আ পিস অফ স্টেক - জ্যাক লন্ডন - বাংলা অনুবাদ - A Piece of Steak - Jack London - Bengali Translation |
আ পিস অফ স্টেক - জ্যাক লন্ডন -
বাংলা অনুবাদ - A Piece of Steak - Jack London - Bengali Translation - Part - 1 of 2
পাউরুটির শেষ টুকরোটা দিয়ে ময়দার অবশিষ্ট
কাথটুকু মুছে নিয়ে মুখে পুরে দিল টম কিং, ধীরে ধীরে চিবুতে লাগল ধ্যানমগ্ন
ভঙ্গিতে। টেবিল ছেড়ে উঠতে টের পেল, খিদে তার একটুও মেটেনি। অথচ
বাড়ির মধ্যে সে-ই শুধু খেয়েছে। অন্য ঘরে সন্ধ্যার আগেই ঘুম
পাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাচ্চা দুটোকে, যাতে রাতের খাবারের কথা
তাদের আর মনে না থাকে। কিছুই পড়েনি স্ত্রীর পেটেও, চুপচাপ বসে
স্বামীকে লক্ষ্য করছে সে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। শ্রমজীবী মহিলাদের মত হালকা-পাতলা শরীর তার, যদিও এক সময়কার সৌন্দর্যের রেশ রয়ে
গেছে এখনও। কাথ তৈরির জন্যে ময়দাটুকু সে ধার করে এনেছে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে,
পাউরুটি কিনতে খরচ হয়ে গেছে সর্বশেষ দুটো আধ পেনি।
জানালার কাছের একটা চেয়ারে বসে পড়ল
টম কিং,
জীর্ণ চেয়ারটা ক্যাচক্যাচ করে উঠল তার শরীরের ভারে। একটা হাত প্রায়
যান্ত্রিকভাবে ঢুকে গেল পকেটে, পাইপটা বের করে এনে ঝুলিয়ে দিল
ঠোটে। অন্য হাত থাবড়া দিতে লাগল কোটের পাশের পকেটে। আর ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেল,
তামাক নেই। একটা ভ্রুকুটি হেনে পাইপটা আবার পকেটে রেখে দিল সে। নড়াচড়া
তার খুবই ধীর, যেন ভারী মাংসপেশীগুলো শরীরের পক্ষে বোঝা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। টম কিং একজন শক্তসমর্থ মানুষ। মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কোনওকিছুতেই বিচলিত হবার
পাত্র সে নয়। পুরনো পোশাকগুলো তার কেমন যেন জবুথুবু। তলায় পট্টির ওপর পট্টি লাগানোয়
জুতোর ডগার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে পেছন দিকের ভার বহন করা। দু’শিলিংয়ের সুতির
সস্তা জামার কলার ক্ষয়ে গেছে, স্থায়ীভাবে বসে গেছে বেশ কয়েকটা দাগ।
টম কিংয়ের মুখমণ্ডলই বহন করছে তার পরিচয়।
ভালভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, এটা একটা জাত পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধার মুখ,
রিংয়ে কেটে গেছে যার বছরের পর বছর। আর এসব বছর লড়াকু জানোয়রের যাবতীয়
চিহ্ন এঁকে দিয়েছে তার মুখে। ঠোটজোড়ার কোনও আকার নেই বললেই চলে, চেহারা বীভৎস, ভারী পাতাঅলা চোখদুটো অভিব্যক্তিহীন,
সিংহের মত তাতে কেবল একটা ঘুমজড়ানো ভাব। ভিলেনের মত মাথাটায় হেলানো
কপাল, খাটো করে ছাঁটা চুলগুলো পড়ে আছে খুলি কামড়ে। অজস্র ঘুসিতে
দু'বার ভাঙা নাকটা দারুণ বাঁকাচোরা, ফুলকপির
মত এবড়োখেবড়ো একটা কান নিজস্ব আকারের দ্বিগুণ হয়ে ফুলে গেছে চিরদিনের জন্যে,
ওদিকে নিখুঁতভাবে কামানোর ফলে গালের চামড়া ধারণ করেছে একটা নীলাভ-কালো রং।
মোট কথা, টম
