মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Saturday, May 29, 2021

বড় অনুবাদ গল্প – কতটুকু জমি দরকার? - হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান নিড? – লিও টলস্টয় - How much land does a man need? – Leo Tolstoy – Translation in Bengali

 

বড় গল্প,শিক্ষামূলক গল্প,অনুবাদ গল্প,লিও টলস্টয়, How much land does a man need?, Leo Tolstoy, Translation in Bengali

বড় অনুবাদ গল্প হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান নিড? লিও টলস্টয় - How much land does a manneed?Leo Tolstoy – Translation in Bengali

[লেখকের সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয় প্রধানত লিও টলস্টয় নামে পরিচিত। জন্মস্থান রাশিয়ার তুলা রাজ্যের ইয়াসনায়া পলিয়ানা এস্টেটে। জন্ম ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর।  পেশায় তিনি ছিলেন একজন লেখক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তার সাহিত্যকর্ম গুলো পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষায়ই অনুদিত হয়েছে। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তববাদীতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার লেখালেখির সময়কাল ১৮৪৭ থেকে ১৯১০ সাল। পৈতৃকসূত্রে টলস্টয় ছিলেন একজন জমিদার। ১৮৬২ সালে ৩৪ বছর বয়সে সোফিয়া বেরকে বিয়ে করেন। এই দম্পতি মোট ১৪ সন্তানের জন্ম দেয়। যাদের মাঝে ৬ জন শিশু অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। তার বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলো হল ওয়ার এন্ড পিস, আনা কারেনিনা, কিংডম অফ গড ইজউইদিন ইউ, রিজারেকশন এবং তার ছোট গল্পের সংকলন। ২০ নভেম্বর ১৯১০ সালে তিনি মৃত্যুবরন করেন।]

একবার এক বড় বোন তার ছোট বোনের গ্রামের বাড়ীতে আসল। বড় বোনের কোনও এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয়েছে, সে শহরে বাস করে। আর ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে একজন সামান্য কৃষকের সাথে, সে বাস করে পল্লীগ্রামে। একত্রে চা খেতে খেতে দুই বোনের অনেক কথাবার্তা হল। বড় বোন শহরে বাস করে বলে অহঙ্কার করে বলল—“যাই বল শহরে অনেক সুবিধা, সেখানে খুব সুখে, খুব আরামে বাস করা চলে, ভাল ভাল কাপড়-চোপড় পরতে পারা যায়। আমার ছেলে-মেয়েরা খুব সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে, ভাল ভাল খাবার খায়। সেখানে থিয়েটার আছে, আমিও গিয়ে থাকি; আরও নানারকমের দেখার ও আনন্দ উপভোগ করার জিনিষ রয়েছে।

ছোট বোন ব্যবসায়ীর কাজের অনেক নিন্দা করল এবং কৃষকের জীবন ও কাজই খুব ভাল মনে করে বললআমার জীবনটা তোমার মত করতে আমার মোটেই ইচ্ছা হয় না। আমরা নিতান্ত সাধারণ ভাবে দিন কাটাচ্ছি, কিন্তু আমাদের কোন ভাবনা-চিন্তা নেই। হতে পারে তুমি আমাদের চেয়ে ভাল ভাবে থাক, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী আয়ও কর, কিন্তু তোমাদের সব লোকসান হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। পয়সা আজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। লোকে বলে, লাভ আর লোকসান দুই-ই সাথে সাথে যায়। এটা প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় যে, যাদের আজকে অনেক টাকা-পয়সা, কাল তারা এক মুঠো ভাতের জন্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে । আমরা তার চেয়ে নির্বিঘ্নে আছি। যদিও কৃষকের জীবনে খুব একটা টাকা পয়সা হয় না, তবুও সে বেচে থাকে বহুদিন। আমরা কখনও বড়লোক হবো না সত্য, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া যথেষ্টই থাকবে।

বড় বোন নাক সিটকে বলে উঠল যথেষ্ট? হ্যা, যথেষ্টই তো, যদি গরু-বাছুরের সাথে ডাবায় খাও তা হলে যথেষ্টই তো! তোমরা সভ্যতা এবং ভদ্রতার কি জানো? এখন যেমন তোমরা গরু-বাছুরের সাথে রয়েছ, মরবেও ঠিক এমনি ভাবে কতকগুলো গোবরের গাদার ওপরে, আর তোমাদের ছেলে-মেয়েগুলোর ওই সেই দশাই হবে।

ছোট বোন বলল-বেশ তো, তাতে আর কি এসে যাচ্ছে? আমাদের কাজটা অবশ্য কুলিমজুরের; কিন্তু এর মার নেই। কারো কাছে আমাদের মাথা নোয়াতে হয় না। তোমরা শহরে থাক, সেখানে কিন্তু নানান রকমের প্রলোভন রয়েছে। আজকে হয়ত দুপয়সা আছেকালকে হয়ত ঘাড়ে ভূত চাপবে, তোমার স্বামীর লোভ হবে, হয়ত জুয়া খেলতে যাবে, না হয় মদ ধরবে। স্ত্রীলোকেরাও লোভে পড়তে পারে, আর তা হলেই তো সর্বনাশ! কেমন- এরকম কি প্রায়ই হয় না?

