দ্যা মিলিওন পাউন্ড ব্যাংক নোট – মার্ক টোয়েন – TheMillion Pound Bank Note – Mark Twain - Bangla |
দ্যা মিলিওন পাউন্ড ব্যাংক নোট – মার্ক টোয়েন – The Million Pound Bank Note – Mark Twain - Bangla (Part 2 of 3)
হেসে
সে নোটটি হাতে নিল—তার মুখে একগাল হাসি। তার সমস্ত মুখে ভাঁজ পড়ে ভ্রুর প্যাচের মতো রেখার সৃষ্টি হল এবং
পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে মারলে সে জায়গায় যে ধরনের ঢেউ সৃষ্টি হয়, তার
মুখের অবস্থাও তেমনি হয়ে উঠল। কিন্তু নোটটির
ওপর দৃষ্টি দিতে গিয়েই তার হাসি হঠাৎ থেমে গেল এবং মুখাবয়ব হলুদবর্ণ হয়ে উঠল। ভিসুভিয়াসের
গরম লাভা পাশের মাটিতে পড়ে যেমন শক্ত হয়ে যায়, তার হাসিও হঠাৎ থেমে
গিয়ে ঠিক তেমনি দেখাচ্ছিল। আমি কখনও কোনো হাসি হঠাৎ থেমে গিয়ে এমনি স্তব্ধ হয়ে যেতে
দেখিনি। লোকটি নোটটি ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দোকানের মালিক ছুটে এল কী ঘটেছে তা দেখতে
এবং তেজের সঙ্গে বলল : ‘কী হয়েছে? অসুবিধেটা
কী? কী চাই?’
আমি
বললাম,
অসুবিধা তেমন কিছু নয়। আমি আমার ভাঙতির জন্যে অপেক্ষা করছি।
‘টড শিগগির ভাঙতি
দিয়ে দাও। তাড়াতাড়ি কর।’
টড
একটু ঠাট্টার সুরে বলল : ভাঙতি দিয়ে দাও বলাটা তো সোজা, স্যার। নোটটা নিজে
একবার দেখুন।
দোকানদার
মালিক নোটটা দেখল এবং আস্তে শিস দিতে লাগল। তারপর পরিত্যক্ত কাপড়ের গাদার উপর এসে
এটা-ওটা টেনে বের করতে লাগল এবং ক্রমে বেশ উত্তেজিতভাবে আপন মনে বলতে লাগল, ‘একজন খেয়ালি
কোটিপতিকে এমনি একটা বাজে স্যুট বিক্রি করছ, টড। তুমি আস্ত একটা বোকা। একেবারে নিরেট বোকা সবসময় এমনি একটা কিছু
করে চলেছে যাতে সব কোটিপতিরা এখান থেকে একে একে সরে যাচ্ছে। সাধারণ বেশভূষার মধ্যে
কে যে কোটিপতি, তা ও কখনই চিনে বের করতে পারে না। হ্যা, এটাই আমি খুজছিলাম, স্যার। ওগুলো খুলে আগুনে ফেলে দিন, স্যার। এই যে স্যার, এই স্যুট—এটাই উপযুক্ত
জিনিস। এমনি দামি স্যুট ডিউকদের মর্যাদার উপযোগী। কোনো একজন বিদেশি রাজকুমারের জন্যে
এটা তৈরি করা হয়েছিল। আপনি তাকে চিনবেন, স্যার। তিনি হচ্ছেন, মাননীয় হ্যালিফ্যাক্সের হসপোডার (Hospodar of Halifax)। এটাকে আমরা
এখানেই রেখে দিয়েছি অনেকদিন ধরে, কারণ, তার মা মরণোন্মুখ। এখন তিনি শোক-বসন পরে আছেন। অবিশ্যি,
তার মা এখনও মারা যাননি। সব ঠিকই আছে। আমরা সবসময় আমাদের অর্থাৎ তাদের
রুচি অনুযায়ী জিনিস রাখতে পারি না। প্যান্টে আপনাকে সুন্দর মানিয়েছে। এখন ওয়েস্ট কোট
হল, এখন কোট। এখন দেখুন, সব ঠিক হয়েছে।
আমি কখনও এত সুন্দর মানানসই পোশাক আর দেখিনি।’
আমি
সন্তোষ প্রকাশ করলাম।
‘ঠিক, ঠিক
স্যার, এ দিয়ে আপনার কোনোরকমে কাজ চলে যাবে—আমি বলতে পারি।
