আ পিস অফ স্টেক - জ্যাক লন্ডন - বাংলা অনুবাদ - A Piece of Steak - Jack London - Bengali Translation |
আ পিস অফ স্টেক - জ্যাক লন্ডন - বাংলা অনুবাদ - A Piece of Steak - Jack London - Bengali Translation - Part - 2 of 2
প্রথম রাউণ্ডটা পুরোপুরিই স্যান্ডেলের।
প্রত্যেকটা ঘুসির সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে উঠল দর্শক। পক্ষান্তরে একটা আঘাতও হানল না
কিং। ব্লক করল, ঘুসি এড়াল মাথা নামিয়ে, কখনও শাস্তির
হাত থেকে অন্তত কিছুটা রেহাই পাবার জন্যে জড়িয়ে ধরল স্যাণ্ডেলকে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড
পাঞ্চে বোঁ করে উঠল মাথা, কিন্তু সামলে নিয়েই খুব ধীরে সরে গেল
সে, অযথা লাফিয়ে উঠে নষ্ট করল না বাড়তি এক তোলা কর্মক্ষমতা।
তার চুল দুলু চোখজোড়া দেখলে মনে হয়, ওই চোখ বুঝি সমস্ত তীক্ষ্ণতা
হারিয়ে ফেলেছে। আসলে বিশ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞ ওই চোখকে রিংয়ের কোনও দৃশ্য ফাঁকি দিতে
পারে না। কোণায় গিয়ে এক মিনিটের বিশ্রাম নিতে বসল টম কিং। পা দুটো সামনে ছড়ানো,
হাঁ করে গিলছে সহকারীদের তোয়ালে দোলানো বাতাস। চোখ বন্ধ, কানে ভেসে আসছে দর্শকদের নানারকম কথা।
-লড়ছ না কেন, টম?
চেঁচিয়ে উঠল কে যেন।
-নিশ্চয় তুমি ভয় পাও না ওকে, নাকি পাও?
-পেশী জমে গেছে, মন্তব্য করল সামনের আসনের এক
দর্শক। দ্রুত নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে ওর। একে দুই, স্যাণ্ডেলের
ওপর-পাউণ্ডে।
ঘণ্টা পড়ল। কোনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দুই
মুষ্টিযোদ্ধা। তিন চতুর্থাংশ দূরত্ব অতিক্রম করে ছুটে এল কৌতূহলী স্যাণ্ডেল। কিং কিন্তু
প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক ধাপও যেতে চায় না। প্রস্তুতি সুবিধে হয়নি তার, ভাল
খাবারও পড়েনি পেটে, প্রতিটা পদক্ষেপই তাই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া,
লড়াইয়ের আগে সে হেঁটে এসেছে দু’মাইল। প্রথম
রাউণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি হলো দ্বিতীয় রাউণ্ডে। ঝড়ের বেগে আক্রমণ চালাল স্যাণ্ডেল। বিরক্ত
দর্শকেরা বারবার জানতে চাইল, কিং কেন লড়ছে না। ধীরে দু’একটা ঘুসি চালানো
ছাড়া ব্লক, আঘাত এড়ানো আর জড়িয়ে ধরা নিয়েই ব্যস্ত রইল সে। গতি বাড়াতে
চাইল স্যান্ডেল, কিন্তু সে সুযোগ কিং তাকে দিল না। স্যাণ্ডেলের
প্রত্যেকটা আক্রমণের ওপর কিংয়ের রয়েছে তীক্ষ্ণ নজর। বেশির ভাগ সাধারণ দর্শকের মনে
হলো, স্যান্ডেলের সাথে কিংয়ের কোনওরকম তুলনাই চলে না। এক পাউণ্ডে
তিন পাউণ্ড বাজি ধরতে লাগল তারা স্যান্ডেলের ওপর। তবে জাত কিছু দর্শক, যদিও তাদের সংখ্যা খুব কম, টম কিংকে বেশ ভাল করেই চেনে।।
তৃতীয় রাউণ্ড শুরু হলো গতানুগতিক ভাবেই।
একতরফা ঘুসি চালাতে লাগল স্যাণ্ডেল। কেটে গেল আধ মিনিট। অতি আত্মবিশ্বাসী স্যান্ডেলের
