ছোট গল্প - সোনালী মৌমাছি - ফয়েজ আহমদ - Short Story - Sonali Moumachi - Foyez Ahmod |
ছোট
গল্প - সোনালী মৌমাছি - ফয়েজ আহমদ
রোববারের
বিকেল। হালকা রোদ আরো হালকা হয়ে আসছে। লুবু মাঠ থেকে খেলা করে দৌড়ে আসছিল বাড়িতে। সে তার ছোট্ট বাগানটায় ঢুকেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। চুপটি করে পা টিপে টিপে সে কুলগাছের পাতার আড়ালে আড়ালে ঘুরে
বেড়াতে লাগল, কিছু একটা ধরতে চায় সে।
মা
তার অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এসে বললেন : কি
করছ, লুবু?
কোনো
উত্তর নেই। কেবল নিজের
মুখের উপর ডান হাতের তর্জনী রেখে ইঙ্গিত করল লুবু, চুপ, কথা বোলো না।
মা
একটু থেমে আবার বললেন : ও, তুমি ফড়িং ধরছ বুঝি—না প্রজাপতি?
লুবুর
সম্মুখের ফুলটা থেকে একটা সোনালী মৌমাছি উড়ে গিয়ে বসল একটু দূরে আর একটা পুলে। গুন গুন করে গান গেয়ে মধু খাচ্ছিল মৌমাছিটা।
কি
যে করলে,
মা! তোমার কথা শুনে সুন্দর মৌমাছিটা সরে পড়ল!
লুবুর ভারি দুঃখ।
মা
তো অবাক
: বলল কি, মৌমাছি ধরতে নেই, হুল ফুটিয়ে দেবে!
‘কেন, সে
হুল ফুটাবে? তাকে তো আমি আদর-যত্ন করে রাখব,
তার গান শুনব আমি! তা ছাড়া সে আমাদেরই আমগাছে
থাকে।’
মা
বললেন
: না বাবা, দরকার নেই মৌমাছির গানে। তুমি এসে পড়। এই বলে মা চলে
গেলেন।
মিহি
সুরে হেসে উঠলো মৌমাছিটা। যেন একটা পাতলা
তারের বাদ্যযন্ত্রে কেউ টোকা দিয়েছে। তারপর মৌমাছিটা
বলল :
তোমার মা ঠিকই বলেছেন। শুধু আমিই তোমাকে
হুল ফুটিয়ে দেব না, শত শত মৌমাছি-বন্ধু এসে
তোমাকে আক্রমণ করবে!
লুবু
একটু এগিয়ে মৌমাছিকে বলল : তোমাদের মধ্যে তো ভারি জোট দেখছি হে!
‘জোট থাকবে না?’ মৌমাছি লুবুর
দিকে মুখ তুলে ফুলের পাপড়ির উপর দাঁড়িয়ে বলল : ‘আমরা যদি পরস্পরকে
সাহায্য করতে না আসি, তবে তো তোমাদের মতো ছেলেরা এক দিনেই আমাদের বংশ
উজাড় করে দেবে।’
‘আচ্ছা, তোমাদের
এই দল বেঁধে থাকার বুদ্ধি কে দিল?’ লুবু
প্রশ্ন করল।
‘আমরা অনেক দুঃখ
পেয়েই শিখেছি।’ মৌমাছি বলে
চলল :
‘তোমাকে তবে
খুলে বলি সব কথা। তিনটে-বুদ্ধি
আমাদের হয়েছে, তিনটে ঘটনায়। তোমাদের মতোই ছিলাম আমরা এক সময়। আমাদের রাজ্যের রাজা ছিলেন ভয়ানক স্বার্থপর আর তিনি তার সভাসদদের
কথাই কেবল শুনতেন। তিনি ভাবতেন
রাজ্যে তার চেয়ে বুদ্ধিমান কেউই নেই।’
শোনাও
দেখি তোমাদের রাজার গল্প। মৌমাছি শুরু
করল :
রাজার সভাসদদের মধ্যে মন্ত্রী, সেনাপতি,
বৈজ্ঞানিক আর একজন যাদুকর ছিলেন সবচেয়ে খয়েরখা, মানে জী-হুজুর গোছের লোক—রাজা যা বলেন। তাতেই রাজি! রাজার খাজনা আর নানা ধরনের কর দিতে দিতেই
আমাদের সব টাকা ফুরিয়ে যেত। তার উপর বৈজ্ঞানিকের পরামর্শে রাজা একবার রাজ্যময় ঢোল পিটিয়ে
দিলেন— প্রজাদের
শালগাছের পাতা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতে হবে, গরিবের এর বেশি লাগে
না! ভালো ঘর না বানিয়ে যে টাকা বাঁচবে তা দিয়ে আসতে হবে রাজাকে।
‘তোমরা রাজার
কথা শুনলে কেন? শালপাতার ঘরে লোকে থাকতে পারে!’ লুবু বলল।
‘সবাই রাজার
অত্যাচারের ভয়ে শালপাতার ঘর বানিয়ে বাকি টাকা সব দিয়ে এলো রাজকোষে।’ মৌমাছি বলল : ‘রাজা পাহাড়
কেটে পাথর এনে আমাদের টাকা দিয়ে বানালেন একটার পর একটা প্রাসাদ। তারপর নতুন প্রাসাদে সভা ডেকে একদিন রাজা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন—কে সবচেয়ে
বুদ্ধিমান দুনিয়ায়?