কিন্তু দয়া করে আপনি দেখুন, আপনার নিজের মাপে আমরা কত সুন্দর জিনিস তৈরি
করি। উড, খাতাপত্র নিয়ে এস। লেখ, পায়ের
লম্বা মাপ ৩২-’ ইত্যাদি।
আমাকে
কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই স্যুট, প্রাতঃবাস, শার্ট এবং অন্যসব পোশাকের মাপ নিয়ে ফেলল। সব শেষ হলে একটু সুযোগ পেলে বললাম। কিন্তু মহোদয়, আপনি নোটটি ভাঙিয়ে না দিলে কিংবা
দামের জন্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা না করলে আমি যে এগুলোর ফরমাশ দিতে পারি নে।’
‘অনির্দিষ্ট
কাল? এটা তো একটা সামান্য কথা, স্যার। বলুন, চিরকাল। সেটাই উপযুক্ত কথা। টড শিগগির কাজগুলো
শেষ করে ফেলবে এবং সময় নষ্ট না করে স্যারের বাড়িতে পৌছে দেবে। সাধারণ খরিদ্দার অপেক্ষা
করুক। স্যারের ঠিকানাটা লিখে নাও টড এবং—’
‘আমি বাড়ি বদল
করছি। আমি এখানে এসে নতুন ঠিকানা দিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে, ঠিক
আছে, স্যার। এক মিনিট, আপনাকে পথ দেখিয়ে
দিচ্ছি, স্যার। এই পথে। আচ্ছা, গুড় বাই।’
নিশ্চয়ই
এখন বুঝতে পারছেন, কী ঘটতে যাচ্ছে? স্বভাবতই
আমার যা-ই প্রয়োজন, তা কিনতে গিয়ে ভাঙতি
চেয়ে বসি। এক সপ্তাহের
ভেতর আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার প্রয়োজনীয় সামগ্রী-সম্ভারে আমি সুসজ্জিত হয়ে পড়লাম। হ্যানোবার স্কোয়ারের ব্যয়বহুল এক হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করলাম।
সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করতাম; কিন্তু নাস্তার জন্যে হ্যারিসের
সেই অনাড়ম্বর হোটেলে যেতাম। সেখানেই প্রথমে আমার দশলক্ষ পাউন্ডের নোট দেখিয়ে খেয়েছিলাম।
হ্যারিসই আমাকে মানুষ করেছে। সারা দেশে হ্যারিস সংবাদ ছড়িয়েছে- যে বিদেশি খেয়ালি ভদ্রলোক জামার পকেটে দশলক্ষ পাউন্ডের নোট নিয়ে ঘুরে বেড়ান,
তিনি এই হোটেলের মহান পৃষ্ঠপোষক। এইটুকুই যথেষ্ট। অল্প পুঁজির দীনদরি গোছের হোটেল প্রসিদ্ধ হয়ে
উঠল এবং খরিদ্দারের ভিড় বেড়ে গেল। হ্যারিস এত কৃতজ্ঞ হল যে, সে
জোর করে আমার ওপর ধার চাপাতে লাগল এবং তী অস্বীকার করার উপায় ছিল না। আমার মতো নিঃস্ব
লোকের ব্যয় করবার মতো যথেষ্ট অর্থাগম হল। ধনী ও বড়লোকের মতো আমি বাস করতে লাগলাম। আমি বুঝে নিয়েছি, শেষে সব ভেঙে পড়বে; কিন্তু
যেহেতু একবার এই গোলকধাধায় ঢুকে পড়েছি, তখন সাঁতরে পাড়ে যেতেই
হবে অথবা ডুবে মরতে হবে। সামনে ধ্বংস আসন্ন- এমনি একটা পরিস্থিতি।
তার থেকে বাঁচতে হলে অতি সাবধানে, ধীর-স্থিরভাবে
উপায় বার করতে হবে। অন্যথায়, সমস্ত ব্যাপারটা হাস্যস্পদ হয়ে
পড়বে। রাত্রে ও অন্ধকারে
বিয়োগান্ত অংশটুকু থাকত আমার সামনে এবং সবসময় সেটা আমাকে সতর্ক করত আর ভয় দেখাত।
সুতরাং আমি আফসোস করতাম এবং বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটাতাম। ঘুম সহজে আসতে
