বড় গল্প,শওকত ওসমান, Boro golpo,Shawkat Osman |
বড় গল্প – প্রাইজ - শওকত ওসমান – Boro golpo – Prize - Shawkat Osman
এই কাহিনী শুরুর আগে তোমাদের কাছে কয়েকটা বাড়তি কথা
আছে। বাড়তি কেন জানো? অনেকের হয়ত ব্যাপারটা
জানা, তবু দু’একজন নাও জানতে পারে! তাই কথা একটু বাড়াতে হোলো। এই বাচালতা তোমরা সহ্য করে নেবে, সে-ভরসা আমার আছে।
স্পোর্টসের সময় তোমাদের স্কুলে কি ‘ড্রেস এজ ইউ লাইক’ বা ‘ফ্যান্সি ড্রেস
প্রতিযোগিতা’ হয়? তখন দেখে থাকবে তোমার সহপাঠিরা,
এমন কি তুমি নিজেই হয়ত কিছু সেজে বসে আছে। কেউ হয়ত চানাচুরওয়ালা,
কেউ মুচি ইত্যাদি। একেই বলে, ড্রেস এ্যাজ ইউ লাইক। কথাটা ইংরেজি। বাংলা করলে দাঁড়ায়, যার যা খুশি বেশ, বা ইচ্ছেমত লেবাস। সকলের বোঝার জন্যে এটুকু বলা দরকার ছিল। আর মনে রেখো, শুধু স্কুলে নয়, বাইরেও ছোট ছেলেমেয়েদের
মধ্যে এই জাতীয় কম্পিটিশান বা প্রতিযোগিতা হোয়ে থাকে।
এবার আসল গল্প
এই পার্কে কয়েকটা সেগুন গাছ সুন্দর বীথি বানিয়ে রেখেছে।
গরমের দিনে ইচ্ছা করলে স্কুল পালিয়ে এসে রীতিমত মার্বেল খেলা যায় বা ঘুমানো চলে।
এখানে একদিকে ছোট ছেলেমেয়েদের ছুটাছুটির বন্দোবস্ত আছে। অনেক সময় জায়গাটা ঘিরে ছোট ছেলেমেয়েদের ফ্যান্সি ড্রেসের প্রতিযোগিতা হয়।
সেদিন সেগুন গাছের গুড়ির উপর বসে বসে ইজাদের বেশ ঘুম
ধরে গিয়েছিল। বাইরে ঝা ঝা দুপুর। এখানে কত ঠাণ্ডা সেই তুলনায়। ঘুম ধরে যাওয়া খুব
স্বাভাবিক। যখন ইজাদের ঘুম ভাঙল, তখন বিকেল। ইতিমধ্যে সেগুন বীথির চেহারা বদলে গেছে। অথচ ইজাদের মা বলেছিল, হাতে বেশ সময় আছে। পরে সে এসে জুটবে। দুপুরে আর তার কোথাও
গিয়ে কাজ নেই! আরো ছেলে-পুলে আসবে পার্কে,
তাদের সঙ্গে খেলা করে সময় সহজেই কাটিয়ে সে দিতে পারবে। কিন্তু মা এখনও
এলো না।
সেগুন বীথির চেহারা সত্যি বদলে গেছে। গাছের আড়াল থেকে
ইজাদ দেখতে পায়, পার্কের ঝোপঝোপ
ফুল বাগানের পাশে চেয়ার টেবিল সাজানো। রঙিন শাড়ি পরে কত না ভদ্রমহিলারা এসেছেন। আর অনেক কুঁচো ছেলেমেয়ে দৌড়াদৌড়ি
শুরু করে দিয়েছে। ইজাদেরও তা-ই ইচ্ছে করে। কি কেমন ভয়-ভয় লাগে। মা সঙ্গে
থাকলে কোন চিন্তা ছিল না।
তবু সাহসের উপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ইজাদ এগোতে থাকে। বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়। হল্লাও
বেশ শুরু হয়ে গেছে।
আরো একটু এগিয়েই ইজাদ দেখলো, তার সমবয়সী কত ছেলেমেয়ে। মা কাছে থাকলে সে এখনই ছুটাছুটি
শুরু করে দিত না?
