খণ্ডচিত্র - ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে - শরীফ-উজ-জামান স্বপন - পর্ব ১ |
খণ্ডচিত্র - ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে - শরীফ-উজ-জামান স্বপন - পর্ব ১
আমি নিশ্চিত যে,
এই অভিজ্ঞতা আপনাদেরও অনেকের আছে। ওই সব গুটিকয়েক বাঙালির জন্য আজ গোটা জাতিই কলংকিত।
(ক)
স্থান রোমা টেরমিনি স্টেশন, ইটালী ২০০০ সাল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেই টেলিফোন বুথ এর দিকে এগোলাম-দেশে ফোন করব। ব্যাটারি চালিত ছোট্ট গাড়ি এসে থামল এবং একজন পুলিশ বলল, দেশ কোথায়। বাংলাদেশ বলতেই আরও দু’জন আমার পকেট, সাথের ছোট্ট ব্যাগ এমনকী পাসপোর্টও খুলে দেখল এবং বলল, সরি,
তুমি ট্যুরিস্ট এবং ভিসার মেয়াদেই আছ। আমি রাগ করে কারণ জানতে চাইলে বলল, আমরা একটা চক্র গ্রেফতার করেছি, তারা সরু সুতোয় কয়েন বেধে টেলিফোন বক্স- এ নামায় এবং কল শেষে আবার তুলে নেয় টেনে। ওদের অধিকাংশই তোমার দেশের নাগরিক! সেইজন্যই তল্লাশি, সরি...
(খ)
প্রানেস্টিনা, রোম। সকালে এখানে এক বাঙালি মেসে এসেছি এক ছেলেকে কিছু ডলার দেব, ওর বাবা দেশ থেকে আমার কাছে দিয়েছেন। ১৪ ফুট গুণ ১৮ ফুট মাপের কামরা, কিন্তু ১২ টি ক্যাম্প খাটের মত বেড প্রতিটি আড়াই ফুট চওড়া এবং দুই বেডের মাঝে এক ফুটের গ্যাপ, চলাচলের জন্য। দিন আর রাত ডিউটি, তাই ওই ঘরে ১৬ জন থাকে। একটা মাত্র টয়লেট। ডলার দিয়ে বের হব এমন সময়, সেই ছেলেটা বলল, চলেন, একসাথেই বেরুব।
ট্রামের টিকিট কাটতে চাইলে, সে জানাল, টিকিট কাঁটা লাগবে না। কেন লাগবে না, জানতে চাইলে বলল, এখানে টিকিট কেটে ট্রামে বা বাসের মধ্যেই মেশিনে ঢুকিয়ে ডেট পাঞ্চ করে নিতে হয়। পাঞ্চ করার পর ৭৫ মিনিট পর্যন্ত জার্নি করা যায় যেকোনও রুটে! তারা সবাই ওইরকম টিকিট কিনেছে কিন্তু কখনোই পাঞ্চ করে না,
ফলে এক টিকিট দিয়েই মাসের পর মাস চালায়। শুধু স্পেশিয়াল চেকিং হলে চট করে পাঞ্চ করিয়ে নেয়, আবার কেউ কেউ বলে যে পাঞ্চ করে নিতে ভুলে গেছে...
(গ)
প্যারিস, ২০০৪। আইফেল টাওয়ারের পাশ থেকে বাসে উঠেছি। পন্তে নাফ হয়ে রুয়ে দো রিভোলিতে যাব লুভর মিউজিয়ামে। হঠাৎ আর একজন বাংলাদেশি উঠতেই, এক যাত্রী ফ্রেঞ্চ ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল এবং সবাই ওই লোকের দিকে তাকাল। দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগেই সে লাফিয়ে নেমে গেল। আমি আমার বেলজিয়ান বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো?
সে জানাল যে মরোক্কান, আলজেরিয়ান এবং ভারত বর্ষের লোক উঠলেই ওই ভাবে সাবধান করে। ওরা নাকি পকেট মারে অথবা কোনও ব্যাগ নিয়ে নেমে যায়। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালাম, ভাগ্যিস ব্রুনো ছিল সাথে অথবা আমার ওভারকোট ও সানগ্রাসের জন্য আমাকে দেখেও টেচিয়ে ওঠেনি।
(ঘ)
আমার একমাত্র ছেলে ফ্রান্সের রশেল (Rochelle) শহরে বি.বি.এ পড়ে। ডেইভ ইন্টার্নশিপ করার জন্য কাগজপত্র জমা দিল গ্রিস-এর এক পাঁচ তারা হোটেলে। শেষ মুহূর্তে জানানো হলো, তারা কোনও বাংলাদেশিকে নেবে না, কারণ গ্রিসে, নাকি বাংলাদেশিদের ট্র্যাক-রেকর্ড ভাল না। রাগে দুঃখে সে সুইস সীমান্তের একটা অখ্যাত শহরে ইন্টার্নি করতে বাধ্য হলো।
(ড)
কুয়ালালামপুর, ২০০৩। পাচদিনের জন্য জালান সুলতান ইসমাইল রোডে মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের হেড অফিসের উল্টোদিকে হোটেল ইকুটোরিয়ালে উঠেছি। প্রায় প্রতিদিনই ওখান থেকে একটা মার্কেটে যেতাম-ট্যাক্সিতে বিল উঠত-১.৭ অথবা ১.৯ রিংগিট। ওই এলাকায় বাংলাদেশি অনেক। একদিন এক বাংলাদেশি ট্যাক্সি-ড্রাইভারের কথায় তার ট্যাক্সিতে উঠে হোটেলে ফিরলাম। একই রাস্তা দিয়ে বরাবরের মতই এলাম, কিন্তু-বিল উঠল ৩.৬ রিংগিত। আমার চোখ কপালে উঠল- ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, আপনার
সামনেই তো মিটারে উঠল, আমার কি কী দোষ?
