![]() |
রহস্য গল্প - পউষমুখি - আলী ইমাম |
রহস্য গল্প - পউষমুখি - আলী ইমাম
চোখ
দুটো যেন একেবারে রক্তজবার মতো টকটকে লাল। মাথায় আলুথালু চুলের জটাতে রাজ্যির ধুলো
লেপটে আছে। গলায় বুনো লতাপাতার একটা মালা ঝোলানো। কানে আবার কি খুঁজেছে দেখ। মুচুকুন্দ ফুল বুঝি। কেমন ঝকঝকে দাঁত
দেখিয়ে হিঃ হিঃ করে হাসছে উড়নচণ্ডি এই লোকটা। হাতে দেখি ছোট্টমতো একটা বাদ্যযন্ত্রও
আছে। কেমন মিষ্টি টুং টুং টুং শব্দ হয়। যেন ঘন পাতার আড়াল থেকে কোন পাখি উতল হয়ে
ডাকছে।
এই
উড়নচণ্ডি লোকটা আজ সকালের ট্রেনে কোত্থেকে যেন এসে নেমেছে এই স্টেশনে। একমাথা আগুনরাঙা
টুকটুকে ফুল নিয়ে পলাশগাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। কদমগাছের ডালে উড়ে এসে ঠোট ঘষতে থাকে
দুটো মানিকজোড় হলুদমণি পাখি। নিঝুম দুপুরগুলো ভরে থাকে জংলা ঘুঘুর একটানা ডাকে। যেখানে
উত্তর দক্ষিণের এলোমেলো বাতাসে গাছের পাতা কাপে ঝিরঝির।
এই
পউষমুখিতে সকালে উত্তরের পাহাড়ি দেশ থেকে ঝকর ঝকর শব্দ তুলে আসা ট্রেন থেকে নেমেছে
লোকটা। গলায় যার বুনো লতাপাতার মালা। এসে অবধি হাসছে। হাসিটা
খুব নিপাপ। বাজনা বাজাচ্ছে। গান গাইছে। গানের সুর চারপাশকে ভরিয়ে তুলছে।
রাধাচুড়ো
গাছের নিচে বসেছে। গলাটা খুব মিঠে। আর যখন গান গায় তখন মনে হয় বুকের সবটুকু দরদ ঢেলে
নিয়ে যেন গান গাইছে। মনে হয় একঝাঁক সোনালি ডানার চিল রোদের দুপুরে ঝিলমিল করে উড়ছে।
নদীর মোহনার কাছে ঝলসে উঠছে মাছের রুপোলি ঝাঁক। লোকটার গানে সেই মায়াবি হাতছানি। কখনো আকাশের বুকে নয়তো কখনো
আবার ছলোছলো নদীর দিকে নিয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে আছে পউষমুখি স্টেশনের রাংচিতার ঝোপের
কাছে। লোকটার গান শুনে কখন যে কোন অজানা প্রান্তরে হারিয়ে যাবে, টেরই
পাবে না।
কতো
পথই না জানি ঘুরেছে এই উড়নচণ্ডি গোছের লোকটা। তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখো। কত রাজ্যির ধুলো লেগে রয়েছে। স্টেশনে ঝাড় দেয় বছর বারোর যে
ছেলেটা,
পলকু যার নাম সে অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিল লোকটাকে।
-বাব্বা! কেমন চাউনি। আর কেমন আজব দুটো ফুল গুজেছে কানে।
দুপুরে
চুপচাপ শুয়েছিল সে। গাছের পাতার একটানা ঝিরঝির শব্দ শুনে কেমন ঘুম পেয়ে যায়। হঠাৎ
দেখে রাধাচুড়ো গাছটার নিচ থেকে সেই অবাক করা লোকটা তাকে ডাকছে রক্তজবার মতো দুটো চোখ
মেলে।
-এই
লেড়কা শুননা, শুনো ইদিকে।
পলকুর
শরীর তখন ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে গেছে। একবার ভাবলো পালায়। মেহেদির বেড়া টপকে ছুট দেয়।
সামনেই খেয়াঘাট। তাকে তাহলে আর পায় কে? কিন্তু কি অদ্ভুত চাউনি সেই
লোকটার। যেন তাকে সম্মোহিত
করে ফেলেছে। যেন পলকুর সব খবর জানে লোকটা। তার যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালার কাছে
গিয়ে জোনাকি জ্বলা দেখতে ভালো লাগে, তাও বোধকরি জানে।
আস্তে
আস্তে রাধাচূড়া গাছটার দিকে এগিয়ে গেল পলকু। হলুদমণি পাখি দুটো তখন কি এক দুরন্ত
আবেগে যেন ওড়াউড়ি করছে।
-কিরে ব্যাটা, ঘুমুচ্ছিস
ক্যান? জেগে থাকতে পারিস না? চারদিকে কত
কি সব ঘটে যাচ্ছে। চোখ মেলে দেখতে পারিস না? কান খুলে শুনতে পারিস
না?