আ রে, কত রকম সব। একটা মেয়ে পরেছে ঠিক চীনাদের ড্রেস। একজনের মুখে বিড়াল-মুখোশ। আর একজন
ডাকাতের মত। ও বাবা, কোমরে পিস্তল ঝুলিয়েছে। সবাই এমন সেজেছে! মা একটু ভাল করে তাকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে দিলেই পারত।
ধীরে ধীরে ইজাদ এগিয়ে যায়। তার মনে পড়ে, সেদিন কলেজের মাঠে
ধেড়ে ধেড়ে ছেলেরা কত কী সেজেছিল। একে বলে, যা-খুশি
সাজো।
ইজাদের খুব মজা লাগে। কিন্তু মন থেকে ভয় একেবারে যায়
না। তাই ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সে।
আ রে দ্যাখো, একজন শিকারী সেজেছে। হাতে বন্দুক, কয়েকটা পাখি পর্যন্ত
ঝুলছে। জ্যান্ত চড়াই পাখি, পালক-বাঁধা।
ইজাদ বড় মজা পায়। সে আরো এগিয়ে আসে। আহ, মা থাকলে কী মজাই না হত।
ফুল গাছের ধারে ধারে রাখা টেবিলগুলো খালি নয়। উপরে কত রকমের খাবার। কেক, সিঙাড়া,
বাদাম-ভাজা, রসগোল্লা। আরো কত কী।
সমস্ত পার্কে রং-বেরঙের পোশাক আর মানুষের মুখ। কি জুলুসাই না বসেছে।
কেয়ারির পাশে সুন্দর সুন্দর ছিটের জামাপরা ছেলেমেয়েরা
ঠিক যেন প্রজাপতি। গুনগুন করছে, গান গাইছে,
কেবল উড়ছে না। কারণ এদের জানা নেই। একটা মেয়ে লতাপাতা আঁকা রেশমের
অপরা, মাউ- অ্যান বাজিয়ে ফুল-ঝোপের দিকে দৌড়ে গেল। কি সুন্দর দেখতে।।
ইজাদের সংকোচ কিছুটা কেটে গেছে। তাই আরো এগোতে থাকে
সে। শিকারী ছেলেটা বন্দুক নিয়ে তাড়া করছে। উপজাতী মেয়েটার কী দুষ্টুমি-ভরা চোখ। সে মাথায় কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুঁজেছে। ফ্রকের উপর সবুজ
পাতা আঁকা। হাতে ফুলের গহনা। হঠাৎ মেয়েটা
নাচতে শুরু করল। নাচের তালে তালে একজন বাঁশি বাজাতে লাগল।
টেবিলের পাশে চেয়ারে নানা রংয়ের শাড়িপরা বয়স্ক
মহিলারা বসে আছে। এরা অভিভাবিকা, বোঝা কঠিন
নয়।
কখন ইজাদ জলসার মাঝখানে এসে পড়েছিল, তার খেয়াল নেই। একদল ছেলেমেয়ে তখন তার আশে পাশে এসে ভিড়
জমায় আর বলাবলি করে, কী চমৎকার সেজেছে দ্যাখো।
ইজাদ থমকে দাঁড়ায়। কেমন অস্বস্থি লাগে তার। কিন্তু
ভয় পায় না সে। ছোট ছেলেমেয়ে, ওদের ভয়
কী?