বাড়ীর কর্তা প্যাহোম পাশের ঘরে খাটের উপর শুয়েছিল। এই সব কথা সে শুনতে পেল। সে বলল, এ খুবই সত্যি, ছেলেবেলা থেকে আমরা জমি চাষ করছি, আমরা চাষা; কিন্তু আমাদের মাথায় কখনও বদখেয়াল ঢোকে না; কেবল এইটুকুই কষ্ট যে, আমাদের যথেষ্ট জমি নেই, যদি খুব বেশী থাকে তা হলে কাউকে গ্রাহ্য করতাম না।

দুই বোনের চা খাওয়া শেষ হল। কাপড়-চোপড় সম্বন্ধে তারা খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করল; তারপর চায়ের সব সরঞ্জাম তুলে রেখে শুতে গেল।

সেই পাড়াগাঁয়ের খুব কাছেই একজন খুব ধনী মহিলা বাস করতেন, তাঁর প্রায় তিনশত একর জমি ছিল। তিনি সেখানকার কৃষকদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করতেন, কিন্তু শেষে তিনি এমন একজন কর্মচারী নিযুক্ত করলেন যে, সে চাষাদের সামান্য কিছু দোষ দেখতে পেলেই কেবল জরিমানা করত। সে যুদ্ধ-বিভাগে থেকে থেকে বৃদ্ধ হয়েছে, তাই তার মেজাজ ভারি কড়া। প্যাহোম খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করত, তবুও মাঝে মাঝে দুই একটা গরু তার বাগানে ঢুকত, বাছুরগুলোও প্রায়ই ছুটে যেত; কাজেই প্যাহোমকে প্রায় সর্বদাই জরিমানা গুণতে হত। জরিমানা দিয়ে দিয়ে প্যাহোমের মেজাজটা একেবারে খারাপ হয়ে পড়ল। স্ত্রীর সাথেও সে খুব খারাপ ব্যবহার করত। গ্রীষ্মকাল তার এই রকম করেই কাটল। সে ভাবল শীতকালে যদিও খোরাকী জোগাতে কষ্ট হবে তবুও গরু বাছুরগুলি গোয়ালেই থাকবেবেশী ভাবতে হবে না।

শীতকালে শোনা গেল যে, সেই ভদ্রমহিলা তাঁর সমস্ত জমি বিক্রয় করবেন; সেখানকার রাস্তার উপরই যে হোটেলওয়ালা আছে সে সেই জমিদারী কিনবেএই গুজব রটল। চাষাদের মনে একটা ভয়ানক ভয় হল। তারা ভাবল, যদি হোটেলওয়ালা লোকটাই জমি কেনে তা হলে বড় খারাপ হবে। এ জমি ছাড়া আমাদের আর কোন উপায়ও নেই, কাজেই জরিমানা করে করে আমাদের অস্থির করে তুলবে।

পাড়ার সকল কৃষকই সেই মহিলার কাছে গেল, শেষে এটাই স্থির হল যে, যার যেমন সাধ্য সে তেমন একটা অংশ কিনবে। প্যাহোম শুনতে পেল যে, তার একজন প্রতিবেশী পঞ্চাশ একর জমি কিনবে, অর্ধেক দাম তখনই দিবে, বাকী অর্ধেক এক বছর পরে দিবে। প্যাহোমেরও জমি কিনতে ইচ্ছা হল। সে ভাবল, জমিটা সবই বিক্রী হচ্ছে, আর আমি এর কিছু পাবনা, এ কি রকম?

সে স্ত্রীকে গিয়ে বলল - সকলেই জমি কিনছে, আমরাও কুড়ি-পঁচিশ একর কিনব। নইলে টিকে থাকাই যে দায়। সেই গোমস্তাটা জরিমানা করে করে আমাদের মেরে ফেলবে।

কি করে জমি কেনা যাবে তাই নিয়ে দুজনে ভাবতে লাগল। তাদের মোটে একশত রুবল ছিল। একটা ঘোড়া তারা বিক্রয় করল, এক ছেলেকে মজুরী করতে পাঠিয়ে তার বেতন অগ্রিম নিয়ে নিল, তার শালার নিকট বাকী টাকা ধার করল। এই রকম করে জমির দামের অর্ধেক টাকা জোগাড় করল। প্যাহোম সেই স্ত্রীলোকটির কাছে চল্লিশ একর জমি কিনার বন্দোবস্ত করতে গেল। কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গেল, তারা শহরে গিয়ে দলিল রেজিষ্টারি করে নিল। প্যাহোম অর্ধেক দাম দিল, বাকী টাকা দুই বছরের মধ্যে দিবে এইরূপ চুক্তি হল।

প্যাহোম এখন নিজেই জমিদার। বীজ ধার করে সে নতুন জমিতে বুনে দিল। সে বছর খুব ভাল ফসল হল এবং এক বছরের মধ্যেই সে সব দেনা পরিশোধ করল। এখন আর সে কারও ধার ধারে না; নিজের জমি চাষ করে, নিজের গাছ ইচ্ছামত কাটে, গরু-ঘোড়াগুলি নিজের জমিতেই চরে বেড়ায়। সে যখন মাঠে চাষ করতে যেত, মাঝে মাঝে ক্ষেত ভরা ফসলের দিকে তাকিয়ে দেখত, আর তার মন আনন্দে ভরে যেত। 