চাইত না। দিনের বেলায় বিষাদের অংশটুকু কমে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত এবং আমি মুক্ত হাওয়ায়
জড়তা ও উন্মত্ততা পরিহার করে চলে-ফিরে বেড়াতাম। সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল। কারণ, আমি পৃথিবীর এই সেরা
রাজধানীতে খ্যাতনামা হয়ে পড়লাম। সেটা শুধু আমাকে একটু-একটু বিচলিত
করেই ছাড়েনি—আমার মাথা একদম ঘুরিয়ে দিল। এমন একটি সংবাদপত্র
পাবেন না—কী ইংরেজি, স্কটিশ কিংবা আইরিশ—যাতে পকেটে
দশলক্ষ পাউন্ডের নোটওয়ালার সর্বশেষ কাজ এবং বক্তব্যের কোনো উল্লেখ নেই। প্রথমে আমার
কথা উল্লেখ করা হয় বিবিধ কলামের নিচের দিকে, তারপর নাইটদের উপরে,
তারপর ব্যারনদের। এইভাবে নাম
যত ছড়াতে লাগল তত উপরের দিকে উঠতে লাগল—যতক্ষৎ-না একেবারে
সর্বোচ্চ স্থানে গিয়ে পৌছুলাম। সেটা হল ডিউকের উপরে এবং রাজবংশীয় ডিউকদের নিচে,
সর্বশ্রেণীর পাদরিদের ওপরে—শুধু প্রধান ধর্মর্যাজকের
নিচে। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবেন, এগুলো
আমার সুখ্যাতি নয়, আমি দুর্নামই কামাই করছি। এরপর এল সর্বোচ্চ
সম্মানের পুস্পবৃষ্টি-যা আমাকে অগৌরবের তলদেশ থেকে সর্বময় খ্যাতিতে
ভূষিত করে ফেলল। ‘পাঞ্চ’ পত্রিকা আমার
এক ব্যঙ্গচিত্র ছাপাল। এটাই আমাকে
মানুষ করল এবং আমার স্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হল। লোকে আমাকে
এখনও ঠাট্টা করতে পারে, কিন্তু সেটা সম্মানসূচকভাবে—জঘন্য বা কঠোরভাবে
নয়। আমাকে দেখে লোকে হাসতে পারে কিন্তু উপহাস করবে না। সে সময় চলে গেছে। পাঞ্চের ব্যঙ্গচিত্রে আঁকা হল : আমি
নোংরা পোশাকে ভূষিত হয়ে লন্ডন টাওয়ারে যাবার জন্য রাজার দেহরক্ষী সেনাদলের সঙ্গে লড়াই
করছি। এখন আমার অবস্থা সহজেই কল্পনা করতে পারেন। একজন যুবক যাকে কেউ কখনও চিনত না—এখন তার এমন
একটা কথা বলবার উপায় নেই, যা নাকি সঙ্গে সঙ্গে লোকের মুখে পুনরুল্লেখ না
হবে। বাইরে বেরুলেই
শোনা যাবে, লোকে বলাবলি করছে : ‘এই তিনি যাচ্ছেন। এই তো তিনি।’
নাস্তা
খেতে গেলে বিরাট এক জনতা তাকিয়ে থাকবে। কোনো নাট্যশালায় গেলে অসংখ্য অপেরা গ্লাস
দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হবে আমার ওপর। আমি যে কী বিরাট
গৌরবের ওপর সাঁতার কাটছিলাম, এই হল তার কিছু নমুনা।
আমি
আমার সেই নোংরা স্যুটটি রেখেছিলাম এবং মাঝে মাঝে সেটা পরে ছোটখাটো জিনিসপত্র কিনতে
গিয়ে অপমানিত হওয়া এবং পরক্ষণেই দশলক্ষ পাউন্ডের নোট বের করে নিন্দুকদের অপ্রস্তুত
করে দেবার আনন্দ উপভোগ করতাম। কিন্তু সেটা বেশি দিন চালাতে পারিনি। সচিত্র কাগজগুলো
আমার সে-পোশাকটিকে এত পরিচিত করে ফেলেছিল যে, যেমনটি আমি সেটা