হোটেলের যে পোর্টার দরজা খুলে দিল সে-ও বলল যে দুই রিংগিটের উপরে কোনওদিন ভাড়া উঠতে দেখেনি! ট্যাক্সি চলে যেতেই আমার ব্যাগ নিয়ে বলল,
এই শালারা খুব চোর,
মিটার ট্যাম্পারিং করে...
(চ)
ফ্রেণ্ডশীপ ব্রিজ, থাই-লাওস বর্ডার। বাপ- ব্যাটা চিয়াং খোং থেকে উথানথানি এলাম এবং নংখাই-এর নাইট কোচ ধরলাম। বাসে ফ্রান্সের হোমার এবং তার ফিয়াসে (বাগদত্তা) এলিসা ছিল। চারজনের বন্ধুত্ব দীর্ঘ যাত্রার বিভিন্ন-ঘটনা চক্রে জমে ক্ষীর হয়ে গেল। আমরা দুই মিনিটে থাই সীমান্ত পার হয়ে লাওস-এ ঢুকলাম। হোমারদের ভিসা ছিল না তাই ওদের ভিসা পেতে আধ ঘণ্টার মত দেরি হবে দেখে ওদের বললাম ওরা যেন লাওস-এ এসে কাছের ডিউটি ফ্রি শপ-এ ঢোকে এবং আমরা একসঙ্গেই আধ ঘণ্টারও কম দূরত্বে রাজধানী ভিয়েনশিয়েন যাব। ওরা খুশি হয়ে রাজি হলো। ছেলের জন্য চকলেট, জার্সি এবং আমার জন্য আফটার শেভ ও টুকিটাকি কিনে দেখলাম ১৬২ ডলার হয়েছে। দুটো ১০০ ডলারের নোট দিতেই পাসপোর্ট চাইল। পাসপোর্ট দেখেই কানাঘুষা চলল মিনিট কয়েক, তারপর টেলিফোন করলে এক অফিসার এসে ডলার উল্টে পাল্টে দেখে বলল, ব্যাংকের অথিন্টিকেশন লাগবে, অপেক্ষা করেন, এক্সপার্ট আসছে ভিয়েনশিয়েন থেকে।
আমি সাফাই গাইতেই বলল, গতমাসে যে দুটো জাল নোট ধরা পড়েছে-দুজনেই বাংলাদেশি! মিনিট পনেরো পরে এক্সপার্ট নয়, হোমাররা এল এবং সব শুনে নোট দুটো দেখে পারফেক্ট বলে রায় দিলেও ওরা সন্তুষ্ট হলো না। এলিসা তার পার্স থেকে দুটো নোট দিলে দাত কেলিয়ে হাসল এবং আমাকে ৩৮ ডলার ফেরৎ দিল এবং বলল, যান,
ম্যাডামের জন্য বেঁচে গেলেন।
এলিসা আমার জাল
(!) নোট দুটো তার পার্স এ ঢোকাল এবং ধ্যাড়ধ্যাড়ে মডেলের এক ভুটভুটির মত টেম্পুতে আমাদের সঙ্গে উঠে বসল।
(ছ)
কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট। অপেক্ষা করছি ঢাকাগামী মালয়েশিয়ান-প্লেনের জন্য। সুটেড-বুটেড হাই ক্লাস এক ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বলছেন, কারও কাছে বাংলাদেশি এক টাকার কয়েন হবে? ওই কয়েন - সাইজ আর
ওজনে দশগুণ মূল্যমানের স্থানীয় কয়েনের বদলে টেলিফোন বক্স-এ নাকি ব্যবহার করা যায় এবং উনি
(?) নারি বহুবার ব্যবহার করেওছেন।
কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী নিষেধ করলেন, তাকে চেন না। ঢাকায় নামলে হাত পা ভেঙে দেবে মেরে... অক্ষমতায় চুপ করে থাকলাম।
পরের পর্ব
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)
বলেনঃ যে ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের কেউ (উম্মাত) নয়। (মুসলিম)
No comments:
Post a Comment