মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Monday, May 10, 2021

মজার গল্প - প্রতিজ্ঞা পূরণ - প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় – Mojar golpo – Protigga Puron - Prabhat Kumar Mukhopadhyay

 

হাসির গল্প, মজার গল্প, mojar golpo, Bangla Funny Story, প্রভাত কুমার মুখোপধ্যায়, Prabhat Kumar Mukhopadhyay,

মজার গল্প - প্রতিজ্ঞা পূরণ - প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় – Mojar golpo – Protigga Puron - Prabhat Kumar Mukhopadhyay

প্রথম পরিচ্ছেদ

ভবতোষ কলেজে ইংরেজি পড়িতেছে বটে, কিন্তু সেটা নিতান্ত অনিচ্ছার সহিত ইংরেজি বিদ্যার প্রতি তাহার তিলমাত্র শ্রদ্ধা নাই ইংরেজি পড়ে পড়েই দেশটা উৎসন্ন গেল ইহাই তাহার মত দেশে আর্যভাব ক্রমশই হ্রাস পাইতেছে, সে কালের সে শুভদিন ভারতে ফিরিবার আর উপায় থাকতেছে না, এই বলিয়া ভবতোষ প্রায়ই আক্ষেপ করত আত্মীয়-স্বজনের তাড়নায় তাহাকে বাধ্য হইয়া ইংরেজি পড়তে হয়, নইলে তার ইচ্ছা নবদ্বীপ বা ভট্টপল্লীতে গিয়া কোনও টোলে প্রবেশ করবে যাহোক, ইংরেজি পড়া সত্ত্বেও ভবতোষ যেরূপ নিজের আচার ব্যবহার চিন্তাপ্রণালী অক্ষুন্ন রাখিতে সমর্থ হইয়াছে আজকালকার দিনে সেরূপ দেখা যায় না

ভবতোষ কলকাতায় মেসের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেছিল, হঠাৎ একদিন পূজার ছুটি হল ভবতোষ বাড়ির জন্য নূতন বস্ত্রাদি খরিদ করে, বাক্স পুঁটুলি বেঁধে গৃহযাত্রা করল তাদের গ্রামটি কলকাতা হইতে অধিক দূরে না

সেদিন ভোরে ভবতোষের বিধবা মাতা গঙ্গাস্নান করতে গিয়েছিলেন গঙ্গার ঘাট গ্রাম হইতে কিঞ্চিৎ দূরে ঘাটে বহুসংখ্যাক পরস্ত্রীর সমাগম হয়েছে স্নানান্তে ঘাটে উঠেছেন, এমন সময় ভবতোষের মাতা দেখলেন, তাঁর একটি ব্যাল্যসখী, উপেন্ধপধ্যায়ের স্ত্রী

কী দিদি, ভাল আছ ? বলিয়া উপেন্ধবাবুর স্ত্রী ভবতোষের মাতার কাছে আসলেন দুই সখীতে কুশল প্রশ্নাদর পর, উপেন্ধবাবুর স্ত্রী বললেন, ভবতোষ বাড়ি এসেছে?

এসেছে তার ছুটিও ফুরিয়ে এল, আবার কলকাতায় আসবে গিয়ে উপেন্দ্রবাবুর একটি সুন্দরী ত্রয়োদশবর্ষী কণ্যা আছে, তাহার নাম পুলিনা মেয়েটি অবিবাহিতা উপেন্দ্রবাবুর স্ত্রী বললেন, দেখ দিদি, আমার পুলিনার সঙ্গে তোমার ভবতোষের যদি বিয়ে দাও, তাহলে বেশ হয়

ভবতোষের মা বললেন আচ্ছা বলে দেখবেন ছেলে যদি রাজি হয়, তাহলে এমনকি এই অগ্রহায়ণ মাসেই বিবাহ হতে পারে

মা যখন গৃহে ফিরলেন, ভবতোষ তখন বৈঠকখানায় বসে বঙ্গবাসী উপহার পরাশর-সংহিতার একখানি তর্জমা মন দিয়া পাঠ করতেছিল মা এসে বললেন, বাবা, বাড়ির ভিতর এস, একটা কথা আছে