পরে বের হতাম অমনি আমাকে চিনে ফেলত সবাই এবং একটা বড় জনতা আমার পেছন পেছন অনুগমন করত। আর কোনো জিনিস কিনতে গেলে নোট বের করবার আগেই দোকানদার তার
সমস্ত জিনিস আমাকে বাকি দিতে রাজি হয়ে যেত।
আমার
সুখ্যাতির দশম দিনে আমি আমার জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে আমাদের রাষ্ট্রদূতের
বাসভবনে গেলাম। এক্ষেত্রে যতটা
উৎসাহ দেখানো সম্ভব, তা দেখিয়েই তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু এত
দেরিতে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ায় তিনি যথেষ্ট অনুযোগ করলেন এবং বললেন :
এ ত্রুটি তিনি ক্ষমা করতে পারেন, যদি আমি ওই রাতে
তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে আমন্ত্রিত অতিথিদের একজনের অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতির শূন্যতা
পূর্ণ করি। আমি রাজি হলাম এবং আমরা দুজন কথাবার্তা বলতে লাগলাম। কথাপ্রসঙ্গে বেরিয়ে
পড়ল, তিনি এবং আমার বাবা স্কুলে সহপাঠী ছিলেন। পরে ইয়েলেও তারা
একত্রে লেখাপড়া করেছেন। সুতরাং, তিনি
আমাকে তার বাড়িতে সময়-অসময়ে আসা-যাওয়া
করতে অনুরোধ করলেন এবং আমি খুব আনন্দের সঙ্গে তাতে রাজি হলাম। আসলে এতে আমার খুব আগ্রহ ছিল এবং এ-ব্যাপারে
আমি খুব খুশি হলাম। কারন ঝামেলায় পড়লে তার সাহায্য পেতে পারি।
কীভাবে
সাহায্য করবেন, বলতে পারি না। তবে হয়তো চিন্তা করে বা বুদ্ধি দিয়ে তিনি সাহায্য
করতে পারবেন। কিন্তু এত দেরিতে তার কাছে আমার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার সাহস হল না। লন্ডনে আমার এ অদ্ভুত জীবনযাত্রার শুরুতে আমি হয়তো অসংকোচে তাকে
সবকিছু বলে ফেলতাম। না, এখন সেটা বলতে সাহস হল না। আমি অনেক জটিলতার ভেতর ঢুকে পড়েছি।
অন্তত এতটা বেশি মাখামাখির পর এমনি একজন নতুন বন্ধুর কাছে ব্যাপারটা বলার দায়িত্ব
আছে—যদিও তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা আওতার বাইরে নয়। কারণ, এত
ধার সত্ত্বেও আমি আমার সীমার মধ্যেই আছি—অর্থাৎ আমার বেতনের
পরিসীমার মধ্যে। অবিশ্যি আমার বেতন কত হবে, আমি জানি না। তবে বাজি যদি জিতে
যাই, তবে ধনী বুড়োর কাছ থেকে যে ভালো একটা দান পাব, সে ব্যাপারে একটা স্থির নিশ্চয়তা ছিল। অবিশ্যি, উপযুক্ত
প্রমাণিত হলে, তবেই। আমি যে উপযুক্ত প্রমাণিত হব সে সম্বন্ধে
আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। বাজির ব্যাপারে আমার তেমন দুর্ভাবনা ছিল না। কারণ,
সবসময়ই আমি বেশ ভাগ্যবান। বেতন সম্বন্ধে আমার অনুমান ছিল, বছরে কমপক্ষে ৬০০ থেকে
১০০০ পাউন্ড হবে। প্রথম বছরে
৬০০ এবং পরবর্তী বছরে বেড়ে গিয়ে নিজ দক্ষতাবলে সর্বোচ্চ অঙ্কে গিয়ে পৌছুব। বর্তমানে
আমার মোট দেনা প্রথম বছরের বেতনের সমান। সবাই আমাকে টাকা ধার দিতে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্ত্র তাদের প্রত্যেককে এটা-ওটা অজুহাত দিয়ে বিরত
করেছি।
মোট
ধার ছিল ৩০০ পাউন্ডের। অবিশ্যি, তিনশ
পাউন্ড বাকি সওদা ও থাকা-খাওয়ার দেনা। আমি বিশ্বাস করতাম, বুঝে-শুনে
খরচ করলে এবং হিসাব করে চললে আমার দ্বিতীয় বছরের বেতন দিয়ে বাকি মাসটা চালাতে পারব।
মাস শেষ হলে আমার মালিক তাঁর ভ্রমণ শেষ করে এসে পড়বেন এবং ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব ঠিক হয়ে
যাবে। কারণ তখন আমি আমার দু-বছরের বেতনই আমার পাওনাদারদের দিয়ে
দিতে পারব এবং সরাসরি কাজে মনোযোগ দিতে পারব। চৌদ্দজন অতিথির এক মনোজ্ঞ নৈশভোজ। শোরডিচের (Shoreditch) ডিউক ও তাঁর পত্নী, তাদের
কন্যা, লেডি এ্যান-গ্রেস-এলেনর-সেলেস্ট (Anne-Grace-Eleanor-Celeste), নিউগেটের
আর্ল ডি বহুন (de-Bohun) ও তার ভাই-কাউন্ট
(Viscount Cheapside) চিপসাইড, লর্ড ও লেডি ব্লাদারস্কাইট
(Blatherskite), আরও কয়েজন খেতাববিহীন নর-নারী, রাষ্ট্রদূত, তার পত্নী ও
কন্যা এবং কন্যার পোর্শিয়া ল্যাংহাম (Portia Langham) নামে ২২ বৎসর
বয়স্কা জনৈক ইংরেজ বান্ধবী—যিনি দুমিনিটের মধ্যেই আমাকে পসন্দ করে
ফেলেন এবং আমিও। সেটা স্বচ্ছভাবেই
আমার কাছে ধরা পড়ল। আরও একজন অতিথি
ছিলেন। তিনি একজন আমেরিকান। কিন্তু আমি গল্পের
খেই ছেড়ে দূরে এসে পড়েছি। অতিথিরা তখন বসবার ঘরে নৈশভোজের জন্যে অপেক্ষা করছেন এবং
নিষ্ক্রিয়ভাবে নবাগতদের লক্ষ করছেন। ইতিমধ্যে পরিচারক ঘোষণা করলঃ
‘মিস্টার লয়েড হেস্টিংস’
স্বাভাবিক
সৌজন্য প্রকাশের পর হেস্টিংসের সঙ্গে চোখাচোখি হলাম। হাত প্রসারিত করে সে সোজা আমার দিকে এগিয়ে এল। এরপর করমর্দন করতে গিয়ে হঠাৎ সে থেমে গেল এবং অপ্রস্তুত হয়ে বলল :
‘মাফ করবেন স্যার, মনে
হয় আপনাকে আমি চিনি।'
‘নিশ্চয়ই চেন।
আমরা তো পুরনো পরিচিত।’
‘মনে হয় না
আপনিই...।’
‘হ্যা, জামার
পকেটে দশলক্ষ পাউন্ডের নোট নিয়ে বেড়ানো সেই দানব?’
‘হ্যা, আমি
সেই। আমার নতুন ডাক-নামে ডাকতে ভয় পেও না। আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে
গেছি।’
‘কী
আশ্চর্য! আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। কয়েকবারই দেখেছি, তোমার
নামের সঙ্গে এই ডাকনাম জুড়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু আমি কখনও ভাবতেই পারিনি যে,
এই বহু বিঘোষিত ভদ্রলোকই আমাদের হেনরি এডামস (Henry Adams) দি ব্যাজার, ছয় মাস আগেও ফ্রিসকোর
ব্ল্যাক হপকিনসের কাছে তুমি কেরানিগিরি করছিলে। অতিরিক্ত বেতনের জন্য কত রাত জেগে কাটিয়েছ। পাউন্ড ও কারি এক্সটেনশনের হিসাবপত্র তৈরিতে তুমি আমাকে
সাহায্য করতে। কী করে লন্ডনে আসার মতলব করলে এবং কেমন করে এতবড় খ্যাতনামা কোটিপতি
হয়ে পড়লে!
কী করে এই আরব্য-উপন্যাস বাস্তবে রূপায়িত হল?
আরে, আমি যে কিছুই বিশ্বাস করতে পারছি না। বুঝতেও পারছি না। আমার মাথায় যে আবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেটা শান্ত
হতে সময় দাও।’
‘লয়েড, তুমি
আমার চেয়ে বেশি হতবুদ্ধি হওনি। আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারি নাই।’
‘অবাক করে তুললে
যে। তিন মাস আগেই-না আমরা
খনিশ্রমিকদের রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম।’
‘না, হোয়াইট
চিয়ারে।’
‘ঠিক বলেছ, হোয়াইট
চিয়ারেই। এক্সটেনশন কাগজগুলোর জন্য ছয়ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনির পর ভোর দুটোর সময় আমরা
সেখানে গিয়ে বসলাম। তোমাকে আমার
সঙ্গে লন্ডনে আসবার জন্য কত পীড়াপীড়ি করলাম। তোমার ছুটি মঞ্জুর করিয়ে দিতে চাইলাম। তোমার সমস্ত খরচপত্রও দিতে চাইলাম। তাছাড়া, বিক্রিতে
লাভবান হলে তোমাকে কিছু মুনাফাও দিতে চাইলাম। তুমি কিছুতেই আমার কথা শুনলে না— বরং
বললে, আমি তাতে সফল হব না। তুমি কাজ ছেড়ে এসে আবার কাজ পাওয়া-না-পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে আসতে চাওনি! কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ তোমাকে এখানে দেখছি। এটা কেমন বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। বল, কী করে তুমি এখানে এসে পড়লে
এবং কী করেই-বা এই অবিশ্বাস্য ভাগ্যলাভ করলে?’
‘শোন লয়েড, এটা
একটা আকস্মিক ঘটনা। এই দীর্ঘ একটা গল্প—কেউ বলবে, রোমাঞ্চকর
ব্যাপার। আমি তোমাকে সব বলব- তবে এখন নয়।’
‘কখন?’
‘এ-মাসের
শেষে।’
‘আরও এক পক্ষকাল
বাকি আছে তার। এই দীর্ঘ সময়
কৌতূহল দমিয়ে রাখা বিরাট ধৈর্যের ব্যাপার। সময়টা এক-সপ্তাহ
কর, ভাই।’
‘আমি তা পারব
না। কেন পারব না, তা-ও ধীরে-সুস্থে জানতে পারবে। কিন্তু তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?’
তার
মুখের সমস্ত প্রফুল্লতা একটা নিঃশ্বাসের মতো যেন উবে গেল। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললঃ ‘পল, তুমি
সত্যিকারের ভবিষ্যৎ-বক্তা। আমি না-এলেই ভালো করতাম। এ-ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না।’
‘তোমাকে অবশ্যই
বলতে হবে। এখান থেকে ছাড়া পেলে তুমি আমার সঙ্গে আসবে। রাতে আমার ওখানে থাকবে এবং আমাকে সব খুলে বলবে।’
‘সত্যি! তুমি
সত্যি কথা বলছ?’ -তার
চোখে জল এসে পড়ল।
‘হ্যা, আমি
সমস্ত ঘটনা জানতে চাই, তার প্রতিটি শব্দ পর্যন্ত।’
‘আহ, আমি
কৃতার্থ হলাম। আমার জীবনে যা ঘটে গেছে, তারপর তোমার কথায় এবং
দৃষ্টিতে আমার প্রতি তোমার যে আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে
তোমার কাছে নতজানু হতে ইচ্ছে করছে আমার।’
সে
শক্ত করে আমার হাত আঁকড়ে ধরল, ধরে রাখল এবং তারপর সব ঠিক হয়ে গেল। এরপর