মুখের ওপর থেকে গার্ড সরে গেল মুহূর্তের জন্যে। ঝলসে উঠল কিংয়ের ডান হাত। হুক-বাঁকানো
বাহু, তার সাথে যোগ হলো আধ পাক খাওয়া দেহের সম্পূর্ণ ওজন। দড়াম
করে চোয়ালের পাশে গিয়ে পড়ল হুকটা, ঘুমন্ত সিংহ যেন থাবা চালাল
হঠাৎ, বলদের মত মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল স্যাণ্ডেল। ঢোক গিলল দর্শক,
প্রশংসার একটা গুঞ্জন উঠল। পেশি মোটেই জমে যায়নি লোকটার, বরং তার হাতে রয়েছে হাতুড়ির সমান আঘাত হানার ক্ষমতা।
উপুড় হয়ে উঠার চেষ্টা করল স্যাণ্ডেল।
কিন্তু চিৎকার দিয়ে নিষেধ করল সহকারীরা, বিশ্রাম নিতে বলল যথাসম্ভব।
এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে চুপ করে রইল স্যাণ্ডেল, ওদিকে কানের কাছে
জোরে জোরে গুণে চলেছে রেফারি। নয় গুণতেই লাফিয়ে উঠল সে, লড়ার
জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে মনে আপসোস করল টম কিং, ঘুসিটা যদি চোয়ালের গোড়ার দিকে আর একটা ইঞ্চি সরে পড়ত! তা হলে ওটা হত একটা নকআউট, তিরিশ পাউণ্ড নিয়ে টম কিং
রওনা দিতে পারত বাড়ির উদ্দেশে।
গড়িয়ে গড়িয়ে শেষ হলো রাউণ্ডের তিনটি
মিনিট। এই প্রথম প্রতিপক্ষের প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠল স্যাণ্ডেলের মধ্যে।
সহকারীদের হাবভাব দেখে কিং যেই বুঝল যে রাউণ্ড শেষ হয়ে আসছে, চলে
এল সে নিজের কোণায়। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে বসে পড়ল টুলে। কিন্তু কোথায় যাবার জন্যে
প্রায় পুরো রিংটাই অতিক্রম করতে হলো স্যাণ্ডেলকে। ফলে অতি সামান্য হলেও ক্ষয়ে গেল
শক্তি, সেই সাথে ব্যয় হলো মহামূল্যবান একটা মিনিটের কিছু অংশ।
ব্যাপারটা একেবারেই ছোট, কিন্তু ঘোট ছোট ব্যাপার একত্র হয়েই
বিরাট আকার ধারণ করে। প্রত্যেক রাউণ্ডের শুরুতে, খুব ধীরে রওনা
দিল কিং, যাতে প্রতিপক্ষকে অতিক্রম করতে হয় অধিকতর দূরত্ব,
আবার রাউণ্ড শেষ করল নিজের কোণায়, যাতে এক মুহূর্তও
নষ্ট না করে বসে পড়তে পারে। পার হয়ে গেল আরও দুটো রাউণ্ড। যথারীতি ঝোড়ো আক্রমণ বজায়
রাখল স্যান্ডেল, কিং রইল সতর্ক বরাবরের মতই। তবে স্যান্ডেলের
গতি বাড়ানোর চেষ্টা একবার ঝামেলায় ফেলে দিল কিংকে, তাকে লক্ষ্য
করে ছোড়া অজস্র ঘুসির বেশ কয়েকটা আঘাত হানল জায়গামত। আরও সতর্ক হয়ে গেল কিং,
ওদিকে আক্রমণ তীব্রতর করার জন্যে তার নাম ধরে চেঁচাচ্ছে মাথাগরম দর্শকের
দল। যষ্ঠ রাউণ্ডে আবার সামান্য একটা ভুল করল স্যাণ্ডেল, বিদ্যুৎ
বেগে ছুটে গেল কিংয়ের ডান হাত। আবার পড়ল স্যাণ্ডেল, উঠল নয়
গুণতে গুণতে।
সপ্তম রাউণ্ডে আক্রমণের সেই ধার আর রইল
না স্যান্ডেলের। বুঝতে পারল সে, এ যাবৎ লড়া প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে টম
কিংই সবচেয়ে শক্ত। এর আগেও আরও অনেক বুড়োর বিপক্ষে লড়েছে সে, কিন্তু এই বুড়োর বুদ্ধি কোনও কিছুতেই গুলিয়ে যায় না।
প্রতিরোধে সে যেমন দক্ষ, তেমনি