কিংয়ের মুখ এমন এক ধরনের মুখ, যা অন্ধকার কোনও গলি বা নির্জন
স্থানে দেখলে আঁতকে উঠবে মানুষ। কিন্তু তাই বলে সে অপরাধী নয়, অন্যায় কোনও কাজই করেনি কখনও। ঝগড়া করেছে দু'চারবার,
কিন্তু ক্ষতি করেনি কারওই। সে একজন পেশাদার, এবং
তার যাবতীয় নিষ্ঠুরতা ভোলা থাকে পেশাদার লড়াইয়ের জন্যে। রিংয়ের বাইরে সে একজন সাদাসিধে
ভাল মানুষ। কারও প্রতি কোনও বিদ্বেষ নেই, শত্রুর সংখ্যাও খুব
কম। রিংয়ে সে আঘাত হানে আহত করার জন্যে, পঙ্গু করার জন্যে,
এমনকী ধ্বংস করার জন্যে; কিন্তু তার পেছনে টম কিংয়ের
কোনও প্রতিহিংসা নেই। সম্পূর্ণটাই নেহাত পেশাগত একটা ব্যাপার। দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী
পরস্পর পরস্পরকে নকআউট করতে চাইছে, পকেটের পয়সা খরচ করে তা-ই দেখতে চায় দর্শক। জয়ী পায় বেশি অঙ্কের পুরস্কার। বিশ বছর আগে টম কিং যখন মুখোমুখি হয় উলুমলু গাউগারের, তখন
সে জানত, মাত্র চার মাস আগে নিউক্যাসলে লড়তে গিয়ে চোয়াল ভেঙেছে
গাউগার। সুতরাং সেই চোয়ালটাই হয়ে দাঁড়াল তার একমাত্র লক্ষ্য। এবং নবম রাউণ্ডে চোয়ালটা
আবার ভেঙে দিল সে। অথচ গাউগারের প্রতি সে অশুভ কোনও মনোভাব পোষণ করত না। কাজটা সে শুধু
করেছিল এজন্যে যে, জয়লাভ করে বেশি অঙ্কের পুরস্কারটা পাবার ওটাই
ছিল সহজতম পথ। গাউগারেরও তার প্রতি কোনও শত্রুতা ছিল না। উভয়েই জানত, পেশাদার মুষ্টিযুদ্ধ কাকে বলে, আর লড়েছেও সেভাবেই।
বকবক করা টম কিংয়ের অভ্যাসের বাইরে।
জানালার কাছে চুপচাপ বসে সে তাকিয়েছিল। নিজের দুটো হাতের দিকে। ফুলে আছে বেশ কয়েকটা
শিরা,
ভেঙে বিশ্রী আকার ধারণ করেছে গাঁটগুলো। ধমনীগুলো অন্যান্য মানুষের তুলনায় অনেক বেশি রক্ত সঞ্চালন করতে
করতে এখন কিছুটা ক্লান্ত, ফলে সেও সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দ্রুত বিশ রাউণ্ড
আর খেলতে পারে না সে। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে সেই ছুটে যাওয়া, অসংখ্য ঘুসি চালানো প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে, নিজেও
অসংখ্য ঘুসি হজম করা, উত্তেজনায় ফেটে পড়া দর্শকদের উত্তেজনায়
শেষ প্রান্তে পৌছে দিতে সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণটা বিশতম রাউণ্ডের জন্যে জমিয়ে রাখা-না, এখন আর তেমনটা পারে না সে। ঘুসির পর ঘুসি চলছে-বম বম বম্ বম্, অবিরাম, অজস্র,
ওদিকে ধমনীগুলো রক্ত সঞ্চালন করে বিশ্বস্ততার সাথে-আহ! কোথায় গেল সেসব দিন। আবার তাকাল সে হাত দুটোর দিকে।
যৌবনে গাঁটগুলো ছিল কতই না সুন্দর! মনে পড়ল টম কিংয়ের। প্রথম
গাঁটটা সে ভেঙেছিল বেনী জোনস্-এর মাথায়, ‘ওয়েলশের আতঙ্ক’ নামেই
সে ছিল সমধিক পরিচিত। খিদেটা আবার মোচড় দিয়ে উঠল।
তা হলে কি এক ফালি মাংসও পাব না আমি!' বলে
উঠল টম কিং, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল একটা শপথ।
বার্ক আর সলি, দু’দোকানেই গেছি
আমি, কুণ্ঠিত স্বরে বলল স্ত্রী।
‘কেউ দিল না?’ জানতে চাইল
টম কিং।
-বার্ক বলল--- তোতলাতে
লাগল মহিলা।
-কী?