নৈশভোজের জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু ভোজ হয়ে উঠল না। সাধারণত ইংরেজ-সমাজে খানাপিনার ব্যাপারে পদমর্যাদার স্তরভেদ নিয়ে যে সংকীর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি
হয়, তাই হল। ফলে খাওয়া
প্রায় হল না। ইংরেজরা ভোজের
নিমন্ত্রণে যাবার আগেই ভোজ শেষ করে যায়। কারণ, তারা সামনের অনিশ্চয়তা
সম্পর্কে সচেতন থাকে। কিন্তু আগন্তুকদের কেউ সতর্ক করে দেয় না। ফলে, তারা একই ফাঁদে পড়ে যায়। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের মতো এ-ধরনের অসুবিধায় কেউ পড়েনি। কারণ, এর আগে আমরা সবাই
ভোজের আমন্ত্রণে গেছি। একমাত্র হেস্টিংস ছাড়া নবীশ কেউ ছিল না। তাকে রাষ্ট্রদূত জানিয়ে দিয়েছিল যে, ইংরেজ-পদ্ধতির এই অনিশ্চয়তার জন্য তিনি কোনো ভোজের বন্দোবস্ত করেননি। সকলেই একজন
করে মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করে ভেজের ঘরে প্রবেশ করল। কারণ, ভোজের জন্য আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের সঙ্গে চলাচল করতে হয়।
কিন্ত
এ-ব্যাপারেই প্রথম গোলমাল দেখা দেয় শোরডিচের ডিউকই সর্বপ্রথম টেবিলের সামনে
গিয়ে প্রধান আসনে বসবার দাবি করলেন। তার ধারণাঃ একজন রাষ্ট্রদূত একটা জাতির প্রতিনিধিত্ব
করেন—কোনো রাজা নয়। কিন্তু আমি আমার প্রাধান্য দাবি করে বসলাম এবং
কিছুতেই নতি স্বীকার করলাম না। সংবাদপত্রের বিবিধ পর্যায়ের কলামে রাজবংশীয় ডিউক ছাড়া
সকলের আগে আমার স্থান। আমি সে-কথা
ঘোষণা করলাম এবং অগ্রাধিকার দাবি করলাম। ঝাকাঝাকি করে সাধারণত যেমন হয়, এ-ব্যাপারেও তেমনি কোনোরকম মীমাংসায় আসা গেল না। অবশেষে
তিনি তার বংশাবলি ও অতীতের পদমর্যাদার উল্লেখ করলেন। তার বংশধররা ছিলেন বিজয়ী যোদ্ধা।
সেজন্য আমি তাকে আদমের বংশধর বলে তুলে ধরলাম এবং আমাকেও সেই একই আদমের বংশধর বলে পরিচয়
দিলাম। বিশেষ করে আমার
নামই যখন তার প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য। পক্ষান্তরে, তার
নিজের প্রদত্ত পরিচয়ের বিবরণ থেকে জানা গেছে যে তিনি নরমান জাতির এক অপ্রধান শাখা থেকে
এসেছেন। সুতরাং আমরা সবাই আবার মিছিল করে বসবার ঘরে ফিরে এলাম এবং লম্বা সারিতে শ্রেণীবদ্ধ
হয়ে সার্ডিন মাছের ঝোল ও স্ট্রবেরি খেলাম। সবাইকে ছোট-ছোট দলে
মিলিত হয়ে দাড়িয়ে খেতে হল। এখানে প্রাধান্য
বা মর্যাদার প্রশ্ন এতটা পীড়াদায়ক নয়। এ-ক্ষেত্রে
খানা শুরু হওয়ার আগে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার দু-জন ভদ্রলোক একটা
শিলিং ছুড়ে দেন। যিনি জেতেন
তিনি স্ট্রবেরি খান, আর যিনি হেরে যান তিনি শিলিংটা পান। পরবর্তী দু-জনও ঠিক অনুরূপভাবে মুদ্রা ছেড়ে। তারপর আরো
দু-জন, তারপর আরও—এমনি করে চলতে
থাকে। খাওয়ার পর আমরা প্রতি খেলায় ছ-পেনি হারে cribbage খেলতে বসে গেলাম। ইংরেজরা কেবল আমাদের উদ্দেশে কোনো খেলা খেলে না।
No comments:
Post a Comment