আঘাত করার বেলায়। বুড়োর উভয় হাতেই রয়েছে নকআউটের মার। তবু কি তাড়াহুড়ো করল না টম
কিং। ক্ষতবিক্ষত গাঁটগুলোর কথা ভোলেনি সে। শেষ রাউণ্ড পর্যন্ত টিকতে চাইলে ওগুলোর কথা
মনে রাখতেই হবে। কোণায় বসে অপর কোণায় বসা প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা
চিন্তা দোলা দিল টম কিংয়ের মনে। তার মেধা এবং স্যাণ্ডেলের তারুণ্য এক করলে তৈরি হতে
পারে একজন বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু যত গোল রয়েছে ওই এক করায়। স্যাঞ্জেল
কখনোই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না। মেধায় কমতি আছে তার। সুতরাং মেধা কিনতে হবে
তাকে তারুণ্যের মূলে; ফলে মেধা যখন তার হবে, ফুরিয়ে যাবে। ততদিনে তারুণ্যের সঞ্চয়।
বিন্দুমাত্র সুযোগও ছাড়ল না কিং। জড়িয়ে
ধরতে একবারও ভুল হলো না তার। আর ওই অবস্থাতেই আঘাত হানল কাঁধ দিয়ে, পাঞ্চের
চেয়ে কোনওমতেই যা কম কার্যকর নয়। জড়িয়ে ধরলে বিশ্রামও মেলে, কিন্তু অস্থির হয়ে ওঠে স্যান্ডেল। বিশ্রাম শব্দটা তার অভিধানে নেই। কিং যখন
কাঁধ দিয়ে আঘাত হানল তার পাঁজরে, নিজের পিঠের পিছনে হাত ঘুরিয়ে
ঘুসি মারল সে কিংয়ের মুখে। চিৎকার ছাড়ল উত্তেজিত দর্শক। মারটায় চালাকি আছে কিন্তু
ভয়ঙ্করত্ব নেই। আর অযথা ঘুসি চালানো শক্তি ক্ষয়েরই নামান্তর। শক্তির এই অপব্যয় ক্লান্তি
ডেকে আনে। কিন্তু ক্লান্তি কী জিনিস, স্যাণ্ডেল বুঝি তা জানে
না।
ঘুসির বন্যা বইয়ে দিল স্যান্ডেল। দর্শক ভাবে পিটুনি খেয়ে মরতে চলেছে টম। কিন্তু অভিজ্ঞরা ঠিকই
লক্ষ্য করল, প্রত্যেকটা ঘুসি আছড়ে পড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কিংয়ের বাম-হাতি গ্লাভস ছুঁয়ে যাচ্ছে স্যাণ্ডেলের বাইসেপস্। অত্যন্ত চতুর এই স্পর্শ আঘাতের
পরিমাণ অর্ধেক করে দেয়। নবম রাউণ্ডে এক মিনিটেই তিনটে হুক কষাল কিং। তিনবারই পাটাতনে
আছড়ে পড়ল স্যাণ্ডেল, তিনবারই উঠল নয় গুণতে গুণতে। গতি সে কিছুটা
হারিয়েছে সত্যি, কিন্তু শক্তি বুঝি এতটুকু হারায়নি। তারুণ্যই
স্যাণ্ডেলের প্রধান সম্পদ, কিংয়ের যেখানে অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা
জানে, তরুণকে কীভাবে প্রলুব্ধ করতে হয়। বারবার হাত, পা ব্যবহার করে স্যাণ্ডেলকে পেছনে লাফিয়ে পড়তে বাধ্য করল কিং। সে বিশ্রাম
নিল ঠিকই, কিন্তু স্যাণ্ডেলকে সে-সুযোগ
দিল না। এটাই বয়েসের কৌশল।
দশম রাউণ্ডের শুরু থেকেই প্রতিরোধের খোলস
ছেড়ে বেরিয়ে এল কিং। ছুটে আসা স্যাণ্ডেলের মুখে সে চালাতে লাগল স্ট্রেট লেফট। প্রথমে
সেগুলো এড়ানোর চেষ্টা করল স্যাণ্ডেল, তারপর পাল্টা জবাব দিতে লাগল
হুকের সাহায্যে। হুকগুলো কার্যকর নয়, বেশির ভাগই পড়তে লাগল
মাথার ওপরের দিকে। হঠাৎ একটা হুক জায়গামত পড়ল, ধীরে ধীরে যেন
চোখের সামনে নেমে এল কালো একটা পর্দা, দর্শকেরা উধাও। তারপর কানে
আবার ভেসে। এল কলরব, একজন দুজন করে ফিরে এল সমস্ত দর্শক। জ্ঞান