এই সময় উপজাতী বেশী মেয়েটা ফিকফিক হাসে আর তাকায়।
ইজাদ ও তখন মুচকি হাসি হেসে ফেললে।
হঠাৎ ছেলেমেয়েদের স্রোত থমকে গেছে দেখে বড়দের সেদিকে
চোখ পাড়ে। ছুটে এলেন সবাই চেয়ার ছেড়ে। মিসেস মজুমদার, রুবি চৌধুরী, লিলি খান, হাজেরা তালুকদার ও অন্যান্য গণ্যমান্য জনেরা।
মিসেস মজুমদার বলে ওঠেন, “রিয়েলি, হাউ নাইস।" তিনি
ইংরেজি ফোড়ন দিতে ভালবাসেন। তারপর দাঁত চেপে চেপে আধা ঘৃণা, আধা অবহেলায় মিহি গলায় বাংলা উচ্চারণ করেন, “কার ছেলে? বড় সুন্দর মেক-আপ, বড় ভাল সাজিয়েছে ত।”
“আমাদের ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশান খুব জোর জমবে।” সায় দিলেন আর এক জল।
মিসেস করিম তালুকদার নিজের মেয়েকে আরবি পোশাকে সাজিয়ে
এনেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “এই ছেলেটাই ফার্ট প্রাইজ পাবে মনে হচ্ছে। এর কপালেই আড়াই হাজার টাকা ঝুলছে।"
রুবি চৌধুরী খুব বেশি তারিফ করে ফেললেন, “দ্যাখেন, কি চমৎকার পাউডার দিয়েছে।
ঠিক ধুলোর মত। আরো দ্যাখেন, ধুলোলাগা ময়লা গালে, ভিখারী ছেলেরা কাঁদলে চোখের পানির যে শুকনা দাগ থাকে, তাও মেক-আপ থেকে বাদ যায় নি। বাহাদুরি আছে বটে।"
লিলি খান স্কুলে নতুন মাস্টারি নিয়েছেন। তিনি একটু
মাস্টারি চাল দিলেন, “আপনি যাই বলেন, মিসেস চৌধুরী,
ছোট ছেলেমেয়েদের এমন ভিখিরী করে সাজাতে নেই। ওদের মনের উপর খারাপ ধারণা চেপে বসে। এমন কালো রঙ দেওয়া উচিত নয়।"
রেবা সরকার দৌড়ালেন তার ক্যামেরা আনতে। বেশি দেরি
হলো না। করিমা তালুকদার জিজ্ঞেস করেন, "কি করবে শুনি?”
“একটা স্ন্যাপ (ছবি) নিই। কাগজের পাঠাব। দেখেছেন কী পোজ? এ ফার্স্ট না হোক
সেকেন্ড প্রাইজ পাবেই। তাও দু’হাজার টাকা।"
“দাড়াও আরো কম্পিটিটর (প্রতিযোগী) আসুক।” মিসেস মজুমদারের মনে ঈষৎ সন্দেহ আছে।
রেবা সরকার কয়েক দিক থেকে ইজাদের কয়েকটা ফটো নিলেন।
গোটা পার্ক গুলজার কয়েক মিনিটে। আরো বড় মা-বোনরা ভিড় করেন। আরো নানা
মন্তব্য ছোটে।
রোজেনা মল্লিকের বয়স চল্লিশের বেশি। দলে গণ্যমান্য। তিনি বাধা দিলেন, “একজনকে ঘিরে থাকলে চলবে নাকি? প্রাইজ যার হয় হবে। এখন ছেলেমেয়েদের খেলতে দিন।"
তবু লিলি খান এগিয়ে এসে ইজাদকে জিজ্ঞেস করেন, “খোকা, তোমার নাম কী?”
