথবাবুর ডেরা তার লাগোয়া ম্যানেজারের ঘর সেই ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণনাথবাবু ম্যানেজারকে জানিয়ে গেলেন, ওঁর কোম্পানির অফিসাররা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছে ভদ্রলোক রোগা এবং বেঁটে মুখে অমায়িক ভাব তালা খুলে প্রাণনাথবাবু বললেন, আপনারা দয়া করে একটু বসুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করে আসি” 
টাইম ইজ মানি! বলে কর্নেল দেওয়ালঘড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন তারপর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন ঘড়ির কাঁটা বারোটা তিরিশে থেমে আছে 
বললাম, একেই বলে বারোটা বেজে যাওয়া” 
কর্নেল আমার রসিকতায় কান দিলেন না একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে তার ওপর উঠে আতশ কাঁচ বের করলেন একটু পরে বললেন, ডায়ালে কিছু কথা লেখা ছিল ঘষে ফেলা হয়েছে তবে ঘড়িটা বিলিতি এবং খুব দামি হরনাথ কিংবা তার পুর্বপুরুষকে কেউ হয়তো উপহার দিয়েছিল” 
চেয়ার থেকে নেমে কর্নেল চেয়ারটা আগের জায়গায় রেখে কাঠের আলমারিটার কাছে গেলেন 
উকি মেরে পেছন দিক দেখে আপন মনে বললেন, সত্যিই এটা নড়ানো হয়েছে ডান দিকের দুটো পায়া ইঞ্চিটাক সরে এসেছে” 
কীভাবে বুঝলেন?” 
কোনও আসবাব অনেককাল এক জায়গায় রাখলে মেঝেয় তার ছাপ পড়ে পায়া দুটো সেই ছাপ থেকে সরে এসেছে” 
এই সময় প্রাণনাথবাবু ফিরে এলেন তার হাতে চায়ের দুটো কাপ প্লেট বললেন, আগে চা খেয়ে নিন আপনারা তারপর সব দেখাচ্ছি” 
কর্নেল বললেন, আপনি এই আলমারিটা খুলুন
খুলছি ওতে দাদার জামাকাপড় আর বইপত্তর ছাড়া কিছু নেই প্রাণনাথবাবু কাঠের আলমারিটা খুলে দিলেন কর্নেল আলমারির ভেতর যেন তল্লাশ শুরু করলেন তল্লাশ শেষ হলে উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার দাদার সেই সুটকেসটা দেখতে চাই” 
চামড়ার সুটকেসেও কিছু জামাকাপড় আর একটা ফাইল পাওয়া গেল ফাইলের কাগজপত্র দেখে কর্নেল বললেন, আপনার দাদা দেখছি শেয়ার মার্কেটে ব্রোকার ছিলেন!” 
তাই বুঝি? আমি কিন্তু দাদার কোনও কাগজপত্র এখনও খুঁটিয়ে দেখিনি!” 
আপনি ম্যানেজারকে ডাকুন ওঁর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে চাই” 
প্রাণনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, ওঁকে ডাকা কি ঠিক হবে?
আপনি ওঁকে ডাকুন” 
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ছিল প্রাণনাথবাবু বেরিয়ে গেলেন কিন্তু উনি বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ওঁকে পাশ কাটিয়ে ম্যানেজারের আবির্ভাব হল প্রাণনাথও ফিরে এলেন আমার সন্দেহ হল, ম্যানেজার দরজার পাশেই হয়তো আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন
কর্নেল বললেন, আসুন প্রভাতবাবু, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে” 
প্রভাতবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনারা লালবাজার থেকে এসেছেন তবে সার, বড্ড দেরি করে এসেছেন মরার আগে হরনাথ চোরাই জিনিস হাফিজ করে গেছে” 
কর্নেল বললেন, চোরাই জিনিস! তার মানে?” 
মানে আপনারা ভালই জানেন! তবে আমি সার ওসব সাতে পাঁচে ছিলাম না হরনাথ আমাকে বলত বটে, খদ্দের দেখে দাও সিকিভাগ তোমার আমি ওকে পাত্তা দিইনি” 
কিন্তু জিনিসটা কী?” 
খুলে কিছু বলেনি হরনাথ কাজেই জিনিসটা কী আমি জানি না শুধু এই টুকু জানি, জিনিসের দাম ছিল বড় বেশি হরনাথ আভাস দিয়েছিল লাখের ওপরে দাম আমার মালিক ভদ্রলোক, যার এই মেসবাড়ি, তিনি কোটিপতি লোক হরনাথ গোপনে তার কাছেও গিয়েছিল কিন্তু তিনিও কিনতে সাহস পাননি আমাকে বলেছিলেন, ওই লোকটাকে তাড়াও কিন্তু তাড়াব কী করে? পাড়ার সব গুণ্ডা, বদমাশ ছিল হরনাথের হাতে 
প্রাণনাথ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এসব কী বলছ ম্যানেজার সাহেব! আমার দাদা--- 
