মজার গল্প, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী, ছোট গল্প, শিক্ষামূলক ঘটনা, মজার মজার কৌতুক, অনুবাদ গল্প, বই রিভিউ, বই ডাউনলোড, দুঃসাহসিক অভিযান, অতিপ্রাকৃত ঘটনা, রুপকথা, মিনি গল্প, রহস্য গল্প, লোমহর্ষক গল্প, লোককাহিনী, উপকথা, স্মৃতিকথা, রম্য গল্প, জীবনের গল্প, শিকারের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, অনুপ্রেরণামূলক গল্প, কাহিনী সংক্ষেপ।

Total Pageviews

Tuesday, August 4, 2020

রহস্য গল্প - দক্ষিণে - আলী ইমাম (ছোট গল্প)

রহস্য গল্প - দক্ষিণে - আলী ইমাম

রহস্য গল্প - দক্ষিণে - আলী ইমাম
অসংখ্য পালতে মাদারের গাছে জায়গাটা একেবারে ঠাসা। তাই কেমন ছায়া ছায়া অন্ধকার এখানে। মাটি ভেজা। এখানে আসতে হয় ডিঙি বেয়ে। এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে নদী। মিশেছে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে। কান পাতলে দূরের বঙ্গোপসাগরের কলকল ধ্বনি শোনা যাবে। একদিককার জায়গা সব জলাজংলা। লোকে বলে বাদা অঞ্চল। কাছেই সুন্দরবন। অনেকে বলে দক্ষিণের দেশ। এখানকার মানুষের ঘুম ভাঙে বনমুরগির ডাকে। 
সিধু মৌয়ালির ছেলে নবু। সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় মধুর খোঁজে। সুন্দরবনের গাছে গাছে মেলা মৌচাক। সেখানে অনেক লোক মধু সংগ্রহ করে দিন কাটায়। 
নবুর গলাটা খুব মিঠে। বলে, মধু খাই বেশি করে তাই বুঝি মিঠে। দল বেঁধে মৌয়ালিরা যায় বনে। কাঠুরেদের সঙ্গে। নবুও যায় মাঝে মাঝে। নবুর গলায় একটা মালা। সবুজ তিতিরের পালক দিয়ে বানিয়েছে সে। একবার গহীন বনের ভেতরে সে হঠাৎ করে সবুজ তিতিরটাকে পেয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের তিতির সুন্দবনে সহজে দেখা যায় না। বোধ হয় পথ ভুলে উড়তে উড়তে অন্য এলাকা থেকে চলে এসেছে এই বনে। নবু তখন একটা মৌচাকের নিচে আগুন দিচ্ছিল। কালো ধোয়া পাক খেয়ে উঠছে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল সবুজ তিতিরটা। 
সামনের গাছ থেকে ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল দিল। নবুও খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে। আবছা আলোতে কী সুন্দর দেখাচ্ছে তিতিরটাকে। নবু অনেক কষ্টে পাখিটাকে ধরল। পাখি ধরার ব্যাপারে ওর মতো কৌশলী ছেলে তল্লাটে আর কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই তার পাখি ধরার শখ।। 
সবুজ তিতিরটাকে ধরতে পেরে খুশিতে চকচকিয়ে উঠল নবুর চোখ দুটো। কী সুন্দর পাখি। কেমন ডানা ঝাপটাচ্ছে। পাখিটার নরম বুক নবু চেপে ধরল তার বুকের সঙ্গে। থরথর করে কাঁপছে সবুজ তিতির। এইভাবে কোনো পাখিকে বুকে চেপে ধরতে নবুর কাছে খুব ভালো লাগে। অদ্ভুত রকমের একটা আনন্দ হয় তখন তার। কেমন আনন্দ, সেটা সে কাউকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবে না। সেই সবুজ তিতিরের পালকের মালা গলায় ঝুলিয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় নবু। কেউ কেউ বলে, ও মৌয়ালির পো, একটা গান গাও দিকি। তখন নবু বনের ভেতর কিংবা নদীর পাড়ে গান ধরে। নদী ছলছল করে। বন সুমসাম করে। নবু 
গায়, 
বাদার রানী বনবিবি
মহারাজ্য তার
তাঁর শাসনে বাদারাজ্যে
শান্তি অপার।
গহীন দরিয়ার বদরগাজী
কৃপাবান যিনি ঝড়
তুফানে শিবসা পসর 
পার করে দেন তিনি।

সবাই বলে, মৌয়ালির পো, তোমার গলাডা বড় মিঠা হে। 
নবুকে ওর দাদি খুব বকাঝকা করে। বলে, তুই একদিন বাঘের পেডে যাবি। জঙ্গলের অত ভিতরে যাস ক্যান? 
নবু হাসে। বাতাসে ওর গলার সবুজ তিতিরের পালকের মালাটা দোলে। বলে, আমারে জঙ্গল ডাকে যে। আমি কী করমু? 
শুনে বুড়ি অবাক হয়ে যায়। ভয় পায়। বলে কী ছেলে। জঙ্গল ডাকে। নবু। তখন গান গাইতে গাইতে ডিঙি বেয়ে চলে যায় বনের দিকে। 
একদিন খাড়ি দিয়ে ডিঙি বাইছিল নবু। কাঠুরেরা গাছ কাটছে। একটানা শব্দ হচ্ছে। চারদিকে রোদ। নবু আস্তে আস্তে সামনের দিকে ডিঙি বাইতে লাগল কোন খেয়ালে। জঙ্গলে সবাই দলবেঁধে আসে। এখানে পায়ে পায়ে মৃত্যু। নবু সেসব কিছু ভাবল না। তার মনে হলো গাছগুলো যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গাছের পাতারা যেন ঝিরিঝিরি করে দুলতে দুলতে বলছে, এসো, নবু এসো নবুর একটা নেশার ঘোর লেগে গেল হঠাৎ করে। ওর মনে হলো যেন কেউ ওকে জঙ্গলের ভেতরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কেমন আচ্ছন্নের মতো ডিঙিটাকে বাইতে লাগল সে। কাঠুরেরা কেউ লক্ষ্য করল না সিধু মৌয়ালির গানপাগল ছেলেটা আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছলছল করছে নদী। দু'পাশের বন ক্রমশ গভীর হয়ে আসছে। কত গাছ জড়াজড়ি করে আছে। গাছ লতাপাতার ঠাসবুনোট যেন। পাখি ডাকছে। কাঠুরেদের গাছ কাটার শব্দ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। একসময় থেমে গেল। অনেকটা বাঁক পেরিয়ে নবুর ডিঙি তখন জঙ্গলের গভীরে চলে এসেছে। নবুর চোখে ঘোর লেগেছে তখন। ওর তখন ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছিল, বনবিবি তুমি কই? তুমি আমারে দেখা দিবা? বনবিবি। নবু বনবিবি-বনবিবি বলে চিৎকার করতে লাগল। ওর চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ডিঙি দুলছে। একটা হরিণের ছানা নদীতে পানি খেতে এসেছিল। নবুকে দেখে দৌড়ে পালাল সেটা। নবু একসময় ডিঙিটার ওপর শুয়ে পড়ল। 
নীল আকাশ ঝকঝক করছে। অনেক উঁচুতে কয়েকটা শঙ্খচিল কালো বিন্দুর মতো উড়ছে। নবু সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ডিঙিটা তখন ছলছলিয়ে সামনের দিকে ভেসে যাচ্ছে। 
নবুর ঘুম যখন ভাঙল তখন ভরসন্ধে। আকাশে তারা জ্বলজ্বল করছে। নদীর পাশের ঝোপেঝাড়ে জোনাকির মেলা। সমস্ত বনে অদ্ভুত রকমের শব্দ হচ্ছে। নবু বিস্ময়ে, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল বনের দিকে। ওর মনে তখন একটুও ভয় লাগল না। 
লোকালয় ছেড়ে এত দূরে চলে আসার কথাটাও ভাবল না সে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে কালপুরুষ। নবুর বুড়ি দাদি মাঝে মাঝে কুপিজ্বলা সন্ধেয় কেমন ফ্যাসফ্যাসে ভুতুড়ে গলায় বলত, কালপুরুষ যার উপর একবার ভর করে সে মানুষ ঘরের ভেতরে একেবারেই থাকতে পারে না। সে মানুষ ঘরছাড়া হয়। 
নবু ভাবল রাত্রির এই জঙ্গল কত অদ্ভুত সুন্দর। কিন্তু নবু জানল না, একটা বাঘ সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে আসছে তার দিকে। নবুর বুকে খুশি। নবুর বুকে দুলুনি। সে চেঁচিয়ে বলল, বনবিবি, বনবিবি, আমি তোমার কাছে আইছি। 
জোনাক জ্বলছে ঝোপে। আকাশে কালপুরুষ। নদীতে তার ছায়া। কালপুরুষ কারো উপর ভর করলে নাকি মানুষ ঘরছাড়া হয়। বাঘটা নবুকে লক্ষ্য করে লাফ দিল। মৌয়ালিরা পরদিন নবুকে খুঁজতে এসে খালি ডিঙিতে একটা সবুজ তিতিরের পালকের মালা পেয়েছিল। তাতে রক্তের দাগ। 

No comments:

Post a Comment

Popular Posts