-বলল, আজ রাতে সহজেই তোমাকে
ধরাশায়ী করবে স্যাণ্ডেল।
ঘোত করে উঠল টম কিং, কিন্তু
কোনও জবাব দিল না। চিন্তার পর চিন্তা ভর করল তার মাথায়। যৌবনে পোষা বুল টেরিয়ারটাকে
মাংস খাওয়াত সে, টুকরোর পর টুকরো। তখন এক হাজার ফালি মাংস বাকি দিতেও বার্ক আপত্তি করেনি। কিন্তু
আজ দিন বদলেছে। বুড়িয়ে গেছে টম কিং। এমন মুষ্টিযোদ্ধাদের কেউ ধার দেয় না।
আজ সকাল থেকেই এক ফালি মাংসের জন্যে আকুল
হয়ে আছে সে! এবারে প্রস্তুতিটাও হয়নি ভালমত। অস্ট্রেলিয়ায় প্রচণ্ড খরা
গেছে এ বছর, সময় খুব খারাপ, অনিয়মিত কাজ
জোটানোও কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনও স্প্যারিং পার্টনার ছিল না তার, খাবারও পায়নি যথেষ্ট পরিমাণে। মজুরের কাজও সে করেছে, পা দুটোকে ঠিক রাখার জন্যে। দৌড়াদৌড়ি করেছে সকালে। কিন্তু পার্টনার ছাড়া
প্রস্তুতি নেয়া বড় কঠিন, এবং সেটা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যদি
কাঁধের ওপর চেপে থাকে স্ত্রী আর দুই বাচ্চার খাদ্য জোগানোর দায়িত্ব। স্যান্ডেলের সাথে
লড়াইয়ের কথাটা পাকাপাকি হয়ে যাবার পরও আহামরি কোনও সুবিধে দোকানদারেরা তাকে দেয়নি।
গেইটি ক্লাবের সেক্রেটারি অগ্রিম দিয়েছে তিন পাউণ্ড-হারলে যে
অঙ্কটা সে পাবে-অনেক বলেও পাওয়া যায়নি অতিরিক্ত একটা পেন্স।
মাঝে সাঝে দু’চার শিলিং সে জোগাড়
করেছে পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে। খরার ফলে তাদের অবস্থাও খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। হ্যাঁ-ব্যাপারটা
মানতেই হচ্ছে—প্রস্তুতি তার সন্তোষজনক নয়। আরও ভাল খাবার
খাওয়া উচিত ছিল তার, উচিত ছিল চিন্তামুক্ত থাকা। তা ছাড়া,
বিশ বছর বয়েসে স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যতটা সহজ, চল্লিশ
বছরে ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়।
-কয়টা বাজে, লিজি?
জানতে চাইল সে। হলঘরে গিয়ে আবার ফিরে এল মহিলা। পৌনে আটটা।
-প্রথম প্রতিযোগিতাটা শুরু হবে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই, বলল
সে। তারপর চার রাউণ্ডের এক প্রতিযোগিতা ডিলার ওয়েলশ আর গ্রিডলির। দশ রাউণ্ডের তৃতীয় প্রতিযোগিতাটা হবে স্টারলাইটের সাথে কোনও এক
নাবিক ছোকরার। আমার লড়াই দেরি আছে এক ঘণ্টারও বেশি।
দশ মিনিট নিশ্চুপ বসে থেকে উঠে পড়ল টম
কিং।
-আসলে, লিজি, ট্রেনিংটা আমার ভাল
হয়নি।
হ্যাটটা নিয়ে দরজার দিকে রওনা দিল টম।
স্ত্রীর চুমুর জন্যে অপেক্ষা করল না-কখনোই করে না সে কোথাও যাবার
সময়—কিন্তু আজ চুমু খাবার সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে মহিলা। দু’হাতে গলা জড়িয়ে
ধরে স্বামীর মুখটা সে নামিয়ে আনল নিজের মুখের ওপর।
-গুড লাক, টম,' বলল সে। আশা করি
তুমি ওকে হারাতে পারবে।
-হ্যা, হারাব ওকে, বলল টম। কাজ তো একটাই-ওকে হারানো।
প্রাণখোলা একটা হাসি হাসার চেষ্টা করল
সে, মহিলা আরও সেঁটে গেল তার শরীরের সাথে। স্ত্রীর কাঁধের ওপর দিয়ে শূন্য ঘরটায়
একটা দৃষ্টি বোলাল সে। এই তার যাবতীয় সম্পত্তি আসবাবহীন একটা ঘর, বাকি পড়া ভাড়া, এক স্ত্রী আর দুই সন্তান। এখন সে চলেছে
তাদের মুখে তুলে দেয়ার জন্যে কিছু খাবার আনতে, যে-খাবার তাকে জোগাড় করতে হবে লড়াইয়ের মাধ্যমে। আধুনিক মানুষ এভাবে খাবার আনতে
যায় না, এটা যেন অনেকটা আদিম মানুষদের শিকারে বেরোনোর মত।
-হারাবোই ওকে, জিতলে পাব তিরিশ পাউণ্ড—সমস্ত ঋণ মিটিয়েও
থেকে যাবে অনেকটা। আর যদি হারি-একটা পেন্সও পাব না। পরাজিত মুষ্টিযোদ্ধার
যা পাবার কথা, অগ্রিম দিয়েছে সেক্রেটারি। গুড বাই, লিজি। যদি জিতি সোজাসুজি ফিরে আসব বাড়িতে।
টমের কণ্ঠে প্রকাশ পেল খানিকটা বেপরোয়া
ভাব।
-অপেক্ষা করব আমি তোমার জন্যে, বলল মহিলা।
গেইটির দূরত্ব পুরো দু’মাইল। হাঁটতে
হাঁটতে টমের মনে পড়ল সেই দিনের কথা-সে যখন ছিল নিউ সাউথ ওয়েলশের
হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন-ক্যাবে চড়ে আসত সে লড়াই করার জন্যে,
বেশির ভাগ সময়েই ভাড়া মিটিয়ে দিত অন্ধ কোনও সমর্থক। টমি বার্নস আর
আমেরিক্যান সেই নিগ্রো-জ্যাক জনসন যেত মোটরে করে। অথচ আজ সে হেঁটে
চলেছে! আর, এ-কথা
সবাই জানে, প্রতিযোগিতার আগে দু’মাইল হাঁটা
মোটেই ভাল নয়। সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, বুড়ো মানুষকে পৃথিবীর কেউ পছন্দ
করে না। মজুরের কাজ ছাড়া আর কিছুই তার দ্বারা হবে না, এমনকী
সে কাজের পক্ষেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ভাঙা নাক আর ফোলা কান। কোনও একটা ব্যবসা
যদি জানা থাকত তার! শেখাত যদি কেউ! কিন্তু
তার অন্তরাত্মা জানে, শেখালেও শিখতে সে চাইত না। এই উত্তেজনার
কি তুলনা আছে! কয়েকটা ঘুসি ছোড়ো, লুটে
নাও কাড়ি কাড়ি টাকা। কিছু দিন বিশ্রাম নাও, তারপর আবার ছেড়ো
ঘুসি-বম্ বম্ কম্ বম্। শেষ রাউণ্ডের সেই আক্রমণ, চারপাশ থেকে ভেসে আসা দর্শকদের চিৎকার, লড়াই শেষে রেফারির