ভবতোষ বই রেখে ধীরে ধীরে মাতার অনুগমন করল নিজের কক্ষে নিয়া গিয়া মা পুত্রকে বললেন, বাবা, এবার একটা বিয়ে করে ফেল তুমি আমার বড় ছেলে, বউমার মুখ দেখব আমার কতদিনের সাধ, সে সাধ পূর্ণ কর

বলেছি, পূর্বে ভবতোষ বিবাহ করতে অত্যন্ত অসম্মত ছিল পাঠদ্দশায় বিবাহ করা উচিত নয়, কিংবা উপার্জনক্ষম না হলে বিবাহ করা উচিত নয়, এরূপ কোনও বিলাতি আপত্তি ভবতোষের ছিল না তার আপত্তিটা অন্যরূপ এবং শাস্ত্রসঙ্গতও বটে সে শুনেছে (এবং সংবাদপত্রেও পাঠ করেছে) যে আজকালের নব্যস্ত্রীরা আর যথার্থ হিন্দু গৃহলক্ষ্মী-স্বরূপ আবির্ভূত হন না তাঁহারা অত্যন্ত বিলাসিনী বাবু হইয়া পড়িয়াছে শাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে স্বামীদিগকে ভক্তিটক্তি আর করেন না, পরন্তু স্বামীর সহিত সখ্য ব্যবহার করিতে উদ্যত আরও নানা প্রকার অভিযোগ সে শুনেছে

কিন্তু বিধবা মাতার একান্ত অনুরোধ - বেচারি কি করে? মাতৃ - আজ্ঞা অবহেলা করিবার পাপও সে সঞ্চয় করতে ইচ্ছা করে না সুতরাং অল্পদিন হতে স্থির করেছে, মা এবার অনুরোধ করলেই বিবাহ করবে কিন্তু সে নিজের

আদর্শানুযায়ী একটি মেয়ে বিবাহ করবে এখন, সম্বন্ধে ভবতোষের স্বাধীনচিন্তা -প্রসূত অনেকগুলি মতাদি ছিল, তার বাসায় সহপাঠীরা সকলেই বিলক্ষণ অবগত আছে রাত্রে আহারের পর ছাদের উপর যখন বাসার ছেলেদের একটি দণ্ডায়মান সভা সমবেত হত, যখন অনেকগুলি সিগারেটাগ্র যুগপৎ প্রদীপ্ত হইয়া উঠত, তখন অনেক সময় এই বিষয়ে আলোচনা হত তর্কস্থলে ভবতোষ কতবার বলেছে, যদি আমি কখনও বিয়ে করি, যদি করি, তবে একটি কালো কুৎসিত মেয়ে বিয়ে করব কারণ সুন্দর মেয়ে প্রায়ই দেমাগে হয় শ্বশুর শাশুড়ীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে না, স্বামীকে গুরুজ্ঞান করে না, সহধর্মিণী না হয়ে সহবিলাসিনী হয়ে ওঠে তাছাড়া, তারা অত্যন্ত বাবু হয় একটু রূপ আছে বলে সে রূপকে ভাল করে সাজিয়ে প্রকাশ করবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে সাবান চাই, পাউডার চাই, ভাল ভাল শাড়ি চাই, সেমিজ চাই স্বামী বেচারার প্রাণও ওষ্ঠাগত দ্বিতীয়ত, লেখাপড়া জানা মেয়েও বিয়ে করব না তারা খালি নভেল পড়ে (কেউ কেউ নভেলও লেখে) আর তাস খেলে, স্বামীকে কবিতা করে চিঠি লিখতেই দিন যায়, গৃহকার্য হয় না, ব্রত নিয়মাদির সময়ই নেই- ছেলে মাটিতে পড়ে কাঁদে ইত্যাদি

এরূপ ওজস্বিনী বক্তৃতা শুনে ছেলেরা কেউ কেউ বলত, আচ্ছা ভবতোষবাবু কার্যকালে কি করেন দেখা যাবে রকম বলে অনেকে বলায় করায় ঢের তফাৎ  

এই সন্দেহবাদে ভবতোষ আগুন হয়ে বলত, আচ্ছা দেখবেন মশায়, দেখে নেবেন আমার যে কথা সেই কাজ

মা যখন বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন, তখন ভবতোষ সম্মত হল বলল, আচ্ছা মা, আমি বিয়ে করব, কিন্তু নিজে দেখেশুনে বিয়ে করতে চাই

শুনে মা অত্যন্ত খুশি হলেন বললেন, দেখেশুনে বিয়ে করতে চাও? তা বেশ তো একটি খাসা সুন্দর মেয়ে আছে, তেরো বছরের

ভবতোষ শুনে চমকিয়া বলল, খুব সুন্দর নাকি?

