রহস্য গল্প - অংশুতপার পুঁথি – আলী ইমাম |
রহস্য
গল্প - অংশুতপার পুঁথি – আলী ইমাম
বিকেলের
দিকে আশ্চর্য রকমের নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে এই ছোট্ট নিরিবিলি পাহাড়ি শহর সারিয়াডিতে।
পলাশের কুঁড়ির মতো রোদ মেখে শহরটা তখন পাইনবন থেকে ভেসে আসা বাতাসে শুধু হু হু করে।
ঝুনু ভাই বলেন, ভারি চমৎকার!
আমি
বলি, কী? এই সারিয়াডি? এই উদ্দাম বাতাসের
ঝাপটা?
ধুত্তোরি
ছাই! তোর সব ব্যাপারেই কাব্যি করার এত শখ কেন রে? চিরল চিরল
পাতা আর ঝিরিঝিরি বাতাস ছাড়া কি আর কিছু দেখতে পাস না? ভালো
লাগে বলছিলাম পাখিদের। এখানকার বাজারে কত্তো রকম পাখি পাওয়া যায় দেখেছিস?
এসব পাখির ঝোল খেতে যেমন মজার, রোস্ট খেতেও তেমনি।
আঃ তোফা!
বলে
ঝুনু ভাই আলতো করে ভেঁকুর তোলেন। কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগে সারিয়াডির এই আকাশ, ঝকঝকে
রোদ, জঙ্গলের পাখিদের ডাক। দূরে আবছা কুয়াশার মতো হিমালয়ের
পাহাড় চোখে পড়ে। এখান থেকে নেপালও খুব কাছে।
ঝুনু
ভাইয়ের যেমন বেড়াবার শখ, আমারও তেমনি। সারিয়াডিতে এবারই প্রথম এসেছি।
লোকজন খুব কম এখানে। পাহাড়ি শহরে হাওয়া বদলাতে আসা লোকের ভিড়
জমে বিকেল সন্ধেয়। যখন পাতা ঝরে শুধু গাছ থেকে। পাতা ঝরে ঝরে সরু পাথুরে রাস্তাগুলো
ভরে যায়। তখন নীরবতা ভেঙে স্কুলের বড় ঘড়িটা টংলিং টংলিং করে বেজে ওঠে।
ঝুনু
ভাই বলেন,
না, শহরটা বড় নিরিবিলি রে। একদম হৈ চৈ নেই।
আমি
আর ঝুনু ভাই হাঁটছিলাম পাহাড়ি একটা ঝোড়ার পাশ দিয়ে একটানা কলকল শব্দ উঠছে। গাছ-গাছালির
ভিড়ে জায়গাটাকে দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকার দেখায়। হঠাৎ দূরে ঝোপের ভেতরে হুটোপুটির
শব্দ শুনলাম। একটা লোকের আর্ত চিৎকার ভেসে এলো, সেভ মি,
মেরে ফেলল আমাকে।।
ঝুনু
ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শিগগির চল বান্টি।
আমরা
দু’জনে দৌড়ে সামনের ঝোপটার কাছে যেতেই দেখলাম একটা পাহাড়ি লোক ছুরি
হাতে ছুটে পালাচ্ছে আর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে মাঝ বয়েসী এক ভদ্রলোক। ঝুনু
ভাইকে দেখেই তিনি কাতরাতে কাতরাতে বললেন, আপনি, আপনি আমাকে বাঁচান। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। বুড়ো লামাটা ভীষণ হিংস্র। আপনারা
আসাতেই ওর অনুচরটা পালিয়ে গেছে।
-আপনি
এ জঙ্গলে এ সময় কি করছেন? আপনাকে কারা মারতে চাইছে? কোথায় থাকেন আপনি?