তার মনে হত সে রকম ফুল, ফল, লতা-পাতা বুঝি আর কোথাও কোনওখানেই নাই। পূর্বে যখন সে মাঠের পাশ দিয়ে যেত, তার ক্ষেত তখন সম্পূর্ণ অন্য রকমের ক্ষেত বলে মনে হত, এত সুন্দর দেখাত না; কিন্তু এখন তার কাছে সেটা একেবারে আলাদা জিনিষ বলে মনে হত।

প্যাহোমের মন খুব খুশী। সে আছেও খুব ভাল; কিন্তু বাড়ীর পাশের কৃষকদের গরু-ঘোড়া এসে তার ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে ফেলত। প্যাহোম খুব কাকুতি-মিনতি করে তাদের বারণ করল; কিন্তু তারা আমলে নিল না। মাঝে মাঝে আবার তারা গরু - ঘোড়া ক্ষেতের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে যেত। বহুদিন সে গরু-ঘোড়া তাড়াল, কারও কোন অনিষ্ট করল না; কিন্তু পরে একসময় তার সহ্য হল না। ধৈর্য হারিয়ে সে জেলার কাছারিতে (কোর্ট) গিয়ে নালিশ করল। সে জানত ও বুঝত যে, তার প্রতিবেশীদের অনেকেরই জমি নাই, তারা ইচ্ছা করেই যে সকল সময় তার অনিষ্ট করে তাও নয়, কিন্তু অন্য উপায় আর কিছু ছিল না। সে ভাবল, নাহ, কিছু না বললে আর চলে না। আমার যা কিছু আছে সবই ওরা এমনি করে নষ্ট করে দেবে। ওদের একটু শিক্ষা দিতে হবে। সে নালিশ করতে আরম্ভ করল। দুই-তিন জনের জরিমানা হল। তারা প্যাহোমের উপর খুব চটে রইল, আর তার পর হতে ইচ্ছা করেই গরু-ঘোড়া তার ক্ষেতে ছেড়ে দিতে আরম্ভ করল। একজন তার বাগানে রাতে ঢুকে পাঁচটি লাইমগাছ কেটে ফেলল। একদিন তার নজরে পড়ল-গাছের গুড়িগুলি পড়ে রয়েছে। এবার সে ভীষণ চটে গেল; ভাবল, এখান থেকে একটা, সেখান থেকে একটাএ রকম করেও যদি কাটত তা হলেও তো যথেষ্ট ক্ষতি হত না; তা না করে এক জায়গা থেকেই সবগুলো কেটে ফেলেছে। যদি লোকটাকে একবার বের করতে পারতাম, তো দেখে নিতাম।

অপরাধীকে খুজে বের করার জন্য সে খুব মাথা ঘামাতে লাগল। ভাবতে ভাবতে সে স্থির করল, এ নিশ্চয়ই সাইমন! সে ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে পারে না।

সে সাইমনের বাড়ীতে গেল, সেখানে কিছুই দেখতে পেল না। দুইজনে খুব রাগারাগি হল। প্যাহোমের খুব বিশ্বাস ছিল যে, সাইমনই গাছ কেটেছে, কাজেই সে নালিশ করল। সাইমনের উপর আদালতের শমন জারি হল। দুই দুই বার বিচার হল, কিন্তু প্রমাণের অভাবে সে খালাস পেল। প্যাহোমের মনে ভারি কষ্ট হল। বিচারকদের উপরও তার রাগ হল। সে বলল - আপনারাই চোরকে আস্কারা দেন। যদি আপনারা ভাল লোক হতেন, তা হলে এই চোরকে শাস্তি না দিয়ে কখনও ছেড়ে দিতেন না।

বিচারক ও প্রতিবেশীদের সাথে প্যাহোম ঝগড়া করল। তার বাড়ীতে আগুন লাগাবে বলে অনেকে তাকে ভয় দেখাতেও লাগল। কাজেই সকলের চেয়ে জমি বেশী থাকলেও তার জন্যে সেখানে থাকা খুব কঠিন হয়ে উঠল, সে অনেকেরই বিষ নজরে পড়ল। এমন সময়ে চারিদিকে গুজব রটল যে, অনেকেই সেই গ্রাম ছেড়ে অন্য এক জায়গায় চলে যাচ্ছে, সেখানে জমিজমার খুব সুবিধা।

প্যাহোম ভাবল, আমার সেখানে যাওয়ার কোনও দরকার নেই। যদি অনেকেই চলে যায় তা হলে আমি আরও বেশী জমি পাব। ওদের জমি নিয়ে জমিদারী আরও বাড়াব; তখন বেশ শান্তিতে থাকব।

প্যাহোম বসে বসে ভাবতেছে এমন সময় একজন কৃষকের সাথে তার দেখা হল। তার বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া করে এক রাত সেখানেই কাটাল - অনেক কথা হল।