মা সোৎসাহে বললেন, খুব সুন্দর মুখখানি যে একবারে প্রতিমা মত যেমন নাম, তেমনি চোখ, তেমনি কপালের রঙটি যে একবারে গোলাপ ফুলের মত

ভবতোষ ধীরে ধীরে গম্ভীরস্বরে বলল, সে আমি বিয়ে করব না মা

মা শুনে আশ্চর্য হলেন কেন, কী হয়েছে?

সুন্দর মেয়ে আমি বিয়ে করব না

তবে কী রকম মেয়ে বিয়ে করবি?

আমি একটি কালো কুৎসিত মেয়ে বিয়ে করব

পাগল ছেলে! সকলেই সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে চায় লোকে পায় না

সকলে করুক, আমি একটু অন্য রকম করব বলতে বলতে ভবতোষের মুখমণ্ডল আত্মগৌরবে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল সে কি সকলের মধ্যে একজন? সে কি সকলের মত বিলাসের জন্য বিবাহ করতেছে?

মাকে একটু দুঃখিত দেখে ভবতোষ সমস্ত কথা তাঁকে খুলে বলল সুন্দরী মেয়ে যে আদর্শ হিন্দু-গৃহলক্ষ্মী কেন হতে পারে না, তা তাঁকে ভাল করে বুঝাইয়া দিল শেষে বলল, তার প্রতিজ্ঞা স্থির-অটল-অচল

সেদিন আর জননী অধিক পীড়াপীড়ি করলেন না ভবতোষেরও ছুটি ফুরিয়ে গেল, সে কলকাতা যাত্রা করল

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উপরিউক্ত ঘটনার কয়েক দিন পরে, একদিন পাল্কি করে উপেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী ভবতোষের মাতার সহিত সাক্ষাৎ করতে আসলেন

প্রথম অভ্যর্থনার কুশলপ্রশ্নাদির পর উপেন বাবুর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, দিদি ভবতোষ রাজি হল?

ভবতোষের মাতা বললেন, বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু তার আবার এক আজগুবি মত

কী রকম?

প্রথমে বলল, আমি দেখে শুনে বিয়ে করব আমি বললাম, তা বেশ , একটি খাসা সুন্দরী মেয়ে আছে, দেখে এস সে বলে, আমি সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করব না, একটি কালো কুৎসিত মেয়ে বিয়ে করতে চাই

উপেন্দ্রবাবুর স্ত্রী শুনে বিস্মিত হলেন বললেন, এমন অনাসৃষ্টি আবদারও কখনও শুনিনি! রকম আবদার কেন তা কিছু বলল?

ভবতোষের মাতা তখন, পুত্রের নিকট যেমন শুনে ছিলেন, সেরূপে বললেন উপেন্দ্রবাবুর স্ত্রী বসে ভাবতে লাগলেন কিছুক্ষণ বললেন দেখ তুমি এক কাজ কর দিকিন দিদি ভবতোষকে এই শনিবারে আসতে লেখ লেখ যে, তোমার যে রকম মেয়ে বিয়ে করার মত, সে রকম মেয়ে একটি স্থির করেছি, তাকে দেখবে এস তারপর এলে, রবিবার দিন বিকেলে আমার ওখানে পাঠিয়ে দিও আমি সব ঠিক করে নেব

ভবতোষের মাতা সম্মত হলেন ভাবলেন, হয়ত উপেন্দ্রবাবুর স্ত্রী মনে করেছেন, ভবতোষ পুলিনাকে দেখলে আর বিবাহে অসম্মত হতে পারবে না বাস্তবিক তাহা আশ্চর্য নয়, কারণ মেয়েটি খুবই সুন্দরী বটে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ভবতোষ শনিবার বাড়ী আসল পরদিন বিকাল একখানি ঘোড়ার গাড়ি করে, চুল উস্কোখুস্ক করে (কারণ সেকালে মুনি ঋষিরা চুল আঁচড়াইতেন না) গ্রামান্তরে উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল

গিয়া শুনল সেদিন উপেন্দ্রবাবু বাড়ি নেই, কার্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গিয়েছে একটি যুবক মহা সমাদরে তাকে নাইয়া লইল এবং বৈঠকখানায় বসাইল যুবকটি উপেন্দ্রবাবুরই ভ্রাতুস্পুত্র

কিছুক্ষণ পর ঝি এসে সংবাদ দিল, আন্দরে যেতে হবে ঝি ভবতোষের মুখের পানে চেয়ে একটু ফিক করে হেসে গেল

যুবকটির সঙ্গে ভবতোষ অন্তঃপুরে প্রবেশ করল তার মনে হল, চাকর বাকর সকলেই যেন হাসি লুকাইবার চেষ্টা করতেছে

ভবতোষ একটি কক্ষে উপস্থিত হল কক্ষটি উত্তমরূপে সাজান মধ্যস্থলে একখানি আসন পাতা রয়েছে আসনের সম্মুখে রেকাবীতে ফল মিষ্টান্ন সজ্জিত অল্প দূরে আর একখানি আসন পাতা রয়েছে

অনুরোধক্রমে ভবতোষ মিষ্টান্নের থালার সম্মুখে বসল এমন সময়ে বাহিরে মলের ঝুম ঝুম্ শব্দ উঠল ঝি মেয়েটিকে লইয়া প্রবেশ করল মেয়েটি অপর আসনখানিতে বসে, ঘরের চতুর্দিকে কৌতুহলপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগল

লজ্জায় ভবতোষের মস্তক অবনত একটু একটু করে ফল খাইতেছে এবং আড়চোখে আড়চোখে মেয়েটির পানে চাইতেছে মেয়েটির পরিধানে বেগুনে রঙের বোম্বাই শাড়ি মাথাটি খোলা চুলগুলি তেলে যে চপ চপ করতেছে

মেয়েটির রঙটি মসীনিন্দিত চক্ষু দুইটি ছোট ছোট, কোটরান্তর্গত সে দুটি আবার অবিশ্রান্ত ঘুরতেছে কপালটি উঁচ্চ নাকটি চেপ্টা চিবুক নাই বললেই হয় সম্মুখের দাঁতগুলি কিঞ্চিৎ দেখা যাইতেছে।।

ভবতোষের মনে হল, রূপ সম্বন্ধে মেয়েটি তাহার আদর্শের অনুযায়ী বটে একটু গলা ঝাড়িয়া সাহস সংগ্রহ করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কী?

মেয়েটি হঠাৎ ভবতোষের পানে চেয়ে, কিঞ্চিৎ জিহ্বা বাহির করে বলল, অ্যা?

তোমার নাম কী?

আমার নাম জগদম্বা

এমন সময় যুবকটিও সেই ঝি তার পানে সরোষ কটাক্ষপাত করল মেয়েটি তৎক্ষণাৎ বলল, জগদম্বা নয়, আমার নাম পুলিনা

যুবকটি বলল, আগে ওর নাম ছিল জগদম্বা, এখন বদলে পুলিনা রাখা হয়েছে

ভবতোষ ভাবল, পরিবর্তনটা ভাল হয় নাই পুলিনা গা জ্বলিয়া যায় তার অপেক্ষা জগদম্বা ঢের ভাল বিবাহ করে সে জগদম্বা নাম বহাল রাখবে

ভবতোষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী পড়? বালিকা পূর্ববৎ জিহ্বা দেখাইয়া বলল, অ্যা?

তুমি কী পড়?

কিছুই পড়িনে

ঝি সেই যুবক তার প্রতি পুনরায় সরোষ কটাক্ষপাত করায় বালিকা থেমে গেল

শুনে ভবতোষ আরও আশ্বস্ত হল এই ঠিক হয়েছে ইহাকে যথার্থ হিন্দুগৃহিণী করে তোলা সম্ভবপর হবে দেখতে একটু তা হক সেই তাহার প্রতিজ্ঞা বিবাহের সময় বাসার ছেলেদের নিমন্ত্রণ করে আনতে হবে

ভবতোষ বলল, আচ্ছা তুমি যেতে পার

মেয়েটি জিহ্বাগ্রভাগ বিকশিত করে পূর্ববৎ বলল, অ্যা?

যেতে পার 

ঝি তখন তাকে সঙ্গে করে নিয়া গেল

ভবতোষের জলযোগ ক্রমে শেষ হল এই সময় একটি ত্রয়োদশবর্ষীয় বালিকা, রূপার ডিবায় ভরে পান লইয়া আসল মেয়েটি দেখতে অত্যন্ত সুন্দরী, একখানা দেশি কালাপেড়ে শাড়ি পরিয়া এসেছে পায়ে চারিগাছি মল হাতে গিনি সোনার টুকটুকে দুই গাছি বালা যুগলের মাঝখানে খয়েরের টিপ পান রেখে মেয়েটি চলিয়া গেল যাইবার সময় অন্যদিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে গেল

ভবতোষ মনে মনে ভাবল, দেখ, এই একটি সুন্দরী মেয়ে ধর, যদি ইহার সঙ্গেই আমার বিবাহ হইত, তাহা হইলে কি আর রক্ষা ছিল? আমার সকল আদর্শ, সকল সঙ্কল্প, অতল জলে ডুবে যেত বিলাস বিভ্রামে মজিয়া হয়ত, আমি যে আমি, আমার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যেত না না, আমি সুখের জন্য, আমোদের জন্য, প্রণয়ের জন্য বিবাহ করতেছি না, আমি ধর্মের জন্য, সংযমের জন্য, আদর্শ হিন্দুগার্হস্থ জীবন যাপন করিবার জন্য বিবাহ করতেছি প্রতিজ্ঞা পূরণ জনিত আত্মগৌরব ভবতোষের মনে উছলিয়া উঠতে লাগল

যুবকটির সঙ্গে ভবতোষ বাহিরে আসল

ঝি আসিয়া, ঈষৎ হেসে বলল, বাড়ির মেয়েরা জিজ্ঞাসা করছে, মেয়ে পছন্দ হয়েছে?

ভবতোষ সগর্বে বলল, হয়েছে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

গাড়িতে আসতে আসতে ভবতোষ মনে মনে অপরাহ্নের ঘটনাগুলি আলোচনা করতে লাগল গ্রামের পথ দিয়া আসতেছে কত যুবতী মেয়ে কলসিতে জল ভরে বাড়ি ফিরতেছে সে সকল মেয়ের মুখগুলি ভবতোষ একটু মনোযোগের সহিতই দেখতে লাগল তাহাদের মধ্যে সুন্দর মেয়ে আছে, কালো মেয়েও আছে- কিন্তু জগদম্বার মত অত কুৎসিত একটি মুখও দেখতে পাইল না গাড়ি ক্রমে মাঠের মধ্যে এসে পড়ল তখনও তাহার মন আত্মীজয়ের উৎসাহে ভরপুর তথাপি মনে মনে ভাবতে লাগল, সে কালো মেয়ে বিবাহ করতে প্রতিজ্ঞা করেছিল বটে, কিন্তু একেবারে এত কুৎসিত না হইলেও ক্ষতি ছিল না যাহা হউক, পছন্দ হইয়াছে যখন বলিয়া এসেছে, তখন সে আলোচনায় ফল কি?

এই অবস্থায় ভবতোষ বাড়ি পৌছল মা জিজ্ঞাসা করলেন, কি বাবা, মেয়ে পছন্দ হল?

হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে  

তবে সব ঠিক করি?

কর

এই অগ্রহায়ণ মাসেই হোক তাহলে?

আচ্ছা বলে ভবতোষ অন্যত্র চলে গেল  

মা দেখলেন, ছেলের মন যেন ভার ভাবলেন, সুন্দর মেয়ে বিবাহ করব না বলে অনেক লম্ফ করেছিল, এখন রাজি হয়েছে, তাই বোধ হয় ছেলের লজ্জা হয়েছে

ভবতোষ রাত্রে কিছু আহার করল না বলল, উহাদের বাড়ি অনেক খেয়ে আসছ, ক্ষুধা নাই তখন তার মন হইতে আত্মজয় প্রতিজ্ঞা পূরণ জনিত উৎসাহ অনেকটা কমে আসছে