ঘোষণা ‘কিং জিতেছে!’ এবং পরদিন খেলার পাতায় খবর বড়
বড় অক্ষরে।
কী দিনই না ছিল সেসব! তখন
সে ছিল যুবক, উঠতি; আর প্রতিদ্বন্দ্বীরা
ছিল বুড়ো, পড়তি। লড়তে আসত তারা কমজোর হাড় আর থেঁতলে যাওয়া
গাঁট নিয়ে, ফলে নেহাত সোজা হয়ে দাঁড়াত পুরো ব্যাপারটাই। বুড়ো
স্টাউসার বিলকে সে নকআউট করেছিল রাস-কাটার্স বে-তে। আঠারো রাউণ্ডে পরাজিত হবার পর বুড়ো বিল শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়েছিল
ড্রেসিংরুমে গিয়ে। বাড়ি ভাড়া হয়তো বাকি ছিল বেচারির। হয়তো পথ চেয়ে বসে ছিল স্ত্রী
আর দুই সন্তান। হয়তো আকুল হওয়া সত্ত্বেও সে রাতে মাত্র এক ফালি মাংস সে জোটাতে পারেনি।
দুর্লভ এক থোক টাকার জন্যে সে-রাতে লড়েছিল বিল, পক্ষান্তরে টম কিং লড়েছিল সহজলভ্য টাকা আর গৌরবের জনন্য।
প্রত্যেক মুষ্টিযোদ্ধারই লড়াইয়ের একটা
নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। কেউ লড়তে পারে একশোটা শক্ত লড়াই, কেউ
হয়তো মাত্র বিশটা; সবই নির্ভর করে তার দৈহিক গঠনের ওপর,
পেশির ধরনের ওপর। নির্ধারিত সংখ্যক সেই লড়াইয়ের পর থেকেই শুরু হয়
মুষ্টিযোদ্ধার পতন। হ্যা, গড়পড়তা মুষ্টিযোদ্ধার চেয়ে অনেক
বেশি লড়ার ক্ষমতা নিয়ে সে এসেছে এই পৃথিবীতে। লড়াইও এ যাবৎ কম করেনি, যে লড়াইগুলো কুরে কুরে খেয়েছে তার অদম্য মানসিক শক্তি, সহনশীলতা। হ্যা, সমকালীন মুষ্টিযোদ্ধাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে ভাল করেছে। সঙ্গীদের কেউই আর টিকে নেই। একে একে সবার পতন দেখেছে
সে, কয়েকজন তো তারই হাতে খতম হয়ে গেছে।
তখন সে ছিল যুবক, তার
ওপর পড়ত বুড়োদের খতম করার ভার। তাই তো ড্রেসিংরুমে বুড়ো স্টাউসার বিলকে কাঁদতে দেখে
হেসেছিল সে দুলে দুলে। এখন সে বুড়ো, তাকে খতম করার ভার দেয়া
হচ্ছে বর্তমানের যুবকদের ওপর। সেই ভার নিয়েই স্যাণ্ডেল এসেছে নিউজিল্যাণ্ড থেকে,
লড়াইয়ে যার রয়েছে ধারাবাহিক রেকর্ড। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় তাকে কেউ
চেনে না। টম কিংয়ের বিপক্ষে সে যদি ভাল করতে পারে, তাকে দেয়া
হবে আরও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই সাথে বাড়তে থাকবে পুরস্কারের
অঙ্ক। সুতরাং লড়াইটা স্যাণ্ডেল হিংস্রভাবেই লড়বে। তার অর্থ আর গৌরবোপার্জনের পথে
টম কিং মূর্তিমান বাধা, অতএব সে-বাধা অপসারণের
জন্যে সে যথাসাধ্য করবে। পক্ষান্তরে টম কিংয়ের লক্ষ্য স্রেফ ওই তিরিশ পাউণ্ড,
যা দিয়ে সে মেটাতে চায় বাড়িভাড়া আর কিছু ঋণ। হ্যা, বার্ধক্য পরাজিত হয় তারুণ্যের কাছে। তারপর, হার মানার
খাতিরে, সে-তারুণ্যও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়
বার্ধক্যের দিকে। ক্যাসলিরিয়া স্ট্রীটে পৌছে সে বামদিকে ঘুরল, তিনটে ব্লক পরেই গেইটি। সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল তরুণ একদল মাস্তান,
ফিসফিস করতে লাগল পরম্পর, এই যে! এই সেই টম কিং!