হারিয়েছিল সে, কিন্তু তা এতই অল্প সময়ের জন্যে যে, সবাই দেখল হাঁটু ভাঁজ হয়েই আবার সোজা হয়ে গেল কিংয়ের। চিবুকটা সে আরও নামিয়ে
দিল বাম কাঁধের আড়ালে।
বেশ কয়েকটা হুক লাগাল স্যাণ্ডেল। সামলে
নিল কিং কোনও মতে। তারপর আধ ধাপ পিছিয়ে এল সে, সর্বশক্তি দিয়ে ঝাড়ল একটা
ডানহাতি আপারকাট। স্যান্ডেলের পুরো শরীর উঠে গেল শূন্যে, মাথা
আর কাঁধ দিয়ে আছড়ে পড়ল ম্যাটের ওপর আরেকবার স্যাণ্ডেলকে শুইয়ে দিল কিং,
তারপর বিরতিহীন ঘুসোতে ঘুমোতে নিয়ে গেল দড়ির ওপর। অনেক চেষ্টা করেও
এক মুহূর্তের দম পেল না স্যাণ্ডেল, অজস্র ঘুসি এসে পড়ছে চোখে,
মুখে, নাকে। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে সারা হল,
চিৎকারে কান পাতা দায়। একটা নকআউট যেন অবশ্যম্ভাবী, পুলিশের একজন ক্যাপ্টেন রিংয়ের পাশে এসে লড়াই বন্ধ করে দিতে বলল। আর ঠিক
তখনই টং করে পড়ল রাউণ্ডের ঘণ্টা। টলতে টলতে নিজের কোণার দিকে এগিয়ে গেল স্যাণ্ডেল।
পুলিশ ক্যাপ্টেনের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, শারীরিক দিক দিয়ে
পুরোপুরি সমর্থ আছে সে। পেছনদিকে দুটো লাফ ছাড়ল স্যাণ্ডেল, সামর্থ্য
প্রমাণ করার জন্যই সম্ভবত। উপায়ান্তর না দেখে হাল ছেড়ে দিল পুলিশ ক্যাপ্টেন।
আপন কোণায় হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল
হতাশ টম কিং। রেফারি লড়াই থামিয়ে দিলেই সিদ্ধান্ত যেত তার পক্ষে। স্যাণ্ডেলের মত
সে গৌরবের জন্যে লড়ছে না, তার লক্ষ্য স্রেফ ওই তিরিশ পাউণ্ড। কিন্তু এক
মিনিটের বিশ্রামেই অনেকটা সামলে নেবে স্যাণ্ডেল।
আধ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। স্যাণ্ডেলের মত
লড়লে সে পনেরো মিনিটও টিকত না। পা দুটো ভারী হয়ে আসছে, রাউণ্ডের
মাঝখানের বিশ্রাম আর কোনও কাজে লাগছে না তার। লড়াইয়ের আগে দু’মাইল হাঁটাটা
মোটেই উচিত হয়নি। আর এক ফালি মাংসের জন্যে সেই নিদারুণ আকুলতা! কসাইদের
ওপর ভীষণ একটা ঘৃণা জন্মালো তার, তুচ্ছ এক ফালি মাংস ব্যাটারা
বাকি দিতে রাজি হয়নি। খুব জোর কয়েক পেন্স মূল্য হবে মাংসের, , যদিও তার কাছে সেটা তিরিশ পাউরে সমতুল্য।
এগারো রাউণ্ডের ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে
ছুটে এল স্যাণ্ডেল, যেন তেজ একটুও কমেনি তার। আসলে পুরো ব্যাপারটাই
ধোকা, এবং কিং তা জানে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে স্যাণ্ডেলকে জড়িয়ে
ধরল সে, ছেড়ে দিল আবার। পিছিয়ে গেল স্যাণ্ডেল, এটাই চাইছিল কিং। বামহাতি ঘুসি চালাল সে, এড়ানোর জন্যে
স্যাণ্ডেল মাথা নামাতেই হুক করল, তারপর আধ ধাপ পিছিয়ে লাগাল
পূর্ণশক্তির আপারকাট। ম্যাটের ওপর ছিটকে পড়ল স্যাণ্ডেল। এবারে উঠতে কিং আর তাকে দম
ফেলার সুযোগ দিল না। নিজে মার খেল, কিন্তু মারল তার দ্বিগুণ।
উন্মাদ হয়ে উঠল হলের সমস্ত দর্শক, যারা
এখন আর স্যান্ডেলের নয়। প্রায় সবাই চিৎকার করছে, এগিয়ে যাও,
টম! ধরো! ধরো ব্যাটাকে!