সেই কৃষক বলল আমি ভলগা নদীর ওপার থেকে এসেছি, সেখানে বহুলোক গিয়ে বসবাস করছে। যে যাচ্ছে সে-ই পঁচিশ একর জমি পাচ্ছে। সেখানে খুব ফসল হয়, রাই এত জন্মে যে, কাস্তের পাচটা পোঁচেই এক একটা আঁটি হয়। একজন চাষা একেবারে খালিহাতে সেখানে গিয়েছিল, এখন সে নিজেই ছয়টা ঘোড়া আর দুইটা গরু কিনেছে।

সেখানে যেতে প্যাহেমের খুবই ইচ্ছা হল। সে ভাবল, যদি অন্য জায়গায় গেলে বেশ সুখে থাকতে পারি, দুপয়সা হয়, তবে এ-রকম একটা জায়গায় থেকে কষ্ট পাচ্ছি কেন? বাড়ী ঘর, জমিসব বিক্রী করে, সেখানে গিয়ে নতুন জমি কিনে, ঘর-দোর তৈরী করে বাস করব। এখানে মানুষের বসতি বড্ড বেশী হয়ে গেছে, সব সময়েই এখানে অসুবিধা। কিন্তু আগে সেখানে গিয়ে সব দেখে আসতে হবে।

গ্রীষ্মকাল আসল। প্যাহোম সেখানে যাবার জন্য যাত্রা করল; ষ্টিমারে করে ভলগা নদী পার হয়ে প্রায় তিনশত মাইল চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল আসলেই সেখানে সকলের প্রচুর পরিমাণে জমি আছে। টাকা থাকলে আরও কিনতে পারা যায়, দামও খুব সস্তা। সকল দেখে-শুনে শরৎকালে সে বাড়ী ফিরল; গরু ঘোড়া, বাড়ী-সব বিক্রী করল এবং বসন্তকালে পরিবার নিয়ে সেখানে যাত্রা করল।

সেখানে গিয়ে প্যাহোম জমি পেল, সাথে আরও কিছু কিনল। সে দেখল যে জমিতে বাস্তবিকই খুব ফসল হয়। তার সংসারের অবস্থা পূর্বের চেয়ে দশগুণ ভাল হল।

প্রথম প্রথম সে খুব সন্তুষ্ট হল। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা ক্রমশঃ বেড়েই যায়। কিছুদিন পরে সে মনে করল যে, সে জমিও যথেষ্ট নয়। তার আরও জমি বাড়াতে ইচ্ছা হল। সব মাঠে আবার গম জন্মাত না। দুই বছর ক্রমাগত ফসল হলে, কয়েক বছর গেলে আর সে মাঠে কিছু জন্মাত না। কাজেই আবার নতুন জমি খুজতে হল। প্যাহোম কাছে জমি পেল নাদূরে পেল বটে, কিন্তু তাতে তার মন উঠল না। সে অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করতে লাগল।

তিন বছর কেটে গেল। খুব ভাল জমি পাওয়ার জন্য সকলের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে গেল; খুব চালাক-চতুর না হলে আর সময়মত চেষ্টা না করলে তা পাওয়াও শক্ত হয়ে উঠল। তৃতীয় বছরে এক জমি নিয়ে গোলমাল বাধল। এমন কি তা নিয়ে মামলাও হল। প্যাহোমের সমস্ত পরিশ্রম পণ্ড হল। সে ভাবল, এ জমি যদি আমার হত তা হলে স্বাধীনভাবে থাকতেও পারতাম-আর ঝগড়াও হত না।

পনেরো শত রুবল দিয়ে একটা জায়গা কিনার জন্য এক মহাজনের সাথে তার কথা হচ্ছে এমন সময়ে একজন বিদেশী ব্যবসায়ী তার বাড়ীতে এসে উপস্থিত হল। সে খুব ক্লান্ত। প্যাহোমের সাথে বসে সে চা খেল। সেই ব্যবসায়ী কথায় কথায় বলল- আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে খুব সস্তায় ভাল ভাল জমি পাওয়া যায়। আমি তো মোটে হাজার টাকা দিয়ে তের হাজার একর জমি কিনেছি।

প্যাহোম জিজ্ঞাসা করল- এত সস্তায় কি করে কিনলে?

- বিশেষ কিছুই নয়। সেখানকার কর্তাদের কিছু জিনিষ-পত্র দিয়ে খুশী করতে পারলেই হল। আমি তো কিছু উপহার আর ভালো পানীয় দিয়ে তাদের হাত করেছিলাম। খুবই সুবিধে, যত চাও ততই পাবে। এ এক রকম বিনা-পয়সায় পাওয়া।

-আমি তা হলে সেখানেই যাব। যে টাকা দিয়ে এখানে জমি কিনব সে টাকা দিয়ে সেখানে এর দশগুণ জমি পাব।

তার স্ত্রীকে বাড়ীতে রেখে একজন লোক সাথে নিয়ে প্যাহোম যাত্রা করল। পথে একটা শহরে গিয়ে প্রথম দিন রইল ; সেখানে এক বাক্স চা, কিছু ভালো মানের পানীয় ও কতকগুলি ভাল ভাল উপহার দেয়ার মত জিনিস কিনল। প্রায় তিন শত মাইল চলে গিয়ে সাত দিনের দিন সে সেখানে পৌছল। সেখানে গিয়ে সে সত্য সত্যই দেখল চারিদিকে ভারি সুন্দর সুন্দর ক্ষেত। লোক গুলিও সেখানে আছে মহাসুখ-শান্তিতে। কারও কোন ভাবনা নাই-উদ্ধেগ নাই। গরু, ঘোড়া সব স্বচ্ছন্দে মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। সকলেরই শরীর বলিষ্ঠ, সকলেই খুব খুশী। তার লেখাপড়ার ধার ধারে না বটে, কিন্তু তাদের স্বভাব খুব ভাল।