ড্রেসিংরুমের দিকে এগোতে দেখা হলো সেক্রেটারির
সাথে। তীক্ষ্ণ চোখ, ধূর্ত
চেহারার লোকটা করমর্দন করল তার সাথে।
-কেমন বোধ করছ, টম?
-সম্পূর্ণ সুস্থ।
কথাটা মিথ্যে, জানা
আছে তার। মাত্র একটা পাউণ্ড হাতে থাকলেও সে খেত এক ফালি মাংস।
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সহকারীদের নিয়ে
এগোতে লাগল সে রিং অভিমুখে। হৈ হৈ করে উঠল
অপেক্ষমাণ জনতা। ডানে বামে ঝুঁকে অভিবাদন গ্রহণ করল সে, তবে
বেশির ভাগ মুখই অচেনা। একের পর এক যখন সুনাম অর্জন করছিল সে, তখন হয়তো এদের জন্মই হয়নি। আলগোছে পাটাতনে লাফিয়ে উঠে, মাথা নীচু করে দড়ি পার হয়ে, সোজাসুজি নিজের কোণে গিয়ে
বসে পড়ল সে একটা ভাজ করা টুলে। জ্যাক বল, রেফারি, হাত মেলাল এগিয়ে এসে। সেও ছিল মুষ্টিযোদ্ধা, দশ বছর
আগে একটা দুর্ঘটনায় পড়ার পর আর রিংয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। জ্যাক বল রেফারি থাকায়
খুশিই হলো টম কিং। বুড়ো তারা দু’জনেই। সুতরাং স্যাণ্ডেলকে
দু’চারটে বেআইনী আঘাত হানলে জ্যাক বল সেটা এড়িয়ে
যাবে,
এটুকু ভরসা তার ওপর করা যায়।
একের পর এক রিংয়ে উঠছে উচ্চাভিলাষী তরুণ
হেভিওয়েটরা। রেফারি তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে দর্শকদের সাথে। এ ছাড়া সে জানিয়ে
দিচ্ছে হেভিওয়েটদের চ্যালেঞ্জ।
-এটা হলো প্রোন্টো, ঘোষণা করল বল। এসেছে উত্তর সিডনি থেকে। জয়ীর প্রতি সে ছুঁড়ে দিচ্ছে পঞ্চাশ
পাউণ্ডের চ্যালেঞ্জ। পঞ্চাশ পাউণ্ড, পঞ্চাশ পাউণ্ড, পঞ্চাশ পাউণ্ড।
স্যান্ডেল রিংয়ে উঠে তার টুলে গিয়ে
বসে পড়তে আবার হৈ হৈ করে উঠল জনতা। কৌতুহলী চোখে তাকাল টম কিং। কারণ, আর
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা জড়িয়ে পড়বে নিষ্ঠুর এক লড়াইয়ে। একে অপরকে অজ্ঞান করে
ফেলার জন্যে তারা প্রয়োগ করবে সর্বশক্তি। কিন্তু খুব একটা কিছু সে দেখতে পেল না। তার
মতই, রিংয়ের পোশাকের ওপর স্যাণ্ডেল পরেছে ট্রাউজার আর সোয়েটার।
ছোকরা দেখতে বেশ সুন্দর, কোঁকড়া কোকড়া হলুদ চুল নেমে এসেছে
কাঁধ পর্যন্ত। মোটা, পেশীবহুল ঘাড়।
তরুণ হেভিওয়েটদের যেন শেষ নেই। তাকিয়ে
তাকিয়ে দেখছে টম কিং। বুড়ো মুষ্টিযোদ্ধাদের মাড়িয়ে এরা মুঠোয় আনে জয়, তারপর
একদিন নিজে বুড়ো হয়ে সুগম করে দেয় অন্য তরুণের জয়ের পথ।
প্রেস বক্সের দিকে তাকিয়ে কিং মাথা নোয়াল, ‘স্পোর্টসম্যান’-এর মরগান
আর ‘রেফারি’-র করবেটের
উদ্দেশে। তারপর বাড়িয়ে দিল দু’হাত। তার দুই সহকারী, সিড
সুলিভ্যান আর চার্লি বেটস, গ্লাভস পরিয়ে বেঁধে দিল শক্ত করে।
মনোযোগ দিয়ে গ্লাভস্ বাঁধা দেখল স্যান্ডেলের এক সহকারী, এর আগে
গাঁটের ওপরের টেপগুলো লক্ষ্য করেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। স্যান্ডেলের কোণে গিয়ে এই একই
কাজ করছে তার এক সহকারী। ট্রাউজার খুলে নেয়া হয়েছে স্যাণ্ডেলের, খুলে নেয়া হলো সোয়েটারটাও। টম কিং দেখল, ধপধপে সাদা
চামড়ার নীচে কিলবিল করছে পেশী।
দুজনেই দু’জনের দিকে এগোল
মিলিত হবার জন্যে। ঘন্টা পড়ল ঢং করে, ভাঁজ করা টুল দুটো নিয়ে রিং
ত্যাগ করল সহকারীরা। দ্রুত হাত মিলিয়ে লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হয়ে দাড়াল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী।
স্প্রিংয়ের মত যাতায়াত শুরু করল স্যাণ্ডেল। বামহাতি একটা ঘুসি চালাল চোখে,
পাঁজরে ডানহাতি, প্রতিপক্ষের একটা ঘুসি এড়াল মাথা
নীচু করে, হালকাভাবে নাচতে নাচতে সরে গেল, আবার এগিয়ে এল ভয়ঙ্কর নাচ নাচতে নাচতে। সে যেমন ক্ষিপ্র তেমনি চালাক। লড়াইয়ের
কৌশলটাও চোখ ধাঁধানো। সমস্ত দর্শক
হৈ হৈ করে সমর্থন জানাল তাকে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো কোনও কৌশলের আশ্রয় টম কিং নিল না।
অনেক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তার, তরুণদের বিপক্ষেও কম লড়েনি। এই ধরনের ঘুসি
চেনা আছে তার। এগুলো দ্রুতগতি, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। শুরু থেকেই
কিছু একটা ঘটানোর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে স্যাণ্ডেল। তরুণেরা এমনই।
পুরো রিং জুড়ে যেন বিদ্যুতের মতই চমকাতে
লাগল স্যাণ্ডেল। এক কৌশল ব্যর্থ হলো, তৎক্ষণাৎ অবলম্বন করল আরেকটা।
হাজারো কৌশলের তার একটাই উদ্দেশ্য-টম কিংকে ধরাশায়ী করা,
যে দাঁড়িয়ে আছে তার ভাগ্যকে আড়াল করে। অপেক্ষা করতে লাগল টম কিং ধৈর্যের
সাথে। যৌবনের তেজ সে চেনে। আর এ-ও জানে যে, যৌবন এখন আর তার পক্ষে নেই। ধৈর্য তাকে ধরতেই হবে, যতক্ষণ
না খানিকটা দম হারিয়ে ফেলে স্যান্ডেল। ইচ্ছেকৃত একটা শয়তানী শুরু করল টম কিং,
মুষ্টিযুদ্ধে যা বেআইনী নয়। এড়িয়ে যাওয়া যায়, এমন কিছু ঘুসি সে গ্রহণ করতে লাগল মাথা পেতে। মাথার ওপরদিকে আঘাত হানলে গাঁটগুলো
থেঁতলে যায়। এই কাজের জন্যে অবশ্য বিবেকের কোনও দংশন অনুভব করল না টম কিং। গাঁটের
রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মুষ্টিযোদ্ধার নিজের। ছোট এই ব্যাপারটা তোয়াক্কাই করল না
স্যাণ্ডেল। করার কথাও নয়। কিন্তু অনেক দিন পর আজকের কথা স্মরণ করে আপসোস হবে তার।
নিজের হাত দুটো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে মনে পড়বে, কীভাবে প্রথম
গাঁটটা সে ভেঙেছিল টম কিংয়ের মাথায়।
পরের পর্ব (শেষ পর্ব)
No comments:
Post a Comment