“ইজাদ”
“বাপের নাম?” লিলি মিটিমিটি হাসেন। ইজাদের ঠোটেও তার ছোঁয়াচ। ইজাদ পিতার
নাম বলে না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক ওদিক তাকায়।
তখন রোজেনা মল্লিক এগিয়ে আসেন, তার ঘাবড়ানি দূর করতে এবং বলেন, “রেবা, চলো। এখন আর দারোগার ইনকোয়ারী নয়। ওসব পরে হবে প্রাইজের সময়। ওদের এখন খেলতে দাও।"
লিলি খান খুব আদরের সঙ্গে ইজাদের মাথায় হাত বুলিয়ে
বলেন, “যাও খোকা, এদের সঙ্গে খেলা কর গে।"
ইজাদ যেন অভয় মন্ত্র পেয়েছে। সে অবিশ্য ছুটাছুটি
করতে গেল না। একটা কেয়ারির পাশে ঘাসের উপর বসে চারদিকে তাকাতে লাগল। জলসা জোর জমে উঠছে। ইজাদ এক কেয়ারির পাশ থেকে আর একদিকে যায়। খুব মজা পায়
সে। মনে মনে গুণতে থাকে আড়াই হাজার বা দু হাজার টাকা তো অনেক টাকা। অনেক টাকা! এত টাকা নিয়ে
মানুষ করে কী? সে যদি পায়, কী মজা না হবে।
আরো ছেলে-মেয়ে মা-বোন অভিভাবিকা দলে দলে পার্কে জুটতে থাকেন।
আকাশে রঙিন মেঘ ভেসে চলছে। নীচে রঙের জোয়ার, হাসির জোয়ার।
একটি মেয়ে, বয়স তিরিশ হবে, সব ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে কেক,
বিস্কুট ইত্যাদি পরিবেশন করল, ইজাদ মাত্র এক পিস
কেক নিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। ছুটাছুটিতে
তার মন নেই। বুড়োদের মত সে যেন দর্শক সাজতেই ভালবাসে।
দুই কেয়ারির মাঝখানে সবুজ ঘাসের উপর কয়েকটি ছোট মেয়ে
কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিয়েছে। ইজাদ কাছাকাছি বসে বোবার মত দেখে আর ছোট্ট বই হাতে
দু’বছরের ছোট্ট মেয়েটা হাত-পা নেড়ে কী
সুন্দর না পড়ে-
আকাশে তারারা
খোকন খোকন
খোকন।
এখনও এখনও ঘুমোও তুমি?
তারপর আর একজন বয়সী মেয়ে অন্য একটি ছেলেকে বলেন, “এবার তোমরা আবৃত্রি কর, খোকন। সেও
কী মজার কথা পড়ে-
আমাদের বাবা ভেরি গুড় বয়
তাতে আর নাইক সংশয়।
যা-ই চাই তা-ই পাই।
সন্দেশ জিলাপী বিস্কুট
চকলেট টপি ডালমুট
লেবু বাদাম আখরোট
পুরী রসগোল্লা রসময়।
আমাদের বাবা ভেরি গুড বয়।
সব ছেলেমেয়েরা কি হাসি হাসে তারপর। ইজাদ ও তখন মুচকে মুচকে হাসে। আবার কয়েকটি ছোট মেয়ে নাচতে লাগল। ঝুমুর ঝুমুর ঘুঙুরের শব্দ হতে থাকে। তখন ওদিকে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে, ওই ছেলেটা কার? হাজেরা তালুকদার বললেন,
“রেবা তুমি লিস্ট দেখো তো। ছেলেটা
কার? সাজিয়েছে বটে। একদম অবিকল ভিখিরী।
আমার মতে ওকেই ফার্স্ট প্রাইজ দেওয়া উচিত। দেখা যাক, আমাদের
জজ, বিচারকেরা কি রায় দেয়?”
মিসেস মজুমদার ঘাড় বাঁকিয়ে আড়চোখে জবাব দিলেন, “আমারও তা-ই মনে হয়। তবে...।”
রেবা সরকার তার কথা লুফে নিলেন, “তবে, জজ যারা প্রাইজের হর্তাকর্তা,
তারা কি করেন দেখা যাক। এ ছেলেটা কার?"
“রেবা লিস্ট দেখো” -তাড়া দিলেন মিসেস তালুকদার।
রেবা সরকার নিজের ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দেখতে দেখতে বললেন, “সবাই নাম পাঠায় নি। তবে আমি ত প্রায় ছেলেমেয়েকে চিনি। এ বোধ হয়, ফিরোজা বানুর ছেলে।”
“আমারও তাই মনে
হয়।” ভিড়ের মধ্যে কে একজন সায় দিল!