একসাথে
বেশ ক’টি প্রশ্ন করল ঝুনু ভাই।
-আমি
সব খুলে বলবো আপনাদের। এখন আমাকে ঝিলভিউ রেস্ট হাউসে নিয়ে চলুন। আমি ওখানেই
উঠেছি।
আমাদের
দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে ঝিলভিউ রেস্ট হাউসে এলেন সেই ভদ্রলোক। তার রুমে আমাদের দুজনকে
বসতে বললেন। বাইরে তখন সন্ধে ঘন হয়ে নেমেছে সারিয়াডিতে। দূরে ধামাই পাহাড়ের
মন্দিরের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। পাইনবনে একটানা সোঁ সোঁ শব্দ উঠছে শুধু।
কফি
বানিয়ে আমাদের দিলেন সেই ভদ্রলোক। একমাথা কাঁচাপাকা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের
চশমা।
-আমাদের
প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না। ঝুনু ভাই বললেন।
-বলছি, সব
বলছি। আজ ওসময় আপনারা না এলে আমাকে মেরেই ফেলতো বুড়ো লামার অনুচরটা। তার আগে আপনাদের
পরিচয়টা?
আমাদের
পরিচয় শুনে পাইপ ধরালেন ভদ্রলোক। বারান্দায় এসে বসলাম আমরা। সরসর শব্দ তুলে পাতা
ঝরে পড়ছে।।
-আমার
নাম ড.
ইরতিজা আহমেদ। ইতিহাসের অধ্যাপক আমি। বাড়ি আমার বাংলাদেশেই।
কিন্তু আজ ত্রিশ বছর ধরে জার্মানিতে শিক্ষকতা করছি। এখানে এসেছি এক আকস্মিক ঘটনার যোগাযোগে।
মাসখানেক আগে মিউনিখে একটি লোকের সাথে আমার আলাপ হয়। সে কথাচ্ছলে আমাকে একদিন জানালো, তার
কাছে কিছু পুরানো পুঁথির পাতা রয়েছে। নেপালের কোনো এক গুহা থেকে নাকি সংগ্রহ করেছে
সে। আমি কৌতুহলী হয়ে সেগুলো দেখতে চাইলে সে বললো, পুঁথিগুলোর
পাতা পাবার পর থেকেই কারা যেন ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করছে। আমি কিছুটা নেপালি ভাষা
জানতাম। সেই পুঁথির পাতাগুলো অনেক প্রাচীন ভাষায় লেখা। দেখলাম নেপালের এক গুহার ভেতরে
কোনো এক প্রাচীন বৌদ্ধ রাজার দুপ্রাপ্য জিনিসের সন্ধান রয়েছে তাতে। যে জিনিসগুলো পেলে
সত্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
আবেগে
গলা কাঁপছিল ড. আহমেদের । আমি বললাম, কি
সেই নতুন দিগন্ত?
ড. আহমেদ
উত্তেজিতভাবে বললেন, জানেন পুঁথির একটা পাতায় পৃথিবীর মানচিত্র
আঁকা ছিল। তাতে এখন আমেরিকা যেখানে অবস্থিত তার অংশে সে স্থানটির উল্লেখ রয়েছে। ভেবে
দেখুন তো ব্যাপারটা একবার! সেই কলম্বাস, লিফ এরিকসন বা প্রাচীন জলদস্যুদের আবিষ্কারের অনেক আগেই তারা সেই দেশটির খবর
জানত। প্রাচীন নেপালি এক পুঁথিতে তার মানচিত্র রয়েছে। ভাবুন দেখি কি আশ্চর্য ব্যাপার!