রাত্রে শয়ন করে জগদম্বার মুখখানি যতই সে ভাবতে লাগল ততই তাহার বুকের ভিতরটা যেন হিম হইয়া উঠতে লাগল মনে হতে লাগল, যদি অত কুৎসিত না হয়ে শ্যামবর্ণের উপর মুখচোখগুলো একটু মানানসই হত তা হইলে মন্দ হত না

সোমবারে উঠে ভোরের ট্রেনে ভবতোষ কলকাতা যাত্রা করল মা বলে দিলেন, বিবাহের আর দশদিন মাত্র বাকি আছে, দুই দিন পূর্বে ভবতোষ যেন বাড়ি আসে

বাসায় পৌঁছিলে সহপাঠীরা দেখিল, ভবতোষের মুখখানি যেন মেঘের মত অন্ধকার ভবতোষ গিয়া নিজ কক্ষের মধ্যে উপবেশন করল  

কি ভবতোষবাবু, খবর কী? বলতে বলতে রজনীবাবু, শরৎবাবু, রাখালবাবু, সতীশবাবু, কুমুদবাবু, পেনবাবু প্রভৃতি এসে উপস্থিত হলেন

ভবতোষ বাড়ি যাইবার সময় ইহাদের সকল কথাই বলে গিয়াছিল

খবর কী ভবতোষবাবু?  

ভবতোষ একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, খবর ভাল

তারপর সকলে প্রশ্ন করে মেয়েটির রূপ, গুণ, বয়স প্রভৃতির সমস্ত খবর জেনে নিল শরত্যাবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটির নাম কী?

ভবতোষ নাম বলল।।

তা শুনে সকলেরই মুখে একটু একটু হাসি দেখ দিল কেবল নৃপেনবাবু আত্মসংযম হারাইয়া উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন, হা-হা-হা জগদম্বা-হি-হি-হি বেশ নামটিত

শরৎবাবু বললেন, নৃপেনবাবু, এটা এমনই কি হাসির কথা? হাসছেন কেন?

নৃপেনবাবু বললেন, না হাসিনি হি-হি-হি হাসব কেন? হা-হা!

রজনীবাবু বললেন, না, নামটি মন্দ কি? পৌরাণিক নাম তোমাদের আজকালকার জ্যোৎস্নাময়ী, সরসীবালা, তড়িল্লতা, মণিমালিনী এই সব নাটুকে বুঝি ভাল?

ভবতোষ ইহা শুনে গম্ভীরভাবে মাথাটা নাড়তে লাগল সকল বিষয়ে তার পূর্ব উত্তেজনা আজই যেন আর নাই

বিবাহের আর নয়দিন বাকি আছে নয়দিন যে ভবতোষের কি অবস্থায় কাটল, তা সেই জানে বাসার লোকেও কিছু কিছু জানতে পারছিল জগদম্বাকে ভবতোষ যতই মনের মধ্যে ভাবে, ততই তাহার বুকের ভিতরটা অন্ধকারে ভরে যায় ভবতোষ কলেজে যায়, কিন্তু লেকচার কিছুই শুনতে পায় না ক্ষুধার জন্য বাসায় সে বিখ্যাত ছিল, এখন তার পাতের অন্নব্যঞ্জন অর্ধেকের বেশি থাকে  

ভবতোষ কারও সঙ্গে হাস্যালাপ করে না, সদাই অন্যমনস্ক থাকে বাসার লোক তাহাকে বলতে লাগল, ভবতোষবাবু, প্রেম ব্যাধির সমস্ত লক্ষণগুলিই ক্রমে আপনার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে  

রাত্রে বিছানায় শুয়ে ভবতোষ আর সহজে নিদ্রা যায় না কেবল পাশ পাশ করে অতিকষ্টে যখন নিদ্রা আসে, তখন কেবল বিভীষিকাপুর্ণ স্বপ্ন দেখে একদিন স্বপ্ন দেখল, জগদম্বা যেন কালো মূর্তি ধারণ করেছে তাহার অল্প পরিমাণ রসনা ভবতোষ যা দেখেছিল, তা যে অর্ধেক বাহির হয়ে পড়েছে তার যেন দুইটা নতুন হস্ত উৎপন্ন হয়েছে তার এক হাতে যেন রক্তমাখা খঞ্জ, অপরটাতে যেন ছিন্ন মুণ্ড দুলিতেছে মুণ্ডটা যে ভবতোষের মত দেখতে আর একদিন স্বপ্ন দেখল, ভবতোষ যেন একটা কন্টকময় জঙ্গলে পথ হারাইয়া ফেলেছে আকুল হয়ে পথ খুঁজে বেড়াইতেছে, এমন সময় একটা মহিষ যে তাকে তাড়া করে আসল মহিষের পরিধানে যে একখানি বেগুনি রঙের বোম্বাই শাড়ি, তার মুণ্ডের স্থানে যে জগদম্বার মুখ, কেবল তাতে দুইটা শৃঙ্গ বাহির হয়েছে