প্যাহোম তাদের ঐ পানীয় ও চা ইত্যাদি উপহার দিল। উপহার পেয়ে তারা খুব খুশী হল। তারা নিজেদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা বলে শেষে প্যাহোমকে বলল- তুমি আমাদের এখানে এসেছ, আমরাও তোমার ওপর খুব খুশী হয়েছি। তুমি আমাদের যে উপহার দিয়েছ আমরাও তার প্রতিদান দিতে চাই। আমাদের যা আছে তার কোনটা তুমি চাও বল।

প্যাহোম বলল-আমি যদি আপনাদের এখানকার কিছু জমি পাই, তা হলে আমার বড় উপকার হয়। আমাদের ওখানে জমি বেশী নেই, লোক খুব বেশী। আপনাদের খুব ভাল ভাল যথেষ্ট জমি আছে, এরকম জমি আমি আর কোথাও দেখি নি।

তারা নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলল। মাঝে মাঝে হো-হো করে হেসে উঠতে লাগল। প্যাহোম তাদের কোন কথাই বুঝতে পারল না। একজন দোভাষী মাঝখানে থেকে তাকে সব বুঝিয়ে দিতেছিল। তারা চুপ করে প্যাহোমের দিকে চেয়ে রইল।

দোভাষী বলল -তুমি যে উপহার দিয়েছ তার জন্যে ওরা তোমাকে জমি দিতে প্রস্তুত আছেন। তোমার যত জমি চাই ততই পাবে। কোন জমি নেবে কেবল হাত দিয়ে তা একবার দেখিয়ে দেবে।

দোভাষীর কথা শেষ হতে সেই লোকদের মধ্যে কথা আরম্ভ হল। দেখতে দেখতে ঝগড়াও বেঁধে গেল। কেউ কেউ বলল- সর্দারকে জিজ্ঞেস না করে কথা দেওয়া খুব অন্যায় হয়েছে।

প্যাহোম দোভাষীকে ঝগড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করল। দোভাষী তাকে সব বুঝিয়ে বলল। লোকে এদের বস্কির বলিত।

বস্কিরদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে এমন সময় একজন লোক শেয়ালের পশমের টুপি পরে সেখানে এসে উপস্থিত হল। সকলেই উঠে দাড়াল এবং চুপ করল। দোভাষী বলল- ইনিই হচ্ছেন আমাদের সর্দার।

প্যাহোম তৎক্ষণাৎ পাঁচ পাউণ্ড চা ও একটা পোষাক এনে সর্দারকে দিল। সর্দার সেগুলি গ্রহণ করে নিজের আসনে বসলেন। বস্কিররা তাকে অনেক কিছু বলল, সর্দার সব কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর সকলকে চুপ করতে বলে প্যাহোমকে বলিলেন- বেশ তা-ই হোক, আমাদের তো যথেষ্ট জমি আছে, তোমার যেটা ইচ্ছা নিতে পার।

প্যাহোম ভাবল, কি করে নেব? পাকা লেখাপড়া করে নেওয়া চাই, নইলে এরা আজকে আমায় দিচ্ছে, কালকে আবার কেড়েও নিতে পারে।

সে প্রকাশ্যে বলল--আপনার দয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি সামান্য কিছু জমি চাই, কিন্তু যেটা নেবো, সেটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নিতে হবে। জমিটা কি মেপে নেওয়া যায় না? জন্ম ও মৃত্যু তো ঈশ্বরের হাতে। আপনারা খুব ভালো লোক, কিন্তু আপনাদের ছেলেরা সেটা আবার কেড়েও নিতে পারে।

সর্দার বলিলেন—‘হ্যা, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা তোমাকে সে ব্যবস্থা করে দিব।

প্যাহোম বলল, আমি শুনেছি এখানে একজন ব্যবসায়ী এসেছিল। আপনারা তাকে একটি ছোট জমি দিয়েছিলেন। আর সেটা পাকাপাকি দলিল করেই লিখে দিয়েছিলেন। আমিও সেভাবেই চাই।

সর্দার বুজতে পারলেন, তিনি বললেন, এটা তো খুব সহজ কাজ। ঠিক আছে আমরা শহরে গিয়ে পাকাপাকি ভাবেই রেজিস্ট্রি করে দিব।

প্যাহোম জিজ্ঞাসা করল—‘দাম কত হবে?

সর্দারের জবাব- আমাদের চিরকালই একদাম, একদিনে হাজার রুবল।

প্যাহোম বুঝতে পারল না; বলল-একদিন? সে কি রকম? তাতে কত একর হবে?