জিতেই গেছ তুমি, টম! লাগাও
আর কয়েকটা! লড়াই শেষ হতে চলেছে ঝড়ের গতিতে, আর এই ঝড় উপভোগের জন্যেই দর্শক আসে গাঁটের পয়সা খরচ করে।।
আধ ঘণ্টা ধরে যে-শক্তি
কিং জমিয়ে রেখেছিল কৃপণের মত, এবারে সে তা দু’হাতে খরচ করতে
লাগল। যা কিছু করার, তাকে এই রাউণ্ডেই করতে হবে। দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে
শক্তি, নিঃশেষ হবার আগেই ধরাশায়ী করতে হবে প্রতিপক্ষকে। আক্রমণ
চালাতে চালাতেই কিং হাড়ে হাড়ে টের পেল, স্যাণ্ডেলকে নকআউট করা
কী ভয়াবহ রকমের কঠিন। তার রয়েছে অসীম
সহ্যক্ষমতা। এমন যাদের শারীরিক গঠন, তারাই হয় সার্থক মুক্তিযোদ্ধা।
টলমল করতে লাগল স্যাণ্ডেল। ওদিকে খিল ধরতে চাইছে কিংয়ের পায়ে, প্রত্যেকটা আঘাতের সাথে সাথে জ্বালা করে উঠছে ক্ষতবিক্ষত গাঁটগুলো। দুর্বলতা ধীরে ধীরে পেয়ে বসছে তাকে। ঘুসিগুলো জায়গামত এখনও পড়ছে
ঠিকই,
কিন্তু কোনও ওজন যেন আর নেই তাতে, প্রত্যেকটা ঘুসিই
যেন স্রেফ ইচ্ছে শক্তির ফসল। সীসের মত ভারী পা জোড়া নড়তেই চাইছে না আর। ব্যাপারটা
লক্ষ করে স্যাণ্ডেলের সমর্থকেরা হৈ হৈ করে উৎসাহ দিল তাকে।
প্রচণ্ড ইচ্ছে শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে
আবার খানিকটা সচল করে তুলল কিং। চোখের পলকে দুটো ঘুসি চালাল সে-বামহাতি
একটা সোলার প্লেক্সাসের সামান্য ওপরে, তারপর চোয়ালে একটা রাইট
ক্রস। ঘুসি দুটোতে কোনও জোর ছিল না বললেই চপে, তবু পড়ে গিয়ে
কাঁপতে লাগল অতি দুর্বল স্যাণ্ডেল। একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গুণতে লাগল রেফারি।
দশ সেকেণ্ডের মাথায় স্যাণ্ডেল যদি উঠতে না পারে, তা হলে সব শেষ।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে সমস্ত দর্শক। কিং দাড়িয়ে আছে নিজের কোণায়। পা কাঁপছে থরথর
করে, বনবন করে ঘুরছে মাথা, রেফারির গলা
যেন ভেসে আসছে কোন্ সুদূর থেকে। এত আঘাত হজম করে উঠে দাঁড়ানো কোনও মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু তারুণ্যের পক্ষে সম্ভব। স্যাঞ্জেল
উঠল। চার গুণতে উপুড় হলো, দড়ি হাতড়াল অন্ধের মত। সাত গুণতে ভর দিল হাঁটুতে,
মাথা ঝুলে আছে কাঁধের ওপর। নয়! চিৎকার ছাড়ল রেফারি।
লাফিয়ে উঠে অবস্থান নিল স্যাণ্ডেল।
বাম বাহু মুখ ঢেকে আছে, ডান
বাহু পেট। এখন তার ইচ্ছে, সুযোগ পাওয়া মাত্র কিংকে জড়িয়ে ধরে
খানিকটা বিশ্রাম নেয়া। স্যাণ্ডেল ওঠার সাথে সাথে কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিং। কিন্তু যে
দুটো ঘুসি সে চালাল, দুটোই ব্যাহত হলো স্যাণ্ডেলের বাড়িয়ে দেয়া
বাহুতে। পরমুহূর্তেই তাকে জড়িয়ে ধরল স্যাণ্ডেল। দুই মুষ্টিযোদ্ধাকে আলাদা করে দেয়ার
জন্যে ছুটে এল রেফারি। নিজেকে মুক্ত করতে কিংয়ের মাঝে প্রকাশ পেল অস্থিরতা। বিশ্রামের