ম্যানেজার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, খাল কেটে কুমির এনেছ এখন তুমিই ঠেলা সামলাও পানু! আমাকে এসব ব্যাপারে জড়িয়ো না” 
বলে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রাণনাথবাবু ধপাস করে বিছানায় বসে বললেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না আমার দাদা বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া ছিলেন বটে, কিন্তু ওঁকে চোর অপবাদ কেউ কস্মিনকালে দেয়নি আর দামি চোরাই জিনিস যদি ওঁর কাছে থাকবে, আমি তার খোঁজ পাব না? যদি বেচে দিয়েও থাকেন, সেই টাকাই বা গেল কোথায়?” 
কর্নেল চুরুট ধরালেন আমি বললাম, এবার মনে হচ্ছে, আপনার ঘরে কেউ আপনার দাদার চোরাই জিনিস বা তা বিক্রি করা টাকা খুঁজতেই ঢোকে
প্রাণনাথবাবু প্রায় আর্তনাদ করলেন, তেমন কিছু ঘরে নেই” 
কর্নেল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বললেন, আপনার বড় ভাই বলেছিলেন টাইম ইজ মানি তাই না?” 
হ্যা” 
টাইমের সঙ্গে ঘড়ির সম্পর্ক আছে আপনি ঘড়িটা সারাতে দিচ্ছেন না কেন?” 
সারাতে অনেক টাকা লাগবে অত টাকা পাব কোথায়?” 
আমি নিজের খরচে সারিয়ে দেব আমার ধারণা, ঘড়িটা চালু হলে আপনার ঘরে আর ভূতের উপদ্রব হবে না ওই অচল ঘড়িই আপনার ঘরে ভূত ডেকে আনছে” 
প্রাণনাথবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন 
কর্নেল চেয়ার টেনে নিয়ে দেওয়ালঘড়ির তলায় গেলেন তারপর চেয়ারে উঠে প্রকাণ্ড ঘড়িটা নামিয়ে আনলেন বললেন, দিন সাতেক পরে আমার কাছ থেকে এটা ফেরত নিয়ে আসবেন কোনও বড় কোম্পানিতে এটা সারাতে দেব” 
ইলিয়ট রোডের তিনতলায় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ঘড়িটা খুলতে শুরু করলেন বললাম, সব ছেড়ে এই ঘড়ি নিয়ে পড়লেন কেন?” 
কর্নেল হাসলেন, কারণ টাইম ইজ মানি” 
কর্নেল! আমার ভয় হচ্ছে এই অচল ঘড়ি আপনার মগজও অচল করে দিয়েছে” 
ডায়ালের কাচ খুলে আতশ কাচ রেখে কী দেখতে দেখতে কর্নেল বললেন, এবার স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে, প্রেজেন্ডেড টু মিঃ গোবিন্দ রায় ফর হিজ সিনসিয়ার সার্ভিস অ্যান্ড অনেস্টি, অন দা অকেশন অব বাহাদুর চৌধুরী সেভেনটি ফাষ্ট বার্থ অ্যানিভার্সারি...” 
চমকে উঠলাম কর্নেল! এটা তো তা হলে সৈয়দাবাদ রাজবাড়ির উপহার! এই উপহার হরনাথের হাতে গেল কী করে?” 
ডার্লিং! হরনাথই গোবিন্দ হরনাথের সুটকেসের ভেতর কয়েকটা পুরনো নেমকার্ড খুঁজে পেয়েছি এই দ্যাখো, হরনাথ নাম ভাঁড়িয়ে রাজবাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি জুটিয়েছিল” 
বুঝেছি কিন্তু জড়োয়া নেকলেসটা গেল কোথায়?”   
ভুলে যাচ্ছ জয়ন্ত! মৃত্যুর সময় হরনাথ বলেছিল, পানু! টাইম ইজ মানি কথাটা মনে রাখিস” 
পানুবাবু সূত্রটা বুঝতে পারেননি নেকলেস চুরি যায় রাত সাড়ে বারোটায় এই ঘড়ির কাঁটা তাই সাড়ে বারোটায় রেখেছিল হরনাথ আর নেকলেসটা---- বলে কর্নেল ডায়াল খুলে ফেললেন এবং ভেতর থেকে একটা লাল ভেলভেটে মোড়া প্যাকেট বের করলেন প্যাকেট খুলতেই দেখা গেল ঝলমলে হিরে মুক্তো বসানো সোনার ঝালর দেওয়া একটা জড়োয়া নেকলেস
কর্নেল মিটিমিটি হেসে ফের বললেন, টাইম ইজ মানি! তবে হরনাথ কীভাবে নেকলেসটা চুরি করেছিল, এখন বুঝতে পারছি এই দ্যাখো, পিঠের দিকে নেকলেসটার ক্লিপ ঠিক ভাবে আঁটা নেই সহজেই খোলা যায় কিংবা নিজে থেকেও খুলে পড়তে পারে বিয়ের পার্টিতে নতুন বউমা নিশ্চয় ঘুমে ঢুলছিলেন সেই সময় নেকলেস খসে পড়ে থাকবে কেয়ারটেকার উপহার সামগ্রীর দায়িত্বে ছিল সে সুযোগটা ছাড়েনি ক্লিয়ার?” 
সায় দিয়ে বললাম অল ক্লিয়ার টাইম ইজ মানি, এটাও ক্লিয়ার” 


1 comment:

  1. খুব ভালো গল্প। পড়ে অনেক ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete

Popular Posts