—“আমরা দিন হিসাবে বিক্রী করি, পরিমাণ কত হবে বলতে পারিনা। একদিনের ভেতরে পায়ে চলে তুমি যত দূর গিয়ে ঘুরে আসতে পারবে ততখানি জমি তোমার হবে। দাম হাজার টাকা।

প্যাহোম আশ্চর্য্য হয়ে গেল; বলল -একদিনে তো অনেকটা জায়গা ঘুরে আসতে পারা যায়।

সর্দার হেসে বললেন--বেশ তো সবই তোমার হবে। কিন্তু একটা কথা, যদি একদিনের ভেতরে যেখানে থেকে রওনা হবে ঠিক সেখানে ফিরে আসতে না পার তা হলে তোমার টাকা মারা যাবে।

আমি যে পথে চলে যাব তার চিহ্ন রাখব কি করে?

কেন? যে কোন জায়গায় ইচ্ছে তুমি গিয়ে দাড়াবে, সেখান থেকে একখানি কোদালের ঘা দিয়ে রওনা হবে। যেখানে যেখানে চিহ্ন রাখা দরকার মনে করবে সেখানে সেখানে চিহ্ন দেবে। যেখানেই মোড় ফিরবে সেখানেই একটা গর্ত খুঁড়বে এবং কতকগুলি ঘাসের চাপড়া গাদা করে রাখবে; এমনি করে যতদূর ঘুরে আসবে ঘাসের চাপড়া গাদা করে রাখবে; এমনি করে যতদুর ঘুরে আসবে ততটা জায়গা তোমার হবে, কিন্তু মনে রেখো যেখান থেকে তুমি বেরুবে, সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে আবার ঠিক সেখানে এসে তোমার পৌছনো চাই।

প্যাহোমের খুব আনন্দ হল। পরদিন খুব ভোরে বাহির হওয়াই সে স্থির করল। আর দুই একটা কথা হতে না-হতেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসল। প্যাহোমকে শোয়ার জন্য পাখীর পালকের খুব নরম বিছানা দেওয়া হল। বস্কিরাও সব চলে গেল।

প্যাহোম পালকের বিছানায় শুয়ে থাকল কিন্তু তার ঘুম হল নাশুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, অনেকদূর অবধি চিহ্ন দিয়ে ঘুরে আসব। একদিনে খুব সহজেই পঁয়ত্রিশ মাইল চক্কর দিতে পারব দিনগুলোও খুব লম্বা। ওহ! কত জমিই না হবে। খারাপ জমিগুলো সব বেচে দিয়ে ভালগুলো নিজে রাখব। গরু আর ঘোড়া কতকগুলো কিনতে হবে, আর বহু লোকও খাটাতে হবে। দেড়শ একর চাষ করে ভাল ভাল ফসল জন্মাব, বাকীগুলোয় গরু-ঘোড়া চরবে।

প্যাহোম সমস্ত রাত্রি জেগে কাটাল, কেবল ভোর হবার পূর্বে তার একটু তন্দ্রার মত হল। তার ঘোরে সে একটি স্বপ্ন দেখল, সে যেন একটা তাবুতে শুয়ে আছে। এমন সময়ে বাহিরে একটা মানুষের উচ্চ হাসির শব্দ শুনে সে যেন তাকে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল যে, বস্কিরদের সর্দার হেসে লুটোপুটি খাচ্ছেন।

প্যাহোম জিজ্ঞাসা করল- সর্দার, আপনি এত হাসছেন কেন?

কিন্তু একটু পরেই দেখল যে, সে সর্দার নয় ; যে সওদাগরের সাথে সেখানে আসার আগে তার দেখা হয়েছিল, সে যেন সেই সওদাগর। যেই মাত্র তাকে জিজ্ঞাসা করল- তুমি কি এতদিন এখানেই ছিলে? অমনি দেখল যে, এ সে সওদাগর নয়; তার নিজের দেশের বাড়ীতে বসে যে বিদেশী কৃষকের সাথে প্রথমে দেখা হয়েছিল, এ সেই কৃষক। তারপর সে দেখল, এ সে কৃষকও নয়, যেন একটা প্রেতমূর্তি; আর তার সামনে খালি গায়ে খালি পায়ে একটা মানুষ পড়ে আছে। ভাল করে দেখে বুঝতে পারল যে, একটা মরা মানুষআর সেটা যেন তার নিজেরই মৃতদেহ। তার ভীষণ ভয় হল।

স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। সে ভাবল, স্বপ্নে মানুষ কি না দেখে! তখন প্রায় ভোর হয়েছে! সে ভাবল, আমাদের বেরুবার সময় হয়েছে, সকলকে জাগানো দরকার।

সে উঠে তার চাকরকে উঠাল, এবং বস্কিরদেরও ডেকে তুলল। তারা উঠল, চা খেয়ে শরীর গরম করল। তখন প্যাহোম বলল সময় হয়েছে, যদি যেতেই হয় তবে চলুন। এখনই যাই।

বস্কিররা রওনা হল। কেউ বা ঘোড়ায় চড়ল, কেউ বা গরুর গাড়ীতে উঠল। প্যাহোম তার চাকরকে নিয়ে গাড়ীতে উঠল। যখন তারা মাঠে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌছল, তখন পূর্বদিক লাল হয়ে উঠেছে। ছোট একটা পাহাড়ের উপরে সকলে জড়ো হল। সর্দারও সেখানে আসলেন এবং হাত দিয়ে চারদিকে দেখিয়ে বললেন-যতদূর তোমার চোখ যায় ততদূর কেবল আমাদেরই জায়গা। তোমার ইচ্ছামত এর যে কোনও অংশ তুমি নিতে পার।

