বাংলা অনুবাদ গল্প,দ্যা মাউজ,এইচ. এইচ. মুনরো (সাকী),The Mouse by H.H. Munro (SAKI),Bangla translation,translated story, |
বাংলা অনুবাদ গল্প - দ্যা মাউজ – এইচ. এইচ. মুনরো (সাকী) - The Mouse by H.H. Munro (SAKI) – Bangla translation
থিওডোরিক ভোলার (THEODORIC VOLER) সেই শিশুকাল থেকে মাঝ বয়স পর্যন্ত মার কাছেই মানুষ হয়েছে। এতকাল তিনি তাঁর ছেলেকে বাস্তব জগত থেকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছিলেন। কিন্তু মা মারা যেতে থিওডোরিক একা হয়ে পড়ল। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে টের পেল যে সে যা ভেবেছিল বাস্তব জগত অনেক বেশি রূঢ়। তার মানসিকতায় রেল ভ্রমণও ছিল তার কাছে খুবই বিরক্তিকর। কিন্তু সেপ্টেম্বরের এক সকালে বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে সে রেলের একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল। থিওডোরিক থাকত তাদের গ্রামের এক ধর্মযাযকের বাড়িতে। প্রতিবেশীরা কেউ তেমন খারাপ ছিল না। তারপরেও তাদের বিশৃঙ্খল জীবন্যাত্রার জন্য সে তাদের খুবই অপছন্দ করত। যে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে থিওডোরিকের ষ্টেশনে যাবার কথা ছিল তা কখনই রেডি থাকত না। এবার যাবার সব সময়ও তাই হল। ঘোড়াটাকে সাজাবার জন্য অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে ঢুকে পড়েছিল সে। তখন কি কেউ জানত ওটাই তার কাল হবে।
আস্তাবলের অন্যান্য গন্ধের সঙ্গে ইদুরের গন্ধ নাকে আসতেই তার সারা গা গুলিয়ে উঠল। ইদুরকে সে ভয় পায় তা না, এদের প্রতি সবসময়ই তার ছিল অসম্ভব বিতৃষ্ণা। ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে গেছে অনেকদূর, তারপরেও আস্তাবলের সেই দুর্গন্ধ তার নাকে লেগে ছিল এবং তার জামাকাপড়ে কিছু খড়কুটো আবিস্কার করে রীতিমত লজ্জিত হল সে। কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল তার সহযাত্রী মাত্র একজন এবং একজন মহিলা। হয়তো তার সমবয়সী। মহিলা তার দিকে না তাকিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতেই বেশি আগ্রহী যেন। পরের স্টেশন আসতে প্রায় ঘন্টাখানে দেরী। ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট টা ছিল একটু পুরানো ধাঁচের। অন্য কম্পার্টমেন্টের সাথে কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। তাই যাত্রাপথের এই সময়টাতে সে আধা নির্জনতা উপভোগ করতে পারবে তা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিল। ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে এগুতে শুরু করল। তারপরেই সে বুঝতে পারল কম্পার্টমেন্টে সে এবং মহিলা ছাড়া অন্য একজন রয়েছে। তার অস্তিত্বকে একেবারে অগ্রাহ্য করে, তার পা বেয়ে যেটা চুপিসারে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করছে সেটা আর কেউ নয় একটা ইঁদুর। নিশ্চয়ই ওটা আস্তাবলে ঘোড়া সাজানো সময় প্যান্টের ভেতর ঢুকে পড়েছিল। পা ঠুকে, ঝেড়ে এবং অনেক খোঁচাখুঁচির পর সেটাকে বের করা গেলই তো না বরং সে আরও ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপক্ষে ঘন্টাখানে ধরে ভ্রাম্যমান ইদুরের (যা না কি তার কল্পনায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল) উৎপাত সহ্য করা তার পক্ষে সত্যি সত্যি কষ্টকর ছিল। পোশাক না খুলে এর হাত থেকে কি করে রেহাই পাওয়া যায় তা তার মাথায় এল না। যুক্তি সঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও ঘুমন্ত মহিলার সামনে তাকে কাপড় খুলতে হবে তা ভাবতেই সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। আজ পর্যন্ত কোন মহিলার মোজা খোলার কথা সে চিন্তা করতেও পারে নি।।