মন্ত্রিগণ
একসাথে উত্তর দিলেন— ‘আমাদের দয়ালু
মহারাজা!’ রাজা সবাইকে
মিষ্টি খাইয়ে বিদায় দিলেন।
‘রাজার মন্ত্রীরা
সব ভাঁড় দেখছি!’
‘কিন্তু আমাদের
গায়ে এক বাড়িতে সাত ভাই আর এক বোন ছিল। সবার ছোট বোনকে
সাত ভাই এত ভালোবাসত যে, বোন যা বলত ভাইরা সে-কাজ
করতই। বোন ভাইদের
বলল, তাদের ঘরগুলো শালপাতার বদলে শালগাছের হওয়া চাই। শালপাতার ঘরে অনেক বিপদ, সে বাস করতে পারবে না। ভাইরা তাই করলো। রাজাকে সামান্য
কিছু টাকা দিয়ে এলো। কিছুদিন পর
বৈশাখ মাসের এক দিন ভয়ানক ঝড় বয়ে গেল। সর্বনাশা ঝড়
গরিব প্রজাদের সমস্ত শালপাতার ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেল আকাশে, কোনো
চিহ্নমাত্র রইল না ঘরের! চারদিকে প্রজাদের কান্নার রোল উঠলো। কিন্তু কেবলমাত্র সেই সাত ভাই, এক বোনের ঘর ঝড়ে উড়ে
গেল না।
‘এবার রাজা কি
বলেন?’
‘তিনি রাজসভার
পরামর্শ চাইলেন নতুন করে টাকা উঠাবার জন্যে।’ মৌমাছি বলতে
লাগল
: এবার মন্ত্রী পরামর্শ দিলেন-- ‘হুজুর, ফরমান
জারি করে দিন, কেউ যেন ধান ইত্যাদি খাদ্যশস্য গোলা করে জমিয়ে
না রাখে। অতিরিক্ত সব
শস্য রাজগোলায় উঠবে, বেশি খেয়ে গরিবের অসুখ হতে পারে!’
শুনে
রাজা ভারি খুশি। এবার রাজা সবাইকে
জিজ্ঞেস করলেন—কে সবচেয়ে বুদ্ধিমান দুনিয়ায়?
সভার
মন্ত্রিগণ একসাথে উত্তর দিলেন—আমাদের দয়ালু রাজা। রাজা সন্তুষ্ট হয়ে সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন।
কিন্তু
রাজ-দরবারের এক কোণে খাঁচার মধ্যে ছিল রাজার প্রিয় কাকাতুয়া। সে বলে উঠলো-- সবচেয়ে বুদ্ধিমতী সেই সাত ভাই-এর এক বোন, যার শালগাছের ঘর ঝড়ে উড়িয়ে নেয়নি!
কাকাতুয়া
ঠিক বলেছে।
সেই
থেকে আমরা নিজেদের ঘর তৈরি করি শক্ত করে, যাতে ঝড়বৃষ্টি ক্ষতি করতে না
পারে। এই আমাদের প্রথম
শিক্ষা।
‘তারপর?’