সমস্ত পুঁথিটি পেলে অনেক অজানা রোমাঞ্চকর তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়বে এ
আমি হলপ করে বলতে পারি।
-কিন্তু
তারপর কী হল? আগ্রহী হয়ে ঝুনু ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
-হ্যা, যা
বলছিলাম। সে লোকটির কাছ থেকে প্রচুর টাকা দিয়ে আমি ঐ পুঁথির ক’টি পাতা কিনে
নিলাম। ওর ঐতিহাসিক মূল্য সম্পর্কে লোকটার অবশ্যি খুব একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু সেই
পুঁথির পাতা কেনার দুদিন পরেই জানলাম, লোকটাকে কারা যেন নৃশংসভাবে
হত্যা করেছে। লোকটার পিঠে আমূল বসানো ছিল এক ধরনের প্রাচীন নেপালি কিরিচ।
-কী
আশ্চর্য,
কী ভয়ানক কাণ্ড! ঝুনু ভাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
-আমার
মাথায় তখন ব্যাপারটা একটা দারুণ নেশার মতো চেপে বসেছে। ম্যাপ দেখে বুঝলাম যে গুহার
উল্লেখ রয়েছে পুঁথিটিতে তা এই সারিয়াডির কাছেই। বুঝলাম আমাকেও কারা যেন ছায়ার মতো
অনুসরণ করছে। কদিন আগে এসেছি সারিয়াডিতে। একদিন একটা চিঠি পেলাম। কে একজন বুড়ো লামা
আমাকে সাবধান করে লিখেছে, আমি যেন এ ব্যাপারে আর বেশি মাথা না ঘামাই। আজ
বিকেলের ঘটনা তো আপনারা জানেনই।
ড. আহমেদের
কণ্ঠ গমগম করে উঠল সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে।
হঠাৎ
ঝুনু ভাই বললেন, কে? কে ওখানে? বলে সামনের দিকে
ছুটে গেলেন। আর আমরা আবছা চাঁদের আলোতে চমকে উঠে দেখলাম কাঠের রেলিং টপকে পালিয়ে যাচ্ছে
এক পাহাড়ি ।
ড. আহমেদ
উত্তেজিত গলায় বললেন, ঐ, ঐ সেই বুড়ো লামার
অনুচর। দেখলেন, দেখলেন আপনারা? কিন্তু আমি
যে করে হোক ইতিহাসের এই অজানা পাতাগুলোর রহস্য বের করবোই। কাল সকালেই আমি রওনা দেব
সেই রহস্যময় গুহার দিকে।
-আপনার
সাথে কিন্তু আমরাও যাব। ঝুনু ভাই উৎসাহী কণ্ঠে বলে উঠলেন।
-সত্যি, সত্যি
বলছেন? আমি তাহলে খুব খুশি হবো। ভীষণ খুশি হবো।।
ড. আহমেদের
গলা আবেগে গাঢ় হয়ে এলো। মেঘ সরে যাওয়াতে
বাইরে চাঁদের আলোর রুপোলি বান ছুটেছে। পাইনবনের একটানা হু হু বাতাসে ভরে থাকা সারিয়াডিকে
তখন কেমন রহস্যময় মনে হল।
পরদিন
খুব সকাল থাকতেই আমরা রওয়ানা দিলাম। সারিয়াড়ি থেকে একটা পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে
চলে গেছে টুনিলঙয়ের দিকে।
ড. আহমেদ
বললেন, এই টুনিলঙয়ের মাইল দশেক দক্ষিণ-পশ্চিমের পাহাড়ি অঞ্চলেই রয়েছে সেই গুহাটি। এ অঞ্চল নেপালের মাঝেই পড়েছে।
আমরা
ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে খুব সন্তর্পণে হাঁটা শুরু করলাম।
আমার
শুধু ইচ্ছে সেই পুরানো পুঁথিটি সংগ্রহ করা। আর কোনো কিছুর উপর আমার লোভ নেই। সেই বুড়ো
লামাটি ভেবেছে আমি বুঝি গুপ্তধনের লোভে এসেছি। এই পুঁথিটি রচনা করেছিল অংশুতপা নামে
এক প্রাচীন নেপালি পণ্ডিত। পুঁথিতে নিশ্চয়ই ছড়িয়ে আছে অজানা ইতিহাসের নানা মণিমুক্তো।
বলতে
বলতে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল ড. আহমেদের চোখ দুটো।
জানেন, এইসব
গুহাতে অনেক মূল্যবান প্রাচীন ছবি আর শিল্পকর্মের নিদর্শন রয়েছে। লামারা লোকচক্ষুর
আড়ালে এসব সম্পদ যক্ষের ধনের মতো পাহারা দিয়ে রাখছে।
হঠাৎ
ঝুনু ভাই আমাকে আর ড. আহমেদকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। আর সাঁ
