মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Tuesday, August 4, 2020

হজরত লোকমান (আঃ) এর উপদেশ

হজরত লোকমান (আঃ) এর উপদেশ

হযরত লোকমানের (আঃ) উপদেশ
আমরা অনেক জ্ঞানীর কথা জানি। জ্ঞানবান বুদ্ধিমান লোকেরা তাঁদের জ্ঞান বুদ্ধির সাহায্যে অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁরা বড় বড় বই লিখেছেন। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার করেছেন। নানা ধরনের মেশিন-কলকব্জা তাঁদের দক্ষতা বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ। বেতার, টেলিভিশন, বিজলী, রেলগাড়ী, উড়োজাহাজ, নৌযান ইত্যাদি তৈরী করে তাঁরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁদের জ্ঞান বুদ্ধিমত্তার কথা অস্বীকার করবে দুনিয়ায় এমন একজন লোকও নেই। কিন্তু যারা বুদ্ধি খাটিয়ে বড় বড় মেশিন তৈরী করেছেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগাবার পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন তারা যদি এই এত বড় বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা, মালিক পরিচালককে চিনতে না পারেন, দুনিয়ায় আকাশে তাঁর কর্মকুশলতা দেখতে না পান, তাহলে তাদের বুদ্ধিকে আমরা কি বলে অভিহিত করবো? তারা কি সত্যি বুদ্ধিকে ঠিক মত ব্যবহার করছেন? তারা এত কথা চিন্তা করেন, এত বড় বড় জিনিস আবিস্কার করেন কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না তাঁরা নিজেরা কোথা থেকে এসেছেন? কেন এসেছেন? বিশ্ব জাহান কে সৃষ্টি করেছেন? তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি?
হযরত লোকমান ছিলেন একজন বুদ্ধিমান জ্ঞানী পুরুষ। আল্লাহ তাঁকে সত্যকে জানার জ্ঞান দিয়েছিলেন। মানুষের মধ্যে সেই বুদ্ধিমান জ্ঞানী যে তার সৃষ্টিকর্তা প্রকৃত মালিক আল্লাহকে চিনতে পারে। হযরত লোকমান তার সৃষ্টিকর্তা মালিক আল্লাহকে চিনতেন। তিনি জানতেন বিশ্ব জগতের সমস্ত জিনিস কে তৈরী করেছেন। কে তিনি যিনি মানুষকে অপার নিয়ামত দান করেছেন। আবার তিনি এই দয়াময় মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তাও জানতেন। হযরত লোকমান ছিলেন বড়ই নেকবখত আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তার কথা বলেছেন। অনেকে তো এমন কথাও বলেছেন যে, হযরত লোকমান ছিলেন আল্লাহর নবী এবং হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের আত্মীয়। আবার অনেকে বলেন, তিনি আল্লাহর নবী নন তবে তার সময়ের অনেক বড় জ্ঞানী, পন্ডিত সৎ লোক। সে যাই হোক তিনি নবী না হলেও ছিলেন তো একজন মস্ত বড় বুদ্ধিমান, জ্ঞানী সৎ লোক।
আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ আমি লোকমানকে দিয়েছিলাম জ্ঞান। উদ্দেশ্য ছিল, এর সাহায্যে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
জ্ঞান আল্লাহর একটি নিয়ামত। নিয়ামতের কতৃজ্ঞতা আদায়ের একটাই পদ্ধতি। যেহেতু নিয়ামত আল্লাহ দান করেছেন তাই এজন্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে তার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, তার নিয়ামত এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে তিনি নারাজ হন। তিনি যে সব নিয়ামত দান করেছেন সেগুলো তার দেয়া নিয়ম অনুযায়ী তাঁর হুকুমমতো এবং তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত আমরা কারোর কোনো দানের বিনিময়ে তার প্রতি কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করি। এতে তার কিছু লাভও হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর নিয়ামতের জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তাতে আমাদেরই লাভ হয়, আল্লাহর কোনো লাভ হয় না। আল্লাহর সত্তা ধরনের কোনো লাভ লোকসানের অনেক উর্ধে। সন্তানও আল্লাহর একটি নিয়ামত। নিয়ামতের জন্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। আর স্বাভাবিকভাবেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পদ্ধতি হবে এই যে, মানুষ তার সন্তানকে এমনভাবে লালন পালন করবে যার ফলে সে বড় হয়ে আল্লাহর একান্ত অনুগত বান্দায় পরিণত হয়। সে হয় একজন সৎ ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। হযরত