তারপর
রাজার লোক গায়ে গায়ে ঢোল পিটিয়ে হুকুম জারি করে গেল রাজাকে অতিরিক্ত শস্য দিয়ে
আসার। প্রজারা নিজেদের পিঠে বয়ে সব ধান, শস্য
রাজার গোলায় দিয়ে এলো অত্যাচারের ভয়ে। রাজা সে শস্য বিক্রি করে লাখে লাখে টাকা দিয়ে প্রাসাদ সাজাবার
জিনিসপত্র ক্রয় করলেন। কিন্তু দেশে
আবার দুর্যোগ এলো, এবার ভাতের অভাব। কারো ঘরেই ধান চাল নেই, বাজারেও কিনতে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া কেনার ক্ষমতা কোথায় তাদের? চারদিকে
হাহাকার পড়ে গেল, দেশে ভাতের অভাবে অর্ধেক লোকই মারা গেল!
সেই সাত ভাই-এর এক বোন গোলার ধান রাজাকে দেয়নি। ভাইদের সে বলেছিল—আমি অভাবের
দিনে কষ্ট করতে পারব না! তারা সবাই ছিল বেঁচে।
‘এবার রাজা কি
বলেন?’
রাজা
সভা ডেকে বললেন, ‘আমার প্রাসাদ
ও জিনিসপত্র পাহারা দেয়ার জন্যে লোকজনের দরকার। তাদের মাইনে, পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাওয়া-দাওয়ার জন্যে টাকা চাই।’ মৌমাছি মুখ
কালো করে কথাগুলো বলছিল : এবার সেনাপতি পরামর্শ দিলেন--- ‘হুজুর, দেশরক্ষার
জন্যে টাকা দরকার। আপনি আদেশ করুন
প্রজারা যেন তাদের সমস্ত ঢাল-তলোয়ার, বল্লম,
বর্ম, কোটালের কাছে জমা দেয়। সে সমস্ত অন্য রাজার কাছে বিক্রি করে বিস্তর টাকা হবে। তা ছাড়া প্রজাদের কাছে অস্ত্র থাকলে কখন যে বিদ্রোহ করে বসে, ঠিক
আছে?’ রাজার মনে ধরল পরামর্শ।
এবার
রাজা সভার সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এদেশে সবচেয়ে
বুদ্ধিমান?’
সভার
মন্ত্রিগণ একসাথে উত্তর দিলেন, ‘আমাদের দয়াল রাজা।’
খুশি
হয়ে রাজা সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। কিন্তু সেই
কাকাতুয়া এতক্ষণ চুপ ছিল, সে বলল—রাজ্যে সবচেয়ে
বুদ্ধিমতী সাত ভাই-এর এক বোন, যে রাজাকে গোলার
ধান না দিয়ে অভাবের সময় কষ্ট পায়নি।
কাকাতুয়া
ঠিক বলেছে।
সেই
থেকে আমরা দুর্দিনের ভয়ে খাদ্য জুগিয়ে রাখি। এই আমাদের দ্বিতীয় শিক্ষা। মৌমাছি বলল।
‘তারপর?’
‘তারপর রাজার
ঢুলী রাজ্যের গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে সমস্ত, আত্মরক্ষার অস্ত্র কোটালের কাছে
জমা দিতে বলে গেল। গরিব প্রজারা
রাজার ভয়ে সমস্ত ঢাল-তলোয়ার দিয়ে এলো গরুর গাড়িতে চাপিয়ে। কিন্তু সেই সাত ভাই-এর এক বোন ভাইদের রাজাকে অস্ত্র
দিতে মানা করেছিল। সে বলেছিল—দেশে চোর-ডাকাতের
ভয় রয়েছে, কোনো অস্ত্র না থাকলে আমার
ভয় করে। ভাইরা বোনের
কথামতো কোনো অস্ত্রই রাজাকে দেয়নি। আমাদের রাজা
সমস্ত অস্ত্র অন্য দেশের রাজার কাছে বিক্রি করে প্রাসাদের খরচ চালাতে লাগলেন। অন্য রাজার নতুন অস্ত্র পেয়ে শক্তি বেড়ে গেল। তিনি একদিন আমাদের দেশ আক্রমণ করলেন। আমাদের রাজা পরাজিত হতে বাধ্য হলেন। কারণ তার অস্ত্র আর সৈন্য নেই বললেই চলে। আর প্রজারা তো মাটির পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল অস্ত্র ছাড়া। তিন দেশের রাজার সৈন্যরা দেশের সব লুট করে নিয়ে গেল, বহু
লোক মারা গেল। আমাদের রাজা
পরাজিত হয়ে বিজয়ী রাজাকে কর দিতে রাজি হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেন। এদিকে সেই সাত ভাই আর এক বোন তাদের অস্ত্র দিয়ে শত্রুদের বাধা
দিল। তারা সবাইকে ডেকে নিয়ে রুখে দাঁড়াল। তাদের গ্রামের তিন দিকে নদী। তারা বাকি দিকটা বিরাট খাল কেটে দু’দিকের নদীর
সাথে মিলিয়ে দিল। শত্রু সৈন্য
আর গ্রামে আসতে সাহসই পেল না। মৌমাছি খুব
গর্বের সাথে শেষের কথাগুলো বলল।’
‘এবার রাজা কি
বলেন?’
‘রাজা সভা ডেকে
পরামর্শ চাইলেন, কি করে রাজ্য উদ্ধার করা যায়! কিন্তু
সভায় কেবলমাত্র উপস্থিত সেই যাদুকর—আর সব মন্ত্রীই যুদ্ধের
সময় ভেড়ার মতো কোনো প্রকার বাধা না দিয়েই মারা গেছেন! যাদুকর
কোনো বুদ্ধি দিতে পারলেন না। কি করেই বা
দেবেন?
কেউ যে রাজার কথা শুনবে, তা তো বলা যায় না!
রাজা ভয়ানক খেপে গেলেন। নিজের মনে শক্তি ও সাহস আনার জন্যে তিনি যাদুকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে
রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান?’
যাদুকর
চিৎকার করে বলল : আমাদের দয়ালু রাজা।
রাজা
খুশি হয়ে তাকে মিষ্টি খাওয়ালেন। এমন সময় রাজ-দরবারের
কোণ থেকে সেই কাকাতুয়া বলে উঠলো, রাজ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী সাত
ভাই-এর এক বোন, যে রাজাকে কোনো অস্ত্র দেয়নি। সে গ্রামের সবাইকে নিয়ে যুদ্ধ করে শত্রুদের তাড়িয়েছে।
কাকাতুয়া
ঠিক বলেছে!
সেই
থেকে আমরা সাথে অস্ত্র রাখি, শত্রুকে ঘায়েল করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ
করি। এই আমাদের তৃতীয়
শিক্ষা। মৌমাছি বলল।
‘তারপর?’
তারপর
রাজা কাকুতুয়া আর সাত ভাই এক বোনের উপর রেগে গেলেন। তক্ষুনি কাকাতুয়াটাকে ছেড়ে দিলেন। সে উড়ে বনে চলে গেল। প্রহরীদের হুকুম
দিলেন সাত ভাইতে বেঁধে নিয়ে আসতে দরবারে। বিচার হবে, কেন
তারা রাজার নির্দেশ মানেনি।
শয়তান
যাদুকরকে বললেন, মন্ত্রবলে সাত ভাই-এর বোন ও তার গ্রামের
লোকদের সামান্য পোকায় পরিণত করতে!
‘শয়তান যাদুকরের
যাদুতে তোমরা মৌমাছি হয়ে গেছ?’
‘হ্যা,
কুফরী কালাম ব্যবহার করে জাদু করে আমাদের মৌমাছি বানিয়ে দেওয়া হল, যাতে কোনো নিজস্ব দেশ আমাদের না থাকে! আমরা আজকে এখানে,
কালকে ওখানে। সাত ভাই-এর বোন
অনেক বুদ্ধিমতী তাই আমরা তাকে রানী বানালাম, আমরা তিন শিক্ষা ভুলিনি। আমরা ভালো করে বাসা বানিয়ে থাকি, দুর্দিনের
জন্য খাদ্য জুগিয়ে রাখি আর ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুকে রুখি। অনেক গল্প হল, আমার তাড়া আছে বলে সোনালী মৌমাছিটা সন্ধ্যার আবছা অন্ধাকারে
গুন গুন করে গান গেয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল।
লুবু
‘দাড়াও,
দাড়াও, মৌমাছি,’ বলে পেছন থেকে তাকে ডাকছিল।
আম্মু
তাকে ঠেলা দিয়ে বললেন, এই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠ, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
লুবু
চোখ কচলাতে কচলাতে খেয়াল করল সে আসলে বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছিল।
No comments:
Post a Comment