এই সুযোগ দেয়ার ভয়াবহতা সে জানে। বড় শিগগির নিজেকে সামলে নিতে পারে তরুণ। এখন বিশ্রামের
সুযোগটা নষ্ট করতে পারলেই জয় হবে তার। আর মাত্র একটা কড়া পাঞ্চ-ব্যস। অবশ্য এক দিক দিয়ে ধরলে সন্দেহাতীতভাবে জয়লাভ করেছে কিং। লড়াইয়ের
প্রত্যেকটা বিভাগে সে পরাস্ত করেছে স্যাণ্ডেলকে। কিংকে ছেড়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল স্যাণ্ডেল,
দুলতে লাগল জয়-পরাজয়ের সূক্ষ্ম সুতোর ব্যবধানে।
এখন শক্ত একটা ঘুসিই ওকে নকআউট করার পক্ষে যথেষ্ট। তিক্ততার একটা স্মৃতি ভেসে এলা টম
কিংয়ের মনে। অতি প্রয়োজনীয় এই পাঞ্চটার পেছনে যে জোর থাকা উচিত, সেটা হয়তো সরবরাহ করতে পারত সেই এক ফালি মাংস। ঘুসিটার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি
নিল সে, কয়েক মুহূর্ত পরেই ছুটে গেল সেটা লক্ষ্যবস্তুর দিকে।
টলে গেল স্যাণ্ডেল, কিন্তু পড়ল না। হাহাকার করে উঠল যেন কিংয়ের
অন্তর। আরেকটা ঘুসি চালাল সে। কিন্তু শরীরটা যেন এখন আর তার নয়। চোয়াল লক্ষ্য করে
চালানো ঘুসিটা আঘাত হানল কাঁধে। ঘুসিটা সে জায়গামতই মারতে চেয়েছিল, কিন্তু ক্লান্ত পেশী বর্তমানে তার আদেশ পালনে অসমর্থ। আর ঘুসির ধাক্কায় নিজেই পিছনে ছিটকে এল টম কিং, পতনটা
সামলাল কোনওরকমে। আবার হাত চালাল সে, পুরোপুরিই লক্ষ্যভ্রষ্ট
হলো এবারের পাঞ্চটা। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল দারুণ এক অবসন্নতা। জ্ঞান হারিয়ে পাটাতনে
লুটিয়ে পড়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই যেন স্যাণ্ডেলকে জড়িয়ে ধরল টম কিং।
নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা আর করল না সে।
সম্পূর্ণ শক্তি যেন উবে গেছে। জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই টের পেল, মুহূর্তে
মুহূর্তে শক্তি ফিরে পাচ্ছে স্যাণ্ডেল। দু’জনকে আলাদা করে দিল
রেফারি। আঘাত হানতে লাগল স্যাণ্ডেল। তার দুর্বল, লক্ষ্যভ্রষ্ট পাঞ্চগুলো
ক্রমেই হয়ে উঠল কড়া আর নিখুঁত। ঝাপসা চোখে চোয়ালের উদ্দেশ্যে চালানো ঘুসিটা দেখতে
পেল টম কিং, বাধা দিতে চাইল হাত তুলে। বিপদটা ঠিকই টের পেল সে। ব্যবস্থাও নিতে চাইল যথাযথ, কিন্তু
কেউ যেন তার হাতে ঝুলিয়ে দিয়েছে হাজারখানেক সীসের টুকরো। শরীর যখন কথা শুনল না, হাতটা টেনে তুলতে চাইল সে আত্মার
সাহায্যে। পরমুহূর্তেই চোয়ালের পাশে আছড়ে পড়ল গ্লাভস পরা হাতটা। দপ্ করে একটা আলো
যেন জ্বলে উঠল মাথার ভিতর, তারপরই নেমে এল কালো একটা পর্দা।
চোখ মেলে টম কিং দেখল, শুয়ে
আছে সে নিজের কোণায়। সমুদ্র গর্জনের মত কানে ভেসে আসছে দর্শকদের চিৎকার। ভেজা একটা
স্পঞ্জ চেপে ধরা হয়েছে খুলির গোড়ায়। মুখে আর বুকে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিচ্ছে সিড
সুলিভ্যান। এর মধ্যেই খুলে নেয়া হয়েছে গ্লাভস দুটো, সামনে ঝুকে