লিলি খানের কথাটা বিশ্বাস হয় না। তাই বললেন, “অতটুকু ছেলে একলা পাঠিয়েছেন?"
মিসেস মজুমদারের মন্তব্যে সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল।
তিনি বললেন, “ফিরোজা বানুর এক গাদা ছেলেমেয়ে।
কে কার খোঁজ রাখে। আমার কোন সন্দেহ নেই। এ ফিরোজা বানুর ছেলে।"
আপাতত সবাই তা মেনে নিলেন।
ওদিকে ইজাদ বেশ জমে গেছে। এতক্ষণ মজার নাচ দেখা গেল।
তারপরই এক কিশোরী মেয়ে ডাক দিলে, “আয়া, আয়া, বাবলুকে নিয়ে এসো...।"
ইজাদ তখন তাকিয়ে দেখে পার্কের দক্ষিণ কোণে আরো কতগুলো
মেয়ে বসে আছে। সবাই প্রায় মাঝবয়সী। দু'একজন বুড়ি। এদের বেশির
ভাগ মেয়ে সাদা থান কাপড় পরে রয়েছে। ওদের সামনে তিন-চারটে প্যারামবুলেটর বা শিশুদের নিয়ে বেড়ানোর গাড়ি। একটা
গাড়িতে এখনও একটি বাচ্চা চুষণী চুষছে হাত পা নেড়ে। অন্যান্য গাড়ি খালি। কয়েকটি তিন সাড়ে তিন, কি তার চেয়ে কমবয়সী শিশু ধীরে ধীরে এদিক ওদিক হাঁটছে, আছাড় খাচ্ছে।
এই দল থেকে একটি বুড়ি আয়া বছর তিন বয়সের একটি ছেলেকে
কোলে করে নিয়ে এলো।
কিশোরী তখন বড় আদরের সঙ্গে বলে, “বাবলু-মণি একটা ছড়া বলো।”
বাবলুর পরণে রঙিন জামা। পায়ে লাল রঙের জুতা। বেস সটান দাঁড়াতে পারে সে। তারপর আধ ফোটা বোলে আউড়ে
চলে
বাবুলাম থাপুলে
কোথায় দাস পা তুলে
আয় বাবা লেখে দা।
দুতে হাপ দিয়ে দা।
তখন জমায়েৎ ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী হাসির হররা বয়।
তারই মধ্যে বাবলুর আবৃত্তি শেষ। সে আবার
আয়ার কাছে ফিরে যায়।
এই সময় তাদের আর এক চোট খাওয়া হোলো। ইজাদ খুব খুশি। বিলাতি পানি, যা গলার মধ্যে গেল চিন চিন করে, তাও ইজাদ ঢক ঢক করে গিলে
ফেলল এক গেলাস।।
গরম কাল। বেলা পাচটা। পার্কময় গাছের লম্বা ছায়া পড়েছে।
প্রায় মুছে যেতে শুরু করেছে রোদুরের নিশানা।
এমন সময় কয়েকজন বয়সী মেয়ে এসে হাজির হোলেন। তখন
বড়দের টেবিলে বেশ হুল্লোড় পড়ে যায়।
কয়েকজন ত চেঁচিয়ে উঠলেন, “জজ সাহেবেরা এসে গেছেন।”
পাঁচজন প্রৌঢ়া মেয়ে এখানে হাজির হলেন। কি খাতির করে সবাই তাঁদের। বোঝা গেল, এঁরাই ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগিতার বিচারক।
এক জজ জিজ্ঞাসা করালেন, “ছেলেমেয়েরা সেজেছ কেমন।"
“সে ত সবই দেখবেন।
তার আগে চলেন আপনারা চা খেয়ে নেন।"
জজদের চা খেতে এক টেবিলে নিয়ে যাওয়া হলো। ইন্তেজাম খুব জোর।
আরো হৈ চৈ পড়ে যায়। দু’জন কর্মকর্তা
একটা টেবিল সারিয়ে নিয়ে এলেন। তার উপর কত রকমের খানা সাজানো।