যখন বিবাহের আর তিনদিন মাত্র বা আছে, তখন ভবতোষ ভাবল, মাকে একখানি পত্র লিখে বিবাহ বন্ধ করে ফেলবে সেদিন অসুস্থতার ভান করে সে কলেজে গেল না সমস্ত দিন একাকী ঘরে বসিয়া মাকে এক একে অনেকগুলি চিঠি লিখে ছিড়ে ফেলল বাসার লোকেরা যখন শুনবে যে বিবাহ ভঙ্গিয়া গিয়াছে, তখন তারা কী বলবে? তাহাদের উপহাস বিদ্রুপ সে মেকন করে সহ্য করিবে?

সেদিন রাত্রে শুইয়া ভাবতে লাগল, কাকেও কিছু না বলিয়া সে পশ্চিম পলাইয়া যাইবে উঠিয়া প্রদীপ জ্বালিয়ে টাইমটেবল উল্টাইয়া দেখতে লাগল কিন্তু প্রভাতে আবার তার মতের পরিবর্তন ঘটল ছি ছি, শেষে কী এক কাণ্ড কারখানার পর সে ভীরু নাম গ্রহণ করবে? তা হবে না, প্রতিজ্ঞা সে পূরণ করবেই, তার পর তার অদৃষ্টে যাই থাক

যথাদিনে সে বাড়ি গেল যথাসময়ে সে বিবাহমণ্ডপেও উপস্থিত হল সেখানকার লোকসমাগম, আলোক কোলাহলে, আজ দশ দিন পরে তার চিত্ত অনেকটা স্থির হল যুদ্ধকাল সমাগত হলে ভীরুতম সৈন্যও ভয় ভুলিয়া যায়

বিবাহ আরম্ভ হইল তখন ভবতোষের চিত্ত নির্বিকার তখন তার মনে ভয় বা হর্ষ বা নৈরাশ্য কিছুই নাই

ক্রমে স্ত্রী আচারের সময় আসল শুভদৃষ্টির জন্য বর কন্যার মস্তরে উপর বস্ত্রাবরণ পড়ল কন্যার পানে চেয়ে দেখে ভবতোষ আশ্চর্য হয়ে গেল তাহার দশ দিনকার বিভীষিকা, নিদ্রার দুঃস্বপ্ন জগদম্বা না সেই চমৎকার সুন্দরী মেয়েটি যে রূপার ডিব্বায় পান রেখে গিয়েছিল

ফুলশয্যার রাত্রে যখন ভবতোষ তার নব বধুকে কথা বলার জন্য বিশেষ চেষ্টা করে অকৃতকার্য হইল, তখন একটা বুদ্ধি করিল সে শুনেছিল, যে নববধু কিছুতেই কথা কহে না, সেও আপনার আত্মীয়স্বজনের অপবাদ শুনলে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে থাকে তাই ভবতোষ বলিল, তোমার মা আমার সঙ্গে চাতুরি কললেন কেন?

পুলিনা তখন বলল, আমি সুন্দর বলে, তুমি নাকি আমায় বিয়ে করতে চাওনি? কেমন জব্দ

ভবতোষ পর্যন্ত প্রহেলিকার মীমাংসা করিতে পারে নাই তাই জিজ্ঞাসা করিল, যাকে দেখেছি, সে মেয়েটি কে?

সে, পাড়ার কলুদের মেয়ে কেমন জব্দ

ক্রমে এমন দিনও আসিল, যখন ভবতোষ ডাক আসিবার পূর্বে বাসার দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে পিয়নের সহিত সাক্ষাৎ করতে লাগল

No comments:

Post a Comment

Popular Posts