লোকমানকেও আল্লাহ সন্তান দান করেছিলেন। তিনি নিয়ামতের জন্যে কিভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন কুরআনে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত লোকমান প্রথমেই অত্যন্ত স্নেহ মমতা সহকারে তাঁর ছেলেকে বললেন : হে আমার প্রিয় পুত্র! আমার, তোমার এবং সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা প্রভু যে আল্লাহ তাঁর কোনো শরীক, সাথী সহযোগী নেই। তিনি এক তাঁর মতো বা তার সমান কেউ নেই। তার কোনো পিতা নেই এবং তিনিও কারোর পিতা নন। তিনি এমন সব গুণের অধিকারী যা আর কারোর নেই। যেমন, তিনি প্রকাশ্য গোপন সব কিছু দেখতে পান। এটা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি যেমন সব কিছু শুনতে পান অন্য কারোর সে ক্ষমতা নেই। মনের গোপন চিন্তা, গোপন কথা গোপন অভিসন্ধি একমাত্র তিনিই জানতে পারেন, অন্য কেউ এর কোনো কল্পনাই করতে পারে না। তাঁর অধিকারেও কেউ তাঁর শরীক নেই। মানুষ তাঁর সামনে হাত বেঁধে দাঁড়াবে এবং তাঁর বন্দেগী করবে, এটা তার অধিকার। তার অধিকার হচ্ছে, মানুষ তার হুকুম মেনে চলবে এবং তার কাছে নজরানা মানত পেশ করবে। হুকুম দেয়া দুনিয়ায় মানুষের চলার জন্যে আইন রচনা করা তার অধিকার। এসব অধিকার ভােগ করার মতো তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো সত্তা নেই। ক্ষমতায়ও আল্লাহর সাথে কেউ শরীক নেই। জীবন-মৃত্যু তাঁর হাতে। মানুষের প্রার্থনা, আবেদন-নিবেদন ফরিয়াদ তিনি শোনেন। ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি সব তাঁর আয়ত্বে রয়েছে। তিনিই কাউকে সফলতা দান করেন আবার কাউকে ব্যর্থ করে দেন। ক্ষমতার ছিটেফোঁটাও অন্য কারোর আয়ত্বে নেই। হযরত লোকমান বলেনঃ হে আমার প্রিয় পুত্র। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করাই হচ্ছে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় জুলুম। মানুষের প্রথম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তার নিজের বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তাকে জানতে চিনতে হবে এবং তাঁর হুকুম মেনে চলতে হবে। আল্লাহর হুকুম মানা তাঁর বন্দেগীর পর মানুষের জন্যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাবা-মায়ের অধিকার। আল্লাহর অধিকারের পর মানুষের জন্যে বাবা-মায়ের অধিকারের চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো জিনিস নেই।
কুরআন মজীদে হযরত লোকমানের নসীহতের আলোচনার মাঝখানে আল্লাহ বাবা-মায়ের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন : মানুষকে তার বাপমায়ের অধিকারের প্রতি নজর রাখার জন্যে আমি কঠোরভাবে তাকিদ করেছি। কেমন বিপদ মাথায় নিয়ে তার মা তাকে লালন পালন করেছে। কতদিন পর্যন্ত সে তাকে নিজের পেটের মধ্যে রেখেছে এবং বিপদের পর বিপদের মুখোমুখি হয়ে নির্দিষ্ট সময়কাল পূর্ণ করেছে। তারপর দুবছর পর্যন্ত দুধ পান করিয়েছে।
হযরত লোকমানের নসীহতের মাঝখানে আল্লাহ আরো কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে উপদেশ দেন। তারপর আবার হযরত লোকমানের নসীহত শুরু হয়ে যায়। পর্যায়ে তিনি বলেনঃ হে আমার প্রিয় পুত্র! আল্লাহর জ্ঞান বড়ই সুদূর প্রসারী। যদি কোনো জিনিস হয় সরিষার দানার সমান এবং লুকিয়ে থাকে কোনো কঠিন পাথরের বুকে অথবা সুদূর মহাশূন্যে আকাশের নীলিমায় কোথাও তা উড়ে চলে যায় কিংবা মাটির বুকে কোথাও তাকে প্রোথিত রাখা হয়, তাহলে তা আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে যেতে পারে না। আল্লাহ যখনই চাইবেন তাকে নিজের সামনে হাজির করতে পারবেন। তাঁর জ্ঞান বড়ই ব্যাপক বিস্তৃত। তিনি সব খবর রাখেন, সব কিছু দেখেন, সব কিছু শোনেন এবং সব জিনিস খুব ভালোভাবে জানেন।
আল্লাহর গুণাবলীকে হযরত লোকমান এজন্যে পরিস্কার করে তাঁর ছেলের সামনে তুলে ধরেন যে, এগুলো সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা না থাকলে আল্লাহর মূল সত্তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা সৃষ্টি হবে না। ফলে আল্লাহর প্রতি ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে না।