ইজদি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে। আর অবাক হয়। তার নিকটেই ছিল আরবী পোশাক পরা
মেয়েটা। সে সঙ্গী আর এক ছেলেকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, “এখানে সব প্রাইজ
রাখা। কততো খেলনা দ্যাখো। আবার টাকা ও দেবে।"
“আমি যদি প্রাইজ
না পাই, তাহলে গুলি ছুঁড়ব।” -বলল শিকারীর পোশাক পরা ছেলেটা। সে
তার খেলনা বন্দুক নিয়ে গুলি-ছোড়ার ভঙ্গী করলে।
যে মেয়েটি আবৃত্তির তদারক করছিল, সেই আবার ছোটদের জোর গলায় তাড়া দিলে, “খোকা-খুকীরা, তোমরা সবাই ওই ফাঁকা জায়গায়
লাইন করে বসে পড়ো এবার।"
হুকুম তামিল হতে দেরি হয় না।
ছোটদের নাচ-কুদে পার্ক তোলপাড়। সবাই ঘাসের উপর বসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তাদের কৌতুহল
তখন উপছে পড়ছে।
রেবা সরকার প্রতিযোগী ছেলেমেয়েদের নাম লিখতে লাগলেন। ইজাদ এবারও নাম বলে। কিন্তু বাবার নাম বলতে পারে না।
হাজেরা মল্লিক তার পাশেই ছিলেন, বললেন, “আসুক না ওর মা। ছোট ছেলে নাম ছাড়া
কি বলবে?”
বেলা পড়ে আসছে। তাই আর দেরি করা চলে না। এক বিচারক
বললেন, “মিস সরকার, আর দেরি করতে পারব না। সন্ধ্যায় আমার অন্য কাজ আছে।”
“আর বেশি দেরি
নেই। প্রতিযোগীদের সব বসিয়ে দিয়েছি। একবার দেখে নিলেই হবে।”
কিন্তু কয়েকজন বলাবলি করতে লাগলেন, "মিসেস বানু মজুমদার এখনও এলেন না। তার জন্যে অপেক্ষা
করতে হয়। তিনি দু’শ টাকার কম কখনও
চাঁদা দেন না। সব কাজেই বানু মজুমদারের সাহায্য লাগে। তাই সবুর করতে হচ্ছে।”
কিন্তু ওদিকে জজেরা তাড়া দিতে লাগলেন। তারা আর বিলম্ব
করতে নারজি।
মিসেস তালুকদার চটে উঠলেন, “একজনের জন্যে- না এ বড় অন্যায়।
মামি ত জানি ওর আঠার মাসে বছর।"
“সত্যি দিস্ ইজ
ব্যাড,” সায় দিলেন মিসেস মল্লিক।
“অথচ বুড়ি-ছোঁয়ার মত ছেলে ঠিক পাঠিয়ে বসে আছেন" ফুট কাটলেন অন্য একজন।
কেউ আর দেরি করতে রাজি নয়। ওদিকে বেলা প্রায় শেষ।
এমন সময় হঠাৎ মাটি খুঁড়ে যেন পার্কে দেখা দিলেন মিসেস
ফিরাজা বানু মজুমদার। চল্লিশের কিছু বেশি বয়স। চলনে বলনে বেশ ভারিক্কি ভাব। ধনী বেগম সাহেবাদের আকসার যা হয়ে থাকে। তিনি কাছাকাছি
আসা মাত্র কয়েকজন তার সম্মানে এগিয়ে গেল।
“এত দেরি কেন, আপা?" সকলের মুখে এই জিজ্ঞাসা,
সকলের গলায় কিন্তু ক্ষমা-চাওয়া সুর।।
মিসেস মজুমদারকে কিন্তু আর কেউ কথা বলতে দেয় না। সকলেই
নিজের কথা আগে বলে একটা বাহবা নিতে ব্যস্ত এবং উদগ্রীব।
রেবা সরকার বললেন, “আপা, আপনার ছেলে ফার্স্ট হবে বলে আপনার একটু আগে আসতে নেই?
আপনি ছাড়া কোন ফাংশান জমে নাকি?”
“হুবহু ছেলেটাকে
সাজিয়েছেন বটে।" কে একজন বলে
উঠল।
"তবে আপনার ছেলে এখন তা আর কেউ
বলবে না।” মিসেস মল্লিক ফোড়ন দিলেন।
ইজাদকে একজন ইতিমধ্যে এখানে হাজির করে রেখেছে। এক অভিভাবিকা
মিসেস খন্দকার, তিনি ইজাদের কাঁধে হাত দিয়ে
চুলে আলতো হাত বুলাতে বুলোত বলেন, “মজুমদার আপা, আপনার মধ্যে এমন শিল্পী লুকিয়ে ছিল তা কি আমরা জানতাম?
আপনি এত চাপা মানুষ? ও আল্লাহ কি যে মেক-আপ দিতে পারেন?
এই ধারায় কথার খই ফুটতে থাকে চারপাশ থেকে। মিসেস বানু মজুমদার নিজে আর কথা বলার সুযোগ পান না। সকলের দৃষ্টি হয় মায়ের উপর, নয় ছেলের উপর। যারা কথা বলছে না, তারা ইজাদের চুলে আলগোছে
হাত বুলায়, কেউ পিঠ থাপড়ায়। চারদিক থেকে খালি বানু মজুমদারের গুণের কীর্তন। হাঁপিয়ে ওঠেন মিসেস মজুমদার।
শেষে এই মসিবত থেকে রেহাই পেতে ধমকের সুরে নিজের খনখনে গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, “দোহাই আপনারা থামুন। আমাকে
কথা বলতে দিন।"
দাওয়াই বিফল গেল না। হল্লা একদম ঠাণ্ডা। মিসেস বানু
মজুমদার এবার জিজ্ঞেস করেন, “এক এক করে বলুন, কি ব্যাপার। আমি কিছু বুঝতে পারছি না আপনাদের এই অতি তড়পানির
চোটে।"
রুবি চৌধুরী জবাব দিলেন, “ছেলে ফাস্ট প্রাইজ পাবে বলে কি এত দেরি করে এলেন, আপা?”
“আমার ছেলে?" বেশ অবাক হোয়েই পাল্টা জবাব দেন মিসেস মজুমদার।
“কেন আর বিনয়
দেখান আপা?” বললেন মিসেস মল্লিক।
“ছেলেপুলে নিয়ে
আমাকে কোন ফাংশানে যেতে দেখেছো, রেবা?” মিসেস বানু মজুমদারের খনখনে গলা এবার ফেটে পড়তে চায়।
“কিন্তু এটা ছোটদের
ফাংশান। আর দেরি করবেন না। আপনার জন্যেই আমরা বসে।"
কথা লুফে নিলে আর একজন- “আপনি যে এমন আঁকতে পারেন তা কে জানত। আপনার শিল্পী মনের----”
মিসেস মজুমদার এমন বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, আর কোন কথাই তাঁর কানে বিষ। তাই মাঝ পথেই চেঁচিয়ে ঘা দিলেন, “কোন ছেলে দেখি?"
সেখানে প্রতিযোগিতা। অতি আদরের ছাপ দিতে সবাই তৎপর।
তারা ইজাদকে এগিয়ে দিলে মায়ের সম্মুখে।
“এ আমার ছেলে নয়।
কার ছেলে?" বানু মজুমদার যেন ছোবল দিয়ে
উঠলেন।
“আপনার ছেলে নয়?” মিসেস মজুমদারের জবাবে কেউ সন্তুষ্ট নয়। কথাটা কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না।
তখন মিসেস বানু মজুমদার নিজের কর্কশ গলায় শেষ তোপ
দাগলেন, “তোমরা পেয়েছ কী? ফ্যান্সি ড্রেস বলে কি আমি ছেলেকে ভিখিরী সাজিয়ে পাঠাব?
আমার টাকা পয়সা নেই?”