এদিকে সমস্যা বেড়েই চলেছে। ভেবে পেল না সে এখন কি করবে। ইদুরটা আবার চলাফেরা করতেই সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইদুরের বাচ্চাটা নিশ্চয়ই আগে কোন অ্যালাপাইন ক্লাবের মেম্বার ছিল। ওটা একবার তার পা বেয়ে ওপরে উঠেছিল, আবার কখনও অতিরিক্ত উৎসাহে উঠতে গিয়ে কয়েক ইঞ্চি নেমে যাচ্ছিল সরাত করে। এমনতর চেষ্টা করতে করতে মহা বিরক্ত হয়ে ইদুরটা থিওডোরিকের পায়ে কামড় দিল। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে সে জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হল। লজ্জায় তার কানের ডগা লাল হয়ে উঠল। ঘুমন্ত মহিলাযাত্রীর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে, নিঃশব্দে, এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে রেলের কম্বলটা আড়াআড়ি ভাবে সে বেঁধে দিল। সেই ছোট্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তার পোশাক খুলে দেখতেই ইঁদুরটা ফাঁদ
থেকে ছাড়া পাবার জন্য বিরাট এক লাফে বেরিয়ে এল তারপর সেটা গিয়ে পড়ল কম্বলের ওপর। কম্বলটাও আলগা বাধন খুলে সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল।
ঠিক তখনই মহিলা চোখ মেলে তাকাল। থিউডোরিক আঁতকে উঠে, ইদুরের চেয়ে দ্রুত গতিতে কম্বলটার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে থুতনি পর্যন্ত টেনে নিল তার নগ্নতা ঢাকার জন্য। ক্রিয়াশক্তি লোপ পাওয়ার মত সে কম্পার্টমেন্টের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। অসহায়ভাবে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, কখন ভদ্রমহিলা চেন টানার জন্য হাত বাড়াবেন। মহিলা কিন্তু তার সহযাত্রীর অদ্ভুত পোশাকের দিকে তাকিয়ে রইলেন নিঃশব্দে। তাঁর অদ্ভুত আচরণে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না তিনি ঠিক কতখানি দেখেছেন। ভাবতে গিয়ে থিওডোরিকের কপাল ও ঘাড়ে রক্তচাপের ফলে যন্ত্রণা অনুভব করল। শিরদাঁড়ার কাছে সে একটা কাঁপুনি টের পেল।
-আমার মনে ঠাণ্ডা লেগেছে। মরিয়া হয়ে বলল থিওডোরিক।
-সত্যি, আমি দুঃখিত, জবাবে মহিলা বললেন। আমি ভাবছিলাম আপনাকে জানালাটা একটু খুলে দিতে বলব।
-আমার মনে হয় ম্যালেরিয়া। থিওডোরিক দাঁতে দাঁতে ঠক ঠক করতে করতে বলল, যত না ভয় তার থেকে বেশি এই মনগড়া কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে।
-আমার হোল্ড অল- এ কিছুটা ব্রান্ডি আছে, আপনি যদি হাত বাড়িয়ে ওটা আমার দিকে এগিয়ে দেন, সহযাত্রীনি বললেন।
-না তা নয়, আমি বলতে চাইছি এর জন্য আমার কোন কিছু লাগবে না, ভদ্রমহিলাকে আশ্বস্ত করার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল থিওডোরিক।
-আপনি বোধহয় গরমের দেশগুলোতে ঘোরাঘুরি বেশি করেছেন।
থিওডোরিক এই গ্রীষ্মকালীন দেশ সম্পর্কে জ্ঞান সিংহল থেকে চাচার পাঠানো বছরে একপেটি চায়ের মধ্যে সীমিত ছিল। ভাবল ম্যালেরিয়াটা ওখান থেকেই এসেছে। ভাবল আস্তে আস্তে সত্যি কথাটা খুলে বলবে সে।
-আচ্ছা আপনার কি ইদুরকে ভয় করে? সে রক্তিম হয়ে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করল।
-বিশপ হাট্টোকে যেমন একদল ইঁদুর খেয়ে ফেলেছিল, ঠিক তেমনই একদল ইদুর না এলে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু আপনি একথা জিজ্ঞাস করছেন কেন?