প্যাহোম দেখল চারিদিকে কেবল সবুজ মাঠ। তার চোখ উজ্জল হয়ে উঠল।

সর্দার তার টুপিটা খুলে মাটিতে রেখে বললেন-এখান থেকে রওনা হবে, আবার এখানেই ফিরে আসবে। যতদূর ঘুরে আসতে পারবে ততটা জায়গা তোমারই হবে।

প্যাহোম টাকা বের করে সর্দারের টুপিতে রাখল; তারপর কোটটা খুলে ফেলল, কোমরে একটা বেল্ট শক্ত করে এঁটে বাঁধল, একটা ব্যাগে করে কিছু রুটি আর একটা বোতলে পানি নিল। তারপর চাকরের হাত থেকে কোদালটি নিয়ে সে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। চারিদিকেই কেবল সবুজ আর সবুজ, কোন দিকে যাবে কিছুই স্থির করতে পারল না। শেষে স্থির করল- যাক, যেদিকে সুর্যটা টকটকে লাল হয়ে উঠছে, সেদিকেই যাব।

পূর্বদিকে মুখ করে ভাবল, না আর সময় নষ্ট করব না, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যতটা এগিয়ে যেতে পারি ততই ভাল।

পাহাড় হতে নেমে প্যাহোম চলতে লাগল; খুব জোরে চলল না, আর খুব আস্তে আস্তেও নয়। হাজার গজ গিয়ে সে একটি গর্ত খুড়ল, দূর থেকে দেখা যেতে পারে এমন ভাবে কতকগুলি ঘাসের চাপড়া উচু করে রাখল; তারপর খুব জোরেই চলতে লাগল, কিছুদূর গিয়ে আর একটা গর্ত খুড়ল। প্যাহোম একবার পিছন দিকে তাকাল। সেই ছোট্ট-পাহাড়, আর লোকজন সবই সুর্যের আলোতে বেশ পরিষ্কার দেখা যেতে লাগল।

সে অনুমান করল যে, তিন মাইল এসেছে। তখন রোদের তেজ ক্রমশঃ বাড়তে লাগল। প্যাহোম জামা খুলে কাদধে রাখল। রোদ আরও বাড়ল। তখন খাবার সময় হয়েছে ভেবে সে কিছু খেয়ে নিল। সে ভাবল, মোড় ফেরবার এখন অনেক সময় রয়েছে, জুতা খুলে চললে অনেকটা যেতে পারব।

জুতা খুলে চলতে চলতে সে ভাবল, আর তিন মাইল গিয়ে বাঁ-দিকে ফিরব। এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে যাওয়া যায় না। যতই এগুচ্ছি ততই আরো ভালো জমি পড়ছে। সে আরও খানিকক্ষণ সোজা চলল। ফিরে চাইল, পাহাড়টা আর ভাল করে দেখা যায় না। পাহাড়ের লোকগুলি কালো কালো পিপড়ার মত দেখা যাচ্ছিল। সে ভাবল, এদিকে খুব দূরে চলে এসেছি, এখন ফিরব। বড় ঘাম হচ্ছে, ভয়ানক তেষ্টাও পেয়েছে।

থেমে সে একটা গর্ত খুড়ল, কতকগুলি ঘাসের চাপড়া স্তুপ করে রাখল ; বোতলের ছিপি খুলে খানিকটা পানি খেল, তারপর বাঁ-দিকে ফিরে খুব জোরে চলতে লাগল। সেখানে ঘাসগুলিও খুব উচু, রৌদ্রও ভয়ানক কড়া। প্যাহোম অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সুর্যের দিকে চেয়ে দেখল বেলা দুই প্রহর; ভাবল, এখন বিশ্রাম করা দরকার।

সে বসে পড়ল, কিছু রুটি আর পানি খেল কিন্তু শুয়ে পড়ল না - পাছে ঘুমিয়ে পড়ে। খেয়ে শরীরে একটু জোর পেল। আবার সে চলতে আরম্ভ করল। এবার একেবারে অসহ্য গরম তবুও সে চলতে লাগল; ভাবল, একদিন কষ্ট করে চিরদিন সুখে কাটাবে। সে বাঁ-দিকে বহুক্ষণ চলল ; একটা গর্ত খুঁড়ে আবার বাঁ- দিকে ফিরল। পাহাড় আর দেখা যায় না। রৌদ্রের তেজে দূরের সব ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে দেখাতে লাগল। সে ভাবল, এ দুদিকে বড় বেশী চলে এসেছি, এখন একেবারে সোজা পাহাড়ের দিকে চলে যাব।

পশ্চিম দিকে চেয়ে সে দেখল সূর্য অর্ধেক পথ নামিয়া পড়েছে। সে খুব দ্রুত চলতে লাগল। তখন দুই মাইলও সে আসতে পারে নাই। তাকে আরও দশ মাইল আসতে হবে। সে ভাবল, এখন একেবারে সোজা চলব। আরও বেশী দুরে যেতে পারতাম! থাক যথেষ্ট আমি পেয়েছি!