আল্লাহর গুণাবলীর কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর এবার হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে বলেছেন নামায পড়ার জন্যে। তিনি বলেনঃ হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি নামায কায়েম করো
নামায এমন একটি কাজ যা মানুষকে আল্লাহর পথে প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারে। আল্লাহকে জানা, তাকে চিনে নেয়া এবং তার গুণাবলীর প্রতি ঈমান আনার পর জীবনকে তাঁর হুকুমের ছাঁচে ঢেলে সাজাতে হলে নামায কায়েম করার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী। যদি দুনিয়ায় আখেরাতে সফলকাম হতে হয় তাহলে নামায কায়েম করা ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। নামায কায়েম করা নামায পড়ার মধ্যে একটা পার্থক্য অবশ্যই আছে। নামায কায়েম করা মানে হচ্ছে, নামায পড়ার জন্যে যত রকম নিয়ম কানুন আছে সব ঠিকমত ভালোভাবে মেনে চলা। যেমন পাক-পবিত্রতা, সময়ের প্রতি নজর রাখা, জামায়াতের সাথে নিষ্ঠা, মনোযোগ বিনয় সহকারে নামায পড়া। জেনে বুঝে এমন কোনো কাজ না করা যাতে নামাযে কোনো ত্রুটি দেখা দেয়।
শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তার গুণাবলী মেনে নেয়া এবং নিজের সামর্থ অনুযায়ী ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো মেনে চলাই একজন মুসলমানের জন্যে যথেষ্ট নয়। তাই হযরত লোকমান এসব কথা বলার পর তাঁর ছেলেকে একথাও বলেছেনঃ হে আমার প্রিয় পুত্র! মানুষকে ভালো কাজ করার আদেশ দাও এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখো আসলে দুনিয়ায় মুসলমান হয় আল্লাহর সেনা। দুনিয়ায় আল্লাহর নাফরমানী হতে দেখলে সবার আগে মুসলমান বাধা দেয়ার জন্যে এগিয়ে যায়। মুসলমান কেবল নিজে ভালো হয়ে যাওয়াকে যথেষ্ট মনে করে না বরং অন্যকেও ভালো করা এবং তাকে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করাকেও সে নিজের কর্তব্য মনে করে। এজন্যে শুধুমাত্র উপদেশ অনুরোধ যথেষ্ট হয় না। কারণ যারা আল্লাহর হুকুম মানেনা, তারা নাফরমানী করে এবং অসৎ পথে চলে। তারা দুচার কথায় নিজেদের পথ ছেড়ে ভালো পথে চলে আসতে রাজী হয় না। তারা বাধা দিতে থাকে। ফলে আল্লাহর সৎ মুমিন বান্দাদের জন্যে এটা হয় বেশ কঠিন পরীক্ষার সময়। তাই হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে কঠিন সংকটের মোকাবেলা করার জন্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ হে প্রিয় পুত্র! পথে যেসব বাধা-বিপত্তি আসে, ধৈর্য্যের সাথে তার মোকাবেলা করো এটাই মানুষের করার মতো সবচেয়ে বড় কাজ।
আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে আহবান করার হিম্মত এবং দুঢ়তা ধৈর্য্য সহকারে পথে সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবেলা করার সাথে সাথে আর একটা জিনিসেরও প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে চারিত্রিক মাধুর্য। যে ব্যক্তি কোমল স্বভাবের নয় এবং মানুষের সাথে অমায়িক ব্যবহার করতে পারে না, সে কখনো আল্লাহর দীনের একজন ভালো আহ্বায়ক হতে পারে না। একজন বদমেজাজী অহংকারী কখনো অন্যের মনে নিজের কথা প্রবেশ করাতে পারে না। তাই হযরত লোকমান নিজের ছেলেকে যে শেষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ নসীহতটি করেন সেটা হচ্ছেঃ হে প্রিয় পুত্র! অহংকারের বশে মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলল না। গর্বভরে বুক চিতিয়ে মাটির ওপর চলাফেরা করো না। আল্লাহ অহংকারী নিজেদের যারা বড় মনে করে তাদেরকে মোটেই পছন্দ করেন না। মাটির ওপর দিয়ে যখন চলবে ভালো লোকের মতো চলার মধ্যে সমতা রেখে চলবে। কারোর সাথে কথা বলার সময় অনর্থক চেঁচিয়ে কথা বলবে না বরং কথা বলার ভংগী আওয়াজের মধ্যে সমতা রেখে কথা বলবে। গাধাকে দেখো, কেমন চিৎকার করে। সবাই জানে গাধার চিক্কার সব চেয়ে কর্কশ শ্রুতিকটু। হচ্ছে পুত্রের প্রতি একজন ভালো পিতার নসীহত। এগুলো পালন করে প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়ে যেমন সুসন্তান হতে পারে তেমনি হতে পারে দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক।


No comments:

Post a Comment

Popular Posts