-একটা ইদুর আমার পোশাকের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, তার নিজের কণ্ঠ নিজের কাছে অপরিচিত মনে হল থিওডোরিকের। কি অস্বস্তিকর অবস্থা হয়েছিল।
-সত্যি তাই, আপনার যদি আঁটো পোশাক পরার অভ্যাস থাকে। খানিক্ষণ ভেবে মহিলা আবার বললেন, ইদুরের আবার আরাম করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
-আপনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন আমি পোশাক খুলে ইদুরটা বের করেছিলাম, একটু ঢোক গিলে আবার বলল, আর তাতেই আমার এই অবস্থা।
-আপনি যাই বলুন না কেন, একটা ইদুর তাড়াতে নিশ্চয়ই আপনার এতটা ঠাণ্ডা লাগে নি, মহিলা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললেন।
থিওডোরিকের কাছে এই ঠাট্টাটা কেমন যেন মনে হল। এর চেয়ে বরং তার বুকের উপর দিয়ে একশটা ইঁদুর হেঁটে যেত তাতে তার কাছে হেয় মনে হত না। লজ্জায় তার সারা শরীরের রক্ত যেন মুখে এসে জমা হল। তার এই মানসিক যন্ত্রণা ভয়ে রূপান্তরিত হতে লাগল যখন সে বুঝতে পারল যে ট্রেনট্রা ক্রমশ জনবহুল স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কম্পার্টমেন্টের এক কোনে চেয়ে থাকা চোখ দুটোর দিকে চোখাচোখি হতেই বুঝতে পারল যে আর কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আশা করেছিল, মহিলাটি আবার ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু সময় যত এগুতে লাগল সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ হতে লাগল। বারবার চোরা চাহনি দিয়েও মহিলার চোখে ঘুমের লেশ মাত্র দেখতে পেল না।
-আমার মনে হয় আমরা এসে গেছি, মহিলা বললেন।
কথাটা থিওডোরিকের চেতনায় কেমন ধাক্কা দিল। এটা ঠিক তাদের ভ্রমণ শেষ হবার পথে। তাই তাড়া খাওয়া জন্তুর মত ছটফট করতে করতে সে ঝাপিয়ে পড়ে খুলে ফেলা তার পোশাকটা টেনে নিল। হৃৎপিণ্ড বুকে ঘা মারছে, গলা শুকিয়ে কাঠ আর মাথায় অবশ করা ভাব, এতসবের ভেতর সে বুঝতে পারছিল ট্রেনের গতি কমে আসছে, অর্থাৎ খুব শিঘ্রই স্টেশনে পৌছে যাবে। কম্পার্টমেন্টের অন্য কোণে হিমশীতল নীরবতা, সেদিকে তাকানোর সাহস তার একটুও ছিল না। একটা ঘোরের ভেতর কাপড় পরে তার সিটে এসে বসল থিওডোরিক।
এক সময় ট্রেনটা থেমে গেল এবং মহিলা কথা বলে উঠলেন।
-আপনি কি দয়া করে একজন কুলি ডেকে দিবেন আমাকে গাড়িতে তুলে দিতে? মহিলা বললেন, আপনার শরীর ভালো নেই জানি, তারপরেও আপনাকে কষ্ট দিতে আমার খারাপ লাগছে। তবে রেল ষ্টেশনে আমার মত একজন অন্ধ কত অসহায় হয়ে পড়ে তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন।
অনুবাদ: হাসান খুরশীদ রুমী
No comments:
Post a Comment