তার সাথে হাত মেলাচ্ছে সাণ্ডেল। নকআউট করলেও স্যাণ্ডেলের প্রতি কোনওরকম বিদ্বেষ তার
নেই। শুভেচ্ছা জানাল কিং। এবারে স্যাণ্ডেল গিয়ে দাঁড়াল রিংয়ের মাঝখানে। প্রোন্টোর
চ্যালেঞ্জ শুধু গ্রহণই করল না, বাজির মাত্রা বাড়াতে বলল পঞ্চাশ
থেকে একশো পাউণ্ডে। মুখ আর বুকের পানি মুছিয়ে দিল সহকারীরা, উদাস চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল কিং। হঠাৎ তীব্র একটা খিদেয় মোচড় দিয়ে উঠল
তার পেট। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য-স্যাণ্ডেল দুলছে জয়-পরাজয়ের মাঝখানে। মাত্র এক ফালি মাংস পেলেই প্রয়োজনীয় পাঞ্চটা সে মারতে পারত
আরও খানিকটা জোরে। নকআউট হয়ে
যেত স্যাণ্ডেল। তার জয়ের মূলে রয়েছে সেই এক ফালি মাংস। রিংয়ের দড়ি পার হবার সময়
সাহায্য করতে চাইল সহকারীরা। ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিল কিং, লাফিয়ে
নামল রিং থেকে। ভিড় সরিয়ে পথ করে দিল সহকারীরা। বড় হল পেরিয়ে রাস্তায় নামতে যাবে,
এগিয়ে এল এক তরুণ।
-হাতে পেয়েও স্যাণ্ডেলকে পরাজিত করতে
পারলেন না, কেন? জানতে চাইল সে।
-জাহান্নামে যা! খেঁকিয়ে
উঠল টম কিং।
রাস্তার মোড়ে যেতে হঠাই খুলে গেল পাবলিক
হাউসটার দরজা। হাসিতে ঝলমল করছে বারমেইডদের মুখ। ক্রেতাদের মাঝে জোর আলোচনা চলছে সদ্য সমাপ্ত লড়াইয়ের! কে
যেন প্রস্তাব দিল মদ্যপানের। এক মুহুর্তের
জন্যে দ্বিধায় দুলল টম কিং, তারপর প্রত্যাখ্যান করে এগোল আবার সামনে।
একটা পেনিও এখন আর তার পকেটে নেই, বাড়ির
এই দু’মাইল রাস্তা মনে হচ্ছে বড় বেশি দীর্ঘ। সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে
সে। আরও খানিকটা এগিয়ে হঠাৎ একটা বেঞ্চে বসে পড়ল টম কিং। লড়াইয়ের ফলাফল জানার অপেক্ষায়
বসে আছে স্ত্রী, ভাবতেই ভীষণ একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। সবচেয়ে কঠিন নকআউটও
যেন ওই প্রশ্নের জবাব দেয়ার তুলনায় অনেক সোজা।
দুর্বলতা আর যন্ত্রণা অনুভব করল সে। গাঁটগুলো
যেভাবে ব্যথা করছে, মজুরের কাজ পেলেও অন্তত এক সপ্তাহের মধ্যে কোনও
গাইতি বা বেলচার হাতল ধরা তার পক্ষে অসম্ভব। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল তীক্ষ্ণ একটা
ব্যথা। খাবার চাই-খাবার। চরম দুর্দশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল,
চোখজোড়া ভিজে উঠল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। দু’হাত তুলে মুখ
ঢাকল টম কিং। কাঁদতে কাঁদতে তার মনে পড়ল সেই বুড়ো মুষ্টিযোদ্ধার কথা। বেচারি স্টাউসার
বিল! হাউমাউ করে কেঁদেছিল সে ড্রেসিংরুমে। স্টাউসার বিলের কান্নার পুরো অর্থ টম
কিং উপলব্ধি করল এতদিনে।
মূলঃ জ্যাক লন্ডন রূপান্তর: খসরু
চৌধুরী
No comments:
Post a Comment