যার শহরে পাঁচখানা বাড়ি এবং চারখানা গাড়ি আছে তাকে
টাকা পয়সাহীন সত্যিই বলা চলে না।
“আপনার ছেলে নয়? আমরা ভাবলাম-” এই কথা বলেই
লিস্টি হাতে মিসেস করিমা তালুকদার ইজাদকে জিজ্ঞেস করেন, “এই ছেলে তোর বাপের নাম কী?"
ইজাদ ঘাবড়ে যায়। তবে জবাব দিতে বেশি দেরি হয় না।
“তোর বাপের নাম
কী?”
“আমার বাপ নেই।”
“কি হোয়েছে?”
“মরে গেছে।”
“তোর মা?"
“মরে গেছে।"
“তবে তুই চার ছেলে?"
আজ সকালে একজনকে মা ডেকেছিলাম, সে নিয়ে যাবে বলেছিল। এখনও আসে নি।”
ইজাদের জবাবে কয়েকজন এক চোট হেসে নিলে, প্রাণ যদ্দুর চায়।। তারপর একজন জিজ্ঞেস করে, “তোর নতুন মা কে?"
“সে একজন ভিখিরিণী।" বলে ইজাদ। কিন্তু করিমা তালুকদারের মেজাজ চড়ে গেছে এতক্ষণে। তিনি আবার প্রশ্ন চালান।
“তুই থাকিস কোথা?”
“যেখানে সেখানে।”
“তুই তবে কে?"
“আমি ভিখিরী ছেলে।”
“ভিখিরী!??!??!!" যারা ইজাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল তারা এক লাফে
দুই গজ পেছনে ছিটকে পড়ল।
কর্কশ আওয়াজে করিমা তালুকদার তবু জিজ্ঞেস করেন সন্দেহ-ভঞ্জনে; “সত্যি ভিখিরী ছেলে?”
“হ্যা।”
“তবে রে শূয়োরের
বাচ্চা, তুই যে এখানে ঢুকেছিস--” কথা শেষ হয়
না। তিনি ইজাদের গালে দুই থাপ্পড় কষিয়ে
দিলেন।
হৈ চৈ শুরু হয়ে যায় তখনই। চেঁচিয়ে উঠলেন রোজেনা
মল্লিক, “ছিঃ একদম স্ট্রিট বেগার (ভিখারী)। তোমরা ভাবলে পেইন্ট করেছে রঙ দিয়ে। হারামজাদার গায়ে কত রাজ্যের আবর্জনা।"
রেবা সরকার ওদিকে দেদার চড় চালাচ্ছেন। মিসেস খন্দকার
আর হাতে নেই। তিনি হাই-হীল তুলে জুতো দিয়ে
ইজাদের পিছে মারলেন এক লাথি। মা গো- শব্দে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল
ইজাদ।
মিসেস মল্লিক তখন হিন্দী চিৎকার জুড়ে দিয়েছেন, “আয়া, আয়া, —সাবুন লাও, পানি লাও- আয়া আয়া...।"
ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকে হুলুস্থুল দেখে কান্না
জুড়ে দিয়েছে।
তেজী ছেলে বলতে হয় ইজাদকে। ধরাশায়ী অবস্থায় আরো
কয়েকটা লাথি খাওয়ার পরও সে চট করে উঠে ব্যুহ ভেদ করে প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। কয়েকটা জুতোর গোড়ালি তখনও শূন্যে, নীচে পড়বে আরকি। কিন্তু শিকার নেই নীচে।
উর্ধ্বশ্বাসে ইজাদ দৌড়াতে লাগল। পার্ক থেকে পালাতে
পারলেই সে বাচে।
তার মনে হয়, শত শত রাক্ষসী যেন হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে তাকে ধরতে আসছে।
ইজাদের কানে ভেসে আসে তখনও হিন্দী চিৎকাররতা মিসেস
খন্দকারের গলা
“আয়া, সাবুন লাও, সাবুন-সাবুন।”
No comments:
Post a Comment