আর একটা গর্ত খুঁড়ে প্যাহোম বরাবর পাহাড় লক্ষ্য করে চলতে লাগল।

প্যাহোমের চলতে অত্যন্ত কষ্ট হতে লাগল। ভয়ানক গরম, সে অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়ল। তার পা কেটে চিরে গিয়েছে, আর চলতে পারে না। বিশ্রাম করতে তার অত্যন্ত ইচ্ছা হল, কিন্তু সূর্যাস্তের পূর্বে পৌছানো চাই-ই চাই। সূর্য কারও জন্য অপেক্ষর করে না, সে আস্তে আস্তে ডুবিয়া যেতেছিল।

সে ভাবল, হায়, হায়! খুব বেশী দূরে ঘুরতে গিয়ে কি বিষম ভুল করলাম। যদি ঠিক সময়ে যেতে না পারি, কি হবে?

একবার পাহাড়ের দিকে চেয়ে সূর্যের দিকে চাইল; তখনও সে অনেক দূরে। সূর্য একেবারে নেমে পড়েছে। প্যাহোম ক্রমাগত চলিতে লাগল। তার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছিল, তবুও প্রাণপণে চলতে লাগল। তখনও সে অনেক দূরে। টুপি, কোট, জুতা, জলের বোতল সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে সে ছুটতে লাগল; কেবল কোদালখানা সাথে রাখল, আর তার উপর মাঝে মাঝে ভর দিয়ে চলতে লাগল। হতাশ হওয়ায় সে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল, কিন্তু আবার ছুটতে লাগল। ঘামে সমস্ত কাপড় গায়ের সাথে এটে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ হল, কামারের হাঁপরের মত তার নিঃশ্বাস পড়তে লাগল, আর হাতুড়ীর মত তার বুকের ভিতর আঘাত করতে লাগল, পা-ও অবশ হয়ে আসল। তার মরণের ভয় হল।

কিন্তু ভয় সত্ত্বেও সে থামল না। ভাবল,এতটা পথ চলে এসে যদি এখানে থামি, তা হলে তারা আমাকে নিতান্ত বোকা বলবে। সে আবার দৌড়াতে আরম্ভ করল। এবার পাহাড়ের অনেকটা কাছাকাছি আসল। তখন শুনতে পেল যে, বস্কিররা চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। তার মনে একটা নতুন বল আসল, আবার প্রাণপণ করে ছুটতে আরম্ভ করল।

সূর্য একেবারে নেমে পড়েছে, রক্তের মত লাল, জ্বলজ্বল করতেছে। প্যাহোমও তার নির্দিষ্ট স্থানের একেবারে কাছে এসেছে। পাহাড়ের উপরের লোকদের বেশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সে সেই টুপিও দেখতে পেল। সে সর্দারও সেখানে বসে আছেন। স্বপ্নে সে তাকে যে রকম দেখেছিল ঠিক সেই রকম দেখল। স্বপ্ন তার মনে পড়ল; ভাবল, জমি যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু ভোগ করার জন্যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন কি? উঃ! আমার প্রাণ যে যায়! মারা গেলাম, আমি কখনও ওখানে পৌঁছতে পারব না।

প্যাহোম চেয়ে দেখল যে, সূর্য পৃথিবীর গায়ে এসে ঠেকেছে, অর্ধেকটা ডুবে গিয়েছে। প্রাণপণ শক্তিতে সে আর একবার দৌড়াল, মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, পা যেন ঠিক মাথার সাথে সাথে আর যেতে পারতেছে না। সে যেমনি পাহাড়ের গোড়ায় আসল, দেখল-হঠাৎ সব অন্ধকার; চেয়ে দেখল সূর্য অস্ত গিয়েছে। তার সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হয়েছে মনে করে সে একটা ভয়ানক চিৎকার করে উঠল। কিন্তু বস্কিররা তাকে শীঘ্র শীঘ্র যাওয়ার জন্য চিৎকার করে বলছে শুনে সে বুঝতে পারিল যে তখনও পাহাড়ের উপর হতে সূর্য দেখা যাচ্ছে। আর একবার দম নিয়ে সে পাহাড়ে উঠতে  লাগল। পাহাড়ে উঠে টুপি আর টাকাও দেখতে পেল। টুপির সামনেই বস্কিরদের সর্দার বসে আছেন আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছেন। স্বপ্নের কথা আবার প্যাহোমের মনে পড়ল, সে চেচিঁয়ে উঠল। পা তার একেবারে অবশ, সে লম্বা হয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে টুপি স্পর্শ করল। সর্দার চেচিঁয়ে বলে উঠিলেনসাবাস! সাবাস! অনেক জমি পেয়েছ।

প্যাহোমের চাকর ছুটে আসল এবং তাকে তুলতে গেল, কিন্তু আর তুলতে পারল না। প্যাহোমের মুখ দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত পড়ছে, সে এই মাত্র মারা গিয়েছে।

বস্কিরা সকলেই জিভ কাটল।।

প্যাহোমের চাকর কোদালি দিয়ে ছয় ফুট লম্বা একটি কবর খুঁড়ে তাতে প্যাহোমকে সমাহিত করল। প্যাহোমের শুধু এইটুকু জমিরই দরকার ছিল।

No comments:

Post a Comment

Popular Posts