সাঁ করে দুটো তীর আমাদের একটু উপর দিয়ে চলে গিয়ে সামনের গাছটায় বিধে থরথর করে কাঁপতে
লাগল।
-কি
সর্বনাশ,
কি ভয়ানক কাণ্ড! ড. আহমেদ
প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।
ঝুনু
ভাই এক দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেলেন। খানিক পরেই একটা পাহাড়ি লোকের হাত মোচড়াতে
মোচড়াতে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন। লোকটা তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
ড. আহমেদ
তাকে দেখেই বললেন, সর্বনাশ, এই লোকটাই তো
কাল আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
লোকটা
হাউমাউ করে কি বলতে লাগল আমরা তা বুঝলাম না। ঝুনু ভাই তাকে জঙ্গলের ভেতরে একটা গাছের
সাথে আচ্ছা করে বেঁধে মুখে কাপড় খুঁজে দিয়ে বলল, থাক জংলিভূত এখানে পড়ে।
ফেরার সময় তোকে নিয়ে গিয়ে থানায় দেব।
হাঁটতে
হাঁটতে এক সময় খা খা একটা প্রান্তরে এসে পৌছালাম। কেমন শূন্যতা চারদিকে। প্রাচীন জন্তুর
কঙ্কালের মতো কোথাও কোথাও পাহাড় যেন মুখ থুবড়ে আছে। সেই ভয়াবহ নির্জনতা মনের ভেতরে
কেমন একটা ভয় ধরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে তখন। ড. আহমেদ
পকেট থেকে একটা ম্যাপ বের করে বললেন, এই দক্ষিণের পাহাড়ের পাশেই
আছে সেই গুহাটা।।
উত্তেজনায়, অস্থিরতায়
আমরা সবাই তখন দপদপ করছিলাম। আস্তে আস্তে সেদিকে এগুতে লাগলাম। কাকের ডানার মতো তখন
সন্ধ্যা নিবিড় হয়ে এসেছে। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ল গুহাটা। অন্ধকারে সেটা একতাল
জমাট বাঁধা আতঙ্কের মতো পড়ে আছে। ড. আহমেদ বললেন, এখানেই আছে সেই হিংস্র বুড়ো লামাটা। সেই আগলে রাখে সব। আস্তে আস্তে এসো।
কোনো
সাড়াশব্দ নেই কোথাও। গুহাটার ভেতর আস্তে আস্তে ঢুকলাম। আমরা। কেমন ভ্যাপসা একটা গন্ধ
আমাদের নাকে এসে লাগল। ঝুনু ভাই পকেট থেকে একটা মোমবাতি বের করে জ্বালালেন। মোমবাতির
আবছা আলোতে গুহার দেয়ালগুলোকে রহস্যময় দেখাতে লাগল। আমার শরীরটা যেন সিরসিরিয়ে উঠল।
আর সে সময়ই পেছনে একটা শব্দ হল। আমরা চমকে পেছন ফিরে দেখি একটা বুড়ো লামা কেমন হিংস্র
চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ঝুনু ভাই হঠাৎ করে ফু দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে
সামনের দিকে লাফিয়ে পড়ে এক ধাক্কা দিলেন লামাকে। আর বুড়ো লামাটা আর্তচিৎকার করে বাইরের
গভীর খাদে গড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ঘটনার
আকস্মিকতায় আমরা সাবই বিমূঢ়। মোমবাতিটা জ্বালালেন ড. আহমেদ।
ড. আহমেদের
গলা কেমন ভারী শোনাচ্ছিল। সেই মোমবাতির আলোতে দেখলাম সামনে একটি কাঠের প্রাচীন সিন্দুক।
সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো কাপড়ে জড়ানো সেই অংশুতপার পুঁথি । ড. আহমেদের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।
আমি
এই ইতিহাসের কথা সাবইকে লিখে জানাবো। প্রাচীন যুগের
এই অনাবিস্কৃত একটি ইতিহাসের অধ্যায় আজ থেকে উন্মোচিত হবে।
বাইরে
ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। আমার মনে হল পৃথিবীর কত ইতিহাস ঐ চাদ নীরবে দেখে যাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment