মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Monday, August 24, 2020

দ্যা গোল্ড বাগ - এডগার অ্যালান পো - বাংলা অনুবাদ - The Gold bug - Edgar Allan Poe - Bengali Translation - Part 1 of 4

দ্যা গোল্ড বাগ - এডগার অ্যালান পো - বাংলা অনুবাদ - The Gold bug - edgar Allan Poe - Bengali Translation


দ্যা গোল্ড বাগ - এডগার অ্যালান পো - বাংলা অনুবাদ - The Gold-bug - Edgar Allan Poe - Bengali Translation - Part 1 of 4

অক্টোবর মাস। সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটন আর তার আশপাশে এরই মধ্যে যা ঠাণ্ডা পড়েছে তাতে সামনের দিনগুলোর কথা ভাবতেই হাত-পা সিঁটিয়ে আসে ভয়ে।
উফ, কী যম ঠাণ্ডারে বাবা, কাঁপতে কাঁপতে বললাম আমি।এই ঠাণ্ডার মধ্যে এককাপ গরম কফির মত আর কিছু হয় না।
ভিতর থেকে কফি তৈরি করে বারান্দায় এসে বসলাম। আয়েশ করে চুমুক লাগালাম কফিতে। প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল দিব্যি ঘূর্তির ভাব চলে এল মনে। তিন হপ্তা হাড়ভাঙা খাটুনির পর এবারে টানা বিশ্রাম আর চুটিয়ে আড্ডা দিতে না পারলে ঠিক জমছে না। কালকে ক্লাবে গিয়েছিলাম। আজকে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়। ভাবছি আর ভাবছি। আরে, লেগ্রান্ডের ওখানে গেলেই তো হয়। এতক্ষণ কেন যে মনে পড়েনি ভেবে অবাক হলাম।
লেগ্রাণ্ড, উইলিয়াম লেগ্রাণ্ড, আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রাচীন হিউজেনো বংশে জন্ম ওর। আর প্রাচীন বংশের যা হয়, নামটাই শুধু আছে। তবু চেষ্টা করেছিল সাধ্যমত, কিন্তু ওর ভাগ্যটাই বোধহয় বাঁকা রাস্তায় চলে। বার তিনেক এটা ওটা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিল ও।
দুত্যোর, আমাকে দিয়ে এসব হবে না,বলে একদিন সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে গেল স্বেচ্ছা নির্বাসনে। সুলিভ্যান দ্বীপে। ওখানেই হঠাৎ করে পরিচয় ওর সঙ্গে। প্রচুর পড়াশোনা করেছে। বইপড়া, শিকার, মাছধরা আর সমুদ্রের ধারে ঝিনুক শঙ্খ কুড়ানোর প্রচণ্ড শখ। সারাক্ষণ যেন টগবগ করছে উত্তেজনায়। আর সুলিভ্যান দ্বীপে এর সবকটিই হাতের কাছে। ওর স্বভাবের সাথে খাপ খায়, এমন সেরা জায়গাটিই বেছে নিয়েছে ও।
ঘড়িতে দেখলাম বেলা খুব বেশি হয়নি তবে আমার বাড়িটা পাহাড়ের কাছে বলে অন্ধকার নেমেছে একটু আগেই। তাড়াতাড়ি রওনা হতে পারলে সন্ধ্যার পরপরই পৌছে যাব মাইল রাস্তাই তো। দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম। শেষ মুহূর্তে ওভারকোটটা নেবার কথা স্মরণ হলো বলে মনে মনে পিঠ চাপড়ে দিলাম নিজেরই।
মূল ভূমি থেকে দ্বীপে যেতে হলে একটা ছোট্ট নদী মত পার হতে হয়। নৌকোয় মাঝ বরাবর আসতেই জোর হাওয়া বইতে শুরু করল। ঠাণ্ডায় হাড়-মজ্জা পর্যন্ত জমে যাবার দশা হলো আমার। সন্দেহ হলো, গায়ে কিছু আছে কিনা। শেষ পর্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল ঠাণ্ডা। বললাম, দাঁড়াও বাবা ঠাণ্ডা, আমার সঙ্গে চালাকি কী করে তোমাকে শায়েস্তা করতে হয়, জানা আছে আমার।
ধীরে সুস্থে কালকে ক্লাবে দেখা নীলনয়না সুন্দরীর মুখখানা মনে পড়ে গেল। ঠাণ্ডাটা একটু যেন কমে গেল মনে হলো। বেশ উৎসাহ পেলাম। ঠাণ্ডার ওঠা নামার সঙ্গে আমার মনঃসংযোগের জায়গাটিও ওঠানামা করতে লাগল। চমক ভাঙতেই দেখি দিব্যি গরম শরীরে। পৌছে গেছি দ্বীপে।
দ্বীপটির চরিত্র লেগ্রাণ্ডের মতই অদ্ভুত। ছিটেফোটা মাটির দেখা মেলে মাঝেমধ্যে, বাকিটা বালিতে বোঝাই। পুরো দ্বীপটা তিন মাইল মত লম্বা হলেও চওড়ায় একটানা আধা মাইলের বেশি নয় কোথাও। সারা দ্বীপ জুড়ে অসংখ্য খাড়ি। নলখাগড়া আর ঝোপঝাড়ে ঠাসা। শিকারের জন্যে এর চেয়ে ভাল জায়গা আর হয় না। দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে পিপড়ে খাওয়া মিষ্টির মত ঝরঝরে টা পুরানো বাড়ি আর পাম গাছের সারি। পশ্চিম প্রান্ত আর বালি ভরা সমুদ্র তীর ছাড়া বাকিটুকু মার্টল-এর ঘন ঝোপে ঢাকা। পুব প্রান্তটাই মূল ভূমি থেকে সবচেয়ে দূরে। আর এখানেই আস্তানা গেড়েছে লেগ্রাণ্ড।
দ্বীপের উত্তরে একটা পাহাড় দেখেছি। ওর ওপাশে যাওয়া হয়নি এখনও। মার্টলের বনের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ। সেই পথ ধরে লেগ্রান্তে কুটিরে যখন পৌছালাম অন্ধকার যেন তখনি ঝপ করে খসে পড়ল আকাশ থেকে। দরজায় তালা দেওয়া দেখে বুঝলাম বাইরে কোথাও গেছে ও। চাবি কোথায় লুকানো থাকে জানাই ছিল, দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানোই ছিল। চেয়ারটা যতটা পারি কাছে নিয়ে বসলাম। হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে মনে হলো বুঝি স্বর্গে পৌছে গেছি। একটু ধাতস্থ হয়ে চারপাশে দৃষ্টি ফেরালাম। মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে ঝিনুক আর শঙ্খের স্তূপ। ওপাশে দেয়াল ভর্তি বই। এক কোণে অগোছালো বিছানা, পাশে আধখোলা বাক্স প্যাটরা। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর গোটা দুয়েক চেয়ার
চারপাশে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতেই কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। একটু পরেই ঘরে ঢুকল লেগ্রাণ্ড, সঙ্গে জুপিটার।
কাহার মুখ দেখিয়া আজি উঠি সকাল বেলা, উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে এল লেগ্রাণ্ড, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল আমাকে। কতক্ষণ হলো এসেছ?’
এই তো, একটু আগে। তারপর, ভাল আছ তো? তোমার কী খবর, জুপ?
ভাল, স্যার,’একগাল হেসে শিকার করে আনা বনমোরগগুলোর ব্যবস্থা করতে বসে গেল জুপিটার।
জুপিটার হলো লেগ্রাণ্ডের কম্বাইন্ড হ্যাণ্ড বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সব করছে লেগ্রাণ্ডের জন্যে।ব্যাটা ছিল ক্রীতদাস, প্রথমবার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বলেছিল লেগ্রাণ্ড। একদিন দিলাম মুক্ত করে। তা আমি ছাড়লেও কমলি ছোড়তা নেহি। তাই কী আর করি, টেনে বেড়াচ্ছি।
ক্রীতদাস ছিল, এখন তা হলে বি-কৃতদাস, কী বলো?’ হেসেছিলাম আমি।
শুনে লেগ্রাণ্ডও এমন ঘর কাঁপানো হাসি দিয়েছিল যে ছাদ থেকে মোটাসোটা একটা টিকটিকি থপ্ করে মেঝের ওপর পড়ে লেজটা খুলে রেখে পালিয়েছিল। এখন এমন হাসি দিলেই চট করে ছাদের দিকে দেখে নিই একবার।
দেখো, কেমন চমৎকার সব ঝিনুক পেয়েছি আজকে, খুশিতে শিশুর মত উচ্ছল হয়ে দেখাতে লাগল লেগ্রাণ্ড। আর জানো, এমন দারুণ একখানা পোকা পেয়েছি না যে, কী বলব। জীবনে দেখোনি এমন পোকা। কালকে দেখাব।
মনে মনে বললাম, তোমার মাথার পোকাটা কবে দেখতে পাব? ওটা বেরোবে কবে? মুখে বললাম, আবার কালকে কেন, এখনই দেখাও না।।
কাছে থাকলে তো দেখাব। রাস্তায় আসতে আসতে লেফটেন্যান্ট জিরাফের সঙ্গে দেখা। পোকাটা...'
লেফটেন্যান্ট জিরাফটা আবার কে?’ থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আরে, ওই যে লম্বু, লেফটেন্যান্ট জি। পোকাটা দেখে তো অবাক, বাড়িতে লোকদের দেখাতে চাইলেন। তাই তো আজকের জন্যে তার কাছে রেখে এলাম। তা তুমিও যে এমন হঠাৎ করে আসবে, কে জানত!’
ঠিক আছে, আরেক দিন দেখা যাবে, এই প্রসঙ্গ থেকে ফেরাতে চাইলাম ওকে, কিন্তু কীসের কী!
আরেক দিন না, কালকেই দেখাব তোমাকে। ওটা গুবরে পোকার জাত, ডাগরডাগর চেহারা, ঠিক যেন একটা আখরোট কী গায়ের রং, আহা! একেবারে কাঁচা সোনা পিঠের ওপর এক ধারে ঠিক পাশাপাশি দুটো কালো কুচকুচে ফুটকি, অন্য ধারে লম্বা কালো বর্ডার।
পাকা সোনার তৈরি, স্যার, আর ভারি কী! ঠিক যেন একটা সোনার চাকতি। জীবনে কোনওদিন এত বড় পোকা দেখিনি,’ একটু ফাক পেতেই এতক্ষণ চেপে রাখা উচ্ছ্বাসটুকু প্রকাশ করল জুপিটার।।
পোক বাদ দিয়ে রান্নার দিকে নজর দাও, চাঁদ, পুড়ে গেলে তোমাকে গরম তেলে ভাজব আজকে।পুরোনো কথার খেই ধরে আবার শুরু করল লেগ্রাণ্ড।তা একেবারে মিথ্যা বলেনি কিছু, পোকাটা দেখলেই বুঝবে। সারা গায়ে চাকা চাকা আঁশ। ঝকঝক করছে সোনার মত। দাঁড়াও, তোমাকে ছবি এঁকেই দেখাই। উঠে গিয়ে কাগজের খোঁজে এদিক ওদিক জিনিসপত্র উল্টানো শুরু করল লেগ্রাণ্ড।
বুঝলাম পাগল ক্ষেপেছে। কোথায় ভেবেছিলাম জমিয়ে গল্প করব অনেকক্ষণ, সেই সাথে দুএক গ্লাস সাবড়ে দেব, তা না, পোকাই খেলো সব। তাকিয়ে দেখি টেবিলের ড্রয়ার শেষ করে বিছানা ওলটপালট করা শুরু করে দিয়েছে লেগ্রাণ্ড। আঁকার মত কোনও কাগজ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পকেট হাতড়াতে শুরু করল।আহ, পাওয়া গেল মনে হয় একটা।কোটের নীচের পকেট থেকে ময়লা একটা চিরকুট বেরোলো। এতেই চলবে, বলে কলম টেনে নিয়ে আঁকতে শুরু করল।
এই নাও,’ আঁকা শেষ করে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল লেগ্রাণ্ড হুবহু প্রায় এরকমই দেখতে পোকাটা।
ঝুঁকে পড়ে কাগজটা নিলাম ওর হাত থেকে, দেখতে যাব এমন সময় আস্তে করে দরজাটা খুলে গেল, দেখি দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কালো একটা কুকুর। জার্ডিন, লেগ্রাণ্ডের আরেক সঙ্গী ওটা। আমার দিকে চোখ পড়তেই ছুটে এল, লাফ, দিয়ে কাঁধের ওপর দুপা তুলে গালটাল চেটে একেবারে একশা করে ফেলল। গলায় হাত বুলিয়ে আদর করে কোনওরকমে শান্তু করলাম ওকে। গালটা মুছে নিয়ে চোখ ফেরালাম কাগজটার দিকে। ভাল করে দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর লেগ্রাণ্ডের দিকে ফিরে বললাম, সত্যি দারুণ একখানা পোকা বটে, জীবনে দেখিনি কোনওদিন, দেখব বলে আশাও করি না। এটা পোকা না মড়ার মাথার খুলি?’
বলো কী? দেখি দেখি,’ বলে আমার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল কাগজটা।তা প্রায় ঠিকই বলেছ, ওপরের কালো ফুটকি দুটো চোখের গর্তের মত আর নীচের লম্বা দাগটুকু মুখের মত, সব মিলে মড়ার মাথার খুলির মতই লাগছে বটে। 
সম্ভবত তোমার আঁকার গুণেই পোকাটার চেহারার এই পঞ্চত্ত্ব প্রাপ্তি (মৃত্যু) ঘটেছে,’ খোঁচা দেয়ার এই সুযোগটা ছাড়লাম না।
ঠিকই এঁকেছি,’ একটু ঝাঝের সঙ্গে বলল লেগ্রাণ্ড।ওরকমই চেহারা পোকাটার।
তা হলে বরং কোনও পোকাবিশারদকে খবর দাও। জীবনে কোনওদিন এমন পোকা দেখা তো দূরের কথা, নামও শোনেনি নিশ্চয়,’ আমি ওকে আরেকটু রাগিয়ে দেবার জন্যে বললাম।
ভাল কথা, তোমার পোকার পাখনা কই?’
তোমার চোখে কী ঠুলি লাগানো? পাখনা যে পোকার সাথেই, চোখে পড়ছে না?’
কই দেখি,' বলে কাগজটা নিলাম ওর কাছ থেকে, উল্টেপাল্টে দেখে বললাম, ‘কী জানি, আমাকে দেখে পোকাটা বোধহয় লজ্জা পেয়ে পাখনা লুকিয়েছে, দেখ তোমাকে দেখে লজ্জা ভাঙে কিনা।
বুঝতে পারছি ওর মেজাজ এখন সপ্তমে। কাগজটা আমার হাত থেকে একটানে কেড়ে নিয়ে ফায়ারপ্লেসের মধ্যে ফেলে দিতে যেয়ে কী মনে করে আঁকা ছবিটার দিকে একবার তাকাল ও। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ওর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে বাতিটা তুলে নিয়ে কোণের দিকে চলে গেল। একটা বাক্সের ওপর বসে বাতির সামনে কাগজটা ধরে উল্টেপাল্টে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে একটা বাক্স খুলে কাগজটা তার মধ্যে রেখে বাক্সটায় তালা লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটু পায়চারি করল, তারপর এসে বসল আগের চেয়ারটায়। চেহারা দেখে বুঝলাম রাগটা নেই বটে, কিন্তু আর জগতে নেই।
জানো, সেদিন এক মজার ব্যাপার ঘটেছে,’ ওকে অন্যদিকে ফেরাবার জন্যে শুরু করলাম।আমাদের...’ তাকিয়ে দেখি একদৃষ্টে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে ও। বললাম, ‘শুনছ নাকি? জানতে চাইছি, আমার কথা তুমি শুনছ?’ 
হাল ছেড়ে দিলাম এরপর। এখন ওকে ফেরানো আমার কর্ম নয়। রাতের খাবার সময়েও কোনও কথা বলল না ও। এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়, উঠে পড়লাম আমি, চলি তা হলে। ভেবেছিলাম থাকতে বলবে, আর আমারও এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে আবার নমাইল রাস্তা ঠ্যাঙাতে ইচ্ছে করছিল না; কিন্তু তেমন কিছুই বলল না ও।
আবার এসো,’ কথাটা অবশ্য খুব আন্তরিক ভাবেই বলল। বাইরে বেরোতেই হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল ঠাণ্ডা
প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে এরপর। লেগ্রাণ্ডের আর কোনও খোজ পাইনি। নানা ঝামেলায় আমারও সময় করে ওঠা হয়নি। একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই দেখি জুপিটার বসে আছে বারান্দায়, মুখ শুকননা, চুল উস্কোখুস্কো। ধক করে উঠল বুকের ভিতর। লেগ্রাণ্ডের কিছু হলো না তো?
কী খবর জুপ, লেগ্রাণ্ড কেমন আছে?’
ভাল নেই, স্যার 
কী হয়েছে?’ কখন যে জুপিটারের কাঁধ ধরে ঝাকুনি লাগিয়েছি খেয়ালই করিনি।
কী হয়েছে জানলে তো আর চিন্তা করতাম না, স্যার বুঝতেই পারছি না কী হলো। 
একেবারে বিছানায় পড়ে গেছে, নাকি নড়াচড়া করতে পারে?’
বিছানায় পড়ে থাকলে তো বেঁচেই যেতাম, স্যার। দিন রাত শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, কোথায় সে যায় তাও জানি না। 
বুকের মধ্যে থেকে একটা ভার যেন নেমে গেল। যাক, সুস্থ আছে। সেই সাথে একটু দুশ্চিন্তাও হলো। মাথায় কী ঢুকল ওর যে এই ভাবে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে! জুপিটারকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চোখে চোখে রাখতে পারো না?
চেষ্টা তো স্যার সবসময়ই করি, পারি কই। গত রাতে তো সারাক্ষণ পাহারা দিয়েই রেখেছিলাম, সকালের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছে, সেই ফাকে উনি সটকে পড়েছেন। আমি আর কী করি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম যা হয়, হবে, আজকে একটা এসপার-ওসপার করে ছাড়ব। মোটা একটা লাঠি তৈরি করে বসে থাকলাম বাইরে। আজ ফিরলেই ঠ্যাং ভেঙে দেব, পড়ে থাকুন ঘরে, তাও তো চোখের সামনে থাকবেন। কিন্তু যখন ফিরলেন উনি, কী বলব স্যার, মুখের দিকে তাকানো যায় না। ময়লা, ঘামে মুখ ভর্তি, জামাকাপড় ছেঁড়া, একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছেন, না ধরলে পড়ে যাবেন মনে হলো। লাঠি ফেলে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। এরপর কী আর লাঠিপেটা করা যায়, স্যার?’
বলো কী জুপ, মনিবকে ঠ্যাঙাবে?’
কী করব স্যার, আপনিই বলেন। 
জুপিটারের করুণ চোখ দেখে মায়াই হলো ওর ওপর। ঠিক আছে, আর ঠ্যাঙাতে হবে না।আচ্ছা, সেদিন তো ওকে ভালই দেখলাম। এর মধ্যে এমন কী হলো যে এরকম হয়ে গেল?’
হয়েছে স্যার, আগেই। অবাক হলাম আমি। বলল কী? কীভাবে হলো?’
আসলে, স্যার, যত নষ্টের গোড়া ওই সোনাপোকাটাই। 
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সোনাপোকা? সেটা আবার কী?’  
জুপিটার চোখ কপালে তুলে বলল, ‘সে-কী, স্যার। এরই মধ্যে ভুলে গেলেন? সেদিন সেই সোনাপোকার ছবি আঁকা নিয়েই না কত কাণ্ড। 
চট করে মনে পড়ে গেল সব। আসলে পোকাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা পোকাটা কী করল?’
পোকাটাই যত নষ্টের গোড়া, স্যার আস্ত শয়তান একটা দেখেননি তো স্যার, দেখলে বুঝতেন। সারাক্ষণ তিড়িং তিড়িং করে লাফায় আর সামনে যা পায় তাতেই কামড় বসায়। প্রথমবার ধরার সময় ওটা স্যারের হাতে কামড় দিয়েছিল। আমার মনে হয়, স্যার, কুকুর কামড়ালে পেটে যেমন বাচ্চা হয়, পোকার কামড়ে স্যারের মাথার মধ্যেও তেমনি সোনাপোকার বাচ্চা হয়েছে অনেকগুলো। তাই খালি সোনার চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই মাথার মধ্যে। স্বপ্নে পর্যন্ত সোনা-সোনা করে চেঁচিয়ে ওঠে।
বলো কী?’ জুপিটারের কথায় দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল আমার। শেষ পর্যন্ত সোনার চিন্তায় লেগ্রাণ্ড পাগল হয়ে গেল নাকি? মনে মনে একটা হিসাব করে ফেললাম। সুলিভ্যান দ্বীপে যাতায়াতের খরচ, সাথে মাসখানেক কোনও মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকার খরচ। তিনেক ডলারে হয়ে যাবে বোধহয়। খরচ যোগাতে আমাকে অবশ্য একটু বেশি লিখতে হবে। কুছ পরোয়া নেই, তবু যদি লেগ্রাণ্ড ভাল হয়। জিজ্ঞেস করলাম; আচ্ছা, তুমি কী নিজেই বুদ্ধি করে আমার কাছে এসেছ, নাকি পাঠিয়েছে?
জ্বী না, স্যার, উনিই পাঠিয়েছেন। এই চিঠিটা দিয়েছেন আপনাকে দেবার জন্যে।
সে কথা এতক্ষণে বলছ বোকাচন্দ্র, ছিনিয়ে নিলাম চিঠিটা ওর কাছ থেকে। কোনও রকম সম্বোধন ছাড়াই লিখেছে ও। 
অনেকদিন হলো তোমার সাথে দেখা নেই। সেদিনের ব্যাপারে আমাকে ভুল বুঝলে কষ্ট পাব খুব। সেদিনের পর থেকে যে দুশ্চিন্তায় আছি, তোমাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনে। কিন্তু কীভাবে বলব সেটাই ভেবে পাচ্ছিনে। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না ইদানীং। তারপর আবার জুপের সেবা যত্নের অত্যাচারে মারা যাচ্ছি। সেদিন ওকে না জানিয়ে পাহাড়ে গেছি একটু শান্তিতে দিনটা কাটাব বলে। ফিরে দেখি লাঠি হাতে ব্যাটা বসে রয়েছে আমাকে ঠ্যাঙাবে বলে। বলো তো কী কাণ্ড। ক্লান্ত না থাকলে নিশ্চয়ই ঠ্যাঙাত সেদিন।
যাকগে, নতুন কিছু জোগাড় হয়নি আর। সম্ভব হলে আজই জুপের সাথে চলে আসবে। আজ রাতেই তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার আমার। মনে রেখো, অত্যন্ত দরকার বলেই তোমাকে ডেকেছি। আজ রাতেই আসা চাই।
তোমারই,
লেগ্রাণ্ড।

চিঠিটা পড়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। কখনোই এমন ভাবে চিঠি লেখে না। নিশ্চয়ই কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। কোন্ উদ্ভট খেয়ালে ক্ষেপে উঠল ? জুপিটারকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতর থেকে পোশাক পাল্টে এলাম। বললাম, চলো।
নদীর ধারে পৌছে দেখি নৌকা নিয়ে এসেছে জুপিটার। নৌকার মধ্যে রয়েছে কাস্তে, দুটো কোদাল আর একটা শাবল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এসব কেন, জুপ?
আমি কী জানি, সব স্যারের হুকুম। নিশ্চয়ই মাথার ভিতর থেকে ওই পোকার বাচ্চাগুলো পরামর্শ দিয়েছে।
বুঝলাম দুজনের মাথাতেই ওই পোকা ছাড়া আর কিছু নেই এখন।
নৌকা থেকে নেমে দুমাইল পায়ে চলা পথ। লেগ্রাণ্ডের কুটিরে যখন পৌছলাম তখন তিনটে বেজে গেছে। দূর থেকে আমাকে দেখেই ছুটে এল ও। কিন্তু কাছে এসে কেমন উত্তেজিত আর একটু ইতস্তত ভাবে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল। মনটা খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলাম ওর ফ্যাকাসে মুখ আর কোটরে বসা চোখ। অস্বাভাবিক এক উজ্জ্বলতা যেন চোখে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছ। 
ভাল। 
ভিতরে গিয়ে বসলাম আমরা। জুপিটারকে কফির জল চড়াতে বলল লেগ্রাণ্ড। জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, সেই পোকাটা ফেরত এনেছ?
লালচে হয়ে উঠল লেগ্রাণ্ডের মুখ।
- হ্যা, হ্যা, পরদিনই এনেছি। তারপর প্রায় আপন মনেই বলতে লাগল, জুপের কথাই ঠিক, খাটি সোনার তৈরি পোকা ওটা। কিছুতেই হাতছাড়া করছিনে ওকে। ওর দৌলতেই এবার আমি আমার সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধার করব। সোনার খবর এনেছে পোকাটা। এবারে শুধু মাথা খেলিয়ে সোনাটা আনতে হবে হাতে। তারপর আমাকে পায় কে। আমি তখন রাজা। হাঃ হাঃ...

No comments:

Post a Comment

Popular Posts