বাতাসে
গাছ-গাছালির গন্ধ। জংলা ঘুঘুর ক্লান্ত ডাক। কড়ই গাছ থেকে পাতা খসে যাচ্ছে আসন্ন
শীতের বাতাসে। পলকু কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। লোকটার দিকে।
কথাগুলো
যেন অনেক দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে সে। নদীর অন্য পার থেকে কথা বললে যেমন শোনায়।
-সব ব্যাটা অন্ধ। দুনিয়ায় সব ব্যাটা অন্ধ। জানিস, আমি
দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। গাছগুলোর ভেতরে কেমন টসটসে সবুজ রস বইছে। ঐ যে পাকুড় গাছের মগডালে
পাখিটা বসে আছে আমি তার বুকের একেবারে ভেতরটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে
পাচ্ছি। আহা, পাখিটার মনে বুঝি খুব দুঃখ রয়েছে।
পলকু
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই লোকটার দিকে। এমন ধারা কথা আগে আর কখনো শোনেনি সে। তার বুকের
ভেতরটা কেমন থরথর করতে লাগল। নিরিবিলি পউষমুখির
পলাশ গাছটার দিকে খুব ভালো করে চাইল সে। চোখ দুটো কচলে নিল। তার কেন জানি মনে হলো ঐ
পলাশ গাছটার ভেতরে সে সবুজ রস দেখতে পাচ্ছে। ধূসর বাকল আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
তার মাঝে সবুজ রস কলকল করে বয়ে চলেছে পাতার দিকে। পাতাগুলো কেমন নিটোল। এই সব ভাবতে
গিয়ে পলকুর কেমন শীত শীত করতে লাগল।
‘এটা হচ্ছে জটিবুড়ির
খলনুড়ি’ বলে নোংরা তেল চিটচিটে ঝোলাটা থেকে একটা চকচকে
পাথর বের করলো লোকটা। ঝোলার মাঝে আরো কত অবাক করা সব জিনিস। ধনেশ পাখির ঠোট, তিতিরের
পালকের মালা, মৃগনাভি, জাফরানের শুকনো গাছ।
লোকটা
সেই নুড়িটাকে হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। লোকটার কথা মনে হতেই সিরসির করে উঠবে বুকের ভেতরটা।
গলার কাছটায় দলা দলা যন্ত্রণা উঠে আসতে চায়। ময়লা বিছানায় মুখ ঘষে কাঁদে। কেন, বলতে
পারবে না সে। যদি জটিবুড়ির খলনুড়ি একটা পাওয়া যেত।
একদিন
পউষমুখিতে পলকু নামের সেই ছেলেটাকে আর দেখা গেল না। কোথায় যেন চলে গেল কাউকে কিছু
না বলে।
রাতের
গাড়িটাকে বিদায় দিয়ে ছোট ঘরটায় ঢুকে পড়ে ঘন্টা বাজিয়ে আব্দুস সামাদ।
স্টেশনের
পেছনের ধানক্ষেত থেকে বাতাসের সাথে নতুন ধানের কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে। টুপটাপ
টুপটাপ করে টিনের চালের উপর ঝরে পড়ে নিমফল। আব্দুস সামাদ ঘোলাটে চোখ তুলে চমকে মাঝে
মাঝে জিজ্ঞেস করে পলকু এলি?
বাইরে
রাতের হু হু বাতাস তখন বয়ে বেড়ায় পউষমুখির নদী, মাঠ ক্ষেতের উপর দিয়ে।
No comments:
Post a Comment